মাজিদির চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলতে গেলেই অনেকগুলো বিষয় আমার কাছে প্রকট হয়ে পড়ে, যেমন ক্যামেরার চমৎকার কিছু কাজ, প্রাকৃতিক দৃশ্যের সমাহার, অভিনয় সাবলীলতা, বিশেষ করে শিশুদের, মধ্যবিত্ত জীবনের খুটিনাটি, বিষয়বস্তু নির্বাচন, কাহিনীর সরল অথচ ব্যতিক্রমী বিস্তার, এবং সর্বোপরি চরম প্রতিকূলতার মাঝেও আশার উদ্দীপ্ত সঞ্চারণ ইত্যাদি খুব বেশি করেই তাকে করে তুলেছে স্বতন্ত্র। ‘দি সংগ অব দ্য স্প্যারোস‘ দেখতে গিয়ে এসব পুনরায় মনে পড়ল, এবং গভীর মনোযোগের সাথেই আবারও উপভোগ করলাম তাঁর দারুন আরেকটি সৃষ্টিশীল কাজ। সিলভার ও গোল্ডেন বার্লিন, এবং এশিয়া প্যাসিফিকসহ ৬টি পুরস্কার জেতা ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ৯৬ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই ছবিটিতে তিনি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন মধ্যবিত্ত জীবন-যাপনের যাবতীয় খুটিনাটি, মানসিক টানাপোড়েন, নির্মম বাস্তবতা, টিকে থাকার সংগ্রাম, ছোট-খাটো নীচুতা, হাসি-খুশি, ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদি। এমনকী ছাদে সন্তানদের জন্য টিলিভিশনের এ্যান্টেনা ঠিক করতে উঠে, উপর থেকে স্ত্রীকে প্রেম নিবেদন, কিংবা তার কামিজের উচিয়ে ধরা প্রান্তে ছুঁড়ে দেয়া জামার ছেঁড়া বোতাম, অথবা বধির বোনকে লুকিয়ে সাহায্য করার অপরাধে ছেলেকে ক্রোধে অন্ধ হয়ে মারতে তাড়ানো, এসব ছোটখাটো ঘটনার মধ্যে খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় মাজিদির সেই দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে তিনি আমাদের দেখিয়ে দেন ঠিক কোথায়, এবং কীভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে মধ্যবিত্ত জীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গ, আনন্দ-বিষাদ, টানাপোড়েন ও বাস্তবতা।
এটি তাঁর ৬ষ্ঠ ছবি, এবং তাঁর অন্যান্য ছবিগুলোর মতই এখানেও তিনি সফল, আর তার সেই সফলতাতে শুধুমাত্র অভিনয় দতা দিয়ে আলাদামাত্রা যোগ করেছে মূল চরিত্রে অভিনয় করা আমির নাজির অসাধারণ অভিনয়। কয়েকটি ক্লোজশটে দেখানো তার বিচিত্র অভিব্যক্তির অর্থপূর্ণ অবয়ব আমাকে বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে বার্গম্যানের কথা, যেখানে তাকে বহুবার দেখেছি মানুষের মুখের নানাবিধ অভিব্যক্তি খুব কাছ থেকে দেখানোর মাধ্যমে দর্শকদের নিয়ে যেতে বিচিত্র এক অভিজ্ঞতার জগতে। মাজিদিকেও এখানে আমরা দেখি তেমন কতগুলো ক্লোজশটের মাধ্যমে অনুরূপ কিছু বিস্তারিত প্রয়াস চালাতে, এবং ছবি শুরুর কিছুণের মধ্যেই যখন আমির নাজিমকে চাকুরীচ্যুতির পূর্বে তেমন এক দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকতে দেখি বৃদ্ধ ফার্ম তত্বাবধায়কের সামনে, কিংবা সেখানে থেকে বেরিয়ে ফার্মের উটপাখিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখি তার চেয়েও করুণ, গভীর ও বিষন্ন চোখে, তখন মাজিদির এই অনবদ্য ক্লোজশটগুলো হয়ে হয়ে ভাষাহীন অভিব্যক্তির এক বিস্তারিত দলিল, যার সামনে বসে থাকতে থাকতেই আমাদের বিচরণ ঘটে যায় বাস্তবতার নির্মম ও করুন পরিসরে।
দুটি কন্যা ও একটি পুত্রসন্তানের জনক করিম একটি উটপাখির ফার্মে কাজ করে, যার চাকরী চলে যায় ফার্ম থেকে একটি উটপাখি পালিয়ে গেলে। এখান থেকেই মূলত ছবির কাহিনী শুরু, যা নাটকীয় মোড় নেয়, এবং চাকুরীচ্যুত করিম তার মোটরবাইক নিয়ে তেহেরান শহরে যায়, যেখানে সে ঘটনাক্রমে হয়ে পড়ে ভ্রাম্যমান যাত্রীবাহক, যে তার মোটর সাইকেলের পেছনে করে লোকজন, মালপত্র বহন করতে শুরু করে, যা তাকে এনে দেয় আশাতীত অর্থ। ক্রমেই সে শহুরে জীবনের চাকচিক্যে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে, এবং প্রতিদিন ঘরে ফেরার সময় তার বাইকের পেছনে করে শহর থেকে নিয়ে আসতে থাকে বিভিন্ন পরিত্যক্ত জিনিস, যা তার বাড়িতে স্তুপ আকারে জমা হতে থাকে, এবং ক্রমশঃ সে এসবের প্রতি হয়ে ওঠে লোভী, ফলে যখন তার স্ত্রী শহর থেকে আনা নীল রঙের একটি দরজা তার আত্মীয়কে দিয়ে দেয়, তখন সে কোনোরূপ সঙ্কোচ ছাড়াই নিলর্জ্জভাবে তা ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এছাড়া তার পুত্রের চরিত্রে অভিনয় করা হামিদ আঘাজির অভিনয়ও ছবিটির উল্লেখযোগ্য একটি দিক, এবং ছবিটিতে তার চরম আশাবাদী উপস্থিতি, যে কিনা বাবার শত প্রতিরোধ সত্ত্বেও বাড়ীর পাশের পরিত্যক্ত জলাধার সমবয়সী বন্ধুদের সাথে নিয়ে পরিস্কার করে, এবং সেখানে মাছ চাষ করে খুব শীঘ্রই ধনী হবার স্বপ্ন দেখে।
বস্তুত পুরো ছবিটাকেই মাজিদি করে তুলেছেন দারুন উপভোগ্য, যেখানে মধ্যবিত্ত টানাপোড়ন, পারিবারিক খুটিনাটি ঘটনা, শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক অংশগ্রহণ ও আচরণ আমাদের একদিকে যেমন একাত্ম করেছে বাস্তবিক মধ্যবিত্ত পারিবারিক অভিজ্ঞতার সাথে, সেই সাথে করে তুলেছে সচেতন ও আশাবাদী। মেহরান কাসামীর সাথে মাজিদির লেখা এই ছবির চিত্রনাট্যের বিষয়বস্তুর সরল বিস্তার ও নাটকীয় মোড় যেমন আগাগোড়া আটকে রাখবে আমাদের, তেমনি তাঁর পরিচালনা ও আমির নাজির অসাধারণ অভিনয় বার বার করবে মুগ্ধ, যেখানে একা আমির নাজিকেই আমরা দেখব ছবিটির পুরো পরিসর জুড়ে বিচরণ করতে। আর সবকিছুর সাথে যোগ হয়েছে নয়নাভিরাম শট পরিকল্পনা, একের পর এক লংশটে দেখানো বিশাল সব ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে প্রাণবন্ত চরিত্রের বিচরণ। এছাড়া আকাশ থেকে নেয়া দু’দুটো ব্যয়বহুল এ্যারিয়েল শট আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে, যখন করিম হারিয়ে যাওয়া উটপাখিটিকে প্রলোভন দেখিয়ে ধরার জন্য নিজে উটপাখি সেজে পাহাড়ের পাদদেশ বা বিস্তীর্ণ প্রান্তরে চলা-ফেরা করতে থাকে, এবং একসময় পাহাড়ের উপর উঠে পড়ে, তখন আকাশ থেকে নেয়া শটটি আমাকে মুগ্ধ করে দেয়, কেননা ঠিক যা দেখানোর জন্য শটটটি নেয়া হয়েছে তার সবটাই গেঁথে গিয়েছিল মনের মধ্যে। ঠিক অনুরূপ আরেকটি শট, যখন সে তার স্ত্রীর দিয়ে দেয়া নীল দরজাটি আত্মীয়ের বাড়ি থেকে পিঠে করে ফিরিয়ে নিয়ে আনে, তখন পথিমধ্যে ধূসর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে নীল দরজা পিঠে পুনরায় আকাশ থেকে নেয়া আরেকটি শট এতটাই অপূর্ব ছিল যে, আমি ব্যক্তিগতভাবে এইজাতীয় ছবিতে এত ব্যয়বহুল শট নেয়ার বিপরীতে অবস্থান করলেও, এখানে তার গ্রহণযোগ্যতা দেখে সহমত হতে বাধ্য হই।
এছাড়াও ছবিটির আরেকটি দিক উল্লেখ না করলেই নয়, আর সেটা হলো ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহৃত মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ, যা তাকে ‘চিলড্রেন অব হ্যাভেন’-এও দেখেছি জুড়ে দিতে। এ ছবিতেও তিনি করিমের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন ব্যাকগ্রাউন্ডে, যা আমাকে জনাব ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’-র নায়ক-নায়িকার মধ্যরাতের সেই মিলনকালীন শ্বাস-প্রশ্বাসের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, কিংবা তারকোভস্কির অনেক ছবির কথা, যেখানে জল ও শব্দকে তিনি ব্যবহার করেছেন বহুভাবে। যদিও মাজিদির সবগুলো কাজের মধ্যে ‘দ্য কালার অব প্যারাডাইস’ আমার বেশি ভাল লেগেছে, তারপরও বলা বলা যায় এটাও তাঁর তেমন এক সৃষ্টিকর্ম যা চলচ্চিত্রপ্রেমীমাত্রই উপভোগ করতে পারবে, আর সেই সাথে তোরাজ মনসুরীর অনবদ্য কামেরার কাজ ও প্রোডাকশন ডিজাইনার আজগর নিজাদ ইমানির মনোরম দৃশ্য পরিকল্পনা সবসময়ই আমাদের ব্যস্ত রাখবে মুগ্ধতা আর বিস্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে, যেখানে খুব সহজেই দর্শক হিসেবে আশ্বস্তহতে পারা যাবে মাজিদির ব্যতিক্রমী সৃজনশীল দতা ও চমৎকার একটি চলচ্চিত্র দেখার আনন্দে।
অরণ্য
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
১৩ই সেপ্টেম্বর ২০১০
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ৮:৪৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




