somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(গল্প) অমাবশ্যার মুখোমুখি

২৮ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আলোকচিত্র: জসীম অসীম
======
সংশোধিত:
=======
বাংলাদেশের নদী এখন তুবড়ানো বুড়ি, ইন্ডিয়া তার তুলতুলে সব জল গিলে নেয়, ভাবে না সে বাংলাদেশের তুলসী গাছেরও জল চাই আজ এবং তীর্থস্থান বাংলাদেশেও আছে। অথবা সে ভাবেই না দুর্গামায়ের প্রতিমা বিনির্মাণেও পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জল লাগে।

কিন্তু বাংলাদেশের একজন বাম রাজনীতিপন্থী যুবক সোমেন প্রায়ই এসব ভাবে। সে আরও ভাবে এবং মনে মনে নিজেকে নিজেই বলে, তুমি আমার জল কেড়ে খাও, ইন্ডিয়ারাজ, আর হতে চাও তিলোত্তমা ? থামো, সকল সহিষ্ণুতাও শেষ, করবো না তাই ক্ষমা। কেনো না তিলে তিলে হারিয়ে যায় এদেশ থেকে পাখির নেতা বাজ। কারণ চৈত্র মাসে বাংলাদেশের নদী এখন জলশুন্য, সীমান্তে তার বিএসএফ আজ দারুণ তীরন্দাজ। হারামীরা কাজ ছেড়ে আজ বাংলাদেশীই মারে। বাংলাদেশের হিন্দুরা তাই জীবন কাটায় কথায় কথায় বাংলাদেশের মুসলমানের নানান তিরস্কারে।
বি.এস.এফ আজ চোরাকারবারী বলে বলে সীমান্তে ওই কৃষকদেরও মারে। এসব করে ওই ভারতের মর্যাদা কি বাড়ে! সেই অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর বাংলাদেশের মুসলিমরা হয় খুবই উত্তেজিত। এরই ফলে এ দেশেরই হিন্দুরা আজ থাকে ভীত। ভীষণতর ভীত।

বাংলাদেশও খেলোয়াড়ই, তবে ‘ইন্ডিয়া’ই এ এলাকার মস্ত খেলোয়াড়। তাইতো আমার ছোট্ট দেশে এমন হাহাকার। আর বাংলাদেশের উদাস হিন্দু, দু’কূল থেকেই পেতে থাকে ধিক্কার ধিক্কার।

উপমহাদেশ উথালপাথাল উদ্বাস্তু হয় আজও। নদীরও অসুখ এখন এ নদীমাতৃক দেশে। বক-মাছরাঙার বুকেও অসুখ। অসুখ রক্তে মিশে। কিছু কিছু শিকারী লোক সেসব বকের খুলি, গুলি করে আকাশে উড়িয়ে দেখে।
আর সেই শিকারীদের অন্যতম ওই ইন্ডিয়ারাজ। তাই তো আজ বাজপাখি হওয়াই আমার সেরা কাজ। এমন কথা ভেবে ভেবেই সময় কাটে সোমেনের।

অন্যদিকে চুরিতে, বাটপারিতে ডাকাতিতে আজকাল যেমন সুবিধা পাওয়া যায়, অন্য কিছুতে তেমন নয়। এখন সৎ থাকছে বোকারা, আস্তিক হয় হাদারা, ধার্মিক হয় ইতররা, মানবিক হয় মেথররা, সহনশীল হয় ভোদারা...আর এমনই ভয়ানক দিনে সোমেন নিজে কেমন হবে, এ নিয়েও সিদ্ধান্তহীন সে। অথচ এখনই চোর-বাটপার হওয়ার মোক্ষম একটা সময় বয়ে যায়।
এ অবস্থায় ঠিক কী করবে সোমেন? চোখে তাঁর বিভিন্ন যন্ত্রণার তপ্ত লাল ছবি। বুকে তপ্ত ভারত মহাসাগরের জল। সেই জল আবার জলোচ্ছ্বাসের সফল খেলোয়াড়।

সোমেন তবে কার মতো হবে? দুঃখে সে পাথর হয়ে যায়। কম দুঃখে কি বাংলার কবি মধুসূদন দত্ত কবি হয়েও প্রেমের কবিতা লিখেননি? যদিও প্রেমের কবিতা লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ, কিন্তু তিনিও তেমন সুখি মানুষ ছিলেন না। সোমেন কি শেষে এসব কবিদেরই শিষ্য হয়ে যাবে?
কেনো সোমেন জীবনের গণিত রপ্ত করতে পারে না? পিউরম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি শিখে তবে তাঁর আর কী লাভ হলো আজ?
ঘূর্ণিঝড়ে পঙ্গু নিকুঞ্জ এখন। সেই নিকুঞ্জের ধ্বংসাবশেষ দেখে বুকের আকাশ কাঁদে। আর বোকা বোকা সৎ সৎ লোক কাঁদে শকুনের উদরকূপে বন্দী মানুষ দেখে।
মনের গভীর থেকে গন্ধরাজ ফুলের প্রতি ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতেই হবে, তা না হলে মানুষ থাকা আর যাবে না, যে মানুষে ভরপুর এখন এই আমাদের ‘পৃথিবী’ নামের গ্রহ। এ মানুষ আর আফ্রিকার গরিলায় কোনো পার্থক্য নেই তেমন। বরং কিছু ক্ষেত্রে গরিলাই শ্রেষ্ঠ জাতের প্রাণি।
কোথাও খুঁজে পায়না সোমেন আর স্বর্গের সেই শুক্তি। যৌবনের বদলে যৌনতার সঙ্গেই হয়ে গেছে আজ সমূহ জীবনের বড় বড় চুক্তি। তাই আর মনুষ্যত্বের নেই তেমন শক্তি। ভক্তিও উঠে গেছে, যেখানে একদা ছিলো জীবনের চূড়ান্ত এক মুক্তি।

এতো লোকের আনাগোনায় সোমেনের মনে হয় জনবিরল রাজ্যে সে বাস করে। অন্যদিকে সে স্বপ্ন দেখে আবার জনযুদ্ধেরও। কিন্তু জনতাও আজ দুর্নীতিকে দারুণ পাথেয় করেছে। পেটের ক্ষুধা দমনের বদলে তাই ‘সিনেমা’ও এখন যৌনক্ষুধা দমনে কিংবা সে ক্ষুধা জাগিয়ে দিতে দারুণ ব্যস্ত থাকে।
এসব দেখে হতাহত আজ আশা। ঘাম দিয়ে কেবল সোমেন মেটায় এ মাটির পিপাসা। ন্যায়ের আসনে বসে এখন আর শাসন করে না কেউ। সোমেনের বুকে তাই ভারত মহাসাগরের জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ। নিকুঞ্জে পিঁড়ি পেতে গানের প্রশান্ত গভীরে ডুবতে সোমেনের আজ ভীষণই ইচ্ছে করে। অথচ নিকুঞ্জ পঙ্গু আজ, কালবৈশাখী তার ঘরে।

সোমেন প্রায়ই ভাবে, এ কোন গ্রহে, এ কোন কালে জন্ম হয়েছে সোমেনের? সোমেন সৎ, সোমেন দক্ষ, সোমেন প্রতিবাদী। তাই চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বদনাম, অপপ্রচার। সোমেন নাকি নিরাপদ নয়। দালালেরাই নিরুপদ্রব আজ। বেগুণেরও গুণ আছে, সোমেন নাকি নির্গুণ এক মানুষ। সোমেনের বিরুদ্ধে এ নির্দেশিকা ছড়িয়েছে চতুর্দিকে। এ কেমন পরিহাস, এ কেমন রাজাজ্ঞা । প্রচন্ড মর্মব্যথায় মর্মাহত হয়ে কোনো এক মরুভূমির ধু-ধু প্রান্তরে ক্রমাগত হাঁটে সোমেন । অথচ সোমেনের সামনে নেই কোনো রাজকুমারী এবং সোমেন নয় কোনো রাজকুমারও।

এমনকি কাকে বলে আজ রাজাকার, সোমেন তাও জানে না। আজ এ পৃথিবীতে রাজাকারের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। যেমনটি হয়েছিলো 1971 সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। এখনও যারা নিজের দেশে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়, এখনও যারা পরদেশকে দিনরাত সহায়তা করে, তারা কেনো রাজাকার নয়, এ বিষয়টা সোমেনের কাছে পরিষ্কার নয়। রাজনীতি শিখেছে কিছু তাই, সোমেন এখন হয়ে গেছে রাজদ্রোহী কবি। কিন্তু কেনো?
কবি সোমেন বহন করে আজ সময়ের ঋণ। দূরে ফেলে এসেছে সোনার পরম খনি এবং রৌদ্রদীপ্ত দিন। অন্ধকারের উদরে বন্দী পৃথিবীর উত্তরকাল। তাই হয়তো কখনো কখনো অতিরিক্ত শালুক খেয়ে সে হয়ে যায় খুব মাতাল। অভাব এখনো বহমান বাংলার ঘরে ঘরে। শাঁকচুন্নিরা ক্ষমতা নিয়ে তবু কাড়াকাড়ি করে।
সোমেন দেশের প্রকৃত একজন সেবক। অথচ দুই বেলা ভাত নেই এই দেশের লক্ষ-কোটি ঘরে। এমন শাপভ্রষ্ট কবি কেনো হয়ে থাকবে সোমেন? মানে না সোমেন এমন শাস্ত্র, এমন শাস্তি, এমন কোনো শাসনতন্ত্র। রাজনন্দন রাজনন্দিনীর বিলাসিতা কি অভুক্ত জনতার ক্রন্দনের চেয়েও দামী?
মৌমাছি বা পিঁপড়ারাও অবসর থাকে না যখন, তখনও ওই রাক্ষুসে রাজনন্দন কিংবা রাজনন্দিনীরা রাজপুরীতে কেবল অবসর থাকে। আর কেবল রঙ্গরসের রসালো ঘ্রাণ ছোঁয়ায় আপন নাকে। তাদের কাছে এ জীবনটা কেবলই রঙ্গরস, আর এই দেশটা যেন কেবলই রঙ্গশালা। সোমেন তাদের এমন শাস্ত্রের কাতারের লোক নয়। তাই তার ভাষা হয়ে যায় ভীষণ শ্রুতিকটু। তার ভাষা তাদের কাছে কাব্য হয় না কখনো, শ্লোগানই কেবল হয়। কারণ সোমেনের শ্রেণীসংগ্রামনির্ভর সব কবিতা, তাদের শরীরে-মনে-মগজে বাড়ায় কেবল জ্বালা । তার রসোত্তীর্ণ কবিতাও বলে উঠে, কী অপরাধ আমার মাটির? কেনো কখনো সুখপাখির ছায়া পায় না এ মাটি?

রাজনন্দন কিংবা রাজনন্দিনীরা বলে, আসো আমাদের আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শিশমহলে, দেখে যাও, এখানে আছে কতো রঙের কতো শীতলপাটি। সোমেন তখন এই বাংলার শীতার্ত-ক্ষুধার্ত মানুষের কথা ভাবে।
তারা সোমেনকে বলে, রগচটা তুই, শীতল হ, শিথিল হ, শিং ফেলে দে, অন্যরকম শিকারী হ, শহীদ হয়ে গেলে তো তুই শাহানশাহ বা রাজাধিরাজ আর হবি না, শৃগাল হ শিষ্ট শৃগাল, শান-শওকত অর্জন করার শাস্ত্র শিখে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যা, তুই কেনো আজ শহীদ হবি, কার কথাতে? তুই হয়ে যা নারীপদ্ম ফুলের কবি। তুই এঁকে যা শারদীয় কুমুদফুলের শুভ্র ছবি। তুই কেনো আজ শহীদ হবি?
কিন্তু সোমেনের তাদের কথায় মন ভরে না। তাঁর রক্তে সব মানুষের তীব্র ক্ষুধা। কারো দুঃখ মনে হলেই ঘুম চলে যায়। তারপরও সে শুধু পথে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে কখনো যখন ক্লান্ত হয়, ঘুমিয়ে পড়ে, দুঃস্বপ্নে তখন দেখে, কুড়াল নিয়ে কিছু লোক তেড়ে আসে তারই দিকে। সোমেন তখন স্বপ্নে থাকে বলেই উড়াল দিয়ে আত্মরক্ষা করে। অথচ বাস্তব জীবনে সোমেনের পাখা নেই। তাই, জীবনের প্রতি মোড়েই সে নিজের শ্রেণীর মানুষকেই নিজের শত্রুরূপে দেখতে পায়। শত্রু করেছে ওরা। যারা এ গ্রহে পুঁজিবাদের ঘোড়া।
এ অবস্থায় সমাজবিপ্লব করবে সে কার নির্দেশে কিংবা কার বলে? যেখানে সে দেখে তাঁর কোনো নেতারই রণনীতি কখনো কখনো রজনীর রঙ্গরসে মেশে।
সব বিশ্বাস ক্রমাগত ভস্ম হয়ে গেলে, দলের সব সঙ্গী সোমেনকে একা ফেলে গেলে, সোমেন হয় বৃষ্টিস্নাত, কষ্টস্নাত এক কবি। কারণ সোমেন একা। সত্যি সত্যিই একা। স্বপ্নবাদী হয়েও নৈরাশ্যবাদী কবির মতোই একা। কারণ সে বিপ্লবী হয়েও শেষ পর্যন্ত নৈরাশবাদী এক কবিই। আর এমন একাকীত্বও স্বপ্নবিক্রেতাদের চোখে দারুণ বেয়াদবি।
কেউ কেউ মনে করে সোমেন বুঝি কান্ডজ্ঞানহীন এক যুবক। অথচ সে দায়বদ্ধ গণমানুষের কাছে। মুখর এক যুবক সে, বহন করে সময়ের ঋণ। কারণ সে মনে করে, উত্তরকালের সোনার খনি খুঁজে পেতে হবেই কিংবা খুঁজে পেতেই হবে ঐ জ্যোৎস্নাস্নাত রৌদ্রদীপ্ত দিন। কারণ সে হতে চায় নৈতিকতার, সততার মানসপুত্র, দায়বদ্ধ বেদুইন।
কারণ সে বণিক নয়, বেনিয়া হতে আসেনি এই গ্রহে।পণ্য বেচতে আসেনি বাজারে নকল হাসি হেসে। নদীর যদি অসুখ হয় নদীমাতৃক দেশে, তবে কি আর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলারা যায় ভেসে?
মাছের মসলিন প্রতীক্ষায় বাংলায় এখন বসে থাকে বক, শখ মিটে না তার। নদীরও অসুখ ভীষণতর,গভীর গভীরতর। বাংলাদেশের চৈত্র নদী তুবড়ানো বুড়ি এখন। খরার দিনে ‘ইন্ডিয়া’ তার তুলতুলে সব জল গিলে নেয়। ভাবে না সে বাংলাদেশের তুলসী গাছেরও জল চাই আজ, তীর্থস্থান বাংলাদেশেও আছে। নদীর যদি অসুখ হয় নদীমাতৃক দেশে, তাহলে আর নতুন করে সোমেনের আর বলার কী-ই-বা আছে? যেখানে একটাও তিলাইবাজ আর বসে না কোনো গাছে। এসব কথা বলতে গেলেই সে হয় কেবল তিরষ্কৃত, উপাধি হয় তার, বদরাগী এক তিরিক্ষি স্বভাবের লোক। অথচ কেউ তলিয়ে দেখে না, দেশের জন্য এ যে তার কী পরিমাণ শোক। সবার মুখেই তালা। সোমেন এসব একা একা বলতে গেলেও তাদের গায়ে ধরে জ্বালা।
তুমি আমার জল কেড়ে খাও, ইন্ডিয়ারাজ, আবার তুমি হতে চাও গণতন্ত্রের মানবতন্ত্রের তিলোত্তমা? থামো, সকল সহিষ্ণুতাও শেষ, করবো না তাই ক্ষমা। তিলে তিলে হারিয়ে যায় এদেশ থেকে পাখির নেতা বাজ। কারণ ভারত-বাংলার সীমান্তে আজ বিএসএফ ওই দারুণ তীরন্দাজ। কাজ ছেড়ে আজ তারা বাংলাদেশের নিরীহ কৃষকও মারে। বাংলাদেশের হিন্দুরা তাই জীবন কাটায় কথায় কথায় বাংলাদেশের উগ্র কিছু মুসলমানের নানান তিরস্কারে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর বাংলাদেশের মুসলিমরা হয় খুবই উত্তেজিত। তাই এ দেশেরই হিন্দুরা হয় ভীত, ভীষণতর ভীত। বাংলাদেশও খেলোয়াড়ই, তবে ইন্ডিয়াই এ এলাকার মস্ত খেলোয়াড়। বাংলাদেশকে শোষণ করাই তার সর্বোচ্চ কারবার। উপমহাদেশ উথালপাথাল উদ্বাস্তু হয় এখনও। কখনো কখনো চীনও এখানে নেতা হতে চায়। তাই ইন্ডিয়ার কোনো মুসলিম বাংলাদেশে না এলেও বাংলাদেশের উদাস হিন্দু প্রায়ই ভারতে চলে যায়।

নদীরও অসুখ এখন এই সোনার বাংলার নদীমাতৃক দেশে। বক-মাছরাঙার বুকেও অসুখ। কিছু শিকারী লোক সেসব বকের খুলি গুলি করে আকাশে উড়িয়ে দেখে। পাকিস্তান 1971-এ আমাদের যেমন উদ্বাস্তু জীবনে বাধ্য করেছিলো। যেভাবে কিছু লোক পাখপাখালিদের উদ্বাস্তু করে ছাড়ে। এসব মনের দুঃখ আজ সোমেন বলবে কাকে?
কাকের কা-কা শব্দের তেজে দিনদুপুরে কাকের কালো শরীরের মতো অমাবশ্যা মাটিতে নেমে আসে। অমাবশ্যার মুখোমুখি এ দেশ। সোমেন এবং দেশ। উপমহাদেশ কিংবা এই গ্রহ। অহ! রহ ...অহ এবং রহ। এতো মানুষ উদভ্রান্ত দেখে সে শান্ত কিভাবে থাকে? সে কি বোবা, সে কি বধির নাকি। ফাঁকির সঙ্গে বিরোধ হবে নিষ্পত্তি। সোমেন তাই ছাড় দেবে না ভুলেও একরত্তি।
সোমেন চায় না কোনো মারহাবা। সোমেন চায় রক্ষা করতে সকল তিলাইবাজ। অথচ শালার সঙ্গে জুটে আন্দোলনে যত্তো ধান্দাবাজ। কাজকর্ম তাই পন্ড হয়ে যায়। ফন্দিবাজের ফন্দিতে আজ কাজ করাই দায়। হায়! মদ না খাওয়া লোকেরাও আজ ‘ধান্দা’ খুঁজে খায়। এমন উন্মত্ততার কালে, এমন মদমত্তের গ্রহে সে পালাবে কোথায়? অবস্থা আজ খুবই শোচনীয়। তত্ত্বজ্ঞানী পন্ডিতও আজ তত্ত্ব ভুলে মাতাল হয়ে সারাদিন বকরবকর করে বলে ঞ-ঞ-ঞ-ক-ব-ল-ম ঞ-ঞ-ঞ। অবস্থা আজ খুবই শোচনীয়। ব-ল-ম-ঞ-ঞ। কী বলে তার মাথা বলে, নেই তার প্রতিকার। পান্ডিত্য তার খেয়েছে আজ নিবুর্দ্বিতায়, তাই তো হাহাকার।
সোমেন কি এখন ব্যস্ত থাকবে অয়েল খেতে, অয়েল দিতে, গ্রীষ্মে বর্ষায় কিংবা শীতে? এটাও নাকি অয়েলপেন্টিং, এটাও নাকি উত্তর আধুনিকতা... পোস্ট মডার্নিজম... অন্যরকম স্যুররিয়ালিজম। কিন্তু সোমেন তো আজ যোদ্ধা এক, দারুণ অরিন্দম। অয়েলিজমের নাম কিভাবে করে দেবে সে স্যুররিয়ালিজম? সোমেন তো দেখেছে এটা হলো অমানবিকইজম কিংবা এটা অর্থের জন্য পুরোই জীবনপাত, শুধুই অর্থাইজম।
সোমেন এভাবে চিন্তা করে বলে, সোমেন এভাবে ভাবনা ভাবে বলে, সোমেন এভাবে স্বপ্ন দেখে বলে, সোমেন এভাবে কথা বলে বলে, সোমেন এভাবে বলে বলে বলে বলে বলে বলে, অমরত্ব হবে না নাকি তার। সোমেনের শত্রুরা তা সর্বত্রই বলে।
অর্থকষ্ট সোমেনের আছে। অর্থচিন্তা? তাও আছে। তাই বলে তো সোমেন কখনো এক অর্থপিশাচ নয়। তবু তাঁকে দেখে কেউ কেউ পেয়ে থাকে ভয়।
এমনকি তাঁর এমন চিন্তা দেখে তাকে আর মনে রাখে না বাংলার চতুরা নারী। সোমেন তাদের চক্ষুশূল, পারলে ওরা ওদের শিল-নোড়ায় তাকে ঠিক মসলা বাটা বাটে। কখনো কখনো মনে হয় তার, এই মড়কের মাটি ছেড়ে ভেসে যায় আকাশ থেকেও দূরে।
কল্পনাতেই সোমেন কখনো দক্ষ এক শিকারী হয়ে ঘোড়া নিয়ে বনে ঘুরে। একটু শান্তি খুঁজে পেতে কেবলই ইচ্ছে করে তার। রাতের বেলা ইচ্ছে করে সুস্থ সবল যাত্রার মঞ্চে আবারও ফিরে যেতে। কিন্তু এসব সফল হয় না শেষে। কারণ অনুন্নত যতো পশু, তাদের চেয়েও নিচু, কিছু কিছু মানুষ, প্রতিদিন প্রতিরাত হিংস্র এক সিংহ হয়ে তাকে দংশন করে যায়। আর অন্যদিকে এক অলোকসুন্দরী কখনো কখনো হয়ে যায় বলে পর, গোমতি নদীর একূল-ওকূল, কোনো কূলেই হয় না সোমেনের ঘর। এরই মধ্যে মনের ভিতর প্রশ্ন দর্শনমাখা বিরাজ করে, কী আছে মৃত্যুর পর? সত্যি সত্যিই আছে কি কিছু? মৃত্যু কেনো ঘরকে এমন বর্শাবিদ্ধ করে? মৃত্যু কেনো এমন করে সব পুড়ে ভস্ম করে দেয়? মৃত্যুর এই লকলকে জিব কেনো এমন সঙ্গোপনে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে? পিপাসিত মৃত্যু আমাদের আসছে পেছন পেছন। এমন জানার পরও কেউ কেউ ওলটপালট করে সবার জীবন। তাঁরা কেবল নিজের সুখই খোঁজে। ওরা কি আসলে মানুষের জীবন কি তা বুঝে?
সোমেন এমনও ভাবে, আর কোনো ধর্মগ্রন্থ অবতীর্ণ হয় না কেনো? তারপরও ধর্মব্যবসা চাঙ্গা কেনো আরও? এমন দিনেও ব্যবসা দারুণ বিভিন্ন জাতের বোমার। মানুষের আর জ্ঞানসঞ্চার হবে না কোনোকালেই। কারণ মগজের সব বোলটুগুলো তাঁর সঞ্চিত ঢেঁকিশালেই। সুন্দরী সব মেয়েগুলোও ব্যাংকে আছে জমা। টাকার কাছেই ব্যবচ্ছেদ হয় ওরা, হায়রে তিলোত্তমা।
আজকে সোমেন মিতব্যয়ী-মিতাহারী বলে, ওই লবঙ্গলতিকারা কাঁথা ছিঁড়ে লাঙ্গলে।
ওই লবঙ্গলতিকারা আর ভালোবাসার গোলাপ কিংবা ঘাসফুলও দিতে পারে না। তাদের লোভনীয় ঠোঁটকেও তাই যম ভুলেও আর ছাড়ে না। ওরা যতোই সুন্দরী হোক, সোমেনের কাছে ওরা ‘ল্যাবেনডিশ’। তাই সে নাগেশ্বর বা নীলকমল দেয় না তাদের হাতে। দিলেও কখনো তাঁদের হয়তো দিয়েছিলো চানাচুর বখশিশ। নাগেশ্বর বা নীলকমল সে দেয়নি তাদের হাতে।
এই যে এতো হতাশা আজ সোমেনের, এই যে আজ চর্তুদিকে এতো কিলাকিলি, এটা কি তবে কিয়ামতেরই লক্ষণ? ইস্রাফিল ফেরেশতা কি আজ ফুঁকবেন তাঁর শিঙায়? জানে না সে এসব, তবে দেখেছে সে আঙ্গিনা তাঁর কালো মেঘে ভরে যায়। এমনকি মাটির গর্ভের স্বপ্নও সিদ্ধ হয়। গর্ভবতী নারীর গর্ভে ভীত অশোক করুণ কিরণময়। কলাগাছও এমনদিনে জলে ডুবে যায়। বৃষ্টিস্নাত কদমতলা, বটবৃক্ষ ক্রমাগত হারায়।
সোমেন মানুষের অন্তর খুঁড়ে দেখে, দেখে সেখানে মণিমানিকের খানিক ছোঁয়াও নেই। এই যদি হয় সময়, এই যদি হয় মাটি, এই যদি হয় নারী, এই যদি হয় সোমেন, তাহলে তো বুঝতে পারে সবাই আমরা আজকে নিম্নগামী। এই যদি হয় মাটি, তাহলে আর কেমন করে সামনের পথ হাঁটি? একদিকে পণ করে যখন, ঘরে আনবে অলোকসুন্দরীর মন, তখনই ঠিক পাচার হয় সব রূপশালি ধান, বেণীবদ্ধ স্বপ্ন এবং সোনার সুন্দরবন।
যখন আবার স্বপ্নে দেখে কবুতর একঝাঁক, ঠিক তখনই বর্ষণসিক্ত শ্রাবণ রাতেও অমাবশ্যার অভিসম্পাত আনে কিছু অবিশ্বাসী লক্ষীছাড়া মানুষ। তাঁরা দিতে থাকে অরণ্যময় অশনিপাতের খাঁ খাঁ খরার ডাক। ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস এক হয়ে যখন একই পুকুরে চলে, তখনও পুত্র পিতার দোষ তার একতরফাই বলে। সমাধান কী এই সমস্যার, সোমেন কোথায় করবে প্রতিবাদ? প্রাণদন্ডে দন্ডিত সব অপরাধী ঘুরে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়, মরেছে জল্লাদ?
এতোকিছু ভাবতে ভাবতে শেষে সোমেনও মনে হয় পাগল হয়ে যাবে। কিংবা হয়তো স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে মার্কসবাদকে জলে ঘুলে খাবে। এমনই তো দেখে আসছে কতো জনের কাছে। মার্কসের কথা বলেও তারা এই মুহূর্তে শূন্যতাবাদে আছে। অথচ এই মতবাদে সকল প্রকার মূল্যবোধকে অস্বীকার করা হয়। যার মুখে সদা শুনেছে ফরাসী বিপ্লবের অগ্রদূত জ্যাক রুশোর কথা, যে সর্বদা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে দারুণ ঘৃণা করতো, তাকে যখন মায়াময় ধনদৌলতে নিক্ষিপ্ত হতে দেখে, তখন সন্দেহ আরও অধিক পাকাপোক্তই হয়। এমন অমাবশ্যার মুখোমুখি সোমেন থাকবে আর কতোকাল? নাকি নিজেও মাতাল হয়ে অমাবশ্যায় মিশে গিয়ে চলে যাবে পাতালরাজ্যের গর্ভে।

এই যে সোমেন সময় কিংবা সমাজ কিংবা দর্শন কিংবা রাষ্ট্র নিয়ে ভাবে, তার কাছে তো পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রের কোনো হিসাব নেই। এই যে সোমেন শ্রম-ঘন্টা নিয়ে এতো চিৎকার করে, তার মাথায় তো অর্থনৈতিক আইনের বিদ্যা খুব বেশি একটা নেই। তবে কিভাবে বিত্তহীনশ্রেণির সমাধান দেবে সে?
তাহলে কেনো সোমেন করছে এই চিৎকার? আসলে সোমেনও নিশ্চিত নয়, কি যে চায় সে। আজকে যেটা চায়, কালকেই সেটা হবে কমদামী। কোথাও কেউ নিবদ্ধ থাকে না, ঘুরছেই যেনো কেবল। আজকে যাকে বন্ধু ভাবছে, কালকেই তাকে মারছে ভীষণ ছোবল। ক্রমাগতই বদল হয়ে যায় কী দেহ কী বিশ্বাস। সোমেন কি তার শেষ নিয়ন্ত্রক? কী বলে নিঃশ্বাস? নারীরা এখন কেনো হয় না সর্বাঙ্গসুন্দর? নারীরা তেমন সুন্দর হলে এ গ্রহ কি বিলীন হতে পারতো? চিরকাল, রেখে লয়-তাল, গড়ে উঠতো আরও তাজমহল। ঐ আগ্রার মতোই। কিন্তু সে মহল হবে না আর। মুছে যাবে তাই বৈশাখের ঐ বটের মেলা শত শত। বটবৃক্ষ? সেতো নারী। এ কবি স্বভাবে সোমেনের নারী দিয়েছে বারবার নানা ক্ষত। কখনো কখনো নারী এসে হিংস্র ছোবলও মেরেছে। তারপরও সে নারীদেরই, সেই লবঙ্গলতিকাদেরই আপন বলে জেনেছে।
সোমেনের জীবনে, জীবনের স্বপ্নে নারী কেবল করে যায় কানাকানি। সহ্য সে তাই করতে পারে না নারীস্পর্শের আনন্দ বিদায়ের শোক। তাই সে ভাবে, প্রেম নিরোধক নারী দেখার আগেই তার সত্যি মরণ হোক।
নারীর সংজ্ঞা তার কাছে যদি কেউ চায়, সে বলে, ‘নারী হলো স্বপ্নের অমরাবতী। কখনো বা রঙিন অলিগলির অলংকারের এক বাড়ি। এ বাড়িকে ছেড়ে কি আমরা কেউ বেঁচে থাকতে পারি? তাই জীবনের, জীবনের স্বপ্নে নারীকে এমন বুকে জড়িয়ে ধরি এবং নারীর স্বপ্নে ভীষণই ডুবে মরি...।’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন সংজ্ঞা তাঁর নিজেরই পছন্দ হয় না। তাহলে সোমেন কি জানে না নারী কাকে বলে? কেনো সে এমন নারীর সঙ্গ চায়। সেটা কি তার এখন এ যৌবনকাল বলেই? নারীই কি এই মানব জীবনের লক্ষ্য? দেশ কিংবা ধর্ম অথবা আদর্শের স্থান কোথায়? কাকে আগে চাই, কতোটুকুই বা চাই? এসবেরও নীতিমালা নেই।

আসলে সোমেন নিজের কাছেই নিজে এক মস্ত অস্বচ্ছ মানুষ। বিখ্যাত সব মানুষগণও এমন ছিলেন নাকি? এই জগতের অনেক অনেক বিখ্যাত বা জ্ঞানী লোকও কেনো আত্মহত্যা করেছেন? কবি মায়াকোভস্কি, চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগখ...? সোমেনও তার বুকের গভীরে কখনো কখনো আত্মহননের সর্পের ডাক শুনে। অথচ সে জানে আত্মহত্যা এক পাপ। তবে কি সোমেন উন্মাদনাগ্রস্ত কোনো মানুষ? যার জীবনে কোনো আশাই নেই? নাকি তার নৈতিকতার অভাব? এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? দার্শনিকগণ তো বিক্রীত আর বিকৃত হয়ে গেছেন। সমাধান সে চাইবে এখন কার কাছে বা দ্বারে?

আত্মহননের সর্প কিন্তু পিছু ছাড়ে না তার। প্রায়ই এ হারামি কিন্তু দংশন করে তাকে। আর করে দিতে চায় হতাশাগ্রস্ত অলক্ষী এক যুবক। ঠিক এমন ক্ষণেও সুন্দরী কোনো নারীর কাছে সোমেন কোনো এক অমরাবতীকে খুঁজে। সোমেন বুঝে আত্মহননের সর্প থেকে বাঁচতে হলে, অমানিশার ঘোর অভিশম্পাত থেকে বাঁচতে হলে বদ্বীপ এলাকার কোনো নারীর সঙ্গ তাঁর চাই-ই চাই। কিন্তু এটাই কি মুক্তির পথ? মানব জীবনের বন্দেগি কেনো নারীর কাছেই বন্দী হয়ে যাবে? কী হবে তার সমাধান? বন্দে লবঙ্গলতিকা নাকি বন্দে মাতরম? কিন্তু সোমেন যদি আস্তিক হতো, তাহলে তো ঈশ্বর কিংবা আল্লাহর বান্দা হতো। আল্লাহর বান্দা কি নারীর জন্য জীবনটাকে বিলিয়ে দিতে পারে? যখন তার বয়ঃসন্ধিকালের শুরু হয়, তখন থেকেই এমন হাজার প্রশ্ন তার মনে। ইদানীং তো মনে হয় নাস্তিকও সে নয়।
নাস্তিক হলে আস্তিকের কাছ থেকে প্রতিদিন কেনো সে এতো সুবিধা নেয়। তবে কি এসব হলো দর্শনের বা সংস্কৃতির অথবা শিল্পকলার শৌখিনতা?
কিছু লোক এই যে তাকে পাগল বলে ডাকে, সে তার শত প্রশ্নের কারণেই। কারণ কারোর উত্তরই শেষ পর্যন্ত পছন্দ হয় না তার। তাই সে সোমেন চন্দকে জেনেও, শওকত ওসমান পড়েও, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর লেখার ঘ্রাণ প্রতিনিয়ত নিয়েও নিজে কোনো কাজেই লাগে না হায়!
তাঁর নিজেকেই নিজের প্রায় মনে হয়, হিজিবিজি এক চরিত্রের মানুষ সে। কারণ আল মা‎হমুদের ‘জলবেশ্যা’ গল্প পড়েও গল্প বুঝে না সোমেন।
তাঁর সামনে দিয়ে একবার অনেক টাকা গেলো। একটি টাকার বস্তাও ধরতে পারেনি সে। শরীর ঘেঁষে কতো কতো সুন্দরী নারী গেলো।একজনকেও ঠিক প্রেম নিবেদন করা হয়নি তার। এটা কেনো তাঁর বারবার হয়? কেনো এমন শক্তিমান লেখক ফ্রানৎস কাফকা চার চারটি প্রেম করেও একটি বিয়েও করতে পারে না? ডারউইন আজ বেঁচে থাকলে উত্তর দিতেন বিবর্তনবাদের সূত্র ধরেই। বলতেন তিনি বানরের কাছে যাও।
কিন্তু সোমেন নিজেই আজ এমনই এক বানর অথবা বান্দর, যার কারণে কারোরই শান্তি নেই। এমনকি তাঁর নিজেরও শান্তি নেই। সোমেন যেন এমনই এক বান্দর, যে বারুদ দিয়ে বালিশ বানিয়ে ঘুমায়। তার চিন্তা আর প্রশ্নের মধ্যে বাবলা গাছের কাঁটার মতো শত-সহস্র কাঁটা। এমনই কাঁটা সঙ্গী তাঁর, কেমন সে বাপের বেটা। কাঁটা তাঁর মিত্র আবার কাঁটাই শত্রু তাঁর। কাঁটাই তাঁর অরি আর সে ওই অরিন্দম। কাঁটা দিয়ে ‘খাটা’ খায় সে, ভীষণই ব্যতিক্রম।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ঐ বলা পর্যন্তই। হেন করিব তেন করিব... শেষে দেখা গেলো কাজের কাজ কিছুই হয় না তার। তাই নিজেকেই তাঁর নিজের কাছেই প্রতারক মনে হয়।
মনে তাঁর ভাবনা আসে, ‘কেনো এমন অক্ষমতা আমার? কেনো আমি জীবনে, রাজনীতিতে, কাজের জায়গায় এমন ব্যর্থ হয়ে আষাঢ় মাসের কদমতলা ছুঁয়ে, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার কাছে জীবনের সংজ্ঞা প্রার্থনা করি? শ্রাবণের পূর্ণিমার কথা মনে হলেই আবার মনে পড়ে শ্রাবণের রাজকন্যার কথা... রাজবাড়িতে তাঁর রিনিঝিনি নূপুরের গান। সেই গানের রস, রসমাধুরী-রূপমাধুরী দিয়ে জ্যোৎস্না-পোহানো জীবন এক কষ্টে খুঁজে পায়। কিন্তু শেষ অবধি সে জীবনেও শুরু হয় অমাবশ্যার অভ্যুত্থান, গুপ্ত কষ্ট, বেজন্মার জন্মদিনের বিবিধ উৎসব।
এক সময় সোমেন দেখতে পায় এই সময়, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই পৃথিবী ঠিক তারই মতো বন্ধ্যা হয়ে গেছে। তারপরও সোমেন যেন চে গুয়েভারার বিপ্লবের যান্ত্রিক দর্শনের মতো বন্ধ্যা সময়কে উর্বর করার সংশপ্তক স্বপ্নের বৃষ্টির দীর্ঘমালা গাঁথে।
সর্বশেষ সোমেন লক্ষ্য করে, এই তাঁকে নারী ছাড়েই না, সেও ছাড়ে না নারীকে। বস্তুত: নারীর জন্যই বিপ্লব করা সোমেনের পন্ড হয়ে যায়। এতো এতো বিপ্লবের কথা বলেও শাড়ি আর নারী, এই পর্যন্তই সোমেনের স্বপ্ন বিরাজিত থাকে। গাড়ি-বাড়ির চিন্তা তাঁর মাথায়ই আসে না ফাঁকে।

ইসলামি মতে সোমেনের এখন কোনো আস্থাই নেই। তারপরও বিশ্বাস করে সোমেন, মানুষের বিবেকই শেষ বিচার করে নিতে পারে। সেই হিসেবে বলা যায় এক অর্থে রোজ হাশরে কিংবা শেষ বিচারে সোমেনও বিশ্বাস রাখে।
আর সোমেনকে এমন উদ্বাস্তু জেনেও, সমাজতত্ত্ব...সমাজতন্ত্র না বুঝতে পারা এক সুন্দরী যুবতী নারী সোমেনের বিভিন্ন পিপাসাকে নিবিড়ভাবে নিবারন করতে চায়। সেই নারী অবশ্য হাসনাহেনা ফুলের দারুণভক্ত। কিন্তু সেই নারী কেনো সোমেনের প্রেমে পড়তে চায়? যেখানে সোমেনের কোনো অর্থপ্রেম নেই!
সোমেন তাকে বলে, ‘হাশরের ময়দান যদি সত্যি সত্যিই আবির্ভূত হয়, তাহলে আমার কঠিন বিচার হবে। সুতরাং আমাকে ভালোবেসে কী লাভ? আমি এখন তীরন্দাজ। সারাক্ষণ লাল রক্তের কমিউনিস্ট সাজ নিয়ে বুকে আওয়াজ তুলি। তুমি কেনো কোনো হিসাবনিকাশ ছাড়া আমারই প্রেমে পড়বে কমলাফুলি?’
আরও বলে, ‘শোষক সিংহ আমেরিকা সারা পৃথিবী ছুটে ছুটে লুটে নেয় এ গ্রহ। তার হীনতার কারণে আজ জীবন দুর্বিষহ। আমেরিকার দালালরা আজ আমাদের বিন্দু স্বপ্নের লেশকেও বিদ্বেষবশে শেষ করে দিতে চায়। আকাশে উড়ে এই পৃথিবীর শোষক বাঁধন ছেদন করবো কবে, তার ঠিক ঠিকানাই নেই । আমার এমন অনিশ্চয়তার সঙ্গে কেনো তুমি একাত্ম হতে চাও?’
মেয়েটি বলে, ‘আমি বুঝি প্রেমের বিনিময় প্রেম। হও তুমি নাস্তিক কিংবা ঐ আস্তিক। আমি তোমাকে ভালোবাসলে তুমি একদিন প্রেম দেবেই।’
সোমেন বলে, কিন্তু আমার দর্শন ভিন্ন, ত্যাগের দর্শন। লোকে বলে, বোকার দর্শন। কারণ, ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতা শূন্য’ কিন্তু আমার দর্শন নয়। আমার দর্শন পুরোই বাকির পক্ষে।
আমি চাই সুন্দর ভবিষ্যৎ কিন্তু যন্ত্রণার বর্তমান। স্বল্পমেয়াদী দুঃখ, দীর্ঘমেয়াদী সুখ। এসব করতে গিয়ে আমি ক্ষমতাসীন শোষকের গুপ্ত হত্যারও শিকার হতে পারি।’
মেয়েটি বলে, ‘যদি আমি এভাবে বিশ্বাস করি যে, তোমাকে আমি ভালোবেসে যাবো, তোমার ভালোবাসা না পেলেও, তখন কি তোমার আপত্তি থাকবে?’ মেয়েটির এই কথা শুনে সোমেন একেবারেই চুপ হয়ে যায়। ভাবে, ‘এই মেয়ে কি সত্যি তাঁকে ভালোবাসে? নাকি সে কারো আদর্শিক গোয়েন্দা? বুর্জোয়ারা তাঁকে টাকা দিয়ে সোমেনের গতিকে ব্যাহত করার জন্য লেলিয়ে দেয়নি তো কোনো? সিআইএ-র পক্ষে তো কিছুই অসম্ভব নয়।’
সোমেন মেয়েটিকে বলে, ‘তারপরও সমস্যা আছে। কারণ নারী অত্যন্ত জটিল বস্তু। তাই তোমাকে আমার আরও বুঝতে হবে।’
মেয়েটি বলে, ‘মানুষ আবার বস্তু হয় কিভাবে? সোমেন বলে, আমিও বস্তু তুমিও বস্তু। আদর্শ বস্তু, ভালোবাসাও বস্তু, মার্কস বস্তু, লেলিনও বস্তু... যাহা বস্তু, তাহাও বস্তু, যাহা বস্তু নয়, তাহাও বস্তু। আর আমি সেই বস্তুবাদী। তাই তোমাকে বস্তুর ঊর্ধ্বে রাখা আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
মেয়েটি বলে, বস্তুবাদের জনক, আমার সঙ্গে এসব তোমার আলাপ করে মোটেও লাভ নেই।
সোমেন বলে, জেনে রেখো, নিজের সুখই অন্যের দুঃখের কারণ। সুতরাং নিজের সুখের চিন্তা করাই বৃথা। এ চিন্তা থেকেই একদিন এ গ্রহ শোষণমুক্ত হবেই। মুক্তির খোঁজে একদিন আমি এই নদী এলাকার সকল মানুষ সঙ্গে নিয়ে লড়বো। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও-সে -তুঙের মতোই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবো আমি।
মেয়েটি বলে, এমন জননায়কের দরকার নেই আমার। তোমাকে শুধু আমার জীবনের নায়ক হলেই চলবে।
মেয়েটির এ কথা শুনে আবারও তাঁকে সন্দেহ হয় সোমেনের। বৃটেনের উইনস্টন চার্চিল কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রাংকলিন রুজভেল্টের সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়া আছে তাঁর। তাই তো সোমেন মেয়েটিকে নিয়ে সন্দেহের মধ্যেই থাকে।

তবে সোমেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠোর হাতে দমন করলেও জোশেফ স্ট্যালিনকে অশ্রদ্ধা বা সন্দেহ করে না। কারণ জোশেফ স্ট্যালিন সোমেনের ঐতিহাসিক-দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অন্যতম নেতা।

মার্কস-এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রতিদিনই পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে আছে সোমেনের । কিন্তু সমস্যা হলো, সোমেন যখন আবার গ্রীক কাহিনীর ট্রয়ের উপাখ্যান পড়ে, তখন স্পার্টার রানী হেলেনকে অপহরণ করার বিষয়টিকেই সে আবার সমর্থন করে বসে। কোন যুক্তিতে? মাথায়ই আসে না তাঁর।
প্যারিস যখন রাজা মেনিলাউসের স্ত্রী হেলেনকে নিয়ে চলে যায়, তখন এটাকে কেনো সে সমর্থন করে, তাঁর কোনো উত্তরই খুঁজে পায় না সে।
তবে কি সোমেন নৈতিকতাহীন? কেন তার স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর চিত্রগুলো এতো ভালো লাগে? অথবা সেই ডাচ শিল্পী ভ্যান গখের সব আঁকা?
এসবের প্রকৃত কোনো কারণ জানে না সোমেন । তবু মুক্তি খুঁজে। মুক্তির খোঁজে গ্রীষ্মে-বর্ষায়-শরতে কিংবা হেমন্তে গমন করে। হেমন্তমনিও নন্দিনী থাকে না আর। পঙ্কিল এক রূপ নিয়ে হয় হিংস্র কালফণী। কালফণীরা স্বপ্নের সকল বাগানকেও বিকল করে ছাড়ে। পুড়ে যায় ফলফলাদি। মানুষও ক্ষয় হয়। রক্ত ঝরায় কিছু তাজা প্রাণ। তারপর জন্ম নেয় যন্ত্রণাযাপনের দিন। রক্ত নিশান আবার আকাশে উড়ে। সেই নিশানের কাস্তে-হাতুড়ি খর রোদে পুড়ে। ততদিনে রক্ত পিপাসা জাগ্রত হয় শত্রু সেনাদেরও। পাখাকাটা সব পাখিরাও শত্রু সেনার সঙ্গে যোগ দেয়। ততোদিনে শীতকাল নেমে আসে। অথচ আনন্দ আসে না ঘরে। নদী যমুনার কিংবা পদ্মার জল খায় ভারত কেড়ে। ক্লান্ত সোমেন দেখেও যেনো না দেখার ভান করে।
অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, জল নেয় কে-রে কে-রে? তারপর যমুনা আরও হিংস্র হয়ে খেতে থাকে সব ফসল, শত শত সংসার। এসবের দায় কার? যীশুর যাবজ্জীবন যন্ত্রণা সোমেনের শরীরে ঢুকে। এমন সংকটে কেউ কখনো থাকতে পারে সুখে? বুকের স্বপ্ন থেকে নারীর স্বপ্ন, স্বপ্নের ঘর, বাসর ঘর, বাসের ঘর, সব লুট হয়ে যায়। মুক্তি আর আসেনা। আরজ আলী মাতুব্বর পড়াটাও তার তখন কোনো কাজেই আসে না।
কিন্তু মুক্তি আসবে কবে কিংবা কিভাবে? অথবা সোমেন কি মুক্তির সংজ্ঞা জানে? নাকি মুক্তি বলতে একটি খণ্ডিত ধারনাকেই সোমেন বুঝে? তার মাথার ভিতর এখন নিরংকুশ মার্কসবাদ। মার্কস কি সমালোচনার উর্ধ্বে? কিন্তু তাঁর সামনে কেউ মার্কস-লেনিন-ষ্ট্যালিনের দোষারোপ করলে মাথার রক্ত গরম হয়ে যায় তাঁর। কিন্তু সেটা কেনো? দল করার স্বপ্ন থেকে কি তার রক্তেও দালালের বীজ ঢুকেছে? সোমেন কি তবে দালালই হচ্ছে ক্রমাগত?

এসবের উত্তর পেতে সোমেন আবারও পড়তে থাকে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের জীবনীসহ নানা গ্রন্থ অথবা ই‎হুদী জাতীয়তাবাদের ভিত্তির ইতিহাস কিংবা ইয়ং কমিউনিস্ট লীগের তাৎপর্য, লেনিন যাকে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য তৈরির কারখানা আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার সমস্যা ভিন্ন। এতো কিছুর পরও সোমেন কিছুতেই কেনো যে নিশ্চয়তা খুঁজে পায় না। এর কারণটা কী, বুঝতে চেষ্টা করে।
যে মেয়েটি তাকে ভালোবাসতে চায়, সে আবারও সামনে আসে। বলে, তোমার শান্তি কবে আসবে? লাল পতাকার বিপ্লব যেনো অক্ষম না হয় তোমার। বসন্তে যেনো অগ্নির আক্রমণে অগোছালো না হয় সব। বুকের ভিতরেই যেনো তোমার সকল অগ্নুৎপাতের অঙ্কুরে বিনাশ হয়।

সোমেন বলে, ‘সেই সম্ভাবনা কম। আমি শেষ পর্যন্ত পাগলই হয়ে যাবো প্রিয় কমলাফুলি। কারণ আমার পেটে থাকে না ভাত। অথচ আমি নিজের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য কোনো চিন্তাই করতে পারি না। একার সুখের চিন্তাকে আমার কাছে এক মস্ত বড় অপরাধ মনে হয়।
আমি এখন ইউটোপিয়ান কিংবা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র নিয়েও খুব পড়ছি। ইদানিং এ বিষয়ে স্যার টমাস মুর লিখিত বিখ্যাত সামাজিক উপন্যাস ‘ইউটোপিয়া’রও খোঁজ করছি। জানি না এর বাংলা অনুবাদ বের হয়েছে কী না। যদি অনুবাদ না থাকে, তাহলে আর পড়াও হবে না আমার। কারণ আমি ইংরেজি তেমন বুঝি না। ইংরেজি না বুঝেই এতো ভাবনা মাথায় লালন করি আমি। তাই যখন কেউ আমাকে পাগল বলে ডাকে, আমি মনে করি, যথাযর্থই সে আমাকে পাগল ডাকে।
মেয়েটি বলে, ব্যাংকে তোমার টাকা জমা আছে? প্রাণ ধারনের অম্লজানে বসন্ত যদি ভরপুর না থাকে তোমার, বসন্তে যদি ক্লান্ত হয় তোমার স্বপ্ন, যদি তোমার চতুর্দিকের মানুষ অক্টোপাসের ভূমিকা নিয়ে দাঁড়ায়, বৃক্ষেরা হয় কৃপণ এবং দুর্ভিক্ষ না হয় দূর, তাহলে তুমি নিজেই নিশ্চিত মরে যাবে।
মেয়েটির কথাবার্তা শুনে সোমেনের আবারও সন্দেহ জাগে। এই মেয়ে তো হাসনাহেনা ফুলের ভক্ত। আমি জানি সে সমাজতন্ত্র, সমাজতত্ত্ব বুঝে না। কিন্তু তার কথা শুনলে তো মাঝে মধ্যে মনে হয়, সে জ্যাক রুশো পড়েছে, পড়েছে নৃতত্ত্ব, প্রেসের স্বাধীনতা কিংবা রাস্ট্রবিজ্ঞানের নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। তবে কেনো সে তার পরিচয় গোপন করে? আমাকে কি সে খুন করবে? স্ট্যালিনের নির্দেশে যেমন এক আততায়ী হাতুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে ট্রটস্কিকে খুন করেছিলো?
সে কি আমাকে ভালোবাসে? নাকি সে আমারই কোনো ঘাতক? নাকি আমি তাকে ভালোবেসে ঘর বাঁধবো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সব স্বপ্ন বাদ রেখে? নাকি শেক্সপীয়রের ‘ওথেলো’র মতো তাকেই আমি খুন করবো, যেমন করে ডেসডিমোনাকে খুন করে ওথোলো? কেনো এমন সিদ্ধান্তহীনতা আমার? আমি কি উন্মাদ? নাকি সবাই উন্মাদ, আমিই কেবল সুস্থ? নাকি রাজনীতির মধ্যে শ্রেয়োনীতি নেই বলে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে অকৃতজ্ঞ, অস্থির, কপট, ভীরু, লোভী মানুষ দেখতে দেখতে ভূতে ধরেছে আমাকে?

সোমেন ভাবে, না আমি তো ভূত বিশ্বাসই করি না। আমি তো মনে করি ভূতে আর ভগবানে বিশ্বাসের মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই। তাহলে আবার আমাকে ভূতে ধরবে কোথা থেকে? অবশ্য আমার বুর্জোয়া শত্রুরা প্রায়ই বলে, লেনিনের ভূতেই নাকি ধরেছে এই আমাকে। কিন্তু যদি ভূত বলে কিছু থাকেও, তাহলেও আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমার মতো অ-মেধাবী এক যুবককে ধরার জন্য লেনিনের ভূতেরও কি ঠেকা পড়েছে?
লেনিনের ভূত পৃথিবীর লক্ষ-কোটি মেধাবী যুবকের ডিউটি করেই তো কাজ শেষ করতে পারছে না। তা ছাড়া সেই ভূতের তালিকায় আমার নাম থাকার বিষয়টি যুক্তিযুক্তও নয়। বিশ্বাসও করি না আমি। কিন্তু ঐ যে মেয়েটি? যে আমার পিপাসা নিবারনে অঙ্গীকারাবদ্ধ কিংবা যে আমাকে ভালোবাসে অথবা আমার গুপ্তঘাতক! তাঁর বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবো আমি? তাঁকে কি বিয়ে করবো আমি? যৌনতাও তীব্র থেকে তীব্রতর গভীরতর আমার শরীরের ভিতর। কিন্তু পছন্দের কিছু গুরুজন প্রায়ই আমাকে বলেন, যে যুবক যৌনতাকে বিসর্জন দিতে পারে না, তাঁর কখনোই নেতা হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই। এমন বাণী জীবনে ধারন করে অনেকে রাজনীতির জন্য চিরকুমারও হয়েছেন। কিন্তু আমার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। সুতরাং ওই নারীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের যাবতীয় বিষয়কেই পুনর্বিবেচনায় আনতে হবে আমার। আর মেয়েটিও ভীষণ আলাপী। আর আমি প্রলাপী। আমার ভীষণ ইচ্ছে ওই কমলাফুলির শরীরে আমার আলিঙ্গনের আলিম্পন এঁকে দেই। কিন্তু সে যদি হয় সত্যি সত্যিই পুঁজিবাদের কোনো এজেন্ট? তাহলে তো সে আমাকেও পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। জিম্মি করে বিভিন্নভাবে পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার আইন আদালত দেখিয়ে তাঁর বিভিন্ন দাবীও আদায় করতে পারে। আমি কি কোনো অমাবশ্যার মুখোমুখিই আজ আছি? নাকি আমি নিজেই এক ঘোর অমাবশ্যার কালো? আর মেয়েটি কি কোনো পূজারি নাকি কোনো স্থলবেশ্যা? নাকি পুত্তলিকা? কোনো বিষয়েই নিশ্চিত নই আমি। যেমন নিশ্চিত নই আমার পাঠ্য বিষয়ে অলঙ্কারশাস্ত্র থাকার পরও আমার লেখার মনোরম অবস্থান নিয়ে। আমার খুব কষ্ট হয়, যখন দেখি মানুষ হয় মানুষেরই দাস কিংবা দাস মানুষ এতো পরিশ্রমের পরেও সুখের নাগাল পায় না। তাই যখন সমাজতন্ত্রের কথা বলি, তখন যখন কেউ আমাকে বলে, সেটা হলো অশ্বডিম্ব, তখন আমার সত্যি খারাপ লাগে। যে তত্ত্বকে ভেবেছিলাম তিলোত্তমা আমি, তাকে যখন দুর্নাম দেয় কেউ, আমি তা কোনোভাবেই সইতে পারি না কখনো। কিন্তু আমি এখনও পার্টির নিবন্ধিত কোনো সভ্য হতে পারিনি।
আমি ভেবেছি, আগে আমি পার্টির লাইনে তত্ত্ব-তথ্য ভালো করে জানি। তারপর না হয় সিরিয়াসলি পার্টি করা যাবে। কিন্তু জানতে গিয়েই ক্রমাগত নিপতিত হই। কাউকে এ লাইনের জটিল প্রশ্ন করলেই বলে, ভালো না লাগলে বিশ্বাস না থাকলে নিবৃত্ত থাকো। শেষে দেখি যাদের কিছুটা পূজাই করি, যারা অবশ্যই পূজনীয়, তাদেরও দেখি ডাস্টবিনে পড়ে আছে। গুরুদক্ষিণা এমন কেন হবে? গুন্ডা-বদমাশও গুণীজন সেজে আছে। আমার এমন হিবিজিবি ভাবনার চাপে, প্রশ্নের অত্যাচারে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলে ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে হঠাৎ লাফিয়ে উঠি। স্বপ্নে দেখি কমিউনিস্ট নামধারী কিছু লোক আমাকে দেখিয়ে বলছে, সোমেন ফিল্মমেকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের মতোই ভুয়া কমিউনিস্ট হবে। সুতরাং কমিউনিজমের এই গীবতকারীর মাথাটাকে এক্ষুনি গিলোটিনে ঢুকাও। আর তারই সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম বিশ-পঁচিশজন যুবক আমার মাথাটাকে শরীর থেকে আলাদা করার জন্য বলপূর্বক এক ভয়ানক গিলোটিনে ঢুকাচ্ছে।
আমাকে যে ভালোবাসে মেয়েটি, যে আমার সমান্তরালে হাসনাহেনা ফুলও ভালোবাসে, তখন দেখলাম সেই কমলাফুলি আমাকে বাঁচানোর জন্য ভীষণভাবেই কাঁদছে।
সময় হারিয়েই বুঝলাম আমি, মেয়েটি আমাকে সত্যি সত্যিই ভীষণই ভালোবাসতো। হায় সোমেন! তুমি এ কথা আগে বুঝলে না!
কিন্তু কমলাফুলিকেও ভালোবাসি আমি। এখন কমপক্ষে তাঁকে এটা জানিয়েই আমি ওদের হাতে খুন হতে চাই। কিন্তু ঘাতকরা আর আমাকে সেই সুযোগ দিতেও নারাজ। কারণ আমি যদি কমলাফুলিকে আমার গভীর ভালোবাসার কথা জানিয়েই মরে যাই, তাহলে সে আমার উত্তরসূরী হয়ে আমারই প্রেমের, আমারই বীরত্বের এক অমরত্ব সৃষ্টি করতে পারে। তাই ওই পুঁজিবাদের পান্ডারা খুব তাড়াতাড়ি করেই আমার মাথা কেটে নেয়।
আর আমার কাটা মাথার এক প্রান্ত দিয়ে বের হওয়া রক্তের গড়গড় শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমি তখন কমলাফুলিকে বলতে চেষ্টা করি, আমি তোমাকে ভীষণই ভালোবাসি প্রিয় হাসনাহেনা...আমার প্রিয়তর কমলাফুলি।
কিন্তু মেয়েটি তখন আমার ওসব শব্দের তাৎপর্য একেবারেই না বুঝেই এলোকেশী হয়ে কেবলই কাঁদতে থাকে। মরতে মরতেও তাঁর সেই কান্নায় আমি সেতারের সুর শুনি।
হায় সোমেন, এমনই করুণ এক মৃত্যু দুনিয়ায় কপালে ছিলো তোমার ? যে তোমাকে এতো ভালোবাসে, মরার সময়েও তাকে তুমি এ কথা একটু খুলেও বলতে পারলে না? অমাবশ্যা এমনভাবেই গিলে খেয়ে নিলো তোমাকে! যেমন করে বাংলাদেশের নদীগুলোকেও বর্ষাকালে ডুবিয়ে মারে ভারত আর শুষ্ক মৌসুমে নদীশুদ্ধই গিলে খেয়ে ফেলে ওই খাদক! ভাবে না সে তুলসীগাছ বাংলাদেশেও আছে!
================================================================================

নোট:
এ গল্পটি আমি লিখেছিলাম আমার জীবনেরই এক ধরনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে অথবা কমিউনিস্ট রাইটার সোমেন চন্দের জীবনের কিছুটা ছায়া অবলম্বনে। এ লেখাটি প্রথম পাঠ করা হয়েছিল 1998 সালে, কুমিল্লার একটি সাহিত্য পাঠের আসরে। সেই সাহিত্য পাঠের আসরে ফারজানা কবির ঈশিতাও উপস্থিত হয়েছিলো, যার সঙ্গে পরে আমার দুই বছরের প্রেম এবং সেই প্রেম শেষে বিয়েও হয়েছিলো। আমাদের সে সংসার পরে মতান্তরে পথান্তরে ভেঙ্গেও গিয়েছিলো ঠিক ওই দুই বছরের মাথাতেই।
কুমিল্লার সেই সাহিত্য সভায় ঈশিতা সেদিন এসেছিলো তাঁর বান্ধবী ক্যামেলিয়া রোজীকে নিয়ে স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে। আমার এ ‘অমাবশ্যার মুখোমুখি’ গল্পটি সেই অনুষ্ঠানে পাঠের পরপরই এ গল্পের বিরূপ সমালোচনা করেন কুমিল্লার তখনকার সাহিত্যবোদ্ধারা। তবে কুমিল্লার সাহিত্যিক আহাম্মেদ কবীর ও গল্পকার কাজী মোহাম্মদ আলমগীরই শুধু এ গল্পের পক্ষে তখন কিছু কথা বলেন। পরে সেই 1998 সালেই সাহিত্যিক আহাম্মেদ কবীর আমাকে বলেছিলেন ‘ময়নামতি’ নামে তিনি একটি সাহিত্যপত্রিকা বের করবেন এবং তার প্রথম সংখ্যাতেই এ গল্পটি ছাপাবেন। কিন্তু আহাম্মেদ কবীরের সেই সাহিত্য পত্রিকা আর বের হয়নি। তাই আমার এ গল্পটিও কখনো কোথাও আর ছাপার মুখও দেখেনি। তবে বর্তমানে এ লেখাটিকে আমি এক বিশেষ ধরনের লেখা মনে করলেও ঠিক পরীক্ষানিরীক্ষানির্ভর কোনো গল্প আর মনে করছি না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৮ ভোর ৬:২৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×