ভাবছিলাম কিভাবে শুরু করব ? ব্লগের শুরুতে শিরোনাম দেখে প্রথমেই যেই বিষয়টা মাথায় আসলো সেটা হল ফিরে আসা। হ্যাঁ আমি একজন সামুর নিয়মিত ব্লগার ছিলাম একসময়। যে কিনা এইমাত্র দীর্ঘ ৫ অথবা ৬ বছর পর ফিরে আসলাম আবার এই সামহোয়ারে। আমার যাত্রা সেবার শুরু হয়েছিলো ২০০৭ সালে কন্গোর শান্তিরক্ষা মিশনে। অবসরে একদিন ইন্টারনেট সার্ফিং করতে করতে হঠাৎ পরিচয় এই সামহোয়ারইনের সাথে, প্রথম দিকে ছিলাম আমি একজন নীরব শ্রোতা, কিছুদিন পর সাহস করে কয়েক লাইন লিখে ফেললাম প্রথমবার ফোনেটিকে। সেই থেকে সামহোয়ারের প্রেমে পড়লাম , একের পর এক লেখে গেলাম , হয়ত সেগুলো কোন লেখার মানদন্ডেই পড়েনা।কিন্ত কন্গোকে নিয়ে জানিনা আমার আগে কেউ এই সামহোয়ারে লিখেছিলো কিনা ( সম্ভবত না) , কিন্ত পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন পাঠকের ভালোবাসা আর অনুপ্রেরনায় কংগো সিরিজকে অনেকদূর আগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।
অবশেষে একদিন আর সবকিছুর মত আমার দীর্ঘ একবছরের শান্তিরক্ষা মিশন শেষ করে আমি দেশে ফিরে আসি। পরবর্তীতে আমার সেই টুকরো টুকরো লেখাগুলো থেকে একটা লেখা নির্বাচন করে সাহস করে মানবজমিনের ঈদসংখ্যার জন্য পাঠাই এবং লেখাটা কোন কারনে সম্পাদকের ভাললাগে এবং লেখাটি প্রকাশ করলে আমি আরেকটু মনে মনে সাহস সন্চয় করে সির্ধান্ত নেই একটি বই বের করার । সামহোয়ারের সেই লেখাগুলো অবশেষে বই আকারে " ব্ল্যাক উডসের দেশে " নামে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে অমর একুশের গ্রন্হমেলায়, রাইটার্স গিল্ড প্রকাশনী থেকে। এর বেশ কিছু সংখ্যা সেসময় বিক্রি হয় এবং পরবর্তীতে প্রচ্ছদ সংস্করনের পরও কিছু কপি বিক্রি হয়। তবে প্রথম বই হিসেবে আমি বিক্রির চাইতে বই পড়ার পর পাঠকদের কাছে যে অনুপ্রেরনা পেয়েছি তার মুল্য লেখক হিসেবে আমার কাছে অর্থের চাইতে অনেক বেশি মুল্যবান ছিল।
আসলে আমি জীবনে কখনো বই লেখে ফেলবো সেই সাহস করিনি । কিন্ত সামহোয়ার আমাকে সেই সাহস যুগিয়েছিলো একটু একটু করে। যদিও এরপর একের পর এক দায়িত্ব আর ব্যস্ততায় কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলি , লেখালেখির থেকে কিছুটা দুরে সরে যাই। যদিও এর মাঝে প্রায় ১০০ টিরও বেশি পোস্ট করেছিলাম এই সামহোয়ারেই কিন্ত অনেকদিন অনুপস্থিতির খাতায় নাম থাকায় আমার সেই পোস্ট গুলো আর দেখছিনা এখন। তবে এবার ঠিক করেছি আমার বইয়ের সেই লেখাগুলো আমি চেষ্টা করব ধারাবাহিকভাবে এখানে প্রকাশ করার। যদিও আমার সেই বইয়ের কপি পাওয়া যাচ্ছে রকমারি ডট কমে। তবুও সামহোয়ারের কাছে আমি চেষ্টা করব আমার সেই লেখাগুলো প্রকাশের মাধ্যমে কিছুটা ঋন শোধ করার। লেখাগুলো পাঠকের মন কাড়লে আমি হয়ত নতুন করে অনুপ্রানিত হব নতুন করে কিছু একটা লেখার। যখন এই লেখাটা লেখছি তখন আমি নতুন আরেকটি দায়িত্ব মাথায় নিয়ে আফ্রিকার সাহারায়।
পটভূমিকা- বিদায় আফ্রিকা, বিদায় কংগো, বিদায় কালো মানুষের দেশ
ঝাপসা হয়ে আসছে জানালার কাঁচ, প্রচন্ড জোরে জেট ইন্জিনের শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে বিমানের পাখা; একটু পরেই রানওয়ে ধরে ছোটার জন্য অপেক্ষা করছে আমাদের বিমানটি। কিছুক্ষন আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিতে রানওয়ে ভিজে সিক্ত। রানওয়েতে জমে থাকা জলের ধারা কুয়াশা হয়ে জানালার কাঁচ ঝাপসা করে দিচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে বৃথা চেষ্টা করছি বাইরের কিনশাসা এয়ারপোর্টকে শেষবারের মত দেখার জন্য। আর কিছুক্ষন পর এই কংগোকে বিদায় জানিয়ে আমরা রওয়ানা হব আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের অভিমুখে। একবছর অর্থাৎ ৩৬৫ দিন অথবা ৮৭৬০ ঘন্টার অনেক বেদনার স্মৃতি বুকে ধরে এই কংগো, এই আফ্রিকাকে বিদায় জানাবো। জানিনা আর কখনো এই কংগোতে আসা হবে কিনা, আর কখনো বান্দাকার জনাকীর্ন বাজারের খেটে খাওয়া মানুষের ভীড়ে হাঁটবো কিনা। জর্ডানের ক্যাপ্টেন মোহতাশিমের সাথে সন্ধ্যাবেলায় কংগো নদীর ধারে বসে আর কখনো কি প্রান জুড়ানো নদীর বাতাসে গা এলিয়ে গল্প করা হবে কিনা ?
একে একে মনে পড়ছে কত স্মৃতি। স্মৃতির পটে ভেসে উঠছে চির পরিচেনা কত মুখ, আমার দোভাষী কংগোর বাসিন্দা জর্জ মোবোয়ু, ভারতের শেখ রিয়াজ, সিংজী, রামান যোশী, পাকিস্তানের রিজওয়ান, মরক্কোর ইমাদআযমী, বাংলাদেশের কামরুল ভাই, সাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার পাটোয়ারী স্যার আরো অনেক নাম না জানা কত মুখের প্রতিচ্ছবি। এইসব মানুসের সান্নিধ্যে কাটিয়েছি গত একবছর। এই মানুষগুলোর সাহচার্য আমাকে পরিবার থেকে দূরে থাকার একাকীত্ব থেকে দিয়েছিলো মুক্তির স্বাদ।আজ একবছরের অনেক মধুর স্মৃতিকে বুকে ধারন করে রওয়ানা হয়েছি বাংলাদেশের পথে। আমার মাতৃভূমি, আমারমা, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আর সন্তান আমার জন্য অপেক্ষা করছে, কত দিন তাদের দেখিনা। বাংলাদেশ কেমন আছে ? কেমন আছে আমার প্রিয় চিরচেনা পরিবেশের মানুষগুলো ?
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে কিনাশাসা এয়াপোর্টের টার্মিনাল ভবন। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের বিমানটা রানওয়ের নির্ধারিত স্হান থেকে ছোট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দৌড় শুরু করল, তারপর একটা মৃদুলাফ দিয়ে আফ্রিকান ভূমিকে শেষবারের মত স্পর্শ করে উড়াল দিলাম। চোখের কোনে কিছুটা আদ্রতা অনুভব করলাম। সৈনিকের কড়া পোশাকে এই অনুভূতি কে পশ্রয় দিলে চলেনা তাই চোখে কিছু একটা পড়েছে ভান করে চোখ থেকে আদ্রতা দূর করলাম। নিচে অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে আফ্রিকার কংগোকে। ঠিক একবছর আগে এই দেশে এসেছিলাম একবুক শংকা নিয়ে, অথচ আজ ফিরে যাওয়ার বেলায় মনে হচ্ছে রেখে যাচ্ছি আমার কত স্মৃতি।মনে পড়লো একবছর আগে এই কংগোতে আসার জন্য কত প্রস্তুতি আর প্রশিক্ষন নিতে হয়েছিলো। তারপর এই কংগোতে এসে শুরু হল ধীরে ধীরে আফ্রিকার নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার পালা। ধীরে ধীরে আফ্রিকা কে চিনতে শুরু করলাম,শৈশবে কল্পনায় আঁকা আফ্রিকার রুপ বদলে যেয়ে অন্য এক আফ্রিকাকে আবিষ্কার করলাম। আফ্রিকার কালো মানুষদের দুঃখ, হাসি, কান্নাগুলোকে উপলদ্ধি করতে শুরু করলাম। কাজের ফাঁকে ,অবসরে তাদের প্রাচীন ইতিহাস সংস্কৃতি , তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানলাম। তাদের মুখে শুনলাম যুগে যুগে তাদের উপর সাদা সভ্যতার অত্যাচারের কথা ,তাদের বন্চনার কথা । পশ্চিমা বিশ্বের কৌশলে আফ্রিকার উপর চাপিয়ে দেয়া গৃহযুদ্ধের কথা ।আর এই গৃহযুদ্ধের সুযোগে কিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ চলে যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে তার কথা । লিওনার্দো ডি কাপ্রিয়িতি অভিনীত BLOOD DIAMOND মুভিটি তার এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি ।
এসেছিলাম একবুক শংকা নিয়ে । কিন্তু আজ দায়িত্ব শেষ করে ফিরে যাবার বেলায় নিয়ে যাচ্ছি এই কালোমানুষদের প্রতি ভালোবাসা আর সহমর্মিতা নিয়ে । একসময় ভেবেছিলাম হিংস্রতা এদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য । কিন্তু এদের সাথে মিশে ,কথা বলে জানার সুযোগ হয়েছে কিভাবে অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এদের কে কৌশলে হিংস্রতা শেখানো হয়েছে , লেলিয়ে দেয়া হয়েছে হিংস্র হায়েনার মত এক গোত্রকে আরেক গোত্রের উপর । এরা যখন একে অপরের সাথে হিংস্র যুদ্ধে লিপ্ত সেই ফাঁকে পাচার হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ এই আফ্রিকা থেকে । আফ্রিকার গহীন অরন্যর নিকষ কালো অন্ধকারে সেই বঞ্চনার ইতিহাস যুগ যুগ ধরে ধরে চাপা পড়ে আছে কিন্তু কে রাখে সেই খবর। এই মানবিকতার দোহাই দিয়ে উন্নত বিশ্ব আজ শোষন করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। তাই আমার কাছে মনে হয় মানবিকতা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের এক প্রতারণার নতুন রূপ ।
এসেছিলাম ,দেখলাম ,অনেক কিছু জানলাম । শিখলাম নতুন করে অনেক পুরোনো শব্দকে । চিরচেনা মানবিক অনুভূতিগুলো আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে দ্রুত বদল হচ্ছে । বৈশ্বয়িক উষ্নতার বৃদ্ধির সাথে সাথে দেখছি কিভাবে মানুষের কোমল মানবিক অনুভূতিগুলো গলে পড়ছে তার উত্তাপে। পৃথিবীর এক নগণ্য মানুষ হিসেবে কংগোর এই বন্চিত কালোমানুষদের দেওয়ার মত আমার কিছু নাই । তাই আজ এই বিদায় বেলায় সাথে নিলাম স্মৃতির ঝুলিতে ভরে তাদের বন্চনার কথা, তাদের শোষনের কথা । আফ্রিকার গহীন অরন্যর ব্ল্যাক উডসের নিচে স্যাঁতস্যাঁতে নিকষ কালো অন্ধকারে যুগে যুগে চাপা পড়া সেই বঞ্চনার ইতিহাসকে তাই ছড়িয়ে দিলাম লেখনীর প্রতিটি শব্দ আর অক্ষরের সাথে। বিদায় বেলায় যেন আজ মনে হচ্ছে এই দেশটি যেন আমার খুব পরিচিত ।কোথায় যেন মিল খুঁজে পাই আমার দেশের মাটির কাছাকাছি বাস করা মানুষগুলোর সাথে । এই পৃথিবীর বঞ্চিত মানুষের চোখের ভাষা কি এক ?
পুনশ্চ: এই লেখাটা ছিলো আমার কংগোতে শান্তিরক্ষা মিশনের শেষ যে দিন কংগোর রাজধানী কিনশাসা কে বিদায় জানাই সেদিনের শেষ কিছু অনুভুতি। আজও মনে পড়ে সেদিনের স্মৃতি যেদিন প্রথম জানতে পারলাম সরকারী আদেশে আমি কংগো যাচ্ছি।। তারপর সেই থেকে এক বিপদ সংকুল অনিশ্চয়তার উদ্দেশ্যে আমার পথ চলার শুরু।
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ ভোর ৪:৩০