somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্ল্যাক উডসের দেশে -পথ চলার শুরু (১ম অধ্যায়ের বাকী অংশ)

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৩:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ব্ল্যাক উডসের দেশে -পথ চলার শুরু (১ম অধ্যায়)

সেই রাত আমারও ঘুম আসেনি । উড়োজাহাজের টিভি স্ক্রিনে দেখছিলাম আমাদের কে নিয়ে উড়োজাহাজটি একে একে ভারত ,আরব সাগর অতিক্রম করে আফ্রিকা মহাদেশে প্রবেশ করলো । এর মাঝে একসময় ভোর হল , অতিচেনা সূর্য কে আজ এক অচেনা আকাশে দেখা দিলো । রিফুয়েলিং এর জন্য আমাদের থাই বিমানটি এসে নেমেছে এক জনবিরামহীন এয়ারপোর্টে শুনলাম এটা নাকি জিবুতি নামের একটি আফ্রিকান দেশ। বিশাল এয়ারপোর্টের আশে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা সকালের সোনালী রোদে দূরে টার্মিনাল ভবনটি অলস ভংগীতে দাড়িয়ে আছে যেন এখনও তার ঘুম ভাংগেনি।


ছবি: জিবুতি এয়ারপোর্টের সকালের দৃশ্য (সংগৃহীত)

আমাদের কে বলা হল কেউ যেন বিমান থেকে না নামে এখানে একঘন্টার মধ্যে রিফুয়েলিং শেষে আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করবো উগান্ডার উদ্দেশ্যে। আমরা কজন অফিসার সিনিয়রদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দাড়ালাম বিমানের খোলা দরজার সামনে। সেখানে দেখি ইতিমধ্যে সিঁড়ি লাগালো হয়েছে ,এরই মধ্যে দেখি একটি বিশাল এয়ার রিফুয়েলিং এর লরী এসে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। রিফুয়েলিং শেষে আবারও গতানুগতিক ভাবে আমরা যার যার সীটে বসে পড়লাম । যান্ত্রিক কন্ঠে স্পীকারে শোনা গেল পাইলটের সীটবেল্ট বাধার বিনীত অনুরোধ। সকালে আমরা এরই ফাঁকে হালকা নাস্তা সেরে নিয়েছিলাম। থাই বিমানটি আবার ছুটতে শুরু করলো তারপর একটা মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বাতাসে ডানা মেলে ভেসে চললো উগান্ডার উদ্দেশ্যে। বিমানে ভেতরে সবাই যেহেতু আমরা একই সংস্থার তাই নিজেদের মাঝে শংকাকে কিছুক্ষনের জন্য ভুলে থাকার উদ্দেশ্যে আমরা গল্পগুজবে মেতে উঠলাম।


প্রায় ঘ্ন্টা দুই পর আবার পাইলটের ঘোষনায় জানতে পারলাম আমরা এসে গেছি উগান্ডার এনটিবি এয়ারপোর্টে। এনটিবিতে নেমেই আমরা দ্রুত আমাদের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিলাম ।এর মাঝে ঘটলো এক বিব্রতকর ঘটনা। আমি যখন ইমিগ্রেশন চেকিং এর জন্য কাউন্টারে এসে আমার হাতব্যাগ জমা দিলাম স্ক্যানিং এর জন্য। স্ক্যানিং শেষে আমাকে কাউন্টারে দায়িত্বরত একজন কৃষ্ণমহিলা জিজ্ঞেস করলেন আমি কেন হাতব্যাগে ধারালো জিনিষ বহন করছি। আমি বেশ অবাক হলাম কারন এবিষয়ে আমরা পূর্ব থেকেই জানা ছিলো এবং সেভাবেই আমরা হাতব্যাগে কোন ধারাল জিনিষ যেমন সেভিং আইটেম বা নেইলকাটার নেইনি। আর আমি নিজে গতরাতে বাংলাদেশ থেকে রওয়ানা দেয়ার আগে শুধুমাত্র আমার পছন্দের কিছু বই ভরে নিয়েছিলাম। আমার আপত্তি শুনে মহিলা প্রায় ক্ষেপে যাওয়ার দশা , আমি দেরী না করে তড়িঘড়ি করে ব্যাগ খুলে সব ঢেলে দিলাম টেবিলের উপরে । সব বই গুলো একে একে টেবিলে উপরে পড়তে লাগলো আমিও বেশ বিজয়ীর বেশে সেই মহিলার দিকে তাকিয়ে হাসছি ঠিক এই সময় হঠাৎ দেখি ছোট্ট একটা নেইল কাটার টেবিলে পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে যেন দাঁত বের করে হাসছিলো। আমি বেশ কাচুঁমাঁচু হয়ে তাকালাম সেই মহিলার দিকে । সে আমার দিকে তার ৩২ পাটি ঝঁকঝঁকে দাঁত ( কেন জানি কৃষ্ণকায় পুরুষ অথবা মহিলাদের দাঁত খুব ঝকঝকে সাদা দেখায়) বের করে হেসে বললো মিস্টার আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম তুমিতো আমার কথা মানলেননা আরেটু দেরী করলেই আমি তোমার জন্য সিকিউরিটি ডাকতাম। আমি বোকার মত হেসে বলললাম ম্যাম. আমার স্ত্রী আসলে আমাকে না জানিয়ে আমার ভালো করতে গিয়ে এই কর্মটি করেছে, যেটা আমার আসলেই জানা ছিলোনা। যাই হওক তাকে অনেক সরি বলে আমি নেইলকাটারটা তাকেই গিফট করে ছুট লাগালাম আমাদের শেষ বিমানটি ধরার জন্য।

অবশেষে অনেক ঝক্কিঝামেলা পার হয়ে বাসে করে রানওয়ের কাছাকাছি এসে নির্ধারিত বিমানের সামনে এসে থামলো। এগিয়ে দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহৃত একটি ৫০ 1সীটের ইউক্রেনীয় বিমান। বিমানটি দুপাশের দুই ডানায় দুটো বিশাল আকৃতির প্রপেলার ইন্জিন দেখে বুঝলাম বেশ পুরোনো মডেলের। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শান্তিরক্ষীদের আনা নেয়ার জন্য জাতিসংঘ কিছু নির্ধারিত দেশের বেসামরিক বিমান ভাড়া করে। এরকমই একটি ভাড়া করা থাই বিমানে আমরা উগান্ডা পর্যন্ত এসেছি। কংগোতে গৃহযুদ্ধ চলছে বলে সেখানে সরাসরি কোন বেসামরিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ছিলো নিরাপত্তাজনিত কারনে। কংগোতে পরিচালিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য উগান্ডা মূলত লজিস্টিক বেইস বা রসদ সরবরাহের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর এই জন্য উগান্ডা বেশ মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা গ্রহন করে আসছে জাতিসংঘের কাছ থেকে। যাই হওক অবশেষে কংগোতে পৌঁছানোর শেষ বিমানে চড়ে বসলাম বেশ শংকিত হৃদয়ে। কারন ইউক্রেনীয় পাইলটদের বেশ সুনাম রয়েছে , তারা নাকি বেশী পরিমানে মদপান না করলে ভালভাবে বিমান চালনা করতে পারেন না। পরবর্তীতে এই বিষয়ে আরো অনেক ভয়ংকর মজার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলো । সেই ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী অধ্যায়ে প্রকাশ পাবে। অবশেষে বিমানের দরজা একসময় বন্ধ হলো দুপাশের প্রপেলার ইন্জিন চালু হওয়া মাত্র সারা বিমানটি যেন জায়গায় দাড়িঁয়ে কাঁপতে শুরু করলো, হঠাৎ মনে হল আমার সীট থেকে শুরু করে নিয়ে পাশের সহযাত্রী এমনকি মেঝের সাথে ফিটিং করা নাট বল্টু এমনভাবে কাঁপা শুরু করলো যে ভয় পাচ্ছিলাম কখন না জানে তা ছিটকে খুলে আসবে। মনে মনে সমানে আয়তুল কুরসী পড়ছি আর ভাবছি কোথায় কংগো, এযে দেখি বিমানের কারনেই এখানে না পটল তুলি । হঠাৎ যেন মনে হল ছিটকে সীট থেকে বেরিয়ে আসবো ভাগ্য ভাল সীট বাঁধা থাকায় সে যাত্রায় রক্ষা । বিমানটা মৃত্যুযন্ত্রনায় কাটা মুরগীর মত কাপঁতে কাঁপতে হঠাৎ যেন শুন্যে ডাইভ দিলো। মনে হচ্ছিলো বিমান নয় আমি যেন মহাকাশযানে এইমাত্র বায়ুমন্ডল ভেদ করে মহাশুন্যে প্রবেশ করলাম। এরপর একসময় বিমান প্রায় ২০০০০ ফিট উঁচুতে উঠে শান্ত হয়ে আসলো আর আমরাও মানসিক প্রশান্তি আর ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে মগ্ন হলাম। অবশেষে ইউক্রেনীয় পাইলট আমাদের কে তার মহাশুন্যযানে করে কংগোর একটি প্রদেশ কিসাংগানী নামিয়ে দিলো প্রায় দেড় ঘন্টা উড্ডয়নের পর। অবতরনের সময়ের অভিজ্ঞতা আবারো একই রকম হল । সেই ঘটনা আর নাইবা বললাম।

অবশেষে যাত্রা পরিক্রমায় আফ্রিকার কংগোতে এসে পৌছাঁলাম। কিসাংগানী ,কংগোর একটি প্রদেশ এখানেও গৃহযুদ্ধের রেশ তখনও কাটেনি , শান্তি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই কিসাংগানী থেকে আমাদের মূল দল অফিসারদের নেতৃত্বে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে যার যার নিজস্ব দায়িত্বপূর্ন প্রদেশে একে একে যাওয়া শুরু করলো। প্রতিটি গন্তব্যস্থলের জন্য নির্ধারিত সময়ে এয়ারপোর্টে ছোট ছোট বিমান এসে ভিড়তে লাগলো। একে একে বিমানগুলো আমাদের ছোট ছোট দলগুলোকে কে নিয়ে বেনী, গোমা, কিভু, বুকাভু, উভিরা, কালিমি, লুবুম্বাসি এবং রাজধানী কিনশাসাতে নিয়ে যেতে লাগলো। এই কিসাংগানী এয়ারপোর্টে প্রায় ৩ ঘন্টা বিরতির পর একসময় আমাদের ডাক চলে আসলো গন্তব্যস্থল বান্দাকার।সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমার দলটি নিয়ে দলনেতা হিসেবে আরেকটি ছোট বিমানে চড়ে বসলাম গন্তব্যস্থল বান্দাকা যার ইংলিশ বানান হচ্ছে MBANDAKA। ছোট্ট এই বিমানটিও একটি ইউক্রেনীয় প্রপেলার চালিত বিমান । অবশ্য এই প্রপেলার ফোবিয়া ইতিমধ্যে আমাদের সবার কেটে গেছে। তাছাড়া আমরাও উদগ্রীব ছিলাম কখন এই দীর্ঘ যাত্রা শেষে আমরা আমাদের নিজস্ব দায়িত্বপূর্ন এলাকায় ক্যাম্পে পৌঁছবো। কারন মন চাই ছিলো একটি গভীর ঘুমে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতে।অবশেষে দীর্ঘ যাত্রা শেষভাগে আবারও বিমানে চড়ে রওয়ানা হলাম বান্দাকা আমাদের শেষ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। মনে মনে হাসলাম এইভেবে ছোটবেলায় আকাশে বিমান দেখে খালি ভাবতাম কবে আমিও এই বিমানে চড়তে পারবো। আজ যেন আল্লাহ আমাকে সারা জীবনের এই বিমান চড়ার আশা পূরন করে দিচ্ছে । একদিনে এতবার বিমানে উঠা আর নামার পর আর বিমান চড়ার শখ আর আগের মত অনুভূত হচ্ছেনা । যাই হোক অবশেষে ছোট বিমানটি আকাশে উড়লো আমি চেয়ে রইলাম জানালার ওপারে মেঘেদের রাজ্যে । বাংলাদেশে এখন কয়টা বাজে? সবাই কি করছে? অনেক প্রশ্ন আর আকুতি নিয়ে ক্লান্ত শরীরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলামনা।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ ভোর ৪:৪১
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×