
ছবি : ঢাকা থেকে বান্দাকা (কংগো) পর্যন্ত বিমানপথের চিত্র ।
কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই হয়ত ঘন্টাখানেক অথবা তারও বেশী । আমার একজন সহযোদ্ধার ডাকে ঘুম ভাংগলো । নিজেকে আবিষ্কার করলাম ছোট্ট এক প্রপেলার চালিত ২০ জনের মত বহন করতে পারে এমন এক বিমানের মধ্যে। মনে পড়ে গেল আমি এখন কংগোতে আছি , আমার প্রিয় বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে। আফ্রিকার গহীন জংগলের উপর দিয়ে তখনও উড়ে চলেছে আমাদের ছোট্ট বিমানটি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি মাইলের পর মাইল বিস্তৃত গভীর বন। ভাল করে চোখ কচলে চেষ্টা করলাম কোন হাতি, সিংহ কিছু দেখা যায় কিনা। আসলে তখনও বিমান অনেক উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো তাই চেষ্টা করলেও উঁচু কিছু গাছ ছাড়া আর তেমন কিছু পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছিলো না। বেশীর ভাগ গাছের উপরের ক্যানোপিগুলো একটার সাথে আরেকটি এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যে প্রথমে দেখলে মনে নীচে যেন বিস্তৃত সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল মাঠ।
অবশেষে ধীরে ধীরে বিকালের শেষ সূর্যের আলো বিমানের আ্যলুমিনিয়ামের ডানায় ঝিকমিক করে উঠলো ,সেইসাথে পাইলটের ঘোষণায় সীট বেল্ট বেঁধে অবতরনের জন্য আমরা তৈরী হয়ে নিলাম । দৃশ্যপটে ধীরে ধীরে আকাশকে বিদায় জানিয়ে দিগন্তসীমা ভেসে উঠলো , দূরে দেখা যাচ্ছিলো বান্দাকা শহরটিকে । মনের ভেতরে শিহরিত বোধ করলাম, কি জানি অপেক্ষা করছে সেই শহরে আমাদের জন্য। কিভাবে কাটবে এই শহরে আমাদের সামনের এক বছর ? সেকেন্ডের মধ্যে কত অজানা বিপদের হাতছানি আর শংকা মনের মাঝে জানান দিয়ে গেল। হঠাৎ চোখ পড়লো শহরের পাশ দিয়ে অসম্ভব সুন্দর এঁকে বেঁকে বয়ে চলা এক বিশাল নদী। পাশের একজন ইউএনের বেসামরিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এই সেই আফ্রিকান সুন্দরী কংগো নদী , যার নাম শুনেছিলাম শৈশবের সেবা প্রকাশনীর টারজান সিরিজের বইতে ।

ছবি : আফ্রিকান গহীন অরন্যর মধ্যে বয়ে চলা কংগো নদী (সংগৃহীত) ।
ধীরে ধীরে বিমানটি নেমে আসলো একসময় বান্দাকার রানওয়েতে । বিমানের দরজা খুলে একসময় আমাদের বলা হল বাসে ওঠার জন্য। পাইলট আমাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানালো আমিও ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দরজার ওপাশে পা রাখলাম , কিছুটা হালকা গরম আর শীতলতায় মেশানো এলোমেলো বাতাসে মন জুড়িয়ে গেল । তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে বললেই চলে , দূরের দিগন্ত সীমায় সূর্য ডুবে গেছে । পরিপূর্ন দৃষ্টিতে একবার চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম দূরের আফ্রিকার গভীর অরণ্যর উপরে ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যা। শেষ বিকেলে কোন এক পাখির ডাক শুনতে পেলাম । অবশেষে আমি এখন আফ্রিকার এক দূরবর্তী প্রদেশ বান্দাকায় । কখনও জীবনে কি ভেবে ছিলাম পুরোনো ঢাকায় অলিগলিতে বেড়ে উঠা এই আমি কোন একদিন পেশার প্রয়োজনে পা রাখবো এই দূর্গম আফ্রিকার অরণ্যবেষ্টিত বান্দাকা নামে ছোট্ট শহরের বুকে?
সহযোদ্ধা সৈনিকেদের নিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম ছোট্ট এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ভবনে, সেখানে অবশ্য তেমন কোন আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হলনা । শুধুমাত্র কিছু কাগজপত্র তারা সাইন করে আমাদের ছেড়ে দিলো । এয়ারপোর্টে আমাদের জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো আমাদের পূর্ববর্তী দল যারা গত একবছর ধরে এখানে শান্তিরক্ষা মিশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সাথে রাখা আমাদের নিজস্ব লাগেজগুলো সংগ্রহ করে এগিয়ে গেলাম পার্কিং লটে আমাদের নিতে আসা গাড়িগুলো কাছে। পূর্বর্তী দলের অধিনায়ক একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো আমাকে । এরপর পরিচিত হলাম আফ্রিকার প্রথম একজন প্রতিনিধি আমাদের ইন্টারপ্রেটার অর্থাৎ দোভাষী জর্জ মোবোয়ু এর সাথে । কালো মানুষের হাসি যে এত দিলখোলা হতে পারে সেটা জর্জ মোবোয়ু কে কেউ না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেনা। সে আমাকে প্রথম দেখার পর থেকে চীফ বলে সম্বোধন করা শুরু করলো । পরে জানতে পারলাম এখানে উর্ধ্বত্বন কর্মকর্তাদেরকে এরা সবাই স্যার অথবা বস এর পরিবর্তে চীফ বলে সম্বোধন করে থাকে। জর্জ মোবোয়ু তার দিলখোলা হাসিতে আমাকে শুরু থেকে দ্রুত আপন করে নিল , মনে হচ্ছিলো সে আমাকে যেন অনেক আগে থেকেই চিনে । এটা হয়ত তার কর্মদক্ষতারই আরেকটি অংশ।
ক্লান্ত শরীরে দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়লাম , চলন্ত গাড়িতে আমি সামনের ২য় আসন ধারী হিসেবে বসলাম পেছনে বসলো আমাদের দোভাষী জর্জ মোবোয়ু সাথে ২ জন সৈনিক । অন্য আরেকটি গাড়িতে আমাদের বাকী সবাই কে নিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম আমাদের পরবর্তী এক বছরেরে বাসস্থান, আমাদের বাংলাদেশী শান্তি রক্ষীদের নিজস্ব ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। আমরা ছাড়া বাকী সবাইকে দেখলাম নিজ নিজ সাব মেশিন গান (যাকে সংক্ষেপে এস এমজি বলা হয়) সাথে বহন করছে নিরাপত্তার জন্য। জানতে পারলাম দিনের বেলায় শহর এলাকাতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত ঘানার একটি কোম্পানী নিরাপত্তা টহলে মোতায়েন থাকে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে । তবে সন্ধ্যার পর থেকে বিনা অনুমতিতে চলাচল নিষিদ্ধ । এবং কোন কারনে চলাচল করতে হলে সেক্ষেত্রে ঘানার একটি ১০ জনের দল সাথে থাকে স্কট হিসেবে । যেহেতু আমাদের সাথে নিজস্ব টহল দল আছে তাই আমরা নিজ দায়িত্বে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরতি পথে ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। পেছনের সিটে বসা জর্জ মোবোয়ু শুরু থেকে আমার সাথে বেশ একটা সখ্যতা গড়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে । আমি প্রথমে একটু বিরক্তি হলেও পরে তার আন্তরিক ব্যবহারের কারনে দু একটা কথা আদান প্রদান করছিলাম মাঝে মাঝে। অবশেষে প্রায় ২০ মিনিটের মাথায় আমি পৌঁছে গেলাম আমাদের ক্যাম্পর সামনে ।
তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সময় দেখাচ্ছে রাত ১২ টা । বেশ অবাক হলাম ভুল দেখছিনাতো নাকি ঘড়িটাই নষ্ট হয়ে গেল। পরে মনে হল আমি সেই গত রাতে বাংলাদেশ থেকে আসার পর থেকে একবারও সময় পরিবর্তন করিনি। দোভাষী জর্জ মোবোয়ু বেশ বুদ্ধিমান । আমার চেহারা দেখে সে বুঝে ফেললো । সাথে সাথে সে আমাকে বললো চীফ আমার মনে হয় তোমার এখন উচিত হবে বান্দাকার এখনকার সময় সন্ধ্যা ৭ টার সাথে তোমার ঘড়ির কাঁটাটা মিলিয়ে ফেলার । জানতে পারলাম আমাদের এখানকার বান্দাকার স্থানীয় সময় বাংলাদেশ থেকে ৫ ঘন্টা পেছনে । রাত হওয়ায় ক্যাম্পটি আর ভালভাবে দেখার সৌভাগ্য হলনা তবে দেখলাম ক্যাম্পের পাশেই একটি ২৫ ফিটের চওড়া লাল মাটির রাস্তা আর তার ওপাশেই ৫ ফিটের উঁচু প্রাচীরের মাথায় পেচাঁনো তারকাঁটা বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি ২ তলার বিশাল অফিস কম্প্লেক্স । শুনলাম এটাই নাকি আমাদের এই বান্দাকা রিজিওনের ইউ এনের সেক্টর হেডকোয়ার্টার। ভালই হলো আমাদের ক্যাম্পের অবস্থান যদিও ইউ এনের সেক্টর হেডকোয়ার্টার বাইরের সীমানায় তারপরও আল্লাহ না করুক কোন বিপদ হলে আমরা অন্তত দ্রুত সাহায্য নিতে পারবো। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম আমাদের বাংলাদেশী ক্যাম্পটি মূলত একটি গুদামঘর বা ওয়্যারহাউস ছিলো আগে । ইউএনের ব্যবস্থাপনায় এটিকে সংষ্কারের মাধ্যমে কোন রকমে একটি থাকার জায়গা হিসেবে তৈরী করা হয়েছে । সেদিনের সন্ধ্যায় দ্রুত আমরা আগে থেকে রাতের তৈরী খাবার খেয়ে নিলাম , খাওয়ার পর পরবর্তী দিনের রুটিন কাজ অর্থাৎ পূর্ববর্তী দলের কাছ থেকে একে একে কিভাবে দায়িত্ব বুঝে নিবো তার একটা ছক করে ফেললাম। সেই সাথে আমাদের নিরাপদে পৌঁছানোর খবর টেলিফোনের মাধ্যমে ৮০০ মাইল দূরে রাজধানী কিনশাসা শহরে আমাদের কন্টিনজেন্ট অধিনায়ককে জানালাম , সেইসাথে আমাদের পরবর্তী করনীয় কাজের বিষয় তাকে জানিয়ে রাত ১০৩০ এর দিকে অবশেষে আমার রুমে যেয়ে কোন রকমে পোশাক খুলে গোসল করে গা এলিয়ে দেয়ামাত্র গভীর ঘুমে ঢলে পড়লাম। আর এইভাবে আমার আফ্রিকার জীবনের প্রথম রাত কাটলো ।
বান্দাকার প্রথম সকালটা বেশ ভালভাবেই শুরু হল । রাতে ঠান্ডা আবহাওয়ার কারনে কখন যে পায়ের কাছে রাখা দেশ থেকে আনা পুরোনো কাঁথা টেনে এনেছি মনে পড়ছেনা। তবে কাঁথার ওম ওম গরমে ঘুমটা বেশ চমৎকার হয়েছে সেটা শরীরের সতেজতায় বেশ অনুভব করছিলাম। হাতঘড়িতে দেখলাম সকাল প্রায় ৭ টা বাজে । স্বভাবজাত সামরিক জীবনের অভ্যাসের বশে আতঁকে উঠলাম কারন সৈনিক জীবনের সকাল শুরু হয় ভোর ৫ টা থেকে। সারাদিনের ভ্রমন ক্লান্তিতে সেই ঘুম ভেংগেছে আমার সকাল ৫ টার পরিবর্তে ৭ টায়। ক্যাম্পে আমি আবার সিনিয়র হওয়ায় কেও হয়ত ডাকেনি। দ্রুত রুমের বাইরে আমার ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত বাথরুমে ঢুকে ঝটপট গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। ক্যাম্পের ভেতরে অফিসারের জন্য একটি থাকার রুম আর সৈনিকদের একসাথে থাকার জন্য একটি হলরুম আছে। সেইসাথে বাথরুমের ব্যবস্থা করা আছে পর্যাপ্ত পরিমানে। ক্যাম্পের ঠিক মাঝখানের রুমটি বেশ বড় সেখানে আমাদের সকলের একসাথে ডাইনিং এবং টিভি দেখার ব্যবস্থা করা আছে। এই রুমটি প্রায় একটি হলরুমের মত বড়। এই রুমের সাথে লাগোয়া আরো দুটি রুম আছে যার একটি রান্নাঘর আরেকটি আমাদের যাবতীয় রেশন রাখা হয় । এছাড়া আমাদের রেশনের মধ্যে কাঁচা মাছ, মাংশ আর সবজী রাখার জন্য ইউএন থেকে বিশাল আকারের দুটো ডীপ ফ্রীজ রয়েছে।
সকালের প্রাতঃরাশ সারার জন্য ডাইনিং টেবিলে যেয়ে দেখি আমার জুনিয়র আফিসার যে এখানে এক বছর যাবৎ আছে , সে বিশাল এক আয়োজন করে রেখেছে। ব্রেড,বাটার , জ্যাম এর সাথে ডিম এবং বেশ কয়েক ধরনের ফলমূল দিয়ে বিশাল টেবিলের প্রায় আর্ধেকটাই ভরিয়ে ফেলেছে। যাই হউক দুজনে মিলে নাস্তা দ্রুত সেরে নিলাম । এরপর দুজনে মিলে ঠিক করে নিলাম কোথা থেকে কাজ শুরু করব। কারন আমার হাতে ছিলো মাত্র ৭ দিন। এর মাঝে আমাকে সব বুঝে নিয়ে আমাদের পরবর্তী দলকে বিদায় জানাতে হবে । এবং তারা এক বছর তাদের দায়িত্ব শেষ করে নির্ধারিত দিনের ফ্লাইটে একইভাবে বাংলাদেশে ফেরত যাবে। আর এভাবেই সাধারনত দায়িত্ব পালাবদলের প্রক্রিয়া সম্পাদন হয়ে থাকে। আমার দলের সবাইকে সাথে নিয়ে ক্যাম্পের ঠিক রাস্তার বিপরীতে ইউএনের সেক্টর হেডকোর্য়াটারে উদ্দশ্যে রওয়ানা হলাম । পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রবেশ মুখে যেয়ে উপস্থিত হলাম , সেখানে দেখি ঘানার দুজন সৈনিক এসএমজি হাতে গেট পাহারায় আছে । আমাকে দেখে তারা সামরিক কায়দায় স্যালুট দিলো আমিও প্রতিউত্তর দিলাম স্যালুটের মাধ্যমে। ঘানা এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর চালচলনে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায় কারন ঘানা মূলত ব্রিটিশ কলোনী ছিলো তাই তাদের সামরিক কায়দাকানুন প্রায় আমাদের মত একইরকম। গেটে ইউএনের সিভিল সিকিওরিটি সেকশনের দায়িত্বরত একজন জুনিয়র অফিসার আমাদের ইউএন আইডি দেখতে চাইলে তাকে জানানো হল আমরা নতুন এসেছি এবং এখনই আমাদের নতুন আইডি কার্ড তৈরী করা হবে। মূলত ইউএনের এই আইডি কার্ড এই সিকিউরিটি অফিসের দায়িত্বে করা হয়ে থাকে । উত্তরে সেই সিকিউরিটি অফিসার আমাদের উষ্ন অভ্যর্থনা জানালো ফ্রেন্চ ভাষায় আমিও দ্রুত আমাদের ইন্টারপ্রটারের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম প্রতিউত্তরে তাকে কি বলতে হবে। গেট পেরিয়ে আমরা দ্রুত সিকিউরিটি অফিসে আমাদের আইডি কার্ড তৈরী করে নিলাম । ১০ মিনিটের মধ্যে আমার কার্ডটি প্রস্তত হয়ে গেল এবং একই সাথে আমার যাবতীয় তথ্য ইউএনের তথ্যভান্ডার যা কিনা ইউএন গ্যালাক্সী নামে পরিচিত তাতে সংযুক্ত হয়ে গেল। এখন থেকে আমি পরবর্তী একবছর ইউএনের একজন শান্তিরক্ষী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে পারবো। এরপর সেদিন আমরা বিভিন্ন অফিসিয়াল দায়িত্ব এবং কাগজপত্রগুলো বুঝে নিলাম। যে কাজগুলো চলমান আছে তার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাগুলো একে একে বুঝে নিলাম। আমরা মূলত এখানে মিলিটারী পুলিশের দায়িত্বে একবছর দায়িত্ব পালন করব। আমাদের দায়িত্বের মধ্যে মূলত যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে সেগুলো ছিলো:
(ক) আমাদের দায়িত্বপূর্ন এলাকায় বিভিন্ন দেশের যে সকল শান্তিরক্ষা দায়িত্বে সামরিক সদস্যগন নিয়োজিত আছেন তাদের ব্যক্তিগত ও সামরিক শৃংখলার বিষয়াদির দিকে লক্ষ্য রাখা । এবং কেউ যদি কোন যানবাহন দূর্ঘটনা বা অন্য কোন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। সেই ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা এবং তদন্ত পক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধের কারন এবং দোষী সাবস্ত্য হলে সে বিষয়ে পূর্নাংগ প্রতিবেদন প্রেরন করা।
(খ) স্থানীয় পুলিশের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা এবং সামরিক কোন সদস্য স্থানীয় কারো সাথে কোন অপরাধের সাথে জড়ালে সে বিষয়ে একইভাবে কাজ করা।
(গ) দায়িত্বপূর্ন এলাকায় কোন ভিআইপি সফরে আসলে তার কনভয় বা গাড়ী বহরকে প্রহরা দেয়া এবং সিভিল সিকিউরিটি অফিসারের সাথে একইভাবে সম্বন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা।
এছাড়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে আমরা ইউএনের যানবাহনের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা অথবা সামরিক বন্দী বিনিময় এর সময়ে বন্দীকে প্রহরার মাধ্যমে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে স্হানান্তরের বিষয়টি পরিচালনা করার বিষয়টি ছিলো। এইভাবে একদিকে আমি অফিসের দায়িত্ব বুঝে নিলাম আর সৈনিকরা তারা তাদের কাজের ধরন অর্থাৎ দায়িত্ব পালনের বিষয়টি বুঝে নিতে লাগলো। এই শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের দলের প্রতিটি সদস্যর নিজ নিজ দায়িত্ব ভাগ করা আছে । আর সেইভাবে আমরা কাজ করে থাকি আর্ন্তজার্তিক পরিমন্ডলে। আমাদের লক্ষ্য একটি আর সেটি হচ্ছে আমাদের কাজের মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব পেশাগত দক্ষতা এবং নিজ কাজের প্রতি আন্তরিকতাকে সঠিক এবং সফলভাবে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরা। এবং এই কাজে আমার আগের পূর্বসূরীরা অত্যন্ত সফলতার সাথে এই বিষয়টি তুলে ধরতে পেরেছেন। বিষয়টি আমি একটি ক্ষুদ্র ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরলে বিষয়টি বোধগম্য হবে। এই কংগোতে আগে ইউএনের সামরিক সদস্যদের শৃংখলার দেখভালের বিষয়টি দক্ষিন আফ্রিকার মিলিটারী পুলিশ পরিচালনা করত। এবং শুধুমাত্র ২/৩ টি প্রদেশে বাংলাদেশ মিলিটারী পুলিশ ছিলো। কিন্ত কয়েক বছরের পর্যালোচনায় দেখা গেল দক্ষিন আফ্রিকার মিলিটারী পুলিশ নিজেরাই বিভিন্ন অপরাধ বিশেষ করে যৌন সংক্রান্ত অপরাধে জড়িয়ে পড়লো অন্যদিকে বাংলাদেশ মিলিটারী পুলিশ অতন্ত্য আন্তরিকতার সাথে নিজ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজেদের ব্যক্তিগত শৃংখলার বিষয়টি সফলতার সাথে বজায় রেখেছিলো। আর সে কারনেই ইউএন পরবর্তীতে দ্রুত অধিকাংশ প্রদেশের দায়িত্ব দক্ষিন আফ্রিকার পরিবর্তে বাংলাদেশ মিলিটারী পুলিশকে কাছে প্রদান করে । আর এভাবেই আমাদের ইউএনে অংশগ্রহনকৃত শান্তিরক্ষীদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে আমাদের আন্তরিকতা আর পেশাগত দক্ষতার কারনে।
আমরা ধীরে ধীরে দায়িত্ব বুঝে নিতে লাগলাম এরই মধ্যে আমাদের কয়েকজনের ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড হয়ে গেলে আমাদের কাজ করার সুবিধা হল। এখন থেকে আমরা ইউ এনের দেয়া গাড়িগুলো ড্রাইভ করতে পারবো। এই গাড়িগুলোর বিশেষত্ব হলো এই গাড়ি, চাবির পাশাপাশি ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ডটির মাধ্যমে চালু হয়। গাড়িতে কারলগ নামে একটি যন্ত্র বসানো আছে । সেই যন্ত্রটিতে ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ডটি প্রবেশ না করালে গাড়িটি স্টার্ট নিবেনা। এবং ইউ এনের নিয়ম হচ্ছে যার যার নির্দিষ্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড ঐ ব্যক্তি ব্যাতীত অন্য কেউ ব্যবহার করবেনা। এইভাবে দেখতে দেখতে আমাদের পূর্বর্তী দলের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো আমরা সবাই আগের দিন রাতে তাদের বিদায় উপলক্ষ্যে একটি ছোটখাট ভোজের আয়োজন করলাম ।
পরদিন একইভাবে এবার আমরা তাদের সবাইকে এয়ারপোর্টে বিদায় দিলাম। যদিও বিষয়টি বিদায় তারপরও তাদের সবার চোখেমুখে আনন্দের ছাপ পরিষ্কার ফুটে উঠছে । কারন গত এক বছর পর তারা আল্লাহর রহমতে আবার দেশে নিরাপদে ফিরে যেতে পারছে এর চেয়ে আর আনন্দের আর কি হতে পারে। সবাইকে বিদায় দিলাম তারা একে একে উঠে পড়লো ছোট্ট সেই বিমানে । এখান থেকে কিনশাসা অর্থাৎ কংগোর রাজধানী এবং সেখান থেকে তারা কিসানগানী হয়ে উগান্ডা পৌঁছবে । অতপর উগান্ডা থেকে অবশেষে বাংলাদেশ। বিমানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল একসময় । তারপর যথারীতি নিয়মে আবারও সেই ছুটে চলা দুরন্ত বেগে এবং একসময় বাতাসে গা ভাসিয়ে বিমানটি দৃষ্টিসীমার আড়ালে মিলেয়ে গেল। শুরু হল আমাদের নিজেদের নতুন করে এই অচেনা পরিবেশে পথ চলার নতুন অধ্যায় , আমাদের পুর্বসূরীদের অবদানকে সমুন্নত রেখে আরো ভাল কিছু করার চেষ্টা। আরেক ধাপ নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ২:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




