somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইউএন অফিসের সালতামামি - ৪র্থ অধ্যায়

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেশ থেকে এসেছি প্রায় একমাস হতে চললো । এরই মাঝে দ্রুততার সাথে এখানকার সব কাজ ইতিমধ্যে বুঝে নিয়েছি আর আমার সাথে থাকা আমার সহযোদ্ধাদের মানসিকতা আর পেশাদারিত্বের মান উঁচু ছিল বলে বিষয়টি আমার জন্য আরো সহজ হয়ে গিয়েছিলো। যেকোন প্রতিকূল অথবা নতুন পরিবেশে কাজ করতে গেলে টীম ওয়ার্ক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয় । আমার সহযোদ্ধাদের প্রতিটি বিষয় আমাকে লক্ষ্য রাখতে হত তাদের কমান্ডার অথবা দলনেতা হিসেবে। এমনকি কোন সেনাসদস্যর মন যদি বিমর্ষ হয়ে পড়ত সেক্ষেত্রে তাকে প্রয়োজনীয় প্রেষনা বা কাউন্সিলিং এর বিষয়টির দিকে আমাকে লক্ষ্য রাখতে হত। আর কখনও কখনও বিষয়টি আমার জন্যও দূরুহ হয়ে পড়ত যখন আমি নিজেই স্বয়ং একজন রক্তমাংশের মানুষ হিসেবে বিমর্ষ বোধ করতাম । তবে সামরিক জীবনের কঠিন প্রশিক্ষন আমাকে একজন দলনেতা হিসেবে কখনোই সুযোগ দিতোনা আমার দলের সদস্যর সামনে আমাকে বিমর্ষ হওয়ার।
আমাদের সকাল শুরু হত ভোর ছয়টায় । নামাজ শেষে ক্যাম্পের পেছনের ব্যাকইয়ার্ডের ছোট্ট একচিলতে ফাঁকা জমিতে ঘাসের উপর আমরা হালকা জগিং অথবা কিছুক্ষন হালকা ব্যায়াম করে নিতাম, শরীরকে ঠিক রাখার জন্য। যদিও সামরিক রীতিতে আমাদের প্রতিদিন সকালে ২ থেকে ৩ কিঃমিঃ দৌড়ের নিয়ম আছে। কিন্ত যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই বিপদসংকুল পরিবেশের কথা চিন্তা করে আমরা ক্যাম্পের পেরিমিটারের মধ্যে আমাদের সকালের পিটি সেরে নিতাম। এরপর গোসল সেরে নাস্তা করে আমরা পৌনে আটটার মধ্যে একদল অফিসে রিপোর্ট করত, আরেকটি দল শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন সময়ে টহল ডিউটি করত। এবং এই টহল ডিউটির সময়ে কোন অনিয়ম অথবা শহরে যদি কোন সামরিক ব্যক্তির কোন গাড়ি দূর্ঘটনায় পড়লে সেক্ষেত্রে তৎক্ষনাৎ মিলিটারি পুলিশ দ্রুত পৌঁছে বিষয়টির তদন্ত এবং রিপোর্ট তৈরী করে মিলিটারি অফিসের মাধ্যমে ইউএনের মোনুক হেডকোর্য়াটারের প্রভোস্ট মার্শালের অফিসে দ্রুত প্রতিবেদন প্রেরন করা হত ।

কংগোর মোনুক মিশন অথবা ইউ এনের পরিচালিত যে কোন মিশনে সাধারনত সামরিক এবং বেসামরিক এই দুই শ্রেনীর কর্মীবাহিনী কাজ করে থাকে। এবং ইউএনের সম্পূর্ন কার্যক্রম এর পরিচালনার ভার Special Representative of the Secretary-General (SRSG) সংক্ষেপে এসআরএসজি এর উপর ন্যস্ত থাকে। তিনি মূলত ইউএনের সেক্রেটারী জেনারেলের প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন ইউএন মিশনের। একেকটি দেশে পরিচালিত ইউএন মিশনের জন্য আলাদাভাবে এই দায়িত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া ইউএনের শান্তিরক্ষী হিসেবে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিভিন্ন সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এই এসআরএসজিকে সহায়তা প্রদানের জন্য ইউএন বিভিন্ন দেশ থেকে প্রেরিত প্রার্থীদের থেকে একজন লেফটেনেন্ট জেনারেল অথবা মেজর জেনারেল পদমর্যাদার ফোর্স কমান্ডার নিয়োগ করে থাকে নির্বাচনের ভিত্তিতে। এই ফোর্স কমান্ডার সবসময় ইউএনের বেসামরিক কতৃর্ত্বের মাধ্যমে কাজ করে থাকেন। আর এই ফোর্স কমান্ডারের নেতৃত্বে যে সকল বাহিনী শান্তিরক্ষীর কাজ করে থাকে তাদের শৃংখলা এবং কোন অপরাধ সংঘটিত হলে সেই অপরাধের তদন্তের মাধ্যমে দোষী শান্তিরক্ষীকে বিচারের আওতায় আনার জন্য মিলিটারি পুলিশ কাজ করে থাকে। কংগোতে জাতিসংঘের পরিচালিত ইউএনের মোনুক মিশনের মিলিটারি পুলিশের কাজ নিয়ন্ত্রন এবং পরিচালনার মাধ্যমে ফোর্স কমান্ডারকে সহায়তা প্রদানের জন্য প্রভোস্ট মাশার্ল হিসেবে একজন কর্নেল পদবীর অফিসার নিয়োজিত আছেন। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে এই প্রভোস্ট মার্শাল পূর্বে ছিলো একজন সেনেগালের কর্নেল পরবর্তীতে মোনুক মিশনে বাংলাদেশে মিলিটারি পুলিশের সুনাম আর দক্ষতার পুরস্কার স্বরুপ একদিকে যেমন মিলিটারি পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি অন্যদিকে এই প্রভোস্ট মার্শালের এপয়েন্টমেন্টে সেনাগালের পরবর্তীতে বাংলাদেশে থেকে স্থায়ীভাবে একজন কর্নেল পদবীর অফিসার নিয়োগ পেতে শুরু করল যা আমাদের দেশের ভাবমূর্তিকে অনেকাংশে উজ্জ্বল করেছে ইউএনের আন্তজার্তিক পরিমন্ডল।

ইউএনের অফিস গুলোতে কাজ করার পদ্ধতি বেশ আধুনিক এবং উপভোগ্য। একটি উদাহারনের মাধ্যমে বিষয়টি আরো সহজে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যেমন একটি তদন্ত প্রতিবেদন এর রিপোর্টটি আমরা প্রথমে একটি নির্ধারিত ফরমেটের হার্ডকপিতে বিভিন্ন তথ্যাদি ঘটনাস্থলেই লেখে ফেলি । সেখান থেকে বিভিন্ন ছবি এবং ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দি বা স্টেটমেন্ট লিখে নিয়ে সমস্ত প্রতিবেদনটি স্ক্যানিং করে ইন্টারনেট ভিত্তিক লোটাস মেইলের মাধ্যমে তৎক্ষনাৎ কিনশাসাতে অবস্থিত কংগোর ইউএনের মোনুক মিশনের সদর দপ্তরে ফোর্স প্রোভোস্ট মার্শালের অফিসে পৌঁছে দেই। একইভাবে লোটাস মেইলের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের জন্য নির্দেশ ভিত্তিক চিঠিপত্র পেয়ে থাকি। যেই সকল তদন্ত কিছুটা স্পর্শকাতর সেই সকল বিষয়ের প্রতিবেদন আমরা অফিসে হার্ডকপি সংরক্ষন করতাম। এছাড়া বাকী সমস্ত কাজকর্ম আমরা এই ইন্টারনেট ভিত্তিক লোটাস মেইলের মাধ্যমে সম্পন্ন করতাম এবং ইউএনের বিশাল আর্কাইভে আমাদের যাবতীয় ডকুমেন্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংরক্ষিত হয়ে যেত।

ইউএনের অফিসিয়াল ইকুইপমেন্ট গুলো বেশ কাজের । সবার আগে যে বিষয়টি সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য তা হল ইন্টারনেট স্পীড, একেকটি ওয়েবসাইট খুলতে গেলে সময় লাগত ১ সেকেন্ড থেকে দেড় সেকেন্ডের মত। তবে ইউএনের অফিসয়াল নিয়ম অনুযায়ী নিষিদ্ধ সাইটগুলো ছিল ব্লকড এবং স্পীড স্লো হতে পারে এই জন্য ওয়েব ক্যামেরা ব্যবহারে নিষেধ ছিল। আমরা আমাদের অফিসে পেয়েছিলাম মাল্টি ফাংশোনাল প্রিন্টার মেশিন যার মাধ্যমে আমরা ফ্যাক্স, প্রিন্টিং, স্ক্যানিং এবং ফটোকপি করতে পারতাম। এছাড়া আমাদের ইউএনের অফিসগুলোর আর একটি উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হচ্ছে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা । সম্পুর্ন নিজস্ব ভিস্যাটের মাধ্যমে ইউএনের সকল ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে এবং টেলিফোনের মাধ্যমে কংগো থেকে শুরু করে ইউএনের মিশন যে সকল দেশে আছে এবং বিশ্বব্যাপী ইউএনের সকল দপ্তরে যে কারো সাথে দ্রুত যোগাযোগ করা সম্ভব।কাজ করার ক্ষেত্রে এই যোগাযোগ যে কতটা অবদান রাখতে পারে তা ইউএন মিশনে এক বছর কাজ না করলে বোঝা যেতনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৩২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×