সিগারেট আর গরম কফির ধূমায়িত পর্দার ভেতর দিয়ে আবারো ভালভাবে দেখার চেষ্টা করলাম তার সমাগত বার্ধক্যর পেছনের সেই সত্তর দশকের উদ্দাম এক যুবকের ছবি । ভদ্রলোক বলেই চলেছেন তার সেই স্বাধীনতা পূর্ব এবং পরবর্তী মুক্ত স্বাধীন দেশের কথা । তার দেশপ্রেম আর রাজনৈতিক গভীর বিশ্বাসের আর আদর্শের কথা । সময় যে কখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গভীর রাতে এসে পৌছেঁ গেছে একদম টের পাইনি । আসলে গত দুদিন হল এই স্টকহোমে এসেছি । এখানে আসার পর থেকেই দিনের তাপমাত্রা শুন্য থেকে বড়জোর ২ ডিগ্রীর মধ্যে উঠানামা করছে আর সারাদিন আকাশ মেঘলা । এইখানে যেন হঠাৎ করে নামে রাতের আধাঁর । আর সে কারনেই স্টকহোমের হালুনদায় এই নিরভানা রেস্তোরায় এসে কখন যে গভীর রাত সমাগত টেরই পেলাম না । ঘড়ির দিকে তাকাতে ভদ্রলোক বলে বসলেন আজ তবে থাক আপনারা হয়ত ক্লান্ত আরেকদিন না হয় সেই অতীতের কথা বলা যাবে । কিন্ত সময়ের চেয়ে আমাদের তার সেই অতীতের সংগ্রাম তার গভীর দেশপ্রেম আর রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা জানার আগ্রহ ছিলো প্রবল ।তাই আবার আমাদের সম্মতিতে তিনি শুরু করলেন তার নিজের কথা বলার ।
আজকের এই স্বল্প ব্লগীয় পরিসরে হয়ত সম্ভব হবেনা তার জীবনের কথামালা সম্পূর্ন প্রকাশ করার । যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নই বরং মাঝে মাঝে মনে হত আমার এই যারা রাজনীতি করে তাদের হয়ত কোন কাজ নেই বলে এসব করে বেড়ায়। কিন্ত সেই ভদ্রলোক আমার এই ধারনা সেদিনের স্টকহোমের প্রানবন্ত সন্ধ্যায় সম্পূর্ন বদলে দিলেন । দেশের প্রতি কি গভীর ভালোবাসা আর মমত্ব বোধ নিয়ে আজও তিনি বেঁচে আছেন সেই সূদুর সুইডেনের স্টকহোমে। হয়ত সেই পচাঁত্তরের কালো রাত বাংলাদেশের আকাশে ঢাকা না পড়লে তার মত অজস্র নিবেদিত কর্মীরা দেশছাড়া হতনা । হয়ত তারা আজ মাথা উঁচু করে এদেশে বাস করতেন। সেদিন তারা পরাজিত যোদ্ধার ন্যায় দেশত্যাগ করেছিলেন যার মর্ম যাতনার পরিষ্কার ছাপ আজও তার বাধর্ক্যের বলিরেখায় পরিষ্কার ফুটে উঠে । কথা প্রসংগে তিনি আক্ষেপ করে বললেন সেই অতীতের ন্যায় এই বর্তমানে আজ আর তার নিজ দল বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোতে নিঃস্বার্থ কোন রাজনৈতিক কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যায়না । এই বিদেশের মাটিতেও দেখা যায় দেশের রাজনীতি নিয়ে নিজেদের মাঝে স্বার্থের হানাহানি আর নিজ দেশকে বিদেশের মাটিতে ছোট করা । রাজনীতি নিয়ে তিনি আজ আর স্বপ্ন তেমন একটা দেখেননা নাকি স্বপ্ন ভংগের ভয়ে দেখার ইচ্ছে করেননা সেই প্রশ্ন আর তাকে করা হয়নি।
হাজার হতাশার মাঝেও উপস্থিত বাংলাদেশী রা দুটো প্রশ্ন করলেন অনেক আগ্রহ নিয়ে । প্রথমত তারা জানতে চাইলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসংগে আর বংগবন্ধু হত্যার বিচার প্রসংগে । মনে হচ্ছিলো আমরাই যেন তাদের কাছে বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র । তবে এই দুটি বিষয় নিয়ে তাদের মাঝে আগ্রহ আর আশার আলো ছিলো । এক সময় রাতের খাবারের শেষ হবার সাথে সাথে রাতের গভীরতা বেড়ে চললো । একে একে চারপাশের সব টেবিল ফাঁকা হয়ে আসলো । শুধু আমরা কজন বিভিন্ন বয়সের বাংলাদেশী রা মিলে বসে থাকলাম । একসময় শুভরাত্রি জানিয়ে বেরিয়ে আসলাম নিরভানা রেস্টুরেন্ট থেকে । বারান্দায় দাঁড়িয়ে হোটেলের মালিক সেই ভদ্রলোকের সাথে ছবি তুললাম । বাংলাদেশে তাকে আসবার আমন্ত্রন জানালাম ।
গভীর শীতের রাতের কনেকনে ঠান্ডা বাতাসে ওভারকোট টা গায়ে চাপিয়ে তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠে বসলাম , গন্তব্য গ্রান্ড হোটেল । গাড়িতে হালকা সুরে বাংলা গান হচ্ছিলো । আর আমার মন যেন তখনও সেই নিরভানার টেবিলে পড়ে ছিলো । কানে তখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো সেই ভদ্রলোকের কথাগুলো । আমাদের অতীত ইতিহাস কবে লেখা হবে সঠিকভাবে ? কবে আমরা সব পন্কিলতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবো ? কবে আমরা আমাদের সেই সত্যিকারের সোনারবাংলা কে খুঁজে পাবো ?
অনেকগুলো প্রশ্ন উত্তরগুলো কিভাবে দিবো তা জানিনা । শুধু জানি আমি গভীর প্রত্যয়ের সাথে সেই ভদ্রলোককে বাংলাদেশে ফিরে যাবার আমন্ত্রন জানিয়েছি । কারন তারা যেই দেশকে একদিন সংগ্রাম করে মুক্ত করেছে কিন্ত সময়ের ঘাত প্রতিঘাতে আজ তারা দেশ ছাড়া । আজ আমরা এই প্রজন্ম আবার সেই সময়ের প্রয়োজনে রুখে দাড়িঁয়েছি সেই সব মুখচেনা হায়েনার বিরুদ্ধে । আজ তাই আবার সময় এসেছে তাদের ঘরে ফেরবার যে ঘর তারা রক্তের দামে কিনেছিলো একদিন।
আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর স্টকহোমকে বিদায় জানিয়ে আবার দেশে ফিরে যাবো । আর হয়ত কখনো এই হালুনদার নিরভানা রেস্টুরেন্টে ফিরে আসা হবেনা । কখনো হয়ত এই টেবিলে বসে সেই দীর্ঘ দিন ঘরছাড়া মানুষগুলোর সাথে কথোপকথন হবেনা । কিন্ত তাদের ভালোবাসা আর দেশপ্রেমের সজীবতাকে এই বুকে ধারন করে যখন দেশে ফিরবো । তখন হয়ত অপেক্ষা করব সেই ঘরছাড়া মানুষ গুলোর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:১১