সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে মৃয়মান হয়ে রাতের আধাঁরে ঢেকে যাচ্ছে চারিদিক। চারপাশে কেমন যেন এক পবিত্র নীরবতা বিরাজ করছে । দূরে কেউ যেন থেকে থেকে চাপাস্বরে কেঁদে চলেছে। পশ্চিমাকাশে গোধূলীর রক্তিমার শেষ আলো নিঃশেষ হতে চলেছে।আমি বসে আছি নীরবে চোখ বেঁয়ে অঝোর ধারায় চোথ থেকে গড়ি্যে পড়ছে অশ্রু।সকালে দ্বিপ্রহরের আগে মাকে সাথে নিয়ে আরাফাতের এই ময়দানে যখন এসেছিলাম তখন বারে বারে ফিরে চাইছিলাম জাবালে আর রাহমাতের দিকে মনের দৃশ্যপটে ভেসে উঠছিলো আজ থেকে হাজার বছর আগে আমাদের মানব পিতা হজরত আদম (আঃ) যখন সন্গী হাওয়া কে হারিয়ে খুজঁতে খুজঁতে তিনশত বছর পরে এই পবিত্র পাহাড়ের কোন এক চূড়ায় উঠে হাজারো আশংকায় সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রতিপালক আল্লাহর কাছে তার কৃতভুলের জন্য বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করছিলেন।
তখন আল্লাহরই ইশারায় তাঁর মনে ভেসে উঠলো বেহেশতে আল্লাহর আরশের গায়ে কোন এক স্থানে তিনি দেখেছিলেন লেখাছিলো "লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্ললাহ্"।তিনি মনে মনে ভাবলেন আল্লাহর কাছে তিনশত বছর ধরে একমনে গোনাহ্ মাফের জন্য কতইনা দোয়া করলেন অথচ এখনও তার সেই গোনাহ্ব্ মাফ আল্লাহ করলেননা। যদি আজ একবার আল্লাহর সাথে যেই মুহাম্মাদ নামটি লেখা আছে সেই নাম ধরে একবার ডেকে দেখি যদি আল্লাহর দয়া হয়।এই ভেবে যেই হজরত আদম (আঃ) এই জাবালে আর রাহমাতের উপর দাড়িয়ে ০৯ জ্বিলহজে তারিখে কাতরমনে আল্লাহকে বললেন "হে আল্লাহ তোমার আরশের লেখা একটি নাম আছে মুহাম্মাদ জানিনা সে কে তবে তোমার নামের পাশে যে নাম লেখা সে অবশ্যি তোমার কোন প্রিয় বন্ধুর নাম হবে আমি সেই মুহাম্মাদের নামের উছিলায় তোমাকে ডাকছি তুমি আমার গোনাহ্ মাফ কর"। এই দোয়ার সাথে সাথে আল্লাহ্ সাড়া দিলেন পিতা আদমের ডাকে । যেই গোনাহ্ মাফ পিতা আদমের তিনশত বছরে হয়নি ,এক মুহাম্মদের নামের কারনে সেই দোয়া আল্লাহ্পাক সাথে সাথে ক্ষমা করে দিলেন । সেইসাথে পিতা আদম কে বিবি হাওয়ার সাথে মিলন করিয়ে দিলেন এই পাহাড়ের কোন এক অংশে। সেই থেকে এই পাহাড় পরিচিতি পেয়েছে রাহমাতের পাহাড় বা জাবালে আর রাহমাতের নামে।
এই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ছে ১৪শত বছর আগে এরকমই একদিন শুক্রবার, ৯ জিলহজ, ১০ হিজরী সনে আরাফার দিন দুপুরের পর রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লক্ষাধিক সাহাবির সমাবেশে হজের সময় হাম্দ ও সানার পর স্বীয় ভাষণে ইরশাদ করেনঃ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মা’বুদ নেই। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন। তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন। আর তিনি একাই বাতিল শক্তিগুলো পরাভূত করেছেন।
হে আল্লাহর বান্দারা! আমি তোমাদের আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর বন্দেগির ওসিয়ত করছি এবং এর নির্দেশ দিচ্ছি। হে লোক সকল! তোমরা আমার কথা শোন। এরপর এই স্থানে তোমাদের সাথে আর একত্রিত হতে পারব কি না জানি না।হে লোক সকল! আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, হে মানবজাতি! তোমাদের আমি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে পয়দা করেছি এবং তোমাদের সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর দরবারে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া অবলম্বন করে, সব বিষয়ে আল্লাহর কথা অধিক খেয়াল রাখে। ইসলামে জাতি, শ্রেণীভেদ ও বর্ণবৈষম্য নেই। আরবের ওপর কোনো আজমের, আজমের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালোর বা কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মর্যাদার ভিত্তি হলো কেবলমাত্র তাকওয়া।
আল্লাহর ঘরের হিফাযত, সংরক্ষণ ও হাজিদের পানি পান করানোর ব্যবস্থা আগের মতো এখনো বহাল থাকবে।হে কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকরা! তোমরা দুনিয়ার বোঝা নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন আল্লাহর সামনে হাযির না হও। আমি আল্লাহর বিরুদ্ধে তোমাদের কোনোই উপকার করতে পারব না।যে ব্যক্তি নিজের পিতার স্থলে অপরকে পিতা বলে পরিচয় দেয়, নিজের মাওলা বা অভিভাবককে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে মাওলা বা অভিভাবক বলে পরিচয় দেয় তার ওপর আল্লাহর লা’নত।
ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। প্রত্যেক আমানত তার হকদারের কাছে অবশ্যই আদায় করে দিতে হবে।
কারো সম্পত্তি সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারো জন্য হালাল নয়। সুতরাং তোমরা একজন অপরজনের ওপর জুলুম করবে না। এমনিভাবে কোনো স্ত্রীর জন্য তার স্বামী সম্পত্তির কোনো কিছু তার সম্মতি ব্যক্তিরেকে কাউকে দেয়া হালাল নয়।
যদি কোনো নাক, কান কাটা হাবশি দাসকেও তোমাদের আমির বানিয়ে দেয়া হয় তবে সে যত দিন আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করবে, তত দিন অবশ্যই তার কথা মানবে, তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে।
শোনো, তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত যথারীতি আদায় করবে, রমজানের রোজা পালন করবে, স্বেচ্ছায় ও খুশি মনে তোমাদের সম্পদের জাকাত দেবে, তোমাদের রবের ঘর বায়তুল্লাহর হজ করবে আর আমিরের ইতা’আত করবে, তা হলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।
হে লোক সকল! আমার পর আর কোনো নবী নেই, আর তোমাদের পর কোনো উম্মতও নেই।
আমি তোমাদের কাছে দু’টো জিনিস রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এ দু’টোকে আঁকড়ে থাকবে, তত দিন তোমরা গুমরাহ হবে না। সে দু’টো হলো আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত।তোমরা দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা দীনের ব্যাপারে এই বাড়াবাড়ির দরুন ধ্বংস হয়েছে।
এই ভূমিতে আবার শয়তানের পূজা হবে এ বিষয়ে শয়তান নিরাশ হয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা তার অনুসরণে লিপ্ত হয়ে পড়বে। এতে সে সন্তুষ্ট হবে। সুতরাং তোমাদের দীনের বিষয়ে তোমরা শয়তান থেকে সাবধান থেকো। শোনো, তোমরা যারা উপস্থিত আছো, যারা উপস্থিত নেই তাদের কাছে এই পয়গাম পৌঁছে দিয়ো। অনেক সময় দেখা যায়, যার কাছ পৌঁছানো হয় সে পৌঁছানেওয়ালার তুলনায় অধিক সংরক্ষণকারী হয়।
তোমাদের আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তখন তোমরা কী বলবে? সমবেত সবাই সমস্বরে উত্তর দিলেনঃ আমরা সাক্ষ্য দিব, আপনি নিশ্চয় আপনার ওপর অর্পিত আমানত আদায় করেছেন, রিসালতের দায়িত্ব যথাযথ আনজাম দিয়েছেন এবং সবাইকে নসিহত করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকাশের দিকে পবিত্র শাহাদাত অঙ্গুলি তুলে আবার নিচে মানুষের দিকে নামালেন।হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো। হে আল্লাহ। তুমি সাক্ষী থাকো।
সেই হজ্বের পর যখন নবীজি ফিরে আসলেন মদীনায় তারপর তিনি আর ফিরে যেতে পারেননি তার প্রিয় জন্মভূমি মক্কায় ।বিদায় হজ্বের ভাষনের ৭২ দিন পর প্রিয় নবী আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে গমন করেলন । কত ম্মৃতি আর ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে ৭০ মিটার উচ্চতার এই পাহাড়টি। একে একে মানসপটে ভেসে উঠলো কত কাহিনী ,এরই মাঝে চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায় ।
মাগরিবের আজান ভেসে আসছে মসজিদে নামিরাহ্ থেকে । একে একে ফাঁকা হয়ে আসছে হাজীদের তাবু গুলো । ধীরলয়ে দূরের রাস্তা দিয়ে সারি বেঁধে বাসগুলো হাজীদের নিয়ে চলেছে মুজদালিফার দিকে । আমাদের তাঁবুর ভেতরে আমি আমার মা বসে আছি । নির্বাক কিন্ত কি এক অপার্থিব কাতরতা আর অনুনয় যেন নীরব চোখের ভাষা হয়ে ফুটে উঠছে আমাদের চোখের তারায়। ধীরে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে মাকে নিয়ে হেঁটে চললাম দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মুজদালিফার উদ্দেশ্য ।
পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে দেখলাম আরাফাকে, জানিনা এই জীবনে আর কখনো কি আর আসা হবে কিনা । মনে এক অব্যক্ত যন্ত্রনা আর আশা তখনও বয়ে চলেছি সাথে নিয়ে আমার গুনাহ কি আল্লাহ মাফ করেছেন কি এই আরাফার দিনে? মনে আজও সেই আশার আলো নিয়ে অপেক্ষায় আছি। আবার কবে সৌভাগ্য হবে কিনা সেই আরাফার ময়দানে হাজির হবার। এখনও কানে ভেসে আসে নামিরাহ মসজিদের আজান আর পবিত্র সেই শব্দ লাব্বায়াক আল্লাহ হুম্মা লাব্বায়েক....আমি হাজির আল্লাহ আমি হাজির । আগামীকাল আরাফার দিন, এই দিন আল্লাহ তার রাহমাতের দ্বার খুলে দিবেন তার বান্দাদের জন্য আর অপেক্ষায় থাকবেন তার গুনাহগার বান্দাদের কাতর ক্ষমা প্রার্থনার আর সেইসাথে তিনি ক্ষমা করে দিবেন আমাদের কৃত গুনাহগুলোকে ।
কারন তিনিই একমাত্র পরম করুনাময় এবং পরম দয়ালু ,ক্ষমাকারী । হে আল্লাহ আমাদের কৃত গুনাহসমূহকে তুমি ক্ষমা করো , যেভাবে তুমি ক্ষমা করেছো হজরত আদম (আঃ) কে । হে আল্লাহ তুমি সকল হাজীদের হজ্বকে কবুল করো । আর যারা তোমার ঘরকে তওয়াফের জন্য অধীর অপেক্ষায় আছে ,তাদের কে তুমি তোমার ঘর এবং পবিত্র হজ্ব পালনের সুযোগ করে দাও। আমীন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১:১৪