somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ত্রৈলোক্যনাথঃ বাংলার মহারাজ

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ সকাল ৯:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“আমি ১৯০৮ সন হইতে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত ৩০ বৎসর কারাগারে কাটাইয়াছি, ৪/৫ বৎসর অজ্ঞাতবাসে কাটাইয়াছি। ...জেলখানার পেনাল কোডে যেসব শাস্তির কথা লেখা আছে এবং যে-সব শাস্তির কথা লেখা নাই তাহার প্রায় সব সাজাই ভোগ করিয়াছি।”কথাগুলো বলেছেন মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাঁর লেখা বই ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ এর ভূমিকায়।

“পৃথিবীতে সম্ভবত আমিই রাজনৈতিক আন্দোলন করার কারণে সর্বাধিক সময় জেলখানায় অতিবাহিত করেছি। মাঝখানে দু-এক মাস বিরতি ছাড়া আমি টানা ৩০ বছর জেলখানায় কাটিয়েছি।”

ছোটবেলায় বাবা-কাকাদের মুখে শুনতাম এই বিপ্লবীর কথা। অনেক গল্পই বলতেন। ঠিক আমাদের পাশের গ্রামেই জন্ম। অনেক গিয়েছি সেখানে। সবচেয়ে বেশি যে গল্পটি আকর্ষণ করতো তা তাঁর কথাতেই শোনা যাক...

“একবার পুলিশের তাড়া খাইয়া আমি ৮৫ মাইল রাস্তা হাঁটিয়া গিয়াছিলাম এবং রাস্তায় শুধু তিন পয়সার ছোলা ভাজা খাইয়াছিলাম। রাস্তাঘাট চিনতাম না, মাঠ দিয়া চলিতে চলিতে এক বড় রাস্তায় উঠিলাম। একটি রাখাল ছেলেকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম 'এই রাস্তা কোথায় গিয়াছে?'”




তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে ঠাকুর পরিবারে তাঁর জন্ম ১৮৮৯ সালের ২১ মে। এখন সেটি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে। যেতে চান সেখানে? খুবই সহজ এবং ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঢাকা থেকে ট্রেন বা বাসে করে (ভৈরব হয়ে) কুলিয়ারচর এসে রিক্সায় করে যেতে পারবেন। কিন্তু সেখানে এখন একটি ভুতুড়ে পোড়া বাড়ি ছাড়া তেমন আর কিছু দেখার নেই।

১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনের জন্ম হয়। স্বদেশী আন্দোলনের সময় বাংলার যুবক, বৃদ্ধ, জমিদার সকলেই স্বদেশ প্রেমে মেতে উঠেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ স্বরূপ সারা বাংলায় সভা সমাবেশ পিকেটিং চলতো। সবার মনে নতুন উৎসাহ-আমরা স্বাধীনতা চাই, বৃটিশদের অধীনে থাকবো না। “আমি তখন ধলা স্কুলে পড়ি এবং বোর্ডিং এ থাকি। স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ ধলায় আসিয়া পৌঁছিল, জমিদার বাড়িতে তাঁত, চরকা বসিল; সভা, শোভাযাত্রা পিকেটিং চলিতে লাগিল-“বন্দে মাতরম, আল্লাহো আকবার, ভারতমাতা কী জয়” ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। যুবকের দল ডন, কুস্তি, কুচকাওয়াজ করিতে লাগিল- লোকের মনে কি উৎসাহ! ধলাতে যাহারা আন্দোলনে মাতিয়াছিল আমি তাহাদের মধ্যে একজন ছিলাম।”

সে সময় পিতা দুর্গাচরণ চক্রবর্তী তাঁর কাছে পার্শেল করে আশীর্বাদ পত্র সহ একজোড়া দেশী মোটা কাপড় পাঠান। তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলে মনে-প্রাণে দেশ প্রেমিক হোক, স্বদেশি হোক।

প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে ১৯০৩ সালে তাঁকে মালদাহ জেলার সানসাটের পুখুরিয়া মাইনর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। শিক্ষকরা তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। এই মাইনর স্কুল থেকে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী বৃত্তি দেয়ার কথা ছিল। তিনি বৃত্তি পাবেন শিক্ষকরাও এ আশা করেছিলেন। কিন্তু পারিবারিক কারণে তাকে ওই স্কুল ছেড়ে চলে আসতে হয়। ওই স্কুলে পড়াশোনাকালে তিনি অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে আসেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহ জিলা হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি এক বছর পড়েছিলেন। ১৯০৬ সালে তাঁকে ভর্তি করানো হয় নরসিংদীর সাটিরপাড়া হাই স্কুলে। মূলতঃ এই স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি বিপ্লবী হবার পথে পা বাড়ার। তিনি অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। বিপ্লবী দলে যুক্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে দলের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যান। তখন তিনি বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাশের কাছ থেকে স্বদেশি মন্ত্রের দীক্ষা গ্রহণ করেন।

প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৯০৮ সালে, ম্যাট্রিক পরীক্ষার ২ মাস আগে। বিপ্লবী দলের কাজে নারায়ণগঞ্জ এলে সেখান থেকেই পুলিশ তাঁকে সহ আরো দুইজনকেগ্রেফতার করে। অভিযোগ ছিল নৌকা চুরি করে ডাকাতি করতে যাওয়া। ডাকাতির অভিপ্রায়ের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি তাই শুধু নৌকা চুরির অভিযোগে ৫ মাস জেল খাটেন এবং ৫০ টাকা জরিমানা দেন। জেলখানায় আক্ষরিক অর্থেই তাঁকে ঘানি টানতে হয়েছিল। প্রথাগত লেখাপড়ার সেখানেই সমাপ্তি।

মুক্তি পেয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে দলীয় কাজে মনোনিবেশ করেন। সে অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি নতুন মামলা (ঢাকা ষড়যন্ত্র) দায়ের হয়। গ্রেফতার এড়াতে দলীয় নেতাদের পরামর্শে আত্মগোপনে থেকে দলীয় কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। চলে যান কুমিল্লা থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে আগরতলার পাহাড়ী অঞ্চল উদয়পুরে। হেঁটেই যেতে হতো সেখানে। সেখানে তিনি বিপ্লবী দল গঠন করেন। গড়ে তোলেন কৃষি খামাড়। অনুশীলন সমিতির হয়ে প্রশিক্ষণ দেন অস্ত্র চালনার।

আত্মগোপনে থাকা অবস্থাতেই দ্বিতীয় বার গ্রেফতার হোন ১৯১২ সালে ষড়যন্ত্রমূলক এক হত্যা মামলায়। আগের দিন সন্ধ্যায় রতিলাল রায় নামের এক পুলিশ কর্মচারীকে কেউ একজন গুলি করে হত্যা করেছে। পরের দিন মহারাজ সেই রাস্তা দিয়ে যাবার সময় সন্দেহবশতঃ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। কারণ প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যে জানা গিয়েছিল খুনির লম্বা দাড়ি ছিল। এবং তখন মহারাজও লম্বা দাড়ি রাখতেন। কিন্তু প্রমাণের অভাবে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মুক্তি পেলেও নজরদারির মধ্যেই ছিলেন তিনি। নজরদারি এড়াতে স্থান ত্যাগ করে চলে যান মালদাহে। সেখানেও গঠন করেন বিপ্লবী দল এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করেন দলের সদস্যদের। এভাবে দুই বছর রাজশাহী ও কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে অনেক গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠনে নেতৃত্ব দেন। এবং তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের বিষয়টিও নিশ্চিত করেন।

১৯১৪ সালে আবার গ্রেফতার হোন কলকাতা থেকে। গঙ্গার তীর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করেন এক বাঙালী অফিসার। তাঁর মামলাটি তখন সরাসরি তত্ত্বাবধান করতেন ইন্সপেক্টর জেনারেল লোমেন সাহেব। (পরে এই লোমেন সাহেবকে ১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে গুলি করে হত্যা করেন বিনয় বসু নামে আরেক বিপ্লবী।) প্রহসনের বিচারে তখন তাঁকে পাঠানো হয় আন্দামান জেলে যা কালা পানি বা সেলুলার জেল নামেই পরিচিত ছিল। জেলখানা তো নয় যেন মৃত্যুকূপ। ১০ বছর সেখানে তাঁর উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। কালাপানি থেকে বেঁচে ফিরে আসা বন্দীর সংখ্যা কম।

“আমি ১৯১৬।১৭ সনে আন্দামানে বারীণবাবু, পুলিনবাবু, সাভারকর, ভ্রাতৃদ্বয়, ভাই পরমানন্দ, জোয়ালা সিং, পৃথ্বি সিং, গুরুমুখ সিং, পণ্ডিত পরমানন্দ, মোস্তাফা আমেদ প্রভৃতির সহিত একত্রে ছিলাম।”

আন্দামানে সাধারণত অসুস্থ বন্দীদের পাঠানো হতো না। কিন্তু তাঁর বেলায় তা হয়নি। তিনি হাঁপানীর রোগী হলেও তাঁকে আন্দামান পাঠানো হয়েছিল। আন্দামান যাবার পূর্বে তিনি কলকাতা জেলের এক সেলে ৯ মাস বন্দি ছিলেন। তাই যাবার আগে কারো কাছ থেকে বিদায় নিতে পারেননি। যাবার আগে সেলের দেয়ালে সুরকি দিয়ে লিখে গিয়েছিলেন-

“বিদায় দে মা প্রফুল্ল মনে যাই আমি আন্দামানে,
এই প্রার্থনা করি মাগো মনে যেন রেখ সন্তানে।
আবার আসিব ভারত-জননী মাতিব সেবায়,
তোমার বন্ধন মোচনে মাগো এ প্রাণ যেন যায়।
বিদায় ভারতবাসী, বিদায় বন্ধু বান্ধবগণ
বিদায় পুষ্প-তরুলতা, বিদায় পশু পাখীগণ।
ক্ষমো সবে যত করেছি অপরাধ জ্ঞানে অজ্ঞানে,
বিদায় দে মা প্রফুল্ল মনে যাই আমি আন্দামানে।”

সেলুলার জেলে তাঁকে সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোই করতে দেয়া হতো। খাবার অযোগ্য খাবার প্রতিদিন খেতে হতো। বছরে মাত্র একটি চিঠি বাড়িতে পাঠাতে পারতেন আর একটি চিঠিই তার ঠিকানায় আসতে পারতো। এটাও নির্ভর করতো সুপারিনটেনডেন্ট এর ইচ্ছার উপর। সন্ধ্যার পর অন্ধকার খোপে থাকতে হতো। সেই খোপেই প্রস্রাব পায়খানা করতে হতো। সে জন্য মাত্র একটি পাত্রই দেয়া হতো। অবর্ণনীয় শারীরিক পরিশ্রমের মধ্যেই অনেক বন্দীর মৃত্যু হতো। সে সময় গড়ে প্রতিমাসে ৩ জন কয়েদি আত্মহত্যা করতো। কয়েদীদের মধ্যে পারস্পরিক কথাবার্তা বলার নিয়ম ছিল না। রাজবন্দীদের অবস্থা আরো খারাপ ছিল। নামে মাত্র একটি হাসপাতাল থাকলেও সেখানে কাউকে রাখা হতো না। একবার হাঁপানীতে অনেক কষ্ট হলে ডাক্তার তাঁকে একদিন হাসপাতালে রেখেছিলেন। পরের দিন সুপারিনটেনডেন্ট ডাক্তারকে ধমক দিয়ে তাঁকে হাসপাতাল থেকে আবার সেলে নিয়ে আসেন। অত্যাচার নির্যাতন চরম হলেও কোন পরিদর্শকই কয়েদীদের কথা শুনতেন না। এ অবস্থায় সেখানে বিদ্রোহ করেন মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ এবং আরো কয়েকজন। ইচ্ছে করেই নিয়ম মেনে চলতেন না। অত্যাচার হলে সকলে মিলে প্রতিবাদ করতেন। এতে করে কোন লাভ হতো না বরং অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়তো। কিন্তু সরকারের উপর মহলে খবর চলে গেলো। কমিশনারে সাহেব পরিদর্শনে এলেন। কিন্তু কারো কথায় তেমন শুনলেন না। তখন বন্দিরা নিজ নিজ সেল থেকে চিৎকার করে কমিশনারকে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে শুরু করলে কমিশনার বাধ্য হন বন্দিদের কথা শুনতে। তিনি সাতজনের কাছ থেকে সাতটি প্রস্তাব লিখিত আকারে চেয়েছিলেন। ফলস্বরূপ পেনাল কোড কিছুটা সংশোধন হয়েছিল এবং জেলার এবং সুপারিনটেনডেন্টকে বদলী করা হয়েছিল। বছরে তিনটি চিঠি আদান প্রদান করা যেত এবং যার যার ধর্মীয় পরিচয় (পৈতা, টুপি ইত্যাদি) সাথে রাখার ব্যাপারে আইন শিথিল করে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যাবে মহারাজের লেখা –‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইতে।

১৯২৪ সালে সেখান থেকেও মুক্তি মেলে। মুক্তির পর কিছুদিন পর কলকাতা এবং ময়মনসিংহ ঘুরে বাড়ি এসে মেজদাকে প্রণাম করেন। মেজদা প্রণাম গ্রহণ করে জিজ্ঞাসা করেন, “তোমার নাম কি, তুমি কে?” অত্যাচার নির্যাতনে তাঁর শরীর এতটাই খারাপ হয়েছিল যে কেউ তাঁকে প্রথম দর্শনে চিনতে পারতো না। এ অবস্থায় মাত্র ২ দিন বাড়িতে থেকে আবার কলকাতা ফিরে যান অনুশীলন সমিতির ডাকে সেখানকার নতুন একটি স্কুলের দায়িত্ব নিতে। সারা ভারতবর্ষ জুড়েই অনুশীলন সমিতির গোপন কার্যক্রম ছিল।

বৃটিশ সরকারের দায়ের করা একের পর এক মামলায় তাঁকে কারাভোগ করতে হয় দফায় দফায়। কখনো হত্যা মামলা, বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা, ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা, রাজাবাজার বোমা হামলা এভাবে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর কারাগারেই কাটে।

“১৯২৫।২৬ সালে ব্রহ্মদেশের অন্তর্গত মান্দালয় জেলে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কাটাইয়াছি, ১৯৩২ সালে মাদ্রাজ প্রদেশের অন্তর্গত বিভিন্ন জেলে কে রামন মেনন, কর্নাটকের সদাশিব রাও, অধ্যাপক এন, জি, রঙ্গ, মালাবার বিদ্রোহের নেতা এম, পি, নারায়ণ মেনন প্রভৃতির সহিত একত্র ছিলাম। বাঙ্গালা দেশের ছয়টি সেন্ট্রাল জেলে এবং কয়েকটি ডিষ্ট্রীক্ট জেলেও ছিলাম।”

মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী চিনিশপুর (নরসিংদী) কালীবাড়িতে গিয়ে বটগাছের নিচে বসে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিকল্পনা করতেন। নির্জন কালীবাড়িতে বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ, লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ও কুস্তিখেলার আয়োজন করতেন। বিপ্লবীরা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে দেশমাতৃকার সদস্য হওয়ার জন্য জীবন বিসর্জন দেওয়ার দীক্ষা নিতেন। চিনিশপুর কালীবাড়ি ও বটগাছটি এখনো টিকে আছে।

১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর তিনি মাতৃভূমি বাংলাদেশকেই বেছে নেন বসবাসের জন্য। এবং হিন্দুরা যেন দেশত্যাগ না করে, সে বিষয়ে জেলায় জেলায় গিয়ে প্রচারণা চালান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁর এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভালো চোখে দেখেনি। সন্দেহ থেকে তাঁর চিঠিপত্র পর্যন্ত জব্দ করে।

বাংলাদেশে থেকে যাওয়া নিয়ে তার স্বহস্তে লিখিত একটি চিঠি দেখুন...



মহারাজ সশস্র বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন। এ জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। অর্থের প্রয়োজন মেটাতে ডাকাতি করতেন। বড়লোকদের টাকা লুট করতেন। এমনকি জাল টাকা তৈরিও করতেন। সব কিছুই করতেন বিপ্লবের স্বার্থে। অনেক বিপ্লবী ছিলেন যারা নিজ বাড়ি থেকে টাকা চুরি করে দলকে দিতেন।

তিনি অস্ত্র লুট, অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করতেন। অনেক খণ্ডযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। এসবের বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর লিখিত ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইতে। তিনি লিখেছেন, “আমি পরাধীন ভারতে বহু ডাকাতি করিয়াছি, খুন করিয়াছি, চুরি করিয়াছি, নোট জাল করিয়াছি, সবই দেশের স্বাধীনতার জন্য-কর্ত্তব্যের দায়ে। আমরা বিদ্বেষ ভাব হইতে বা ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধনের জন্য কিছুই করি নাই। আমি যাহাকে হত্যা করিয়াছি, তাহার আত্মার কল্যাণ কামনাই করিয়াছি, তাহার পরিবারের শুভ চিন্তাই করিয়াছি। ডাকাতি বা খুন আমাদের পেশা ছিল না। আমরা যাহাদের বাড়িতে ডাকাতি করিয়াছি, যাহাদিগকে হত্যা করিয়াছি, আমরা জানিতাম তাহারা আমাদের স্বদেশবাসী।”

১৯৫৪ সালে তিনি যুক্ত ফ্রন্টের হয়ে নির্বাচন করে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হোন। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারত স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বই বের হয়ে কলকাতা থেকে। বইটি পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করে সে সময়ই ‘বিপদজনক বই’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করে রাখে এই বইটিকে। পরে ১৯৮১ সালে বইটি আবার প্রকাশিত হয়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় দেশপ্রেমিক এই মানুষটিকে পাকিস্তান সরকার দুই বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখে। জেল থেকে বের হয়ে খুব ভেঙ্গে পরেন। চলে যান গ্রামের বাড়ি কুলিয়ারচরে। সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাঁপানীর সমস্যা প্রকট হয় এবং হৃদরোগ ধরা পড়ে। এক পর্যায়ে ১৯৭০ সালে তাকে চিকিৎসার জন্য ভারত নিয়ে যাবার অনুমতি দেয় পাকিস্তান সরকার। সেখানে ভারত সরকারের আতিথেয়তা তাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসতে পারেন নি মাতৃভূমিতে। সে বছরই ৯ আগস্ট পরলোকগমন করেন এই চিরবিপ্লবী।

মৃত্যুর তিন দিন আগে (০৬ আগস্ট, ১৯৭০) ভারতের পার্লামেন্টে তিনি বাংলায় ভাষণ দেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন এক ধর্ম নিরপেক্ষ পাকিস্তানের। তাঁর ভাষণের কপি পড়তে ডাউনলোড করুন 'ভারতীয় পার্লামেন্টে সংবর্ধনার উত্তরে মহারাজ'

ভারত সরকার তার সম্মানে কলকাতার একটি রাস্তার নামকরণ করে। আর বাংলাদেশে তাঁর নিজ এলাকায় একটি বেসরকারী গণগ্রন্থাগার ছাড়া আর কিছু আছে বলে জানা নেই।



চিরকুমার এই বিপ্লবীর নিজের সম্বন্ধে মূল্যায়ন দেখুন তার নিজের লেখায়। “আমার স্বপ্ন সফল হয় নাই, আমি সফলকাম বিপ্লবী নই। আমার ব্যর্থতার কারণ, আমার দুর্বলতা নয়। আমি কখনও ভীরু ছিলাম না- আমার জীবনে কখনও দুর্বলতা দেখাই নাই। আমি আমার চরিত্র নির্মল ও পবিত্র রাখতে সক্ষম হইয়াছি। অর্থলোভ আমার ছিল না। এক সময় হাজার টাকা আমার কাছে আসিয়াছে, কিন্তু সে টাকা নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য ব্যয় করি নাই।—– মৃত্যুভয় আমার ছিল না, যে কোনো বিপদজনক কাজে হাত দিতে আমি পশ্চাৎপদ হই নাই। আমার স্বাস্থ্য ভাল ছিল, আমি কখনও অলস ছিলাম না, কঠিন পরিশ্রমের কাজে কখনও ভীত হই নাই, যখন যে কাজ করিয়াছি, আন্তরিকতার সাথে করিয়াছি। আমার ব্যর্থতার কারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আমার ব্যর্থতার কারণ একজন দক্ষ ও সফলকাম বিপ্লবীর যতটা ধীশক্তি ও জন-গণ-মন অধিনায়কতার যে ব্যক্তিত্ব থাকা আবশ্যক তাহার অভাব”।

৯ আগস্ট তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। চিরবিপ্লবী এর মহান মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ সকাল ৯:০২
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×