somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: ৭ম অধ্যায়: ইতিহাসের পথে রোম (৩য় অংশ)

২৯ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মিসরের রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে ক্রমশ প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ছিল একটি নিয়মিত ব্যাপার। এ ষড়যন্ত্রে ক্লিওপেট্রা ধরাশায়ী হলেন। জনঅসন্তোষ এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের চাপের মুখে ক্লিওপেট্রা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিণ মিসরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেশের বাইরে গিয়ে ফিলিস্তিনের কাছাকাছি আরব আদিবাসীদের এলাকায় নিজস্ব সেনাবাহিনী নিয়ে আশ্রয় নেন। ক্লিওপেট্রা নিজেও ৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনের অংশীদার তার নাবালক ভাই ও স্বামী ত্রয়োদশ টলেমিকে বঞ্চিত করে নিজেই সিংহাসন দখল করে নিয়েছিলেন। এবার নাবালক ত্রয়োদশ টলেমিকে একক ভাবে সিংহাসনে বসানো হল। টলেমিদের রীতি অনুযায়ী ভাইকে বিয়ে করে রাণী হিসেবে বোনেরা যুক্ত ভাবে সিংহাসনের অধিকারী হন। ক্লিওপেট্রা পালিয়ে যাওয়ার পরে ৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ত্রয়োদশ টলেমিকে সিংহাসনে বসানো হয়। নাবালক টলেমির নামে মূলত রাজ্য শাসন ও ভোগ করছিলেন প্রধানমন্ত্রী পথিনাস। অন্যরাও সুবিধা পাচ্ছিলেন। ত্রয়োদশ টলেমিকে পম্পেই সমর্থক সিনেটররাও গ্রিস থেকে সমর্থন জানাল। রোমান সিনেটের একাংশ তখন সিজারের সমর্থনে রোমে অবস্থান করছে আর বৃহৎ অংশটি পম্পেইর সাথে পালিয়ে গ্রিসে অবস্থান নিয়েছে। সিনেটরদের মাঝে অভিজাতদের সংখ্যা বেশি ছিল বলে এই অবস্থা। অতীতের রোমান দখলদারি প্রথা অনুযায়ী পম্পেই ত্রয়োদশ টলেমির অভিভাবক নিযুক্ত হন। তবে পম্পেইর সাথে টলেমির এই সংশ্লিষ্টতা মিসরের সাথে ক্লিওপেট্রার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাকে জোরদার করে।

ইতোমধ্যে রোমের গৃহযুদ্ধে অতি দ্রুত পটপরিবর্তন হতে থাকে। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি থেসালির যুদ্ধে, পম্পেই সিজারের বাহিনীর হাতে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হন। নতুন সৈন্যবাহিনী সংগ্রহের জন্য তিনি মিসর যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। আগের বছর তিনি টলেমিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ও তার অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছেন। একদিন টলেমির পিতাকেও তিনি সাহায্য করেছিলেন। ৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ত্রয়োদশ টলেমির পিতা আউলেটস যখন সাহায্য ভিক্ষার জন্য রোমে পৌঁছেছিলেন, তখন কনসাল পম্পেই তাঁকে আদর আপ্যায়ন করেছিলেন এবং মিসরের সিংহাসনে পুনরায় বসার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। এর প্রতিদানে পম্পেই ত্রয়োদশ টলেমির সাহায্য পাবেন বলে আশা করলেন। এই সময়ে ক্লিওপেট্রা তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছিলেন। টলেমি তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে ক্লিওপেট্রাকে বাঁধা দেওয়ার জন্য মাউন্ট ক্যাসিয়াসে এসে শিবির স্থাপন করেন।

পম্পেই নৌবহর নিয়ে টলেমির সাথে সেখানেই দেখা করতে যান। ফ্ল্যাগশিপ ছেড়ে একটি ছোট নৌকায় চড়ে তিনি উপকূলের দিকে টলেমির শিবিরের কাছাকাছি পৌঁছান। তীর থেকে আর একটি নৌকা পম্পেইকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসে। পম্পেই সে নৌকায় চড়ে তীরে পৌঁছালেন। কিন্তু হায়! তীরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই পম্পেই আক্রান্ত হলেন। গেবিনিয়ান সেনাপতি সেপ্টেমিয়াসের আঘাতে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হলেন। নিয়তির কি পরিহাস! স্বার্থ কী বিচিত্র জিনিস! স্বার্থ কাউকে মনে রাখে না। একসময় গেবিনিয়াস ও গেবিনিয়ান সৈন্যরা ছিল পম্পেইর অধীনস্থ। পম্পেই সিরিয়া বিজয় করে গেবিনিয়াস ও তার অধীনস্ত সৈন্যদের রেখে গিয়েছিলেন অবাধে লুটে খাওয়ার জন্য। এর ওপরেও তাদের উপরি লাভ ছিল দ্বাদশ টলেমির মিসরের রাজকোষ লুটে খাওয়ার সুযোগ। মিসরের সম্পদশালী রাজকোষ হতে উচ্চ বেতন পেয়ে গেবিনিয়ান সৈন্যরা পম্পেইর কথা ভুলে গেছে। ডাকাতির ধনের এমনই গুণ। ডাকাতের অবদানের কথা ডাকাত মনে রাখে না।

এই গেবিনিয়ান সৈন্যরা ক্লিওপেট্রার সময়ে সিরিয়ার রোমান গভর্নর বিবুলাসকেও বিপদে সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিল। কারণ বিবুলাসকে সাহায্য করলে লুটের বখরা যা আসত, তাতে তারা সন্তুষ্ট ছিল না। মিসর হতে সিরিয়ার রাজকোষ নিতান্তই অস্বচ্ছল ছিল। তাই গেবিনিয়ান সৈন্যরা সাহায্যপ্রার্থী বিবুলাসের দুই পুত্রকে হত্যা করেছিল। অবশ্য ক্লিওপেট্রা হত্যাকারিদের গ্রেপ্তার করে বিবুলাসের কাছে পাঠাতে পেরেছিলেন। শোষক মহলে পরষ্পরের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও যুদ্ধ-সংঘাত ছিল নিয়মিত ব্যাপার। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। একসময়ের পম্পেইর সমর্থন পুষ্ট মিসর তার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে সেটাই প্রমাণ করল। মিসরের যুদ্ধ জাহাজগুলি পম্পেইর নৌবহর আক্রমণ করে কয়েকটি ধ্বংশ করে এবং বাকিগুলি পালিয়ে যায়। কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন টলেমির নামে রাজ্য শাসনকারি প্রধানমন্ত্রী পথিনাস যিনি ছিলেন ক্লিওপেট্রা বিরোধী ষড়যন্ত্রের নায়ক, তিনিই এই পরিকল্পনা করেছিলেন। কারণ হয়তো জুলিয়াস সিজারকে খুশি করা। তাছাড়া গৃহযুদ্ধে পম্পেইর বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই কমে গিয়েছিল। পম্পেইর মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলেরা নেতৃত্ব গ্রহণ করে। পম্পেই নিহত হয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর।

পম্পেই হত্যার মাত্র ৪ দিন পর জুলিয়াস সিজার ১০টি যুদ্ধ জাহাজ ও ৪০০০ সৈন্য নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার উপক’লে এসে হাজির হন। এ পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই পম্পেইর মাথা কেটে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। মিসরের রাজপ্রতিনিধি সিজারের জাহাজে গিয়ে পম্পেইর আংটি ও কাটা মাথা থালায় করে সিজারের সামনে পরিবেশন করলেন। হায় পম্পেই! যিনি ছিলেন একসময় রাজনীতিতে সিজারের সবচেয়ে বড় বন্ধু। এখন সিজারকে খুশি করার জন্য তাঁরই কাটা মাথা পরিবেশন করা হল। কিন্তু এতে খুশি হয়ে সিজার ফিরে গেলেন না। কারণ তখন সমগ্র বিশ্বের মধ্যে রাজস্ব আয়ে মিসর ছিল সবচেয়ে বিত্তশালী দেশ। অতএব সেই রাজস্ব আয়ের ভাগ সিজারের চাই। ত্রয়োদশ টলেমি তখনও মিসরের পূর্বাঞ্চলে ক্লিওপেট্রার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। সেনাপতি অ্যাকিলাসের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীকে রেখে টলেমি সিজারের সঙ্গে দেখা করার জন্য আলেকজান্দ্রিয়ায় এলেন। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পথিনাসও ছিলেন। তারা সিজারকে মিসরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে ব্যার্থ হলেন। এরই মাঝে সিজারকে হাত করার জন্য লুকিয়ে দেখা করতে চলে আসলেন ক্লিওপেট্রা।

ঐতিহাসিক প্লুতার্কের ‘সিজার’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ক্লিওপেট্রা লুকিয়ে জাহাজযোগে সমুদ্রপথে এসে টলেমির নৌসেনাদের ঘুষ দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া হারবারে প্রবেশ করতে সমর্থ হন। কবি লুকানের রচিত কাহিনী এই ঘটনাকে অমরত্ব দিয়েছে। এই কাহিনী অনুযায়ী একজন সিসিলিয়ান ব্যবসায়ী উপকূলের পাহারাদারদের ফাঁকি দিয়ে ক্লিওপেট্রাকে কম্বলের ভেতর জড়িয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার ভেতরে পৌঁছে দেন। সিজার ও টলেমি তখন আলেকজান্দ্রিয়ায় রাজপ্রসাদে অবস্থান করছিলেন। ক্লিওপেট্রা সেখানে সিজারের সামনে হাজির হলেন। বিভিন্ন বিবরণ থেকে জানা যায় ২১ বছর বয়সী ক্লিওপেট্রাকে দেখে ৫২ বছর বয়সী সিজার মোহিত হন। অনেকেই মনে করেন সিজারের সাথে তাঁর মিলনের ঘটনা ঘটেছে। ক্লিওপেট্রা তাঁর পিতার মতই রোমান অনুগ্রহে ক্ষমতায় ফিরে আসার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সিজারের প্রতি তাঁর আনুগত্যের এটাই ছিল সবচেয়ে বড় কারণ।

সিংহাসনের অংশীদার সৎ বোন ক্লিওপেট্রার উপস্থিতিতে ত্রয়োদশ টলেমি অবাক হয়ে যান। সিজারের সাথে ক্লিওপেট্রার দহরম-মহরম আঁচ করতে পেরে তিনি রাজপ্রসাদ থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে আলেকজান্দ্রিয়াবাসীকে সিজার ও ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন। আলেকজান্দ্রিয়াবাসী রোমান আধিপত্য ও ক্লিওপেট্রার রোম ভজা নীতির ঘোর বিরোধী ছিল আগে থেকেই। তের বছর বয়সী বালক রাজা টলেমির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিক্ষুদ্ধ জনতা রাজপ্রসাদের সামনে ভীড় করে। শুধু মাত্র উত্তেজিত বালক টলেমির বড় বোনের বিরুদ্ধে আস্ফালনের কারণেই জনতা সাড়া দেয়নি বরং তারা ক্লিওপেট্রার সিংহাসন দখলের মাধ্যমে মিসরের বুকের ওপর রোমান আধিপত্য চিরস্থায়ীভাবে চেপে বসার আশংকা করছিল। সিজার রাজপ্রাসাদের সামনে বেরিয়ে এসে জনতাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠান্ডা করে আশ্বাস দেন যে, সিংহাসনের বৈধ অধিকারি ভাই-বোন দুজনকেই তিনি ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করবেন। সিজার জানতেন ভাই বোনের ক্ষমতার দ্বন্ধ সহজে মিটবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্তের ভার তাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষায় থাকলেন।

কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল না। ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অক্টোবরের শেষদিকে মিসরের পূর্বাঞ্চলে অবস্থারত টলেমির সৈন্যবাহিনী পথিনাসের গোপন নির্দেশে আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে রওনা হল। সিজারের সৈন্যসংখ্যা স্বল্প হওয়ায় তিনি এদেরকে ঠেকানোর জন্য সিরিয়া থেকে অতিরিক্ত সৈন্য চেয়ে পাঠালেন। তারা এসে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয়ায় খন্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। এসময় সিজার টলেমিকে রাজপ্রাসাদে আটকে রেখেছিলেন। টলেমির সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্বে এসময় বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। কয়েকটি খন্ডযুদ্ধের পর সিজার টলেমিকে আপোষের জন্য ছেড়ে দেন। কিন্তু টলেমি সৈন্যবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করে খোলাখুলিভাবে সিজার ও ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৭ সালের মার্চ মাসে সিজারের সাহায্যার্তে প্রেরিত সেনাদল এসে পৌঁছায়। এদের মধ্যে ছিল এশিয়ান, সিরিয়ান ও আরব সৈন্যদল। এমনকি জুডিয়া থেকে একটি ইহুদি সৈন্যদলও যোগ দিয়েছিল। ইহুদি সৈন্যদের উপস্থিতির ফলে আলেকজান্দ্রিয়াবাসী ইহুদিরাও খোলাখুলিভাবে সিজার ও ক্লিওপেট্টার পক্ষ সমর্থন করে। তৎকালীন আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসীদের পাঁচ ভাগের দুই ভাগই ছিল ইহুদি। খ্রিস্টপুর্ব ৪৭ সালের ২৭ মার্চ সিজারের সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধে টলেমির বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। টলেমি পালাতে গিয়ে নীল নদে নৌকা ডুবে মারা যান। সিজারের সহায়তায় ক্লিওপেট্রা মিসরের সিংহাসনে পূণর্বহাল হলেন। যথারীতি সিজারও ক্লিওপেট্রার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করলেন। সিজারের মিসর লুটের ইচ্ছা পূর্ণ হল।

টলেমি বংশের প্রথা অনুযায়ী ক্লিওপেট্রা ১২ বছর বয়সী সর্বকনিষ্ঠ সৎভাইকে বিয়ে করে রাণী হিসেবে রাজ্য শাসনের বৈধতা আদায় করেন। সিজার তাঁর চারটি সৈন্যবাহিনীর তিনটি মিসরে রেখে আলেকজান্দ্রিয়া ত্যাগ করেন। সিজার মিসর ত্যাগের কিছুদিন পরে ক্লিওপেট্রার এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসীরা রসিকতা করে তার নাম রাখে সিজারিয়ন (Coesorion) অর্থাৎ ক্ষুদে সিজার বা সিজারের পুত্র। ক্লিওপেট্রা তাঁর নাম দেন টলেমি সিজার। এই নাম থেকে রসিকতার সত্যতা পাওয়া যায়। ৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের জুন মাসের মধ্যে সিজার সিরিয়া পৌঁছান। সেখান থেকে পশ্চিম তুরস্কে যান। ১ আগষ্ট তিনি পন্টাসের রাজা দ্বিতীয় ফারনেসেসকে পরাজিত করেন। এই বিজয়ের সাফল্যে উদ্বেলিত হয়ে সিজার দম্ভভরে লিখেছিলেন “ভিনি, ভিডি, ভিসি” অর্থাৎ ‘‘আমি এলাম, আমি দেখলাম, আমি জয় করলাম”।

এরপর সিজার ইতালি হয়ে তিউনিসিয়ায় যান। ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ৬ এপ্রিল তিনি সেখানে পম্পেই পুত্রদের পরাজিত করেন। ১৫ জুলাই রোমে ফিরে গিয়ে বিজয় উৎসব পালনে মনযোগ দেন সিজার। বিজয় উৎসবের পরে ক্লিওপেট্রা তার ভাই ও স্বামী বালক চতুর্দশ টলেমিকে সঙ্গে নিয়ে রোমে এসে অবস্থান করতে থাকেন। পরের বছর সিজার আবার স্পেনে গিয়ে পম্পেইর পুত্রদের পরাজিত করেন। এ বছর সিজার তাঁর শেষ ইচ্ছা সংবলিত দলিল প্রস্তুত করেন। দলিলে তিনি তার বোনের পৌত্র- গেইয়াস অক্টেভিয়ানকে নিজের পোষ্য-পুত্র হিসেবে উত্তরাধিকারি মনোনীত করেন।

৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার আজীবন কনসাল নিযুক্ত হলেন। এট্রুস্কানদের বিতাড়নের পর থেকে রাজা শব্দটি রোমানদের অপ্রিয় ছিল। তাই সিজার রাজা উপাধি না নিয়ে কনসাল নামে থাকতেই পছন্দ করেন। সিজারের জয়ের ইতিহাসে একটি অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছিল। এটা হল, পার্থিয়া (ইরান) তখনও রোমান সাম্রাজ্যের পদানত হয়নি। কয়েক বছর আগে পার্থিয়ার কাছে ক্রাসাস শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। এর প্রতিশোধ নিয়ে পার্থিয়া দখল করার জন্য খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৭ মার্চ সিজারের সামরিক অভিযানে রওনা হওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়। ১৫ মার্চ সিজার সিনেট অধিবেশন আহ্বান করেন।

সেসময়ে রোমান রাজনীতি ষড়যন্ত্রের খনিতে পরিণত হয়েছিল। সিজারের ভাগ্যাকাশেও দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছিল। অভিজাতরা তাকে হত্যার চক্রান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছিল। শোষণ ও লুণ্ঠনের বখরা পাওয়া যে রাজনীতির মূল লক্ষ্য, তার চরিত্র এমনই হয়। ১৫ মার্চ সকাল দশটায় সিজার সিনেট অধিবেশনে যোগ দিতে পম্পিয়ান মিলনায়তনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। মিলনায়তনে আসন গ্রহণের পরেই আততায়ীরা তাকে ঘিরে ফেলে। একের পর এক ধারালো ছোরার আঘাতে সিজার রক্তাক্ত হতে থাকেন। ষড়যন্ত্রের অন্যতম নেতা ছিলেন একনায়কত্ব বিরোধী প্রজাতন্ত্রের সমর্থক ও অভিজাতপন্থী মার্কাস ব্র“টাস। কেউ কেউ বলেন, ছুরি হাতে আঘাত করতে উদ্যত মার্কাস ব্র“টাসকে দেখে, সিজার গ্রিক ভাষায় বলে উঠেছিলেন, ‘‘বৎস, তুমিও।’’ হায় সিজার! পম্পেই থেকে সিজারের পরিণতিও কম দুঃখের হয় নি।

সিজারের মৃত্যুর পরে রোমান সাম্রাজ্য নতুনভাবে সংঘাতের অন্ধকারে ছেয়ে যায়। স্বার্থ ও ক্ষমতার সংঘাত রোমান সাম্রাজ্যের অনিবার্য অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সিজারের মৃত্যুর পরে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যে পুনরায় ত্রয়ী শাসনের আবির্ভাব ঘটে। সিজারের মনোনীত পোষ্যপুত্র অক্টেভিয়ান, সহকারি মার্ক এন্টনি এবং ধনী বণিক ও সেনানায়ক লেপিডাসের মধ্যে রোমান সাম্রাজ্য ভাগাভাগি হয়ে যায়। সিনেট বাধ্য হয়ে ত্রয়ী শাসনব্যবস্থা মেনে নিয়ে পাঁচ বছরের জন্য পূর্ণ ক্ষমতা তাঁদের হাতে ন্যস্ত করেছিল। ৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ত্রয়ী শাসকদের সদস্য হিসেবে অক্টেভিয়ান মেসিডোনিয়ায় পালিয়ে যাওয়া সিজারের হত্যাকারিদের সৈন্যবাহিনীকে স¤পূর্ণ পরাজিত করেন। অপর ত্রয়ী শাসকদের অন্যতম লেপিডাসকে পম্পেইর পুত্রের সাথে যোগসাজশে সন্দেহ করায় অন্য দুজন তাকে আফ্রিকা এলাকার শাসনভার দিয়ে নিজেরা মূল সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন।

অক্টেভিয়ান রোম সহ সাম্রাজ্যের সমগ্র পশ্চিমাঞ্চল এবং মার্ক এন্টনি সমগ্র পুর্বকালের শাসনভার গ্রহণ করেন। এ ভাগাভাগির পরে মিসর হতে ক্লিওপেট্রার যোগসূত্র স্থাপিত হয় মার্ক এন্টনির সঙ্গে। এন্টনির সঙ্গেও তাঁর মিলন হয় এবং এন্টনির সন্তানও জন্ম নিয়েছিল ক্লিওপেট্রার গর্ভে। ৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্লিওপেট্রা তুরস্কে গিয়ে এন্টনির সঙ্গে দেখা করেন। ৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গোড়ার দিকে পার্থিয়ানরা সিরিয়া দখল করে নেয়। ৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এন্টনি সাময়িকভাবে এথেন্সে তার রাজধানী স্থাপন করেন। এ বছরের শেষ দিকে তিনি পার্থিয়ানদের হাত থেকে তুরস্ক, সিরিয়া ও জুডিয়া উদ্ধারের জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। তারা সফল হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮ ও ৩৭ সালে অক্টেভিয়ান পর পর দুইবার পম্পেইর ছেলের সাথে নৌ-যুদ্ধে পরাজিত হলে এন্টনি তাঁর আহ্বানে জাহাজ নিয়ে ইতালিতে পৌঁছান। ১২০টি জাহাজ দিয়ে তাঁকে সাহায্য করতে এন্টনি রাজি হন। এর বিনিময়ে পার্থিয়া দখলের জন্য অক্টোভিয়ানের ২০০০০ সৈন্য দিয়ে এন্টনিকে সাহায্য করার কথা ছিল। এন্টনি এ সাহায্য পাননি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ সালে অক্টেভিয়ান আরও একটি নৌ যুদ্ধে হেরে যান। কিন্তু এর চেয়েও বহুগুণে বেশি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলেন এন্টনি, পার্থিয়া আক্রমণ করতে যেয়ে। এ অভিযানে তিনি ভয়ানকভাবে পর্যদুস্ত হয়েছিলেন। এন্টনির এ পরাজয়ের কারণে আরও দেড়শ বছর পার্থিয়ান সাম্রাজ্য অপরাজেয় ছিল।

৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অক্টেভিয়ান ও মার্ক এন্টনির মধ্যকার সন্ধিকে আরও স্থায়ী ও শক্তিশালী করার জন্য অক্টেভিয়ানের বিধবা বোন অক্টেভিয়ার পূণর্বিবাহ হয় মার্ক এন্টনির সাথে। অক্টোভিয়ার গর্ভে এন্টনির একটি কন্যা সন্তানেরও জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এন্টনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তাঁর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছিলেন। ৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এন্টনি জাহাজ প্রদান শেষে ইতালি থেকে ফেরার সময় অক্টোভিয়াকে ইতালিতে রেখেই সিরিয়ায় ফিরে আসেন। এতে অক্টেভিয়ান অপমানিত বোধ করেন। এন্টনি সিরিয়ায় পৌঁছেই ক্লিওপেট্রাকে আসতে খবর পাঠান। কিন্তু অক্টেভিয়ানের প্রতিশ্র“ত সৈন্য পাঠাবার কোন লক্ষণ না দেখে তিনি নিজেই আলেকজান্দ্রিয়ায় চলে যান। উদ্দেশ্য ক্লিওপেট্রার সাথে মিলিত হওয়া ও সামরিক সাহায্য আদায় করা। পুরো শীতকাল তিনি সেখানে, ক্লিওপেট্রার সঙ্গে কাটান। ক্রমশ এন্টনির সঙ্গেই ক্লিওপেট্রার ভাগ্য জড়িয়ে যায়। এন্টনির জন্য সামরিক ও আর্থিক সাহায্যের প্রতিদানে তিনি রাজ্যসীমাকে বহুদুর বিস্তৃত করে ফেললেন। বহু নতুন অঞ্চল ও শহর তাঁর শাসনাধীনে চলে আসল। এককালে মিসরের অধীনস্ত জুডিয়াকে তিনি আবারও হস্তগত করার চেষ্টা করলেন। হেরোদ শাসিত জুডিয়ার অনেক অংশ তিনি এন্টনির বদান্যতায় মিসরের অন্তর্গত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু পার্থিয়ায় এন্টনির পরাজয়ে ক্লিওপেট্রার সকল স্বপ্ন বৃথা গেল। এন্টনির পরাজয় ক্লিওপেট্রার জন্যও ছিল একটি মহাবিপর্যয়।

এন্টনির ব্যর্থতা অক্টেভিয়ানের রোমান সাম্রাজ্যের একক অধিপতি হওয়ার সম্ভাবনাকে জোরদার করে তোলে। ক্লিওপেট্রা, এন্টনির উপপত্নী হিসেবে অক্টেভিয়ানের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলেন। এন্টনির সাথে অক্টেভিয়ানের সম্পর্কের অবনতির অন্যতম কারণ ছিল অক্টেভিয়ানের বোনকে অপমান ও অপদস্ত করে এন্টনির ক্লিওপেট্রার সাথে সম্পর্কে চালিয়ে যাওয়া। এন্টনি পার্থিয়া থেকে সিরিয়ায় ফেরার পরে তাঁর স্ত্রী রোম থেকে এথেন্সে ফিরে আসলেন। কিন্তু তাঁর ভাইয়ের প্রতিশ্রতি ভঙ্গের ঘটনায় ক্ষিপ্ত এন্টনি স্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়ে রোমে ফিরে যেতে বলে অপমানের চূড়ান্ত করলেন। পরবর্তী তিন বছর এন্টনি তার রাজধানী কখনও আলেকজান্দ্রিয়ায়, কখনও সিরিয়ার এন্টিয়কে স্থাপন করেছিলেন। এ সময় তিনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গ ছাড়েননি। এ সময়ে এন্টনি আর্মেনিয়ায় সফল অভিযান চালিয়েছিলেন এবং মিডিয়ার আনুগত্য লাভ করেছিলেন।

৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্মেনিয়া থেকে আলেকজান্দ্রিয়ায় ফিরে বিজয় উৎসব পালন করতে গিয়ে এন্টনি রোমানদের ধর্মীয় রীতি ভঙ্গ করেন। কিছু দিন পরে আরেকটি অনুষ্ঠানে এন্টনি, ক্লিওপেট্রা ও তাঁর সন্তানদের জন্য রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা দান করলেন।এসব খবর রোমে পৌঁছলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ক্লিওপেট্রা রোমের শত্রুতে পরিণত হন। ক্লিওপেট্রা বিরোধী নানা গুজব ও কাহিনীও রোমে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অমূলক ও অসত্য কাহিনীও পল্লবীত হয়ে ওঠে রোমবাসীদের মুখে মুখে। ৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অক্টেভিয়ানের সাথে এন্টনির দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২ সালের মে অথবা জুন মাসে এন্টনি, অক্টেভিয়ানের বোন অক্টেভিয়াকে ডিভোর্স করেন। এ বছরেও এন্টনি ও ক্লিওপেট্রা একসাথে সময় কাটিয়েছেন তুরস্ক ও এথেন্সে। এন্টনির রাজত্বে ক্লিওপেট্রা রাণীর মতই আচরণ করতেন, বিদেশী অতিথির মত নয়। এ বছরের শেষ দিকে অক্টেভিয়ান ক্লিওপেট্রাকে পরিত্যাগ করার শেষ অনুরোধ জানান এন্টনিকে। এন্টনি এ প্রস্তাবকে পাত্তাই দিলেন না।

ফলে শীঘ্রই অক্টেভিয়ান আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্লিওপেট্রাকে রোমের শত্রু ঘোষণা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আর শত্রুর সাথে মিত্রতার কারণে আইনিভাবে এন্টনিও শত্রুতে পরিণত হলেন। ক্লিওপেট্রার গর্ভে সিজার ও এন্টনির সন্তান জন্ম নেওয়ায় ভবিষ্যতে এরা রোমান সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বের দাবিদার হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছিল। এন্টনির সাথে যেভাবে ক্লিওপেট্রা একীভূত হয়ে গিয়েছিলেন তাতে এন্টনি শাসিত রোমান সাম্রাজ্য ও মিসরের যৌথ নেতৃত্ব ক্লিওপেট্রা ও তাঁর সন্তানদের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। এমনকি এন্টনি নাকি রোমান রীতি ভঙ্গ করে আলেকজান্দ্রিয়ায় সমাহিত হওয়ার ইচ্ছাও তাঁর দলিলে ব্যক্ত করেছিলেন। এতে আলেকজান্দ্রিয়া রোমের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্ধী এমনকি ভবিষ্যতে রোমান সাম্রাজ্য আলেকজান্দ্রিয়ার অধীনে চলে যাওয়ারও আশংকা দেখা দিয়েছিল। অক্টেভিয়ান রোমবাসীদের অনেককেই বোঝাতে সফল হয়েছিলেন যে আলেকজান্দ্রিয়া রোমের জন্য হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। তাই ক্লিওপেট্রাকে সিনেটের মাধ্যমে শত্রু ঘোষণা করা তাঁর জন্য সহজ হয়েছিল।

তখনও পর্যন্ত সিনেট প্রতি বছর দুজন কনসাল ও টিবিউনরা নিযুক্ত হচ্ছিলেন। পাঁচ বছরের ত্রয়ী শাসনের বৈধতার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে অক্টেভিয়ান ও এন্টনি কনসালদের অধীন সেনানায়কে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু রোমান সিনেটের ক্ষমতা খুবই সংকুচিত হয়ে পড়েছিল সেনানায়কদের দাপটের কাছে। কনসালদের কেউ এন্টনির পক্ষে, আবার কেউ অক্টেভিয়ানের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করতেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালের বসন্তকালে অক্টেভিয়ানের নৌবাহিনী এন্টনির নৌবাহিনীকে আক্রমণ করে। এতে এন্টনির নৌবহরের বিরাট একটি অংশ ধ্বংস হয়। ইউরোপের উপকূলবর্তী এন্টনির শক্তিশালী নৌঘাঁটিগুলো একে একে পরাজিত হয় অক্টেভিয়ানের নৌবাহিনীর শক্তিশালী আক্রমণের কাছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালের ২ সেপ্টেম্বর অ্যাকটিয়াসের নৌঘাঁটির যুদ্ধে এন্টনি ও ক্লিওপেট্রার যৌথ নৌবহর শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এন্টনি ও ক্লিওপেট্রা ২৩০টি জাহাজের মধ্যে মাত্র ৬০টি জাহাজ নিয়ে মিসরে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। গ্রিস অক্টেভিয়ানের বশ্যতা স্বীকার করে। ক্লিওপেট্রা ও এন্টনির স্থলবাহিনী উত্তর গ্রিসে আত্মসর্মপন করে। ক্লিওপেট্রা আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে নতুন সৈন্যবাহিনী সংগ্রহের জন্য ধনসম্পদ কাজে লাগান। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর গর্ভজাত কথিত সিজারের পুত্র সিজারিয়ান ও এন্টনির পুত্র এন্টিলাসকে অক্টেভিয়ান ভবিষ্যতের বিপদ গণ্য করেন। এ দুজনের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৬ ও ১৪ বছর। এ দুজনকে নিরাপদ করার জন্য তিনি ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ভারতের সঙ্গে তখন মিসরের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে সিরিয়ার রোমান গভর্নর, অক্টেভিয়ানের পক্ষে যোগদান করেন। এমনকি জুডিয়ার রাজা হেরোদও অক্টেভিয়ানের সাথে আপস করেন। ক্লিওপেট্রা ও হেরোদ মনেপ্রাণে শত্র“তে পরিণত হয়েছিলেন। ক্লিওপেট্রা তাঁর পূর্ব পুরুষদের দ্বারা শাসিত জুডিয়াকে মিসরের অংশ বলে বিশ্বাস করতেন। জুডিয়াকে আবারও মিসরের অংশে পরিণত করার জন্য এন্টনিকে রাজি করাতে তিনি হেন কোন প্রচেষ্টা বাকি রাখেননি। কিন্তু এন্টনি বারবার সামরিক সাহায্যের জন্য হেরোদের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। তারপরেও ক্লিওপেট্রা এন্টনির ঘাড়ে ভর করে হেরোদকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে প্রচেষ্টায় কোন ত্র“টি রাখেননি। হেরোদকে জুডিয়ার স্বাধীন রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন পম্পেই ও সিজার। হেরোদের সহায়তায় অক্টেভিয়ান নীল নদের ব-দ্বীপ এলাকার মিসরীয় শহর পেলুসিয়াম জয় করে আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে এগিয়ে যান।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালের ১১ আগষ্ট আলেকজান্দ্রিয়ার উপকণ্ঠে অক্টেভিয়ানের বাহিনীর কাছে এন্টনির নৌ ও অশ্বারোহী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পদাতিক বাহিনীও যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যায়। বিনা বাধায় অক্টেভিয়ান আলেকজান্দ্রিয়া দখল করে নেন। এরপরে এন্টনি ও ক্লিওপেট্রার জীবনাবসানের করুণ ইতিহাস নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে সকল কাহিনী থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় তাঁরা উভয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। ক্লিওপেট্রা ও এন্টনির আত্মহত্যার করুণ ঘটনাটি ইতিহাসের অন্যতম নাটকীয় অধ্যায়। শোনা যায়, এন্টনির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অক্টেভিয়ান কেঁদেছিলেন। ক্ষমতা নিয়ে হাজারও সংঘাতের পরেও হয়ত অক্টেভিয়ান ভুলতে পারেননি, এন্টনি ছিলেন তাঁর পালক পিতা জুলিয়াস সিজারের অকৃত্রিম বন্ধু ও সহকর্মী এবং ত্রয়ী শাসক হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর নিজেরও সহকর্মী। এছাড়াও বিচ্ছেদ হলেও তো তিনি একসময়ে ছিলেন বোনের স্বামী।

এন্টনির মৃত্যুর কয়েকদিন পরে ১২ আগস্ট ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেছিলেন। জানা যায় অক্টেভিয়ান নাকি ক্লিওপেট্রার করুণ মৃত্যু চাননি। তিনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গেঁ সাক্ষাৎ করে তাঁকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সাক্ষাৎকালে ক্লিওপেট্রা অক্টেভিয়ানের স্ত্রী ও বোনের জন্য নাকি উপহার পাঠাবার আগ্রহও প্রকাশ করেছিলেন। অক্টেভিয়ানের বোনকে তিনি একদা এন্টনির কাছ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। তবে ক্লিওপেট্রা এন্টনির শোক হয়ত ভুলতে পারেন নি। তাই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন। অক্টোভিয়ানের উদারতার কারণ হয়ত ছিল তিনি আশংকা করেছিলেন ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যার সাথে তাঁর মূল্যবান ধনসম্পদ আগুনে পুড়িয়ে ফেলবেন। ক্লিওপেট্রার ধনসম্পদ হস্তগত করার উদ্দেশ্যেই তিনি মিসর দখল করেছিলেন। তাঁর উদারতার ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায় না।

প্রাচীন কাহিনীকার ডিয়ো ক্যাসিয়াস জানান, ক্লিওপেট্রা কিভাবে মারা যান তা কেউ জানে না। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর ৭৫ বছর পর জন্মগ্রহণকারি গ্রিক ইতিহাসবিদ প্লুতার্ক বিভিন্ন কাহিনীর কথা উল্লেখ করেন। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে তিনিও কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেননি। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর আগেই অক্টেভিয়ান আলেকজান্দ্রিয়ায় নিজেকে মিসরের অধীশ্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। টলেমি বংশের শাসনের প্রায় তিনশ বছর শেষে মিসর তার স্বাধীন সত্ত্বা স¤পূর্ণভাবে হারাল। অক্টেভিয়ান মিসরকে একটি রোমান প্রদেশে পরিণত করেন। ক্লিওপেট্রা তাঁর পুত্রদেরকে তাদের শিক্ষকদের সাথে ভারতের পথে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পুত্র সিজারিয়ন তাঁর শিক্ষক রোডেনের পরামর্শে কিছুদুর যাওয়ার পরে আবার আলেকজান্দ্রিয়ায় ফিরে আসে। অপর পূত্র এন্টিলাসের শিক্ষক থিওডোরাস তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। অক্টোভিয়ানের নির্দেশে দুই পুত্রকেই ধরে এনে হত্যা করা হয়। এন্টিলাস ছাড়া এন্টনির অন্যান্য তিন স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া ৭ সন্তানকে অক্টেভিয়ান রোমে নিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মতই লালন পালন করেছিলেন।

অক্টেভিয়ান রোমের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মিসরকে সিনেটের শাসনাধীনে না রেখে সরাসরি নিজের শাসনাধীনে রাখেন। অক্টেভিয়ান ছিলেন জুলিয়াস সিজারের বোন প্রথম জুলিয়ার পৌত্র। সিজার পোষ্যপুত্র হিসবে তাকেই উত্তরাধিকারি মনোনীত করেছিলেন। ক্লিওপেট্রার গর্ভজাত সিজারিয়ন জুলিয়াস সিজারের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও সে বিদেশী হওয়ায় রোমান আইন অনুযায়ী তাকে সিজার উত্তরাধিকারি হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন নি। সিজারিয়নকে হত্যা করে অক্টেভিয়ান আরও নিশ্চিন্ত হন। অক্টেভিয়ান রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রলেতারিয়ানদের নেতা ট্রিবিউন সেটারনিনাসের পরাজিত হওয়ার পর শুরু হওয়া রোমান গৃহযুদ্ধ টানা ৭০ বছর ধরে চলার পর অক্টেভিয়ানের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাময়িকভাবে বিরত হয়। প্রায় পাঁচশ বছরের পুরোনো রোমান প্রজাতন্ত্রও বিলুপ্ত হয় স্থায়ী সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে।

খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে রোমান সিনেট অক্টোভিয়ানকে ‘অগাস্টাস’ অর্থাৎ ‘পবিত্র ব্যক্তি’ উপাধিতে ভূষিত করে। তখন থেকে তিনি অগাস্টাস সিজার হিসেবে পরিচিত হন। গেইয়ান অক্টোভিয়ান থেকে অগাস্টাস সিজারে পরিণত হয়ে তিনি রোমান সম্রাট হয়ে বসলেন। ৫০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান রাজতন্ত্রের পতনের পরে অগাস্টাস সিজারই প্রথম রোমান সম্রাট হয়ে দেখা দেন। সিনেট প্রজাতন্ত্রের কার্যকারিতা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। রাজতন্ত্রী শাসনে আবারও বাঁধা পড়ে রোমান সাম্রাজ্য। থেকে যায় পাঁচশ বছরের প্রজাতন্ত্রী সিনেট শাসনের ইতিহাস।

(পরবর্তী পোস্টে বাকী অংশ পড়ুন)

লেখক: আসিফ আযহার, শিক্ষার্থি, ইংরেজি বিভাগ, শা.বি.প্র.বি.
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৮
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×