দারূল উলূম দেওবন্দ ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত একটি বিশ্বখ্যাত ধর্মীয় শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান । বর্তমানে এটি একসময়কার জগতখ্যাত ইসলামী গবেষনা প্রতিষ্ঠান '' আল-আযহার '' এর ভূমিকা পালন করছে। এই প্রতিষ্ঠান টি সূচনা লগ্ন থেকে মান্ সম্মত ও সুন্নত তরিকা মোতাবেক শিক্ষা প্রদান করে আসছে। যুগে যুগে এই মাদ্রাসাটি পেয়েছে আশ্রাফ আলি থানভি,আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি, মাহমুদ হাসান, রশিদ আহমেদ গাঙ্গুহির মত নামকরা শিক্ষক ও ইসলামী গবেষককে ।বর্তমানে বাংলাদেশের হাট হাজারি, জামেয়া রহমানিয়া, পাকিস্তানের দারূল উলুম করাচি, যুক্তরাজ্যের ডুইসবারে, দক্ষিন আফ্রিকা এমনকি আমেরিকা মহাদশেও এই মাদ্রাসাটির শিক্ষাপদ্ধতির আলোকে মাদ্রাসা ও ইসলামী গবেষনা প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। কিন্তু এই মাদ্রাসাটির শুরুর ইতিহাস অনেকেরই অজানা। আর অনেকেই জেনেও না জানার ভান করেএই মাদ্রসাটি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করছেন। বর্তমানে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়েছে, যার টার্গেট হল কওমী মাদ্রাসা, দাওয়াত ও তাবলীগ ও হক্কানী পীর মাশায়েখ দের সম্পর্কে খারাপ ধারনা ছড়ানো। বাংলাদেশি হাজিদের তারা এই সম্বলিত ফ্রি সিডি ও বিতরন করেছে। এই ভন্ডদের প্রধান হাতিয়ার হল ডঃ জাকির নায়েক, যিনি নিজেই সুন্নত অনুযায়ী পোশাক পড়তে লজ্জা পান। তাই দেওবন্দ সম্পর্কে আমার ছোট লেখার পসরা ।
আমরা যদি উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই, মুঘল আমলে এই উপমহাদেশে ১২ লক্ষ মাদ্রাসা ছিল। এগুলোর ব্যয়ভার জনগন বা সরকার কেউ করত না। প্রত্যেক মাদ্রাসার নিজস্ব ওয়াকফকৃত জমি ছিল। তাই মাদ্রাসাগুলো ছিল স্বয়ংসম্পুর্ণ। ইংরেজ বেনিয়ারা ভারতীয় উপমহাদেশ দখলের পর এই ১২ লক্ষ মাদ্রাসার ওয়াকফ জমি বাজেয়াপ্ত করে দেয়। তখন মোল্লা মাজেদুদ্দিন নামের এক বুজুর্গকে সাথে নিয়ে কিছু লোক কলকাতার ছেলেদের দ্বীন শিক্ষার সুযোগকরে দেয়ার জন্য ইংরেজ সরকারকে অনুরোধ জানায়। ১৭৮১ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস এর সময় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার উদ্বোধন হয়। পরবর্তিতে শাহ আব্দুল আজিজ (রহঃ ) এর ইংরেজ বিরোধী ফতোয়া আর কাসেম নানুতুবী (রহঃ) এর স্বাধীনতা আন্দোলন ঘোষনার কারনে সমগ্র উপমহাদেশে আজাদি আন্দোলন শুরু হয় ।এতে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অনেক ছাত্রে অংশ নেয়। স্বভাবতই ইংরেজরা এতে নাখোশ হয়। তারা তখন এই আলিয়া মাদ্রাসাটির বারোটা বাজানোর ব্যবস্থা করে। ইংরেজ সরকার মাদ্রাসাটির ৩ টি ক্ষতি করে।
১। ইংরেজ্রা কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় একটানা ২৬ জন খ্রিষ্টান প্রিন্সিপাল নিয়োগ করে।
২। ছাত্রদের মাদ্রাসায় পঠিত সিলেবাস থেকে তফসিরে বাইযাবি ও মিশকাত শরিফকে অর্থাৎ কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ দুটিকে বাদ দেয়।
৩। ইংরেজ সরকার ঘোষনা করে শুধুমাত্র ইংরেজি শিক্ষিত লোকেরাই শিক্ষিত,বাকি অন্য ভাষায় শিক্ষা গ্রহণকারীরা সবাই অচল। এতে করে আলিয়া মাদ্রাসাটির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল। এটি আর মাদ্রাসা হিসেবে আগের মত অবস্থায় থাকল না। তখন ই মাওলানা কাসেম নানুতুবি (রহঃ) মাদ্রাসাশিক্ষার সংস্কার এ এগিয়ে আসেন। তখন এই কাজের সাথে জড়িত ছিলেন আরো কয়েকজন প্রখ্যাত আলেম। তাদেরই একজন মাওলানা শাহ রফিউদ্দিন (রহঃ) রাসূল (সাঃ ) এর স্বপ্ন দর্শণ লাভ করেন। রাসূল (সাঃ) তার লাঠি মোবারক দিয়ে এই মাদ্রাসাটির সীমারেখাটি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার বর্ণনা ইসলামী ফাউন্ডেশন এর অনুবাদকৃত '' তারিখে দেওবন্দ'' বইয়ের শুরুতেই আছে। তাই বলা যায় দেওবন্দ প্রতিষ্ঠায় বাহ্যিক প্রতিষ্ঠাতা কাসেম নানুতূবি হলেও এর আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠাতা রাসুলে আকরাম (সাঃ )। কাসেম নানূতুবি রহঃ ১৮৬৬ সালে এই মাদ্রাসাটির গোড়াপত্তন করেন । তখন থেকেই কওম বা জনগনের টাকায় কওমী মাদ্রসার গোড়াপত্তন।
কাসেম নানূতুবি (রহঃ ) এর পরিচয় ঃ অনেকেই তার সম্পর্কে না জেনে তাকে নিয়ে বিভিন্ন খারাপ মন্তব্য লেখে। কিন্তু তারা কি জানে আজ উপমহাদেশে ইসলামী আকিদা, আচার ,কৃষ্টি টিকে আছে কার বদৌলতে? পূর্ব বর্তী বুজুর্গদের সমালোচনা করা মানে আমাদের দীর্ঘ ইসলামী ইতিহাসকেই অস্বীকার করা। কাসেম নানূতুবি (রহঃ ) জন্মগত দিক দিয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ ) এর বংশধর । আর শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি মামলুক আলী (রহঃ ) এর ছাত্র। আবার মামলুক আলী (রহঃ ) শাহ আব্দুল আজিজ (রহঃ ) এর ছাত্র ছিলেন । শাহ আব্দুল আজিজ এর উস্তাদ ছিলেন শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রহঃ )।
কাসেম নানূতুবির রাজনৈতিক পরিচয়ঃ তিনি ১৮৫৭ সালে সিপাহি জনতার বিদ্রোহের সময় '' শামেলির ময়দানে '' সেনাপতি ছিলেন।
তথ্যসুত্র ঃ তারিখে দেওবন্দ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
মাওলানা নূরুল ইসলাম অলীপূরি সাহেবের বয়ান ( মিরপুর -১৪ ,জামেউল উলুম মাদ্রাসায় , ২০০৯ সাল ) ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:৪৩