‘সার্চিং ফর শত্রুজ’ নামক প্রত্যয়ের জনক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক; ২৬শে মার্চ ২০০৪ সালে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন প্রত্যেকটা দলকে আইনগত এবং আইন বহির্ভূত সাহায্য সহযোগীতা করার জন্যে র্যাবের জন্ম হয়! যা র্যাবের মূল লক্ষ্য ছিলো না কখনোই। কিতাবি আইনে তাদের মূল লক্ষ্য হলো, জনগনের সেবা করা। কিন্তু তা হয়নি। যার ফলে দেখা যায় বিরোধীদলগুলো সবসময় এর বিরোধীতা করে থাকে। আর ক্ষমতায় গেলে নিজেদের বিরোধীতার কথা বেমালুম ভূলে যায়। ২০০৪ সালে বিএনপির আমলে র্যাবের সৃষ্টি এবং কর্মকান্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেছিলো আওয়ামীলীগ। সেই একই কাহিনী করেছে বিএনপি ২০১৪ সালে এসে।
র্যাবের অন্যতম স্লোগান হচ্ছে ‘War Against Terrorism.’ কিন্তু তারাই ‘Crossfire’ ‘Extrajudicial Killing’ ‘State Terrorism’ নামের নেগেটিভ তকমাগুলো নিজেদের আত্মার সাথে জড়িয়ে নিয়েছে। নির্দ্বিধায় খুন করেছে মানুষকে। সে যতো বড় সন্ত্রাসীই হোক বাংলাদেশের সংবিধান কখনোই বিচার বহির্ভূত এসব ক্রস ফায়ার নামক হত্যাকে সমর্থন করে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে-
• আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। (অনুচ্ছেদ ৩১)
• আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না। (অনুচ্ছেদ ৩২)
• ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হইবেন। (অনুচ্ছেদ ৩৫ এর গ)
র্যাব, চিতা, কোবরার জন্ম সমসাময়িক হলেও এরকম প্রতিষ্ঠানের বাপ-দাদার ইতিহাস বেশ পুরানো। ১৯৭২ সালে জন্ম নেয়া ‘জাতীয় রক্ষী বাহিনী’ স্টেট টেরোরিজমে অংশ নিয়ে সুনাম(!) কুড়াতে সক্ষম হয়েছিলো। সুতরাং বাঙালীকে দমিয়ে রাখার জন্যে; ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার জন্যে; সরকারের হাতিয়ার হিসেবে র্যাবের মতো বাহিনীর বিকল্প নেই। হিউম্যান রাইটস নিয়ে যতো বুলিই আওড়ানো হোক না কেন।
২০০৫ সালের মার্চ মাসে আওয়ামীলীগ র্যাবে বিরোধীতা করে বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে নিউজ লেটার পাঠায়। যা ছিলো নিম্নরুপ-
These forces have been given so much power and authority that they have blatantly disregarded constitutional provisions, human rights laws, as well as court law. Almost every day they are catching people on different false charges and are brutally murdering them, covering it by calling it ‘crossfire deaths.’
এরপর আওয়ামীলীগ নির্বাচনী ইশতেহারে ডিসেম্বর ২০০৮ সালে ঘোষণা করে যে, যদি তারা ক্ষমতায় আসে তাহলে এরকম আইন বহির্ভূত খুন বন্ধ করা হবে। তাদের ক্ষমতায় আসার প্রায় সাত বছর হতে চললেও কথা রাখেনি তারা। আসলে কেউ কথা রাখে না! বিএনপি থেকে আওয়ামীলীগ; রাজনৈতিক চরিত্রের দিক থেকে বাহ্যিকতা আলাদা হলেও, ক্ষমতা আকড়ে ধরার দিক থেকে তারা মাসতুতো ভাই।
মার্চ ২০১০ সালে এক ব্রিফিংয়ে র্যাব স্বীকার করে তাদের হাতে ক্রসফায়ারে মারা গেছে ৬২২ জন। এর একবছর পর ২০১১ সালে অধিকার নামক একটি সংগঠণ র্যাবের খুন সংখ্যাকে ৭৩২ জন বলে প্রকাশ করে। গড়ে প্রায় প্রতিবছর র্যাবের হাতে খুন হয় বাংলাদেশের ৮৭ জন নাগরিক। এ সংখ্যাটা তো তাদের স্বীকার্য্য শুধুমাত্র। আর যেটা অন্তরালে থেকে যায় তার হিসেব রাখার লোক কোথায়?
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারীতে বলেন, ‘আইন বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সেটা তো আর এক রাতেই করা সম্ভব নয়!’ এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কি র্যাব এমন শক্তিতে রুপান্তর হয়েছে যাকে নির্মূল করতে গেলে সরকারকেও কয়েকবার ভাবতে হয়? যদি তাই হয় তবে কিছুই করার নেই। টিউমার এখন ক্যান্সারে রুপান্তরিত হয়েছে। আর মানবাধিকার এখানে লিউকেমিয়া আক্রান্ত।
গতকাল রাতেও দুইজন অজ্ঞাতনামা যুবক রামপুরায় র্যাবের সাথে বন্ধুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে। র্যাব অজ্ঞাতনামা যুবকদের কিভাবে চিনলো তারা সন্ত্রাসী? যদি বুঝতেই পারলো সন্ত্রাসী তবে তাদের আধুনিক কার্য্যাবলী দিয়ে কেন খুজে বের করতে পারলো না যুবক দুটোর পরিচয়? আর সন্ত্রাসী হলেই কি খুন করতে হবে? যদি তাই হয় তবে আপনি অথবা আমি যেকোন দিন তাদের সন্দেহের তালিকায় খুন হয়ে যেতে পারি। লিমনকে যেভাবে পঙ্গু বানানো হয়েছিল সেভাবে।
ভাবতে খুব কষ্ট হয়, আমার সোনার বাংলায় র্যাব নামক প্রানীরা ‘ভাইস সিটি’ গেমের মতো যে কাউকে খুন করতে পারেন! এখানে ক্রসফায়ার নামক গেমে কেউ তাঁদের হারাতে পারে না! এ যেনো আট নাম্বার বিস্ময়। শেষ প্রশ্ন, এতো যে ক্রসফায়ার হয় র্যাব মরেছে বলে তো শুনি না; তবে তারা কি সুপার হিউম্যান? স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান, কৃষের মতো।
ছবিঃ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান রাইটস।