আরাফাত আল মাসুদ
মিতু আপুকে নিয়ে লেখা গল্পটি আজ ছাপা হয়ে গেল। দৈনিক পত্রিকাটির সাহিত্য পাতায় বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে গল্পটি। নতুন লেখক হিসেবে আমার তো এখন আনন্দে নাচার কথা। কিন্তু তার বদলে লজ্জা, অনুশোচনা আর বিবেকের তীব্র কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে উঠছে আমার সমস্ত সত্ত্বা। যদি এই মুহূর্তে পত্রিকাটির সাহিত্য পাতার সবগুলো কপি পুড়িয়ে ফেলতে পারতাম, তাহলে এই লজ্জা আর অনুশোচনা হতে আমার জর্জরিত মন কিছুটা রেহাই পেতে পারত। তা তো আর সম্ভব না। আমার বিক্ষত মন কোনোরকমে দেহটাকে টানতে টানতে হেঁটে চলেছে হাতে পত্রিকাটি নিয়ে। বাড়ির পথে।
বাড়ি ফিরব আমি? যেতে পারব? পা দুটো অবশ হয়ে আসছে যেন। এই আমাদের বাড়ি ফেরার পথ। শহরের খুব কাছেই আমাদের বাড়ি। পেছনে নাগরিক কোলাহল। সামনে সবুজ গ্রাম। । বাবা এখানে বাড়ি করেছেন বছর পনের ষোল আগে।ছিমছাম ছায়া কুটির। কতো আনন্দ ,উচ্ছ্বাস কতো ছোট ছোট এলোমেলো অনুভবে স্মৃতিতে আমার ভিতরটা উজ্জ্বল করে রেখেছে। এর বেশিরভাগটাই মিতু আপুকে ঘিরে। মিতু আপুদের বাড়ি আমাদের পাশেই । আমাদের আরও আগে থেকেই এখানে। মিতু আপুর ছোট ভাইটা খুব কম বয়সেই মারা যায়। আমার মতই নাকি ছিল দেখতে। তাই আমিই হয়ে উঠি তার আপন ভাই। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও। আমিও তাকে বোনের মতই ভালবাসতাম। তবে মিতু আপু আমাকে ভালবাসত তার চেয়েও বেশি।
পথে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালাম। আচ্ছা, মিতু আপু কি করছে এখন? সকালের কাজ শেষ করে বাইরে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে পত্রিকা কেনার জন্য? ধক করে উঠল আমার ভিতরটা। আজ তাকে নিয়ে আমার গল্পটি ছাপা হবে, জানে। একটা উৎসব উৎসব অনুভুতি নিয়ে বাজারে আসবে হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যে। আমার আর হাঁটতে ভাললাগছেনা। কোথায় যাব আমি? কোথায়? কিছুক্ষণ না হয় দাঁড়িয়ে থাকি এই শুন্য মাঠে। ছোটবেলায় এভাবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে মিতু আপু পেছন থেকে হঠাৎ চুল ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলত, ‘একেবারে কবি হয়ে গেলি নাকি’! বলেই হাসত। ‘কবিরা এভাবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে বুঝি’? ‘হ্যাঁ। আর তখন আমার মত বড় বোনেরা এসে ওদের চুল টেনে দেয়। কান মলে দেয়’। ‘ধুর, বানিয়ে বলছ তুমি’। শুনে মিতু আপু হাসত। ‘বোকা ছেলে’।
মিতু আপুর সাথে আর আগের মতো সময় কাটানো হয় না। অনেকদিন। বয়সের ব্যবধান পাঁচ’ছ বছর আমাদের । অথচ আমাদের দিনগুলো কেটেছে বন্ধুর মত। সেই যে আমাদের সোনামাখা দিনগুলি। উঠোনে বসে লুডু খেলা। ছিপ ফেলে পুকুরে মাছ ধরা একসাথে।রাতে বসে টি ভি দেখা। মাঝে মাঝে ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। যেন আমরা অপু দুর্গা। মিতু আপুর কাছে আমি থাকলেই মা নিশ্চিন্ত থাকতেন। আমার প্রতি মিতু আপুর পরিবারের সবার ভালবাসা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক মনে হত। এ যেন আমার প্রাপ্যই।
অনেকদিন আর আগের মত হয় না। ‘খুব বড় হয়ে গেছিস না’? মিতু আপুর কণ্ঠে অনুযোগ। ‘এখন তো সবসময়ই খুব ব্যস্ত তুই। ভার্সিটি থেকে বাড়ি আসলেও তোর সময় হয়না’। আসলেই। মিতু আপুকে আগের মত সময় দেয়া হত না।এখন অনেক বন্ধু আমার। মুখে বলতাম, ‘প্রতিশোধ নিচ্ছি বুঝলে’। মিতু আপু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাতো।‘ কিসের প্রতিশোধ’? ‘কেন, আমাকে একা করে চলে যাও নি। তোমার বর তো আসতেই দিত না। এত বেশি ভালবাসত যে তার বউএর যে একটা নেওটা ভাই আছে তা কি আর মনে থাকত’। মিতু আপু হাসত না। দীর্ঘশ্বাস ফেলত। ‘হ্যাঁ। ভালবাসত হয়ত। তাই তো আর সইলনা’। আমি চুপ হয়ে যেতাম। কেন যে বলতে গেলাম!আমায় চুপ দেখে মিতু আপু হেসে দিত। ‘তুই আবার মন খারাপ করে ফেললি নাকি। আরে আমার কোন কষ্ট নেই,বুঝলি। কষ্ট হবে কেন। তোর মত ভাই আছে না পাশে’।
তাই!ওসব মনে হতেই আমার দুচোখ জলে ভিজে উঠল আজ । বুকের ভিতরটা শীতের এই শুন্য মাঠের মতই ফাঁকা। কতক্ষণ আর বসে থাকব এখানে। এখানে বসে থাকলেই তো আর সব বদলে দেয়া যাবেনা। উঠে দাঁড়ালাম।আচ্ছা, যদি গিয়ে বলি আজ গল্পটি ছাপা হয়নি, মিতু আপু কি বিশ্বাস করবে? কি সব পাগলের মত ভাবছি। এভাবে সত্য লুকানো যায়? তাকে নিয়ে লেখা একটা গল্প ছাপার অক্ষরে দেখার খুব শখ তার অনেক দিনের। ‘তুই তো এখন লেখালেখি করিস। লিখনা তোর এই বোনটাকে নিয়ে একটা গল্প’। ‘আমি যা লিখি তা কি একটা লেখা!’ ‘কেনরে। আমার তো খুব ভাল লাগে। কী সহজ করে কত গভীর সব কথা। ঐ তোর একটা গল্পের নায়িকা সুপ্তি। কম বয়সে বুড়ো এক দোজবরের সঙ্গে বিয়ে হয়, গল্পটা খুব লেগেছে জানিস। লিখনা আমায় নিয়ে অমন একটা’।
আমারও খুব ইচ্ছা হত মিতু আপুকে নিয়ে লিখি। তার জীবন নিয়ে। কলেজে পড়া অবস্থায় তার বাবা মারা যাওয়া, পড়া বন্ধ করে বিয়ের পিড়িতে বসা, বছর তিন না ঘুরতেই আবারও ফিরে আসা অসুস্থ মার কাছে। বিধবা হয়ে। একটা গল্প লেখা যেত এ নিয়ে।অনেক আবেগ ভরা হৃদয়স্পর্শী। নাড়া দিত পাঠককে। কিন্তু না! সময় ডাকাতের মত এসে আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পালালো।
শুধু নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে আজ। তবু যদি শান্তি পাওয়া যেত। ভিতরটা শুধু আরও ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। আচ্ছা কেন এমন করলাম আমি। আমার প্রতি যার অগাধ বিশ্বাস আমি কেন তার প্রতি বিশ্বাস হারালাম। কেন বিশ্বাস করলাম তার বিরুদ্ধে উঠা চরিত্রহীনতার অভিযোগ। গত দু মাসে যা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কেন বিশ্বাস করলাম? তাকে অনেক শ্রদ্ধা করতাম বলে? হঠাৎ করে চারপাশের মুখরোচক কথায় সেই দেবীর আসন টলটলায়মান হয়ে গেছে তাই? নাকি আমি পুরুষ বলে? কিন্তু মিতু আপু তো জানে না আমি তাকে অবিশ্বাস করেছি। কখনও বিশ্বাসই করবে না তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা কিভাবে ধীরে ধীরে ঘৃণায় রূপ নিয়েছিল নিকটজনদের কথায়। কোনোদিন যে এ নিয়ে তাকে কিছু বলিনি।বলতে ইচ্ছা হয়নি। মিতু আপুও কিছু বলেনি। হয়ত ভেবেছেন, সারা দুনিয়া বিশ্বাস করলেও তার এই ভাই তা করবে না। তার সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হওয়াকে ধরে নিয়েছেন আমার ব্যস্ততা বলে। ‘হ্যাঁ ,তোর তো সামনে পরীক্ষা। মন দিয়ে পড়। আর শোন, গল্পটা কি এ সপ্তাহেই আসছে?’ফোনে তার উৎসুক জিজ্ঞাসা গল্পটির জন্য। অথচ কাল বাড়ি এসেও আমি দেখা করিনি তার সাথে। কিন্তু এই কী সেই গল্প! এইই! এ যে তার প্রতি বিশ্বাস হারানোর পর লিখা। তার প্রতি আমার ভিতর ফেনিয়ে উঠা ঘৃণার বিষ উগরে দিয়ে রচনা করা।এ গল্পে আমার সেই মমতাময়ী বোনটি নেই,গল্পের মিতু চরিত্রটি এক চরিত্রহীনা নারী, রওনকের তৈরি করা অপবাদের আদলে। অথচ এই গতরাত ,গতরাতেই জানলাম ওসব মিথ্যা। রওনক, আমার বন্ধু ভাবতেই ঘৃণা লাগছে এ অপবাদ ছড়িয়েছিল তার বিদেশ যাবার আগে। কাল বিদেশে বসে ফোনে কথায় কথায় অকপটে স্বীকার করার পর ওকে খুন করতে ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু তার আগে কি আমার নিজেরই নিজেকে খুন করা উচিত না? মিতু আপুকে বিশ্বাস করিনি। করেছি রওনকের নাটকীয় উপস্থাপনকে। ওর হীন উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার প্রতিশোধ যে এটা কেন আগে ভাবতে চায়নি? কেন আর সবার মত আমিও ? হাহ! সব হারিয়ে ফেলেছি আমি ।স-ব।আস্থা। বিশ্বাস। ভালবাসা। স--ব। স----ব।
মিতু আপু, তুমি কি আমায় ক্ষমা করবে? ছোট্ট বেলায় কোন অন্যায় করলে মুখ ভার করে তোমার পাশে গিয়ে বসতাম। আর তুমি জড়িয়ে ধরে আদর করে দিতে।‘আমার লক্ষ্মী ভাই। আবার কাঁদতে আছে! কি খাবি বল? পায়েস করি তোর জন্য?’ তার অচিনলোকে হারিয়ে যাওয়া ভাইকে খুঁজে ফিরত আমার মাঝে। অথচ আমি! আমার এ অপরাধের কি কোন ক্ষমা আছে? মিতু আপু, তোমায় আমি ভালবাসতাম ঠিকই। তবে তোমার মত করে পারিনি। কিন্তু আজ যে তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসতে ইচ্ছা করছে। খুব বেশি করে।
টলতে টলতে কোন রকমে হেঁটে আসলাম। পরাজিত এক কাপুরুষের মত। বাড়ির কাছে এসেই দেখি মিতু আপু হাসিমুখে দাড়িয়ে। সাথে তার পরিচিত আরও কয়েকজন। ‘কিরে এত দেরী করলি কেন?কখন থেকে তোর অপেক্ষায় আমরা বসে আছি’। ‘আমার জন্য! কেন?’ ‘ কেন আবার।পত্রিকার জন্য। আমি জানি তো তুই পত্রিকা নিয়েই আসবি। এই দেখ, ওদের সবাইকে ডেকে এনেছি। ওদের সবাইকে শোনাবো গল্পটা। দে তো পত্রিকাটি’। আমার পৃথিবী যেন দুলে উঠল। ‘না মানে- মিতু আপু, তোমার সাথে আমার কথা ছিল’। ‘আচ্ছা পড়ে শুনব, আগে দে তো’। মিতু আপু এক ঝটকায় পত্রিকাটি কেড়ে নিয়ে ভিতরের রুমে চলে গেল।।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১৭