আরাফাত আল মাসুদ
আবদুর রাহমান এতটা তীব্রভাবে ফিরে আসলেন যে সবার অন্তরাত্না যেন কেঁপে উঠল। অথচ এতদিন তাঁর নিরুদ্দেশ হওয়াটা কারো কাছে কোন গুরুত্বই পায়নি। পাবার কথাও নয়। ঘরের এক কোনায় পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয় পুরোনো আসবাবের মতই ছিলেন সবার কাছে।
আবদুর রাহমান নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন মাসখানেক আগে। এক রাতে অফিস থেকে আর বাসায় ফেরেন নি। বাসায় স্ত্রী আছে। দুই সন্তান আছে। ছেলে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ছে। মেয়ে ইন্টারমিডিয়েটে। এরকম কন্ডিশনে বাসায় অন্তত বিষয়টা গুরুত্ব পাবার কথা ছিল। পায়নি। থেকেও অনেকটা না থাকার মত ছিলেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি হলেও করুনা, বিরক্তি আর অশান্তির কারণ ছিলেন আপাদমস্তক নির্ভেজাল, সহজসরল এই লোকটি। আর সবকিছু নীরবে মেনে নেবার আশ্চর্য ক্ষমতাও ছিল লোকটার। প্রতিদিন বাসায় ফেরার পর স্ত্রীর একরাশ অভাব অভিযোগের তীব্র বাক্যবাণে বিদ্ধ হওয়া এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে কোনদিন এর ব্যত্যয় ঘটলেই তার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকতো এবং কেমন জানি ভয়ভয়ও করতো। আবার স্ত্রীর মন ভাল বলে তার সাথে কিছু মধুর আলাপন জুড়বেন সেই সাহসও হত না। সেই অস্বাভাবিক দিনে তিনি কী করবেন তাই তাকে অস্থির করে তুলতো।
ছেলেমেয়েদের কাছেও তাঁর বাবা হিসেবে আলাদা কোন জায়গা ছিল না। বাবার কাছে চেয়ে কোনকিছু পাওয়া যায়! না তা দেবার ক্ষমতা তার আছে! ছেলেমেয়েদের কাছে বাবার চাইতে বড় মামার কদর অনেক বেশি। যা দেয় বড় মামাই তো। ছেলের প্রাইভেট ভার্সিটির খরচ চালাচ্ছেন কে? তার বড় মামাই। দু ভাইবোনের আহ্লাদি জিনিস চাই। বড় মামা ছাড়া আর কে দেবে? বাসায় আবদুর রাহমানের এই সম্বন্ধি মাঝেমাঝে আসেন। এসে স্ত্রী আর ছেলেমেয়ের সামনেই তাঁকে বকাঝকা করেন। তার বোনের জীবনটা আবদুর রাহমানের জন্য নষ্ট হয়েছে বলে প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। আবদুর রাহমান কোন সাপোর্ট পেতেন না। তাঁর স্ত্রীর কাছে তা ‘বেশ জব্দ হয়েছে’ বলে মনে হত। ছেলেমেয়েদের চেহারায় এতটাই ভাবলেশহীনতা প্রকাশ পেত যেন জগৎ সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পারলৌকিক মুক্তির পানে নিজেদের তারা নিবেদিত করেছে। কোন বিশেষ মুহুর্তে বাবার জন্য মেয়ের মনটা হয়তো খচখচ করতো। তবে তা করুনা কি ভালবাসা তা বোঝার বা ভাবার অতখানি সময়বা কোথায়! তবে স্ত্রী, ছেলের কাছে তিনি সবসময়ের জন্যই এক বোরিং পার্সন।
অশান্তি অবশ্য অফিসেও কম ছিল না। উর্ধ্বতনদের বকাঝকা আর সহকর্মীদের ঠাট্টা উপহাস স্ত্রীর প্রতিদিনকার তীব্র বাক্যবাণের মতই নিত্যনৈমিত্তিক ছিল। গোবেচারা টাইপের হলে যা হয়, তাকে কাজ করতে হত বেশি। উর্ধ্বতনদের চাপিয়ে দেয়া কাজ, কখোনোবা সহকর্মীরাও এটাসেটা বুঝিয়ে চাপিয়ে দিত। কৌশলে যে এড়িয়ে যাবেন, আবদুর রাহমানের বুদ্ধিতে তা কুলোতো না। তাই নিরাপদ থাকার একটাই উপায়, নীরবে মেনে নেয়া। সভ্যতার পুরোনো মরচে পড়া এই পদ্ধতি অনুসরণ না করে তাঁর উপায় ছিল না। তাকে ছাড়া কারো চলে না, তবু কতটা গুরুত্বহীন সবার কাছে! অফিসের কারো জন্মদিন বা কোনো উপলক্ষ্যে খুব একটা দাওয়াত পেতেন না আবদুর রাহমান। পেলেও যেন তা বলার জন্য বলা। নিমন্ত্রনে তিনি আসলেন কিনা তা কারো খেয়ালেই পড়তো না। কখোনো সেই সামান্য নিমন্ত্রনেই হাজির হলেও কারো কারো মুখ টেপা উপহাস বা অকারণ বিরক্তির পাত্র হতেন। তাঁর পোশাক-পরিধান, চাল-চলন আর লাজুক ও নিরীহভাব সহকর্মীদের কাছে দারুন বিনোদনের বিষয় ছিল। অবশ্য কারো কারো যে আবদুর রাহমানের প্রতি সহানুভূতি ছিল না তা নয়। তবে তা অতটা গভীর নয় যে, কোন ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। আর কেইবা এমন মেন্দামারা গোবেচারার পক্ষ নিয়ে অন্যদের শত্রু হতে যাবে।
সত্যি বলতে আবদুর রাহমানের কাছের বলতে কেউই ছিল না। তাঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার রাত বাসার কারো নজরেই আসে নি। ছেলে বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গেছে। ফোনে মায়ের সাথে কথা হয়। বাবা কোথায় আছে কী করছে কখোনই তার জিজ্ঞেস করা হয় না। মেয়ে আছে ফেসবুকিং নিয়ে। এছাড়া ঋতু বদলের মত নতুন নতুন বয়ফ্রেন্ডের সাথে তার দৈনিক ফোনে বা ডেটিংয়ে এতটা সময় কেটে যায় যে ঘরের কোথায় কে কী করছে না করছে এ নিয়ে ভাবার ফুসরত তার হয় না বলতে গেলে। স্ত্রীর টিভি সিরিয়াল পর্ব শেষ করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস। স্বামীর জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করার অপমানজনক চিন্তা কখোনো কল্পনাও করতে পারেন না তিনি। বস্তুত এ পরিবারের কেউই খাবার টেবিলে কারো জন্য অপেক্ষা করে না। প্রত্যেকেই এখানে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করে।
তবে পরের দিন অফিস থেকে ফোন আসার পর বাসার সবাই বুঝতে পারে রাতে ফেরেননি আবদুর রাহমান। স্ত্রীর দুশ্চিন্তা হবার বদলে প্রথমে বিরক্তিই ধরে। তারপর এর ওর কাছে ফোন দেয়। কিছু সময়ের মধ্যে বাসায় তার বড় ভাইসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয় এসে ভীড় করে। তাঁর বড় ভাইয়েরও প্রথমে ভগ্নিপতির উপর রাগ হয়। যেন বোনকে কষ্ট দেবার জন্য ইচ্ছা করেই তিনি বাসায় ফেরেন নি। তারপর এখানে সেখানে খোঁজখবর লাগান। আবদুর রাহমানের দেখা মেলে না।
তবে তৃতীয় দিন আবদুর রাহমানের খোঁজ মেলে হাসপাতালের মর্গে। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আবদুর রাহমানের গায়ের শার্টের সাথে ও আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যাওয়া বিকৃত মুখের এক লাশকে তাঁর মৃতদেহ বলে সনাক্ত করতে ভুল হয় না কারো। স্ত্রীর চোখের কোনে দুফোটা অশ্রু জমে। ছেলেমেয়েদেরও। আবদুর রাহমানের জন্য যা এক পরম প্রাপ্তি। নিজ চোখে দেখতে পেলে আজ অস্থিরতার চরমে উঠত তাঁর মন। বাসায় বিষণ্নভাব জুড়ে থাকে দিনভর। তবে পরদিন থেকে পৃথিবী নিজের নিয়মে স্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করে।
তবে ওই পরদিন থেকেই আবদুর রাহমান নয়, তাঁর রেখে যাওয়া বিমার টাকা উঠে আসে আলোচনায় । এবং খুব দ্রুতই সবার অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের মনে হতে থাকে তাঁর তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা ভালই হয়েছে। নয়তো এই বিমার টাকার জন্য আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হত। এখন মৃত্যুকালীন বিমার মোটা অঙ্কের টাকা এখনই নিজ নিজ একাউন্টে জমা হবে ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠেন তারা। এ নিয়ে পরিবারে কয়েকদিন আলোচনা হয়। কথা কাটাকাটি, চিল্লাচিল্লি হয় ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। রাগ করে ছেলে এক রাতে বাসা থেকে চলেও যায়। অবশ্য পরদিন আবার ফিরে আসে। স্ত্রী তার ভাইয়ের সাথে ও আবদুর রাহমানের এক কলিগের সাথে এনিয়ে কথা বলেন। ওই কলিগের সাথে আরো আগ থেকেই এক ধরণের ঘনিষ্ঠতা ছিল আবদুর রাহমানের স্ত্রীর। তা কতদূর গভীরে গিয়েছে তার তল খুঁজে পাওয়া আবদুর রাহমানের মত বেঁটে শরীরের মোটা মাথার লোকের বোঝার কথা নয়। সেই কলিগ আবার আবদুর রাহমানের সম্বন্ধিরও শ্বশুর পক্ষের আত্মীয়। সেই প্রসঙ্গ থাক। এখন মূল বিষয় হল, ছেলেমেয়েদের হাতে অত টাকা তুলে দিতে চান না আবদুর রাহমানের স্ত্রী। নাবালক ছেলেমেয়ে দুইদিনেই উড়িয়ে শেষ করে দেবে বলে তার ভয়। এক্ষেত্রে সেতারের সুক্ষ্ম তারের মত চিকন বুদ্ধিসম্পন্ন সেই কলিগ আবদুর রাহমানের পরিবারের উদ্ভুত সমস্যার সুন্দর এক সমাধানে এগিয়ে আসেন। সঙ্গে ছেলেমেয়েদের মামা।
সেদিন সন্ধ্যায় আবদুর রাহমানের বাসায় এক বৈঠকে বসেছিল তাঁর স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা, তাদের মামা ও সেই কলিগ। কলিগ আবদুর রাহমানের ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর নেন। ছেলের তার বন্ধুদের সাথে একটা অনলাইন বিজনেস করার প্লানের কথা শুনে ওর বুদ্ধির তারিফ করেন। এক্ষেত্রে তার মায়ের বাধা দেয়াকে নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করে ছেলেকে উৎসাহিত করা উচিত বলে জানান এবং ছেলের মামার দিকে তাকিয়ে তাঁর সম্মতি আদায় করেন। মেয়ের মডেলিং করতে চাওয়ারও প্রশংসা করেন। এক্ষেত্রে তাঁর এক বন্ধু যার কিনা ধানমন্ডিতে একটা অ্যাড ফার্ম আছে, তার সাথে কথা বলবেন বলে জানান। এটা সেটা আলাপের পর আসে বিমার টাকার প্রসংগ। ছেলেমেয়েদের জানান, তাদের বাবা তার কাছ থেকে একবার লাখ দশেক টাকা নিয়েছিলেন গ্রামে জমি কেনার জন্য। কাগজপত্র করা হয়নি। আর দরকারইবা কী। নিজেদের লোকই তো। তবে বিষয়টা জানতেন ওদের মা। তাদের মামাও। ওই টাকা বাদে বাকি টাকার কিভাবে সুষ্ঠু ব্যাবহার হবে তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। ছেলের বিজনেসের জন্য বেশিরভাগটা তাকে দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা তখন তুঙ্গে। ঠিক ওই মুহুর্তে দরজা নকের শব্দ হলো। কাজের মেয়ে দরজা খোলার পর টলতে টলতে ঘরে যিনি প্রবেশ করলেন, তাঁকে দেখে সবাই ভূত দেখার মতই চমকে উঠলেন। সিনেমায় এমনটা হয়। এপরিবারের সদস্যরা যা হিন্দি ও কলকাতার ছবিতে বহুবার উপভোগ করে থাকবেন। কিন্তু আজকের এই পরিস্থিতি তাদের অন্তরাত্মা যেন কাঁপিয়ে দিল। মেয়েই প্রথমে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘বাবা তুমি!’ ‘হ্যারে মা। কোনরকমে বেঁচে ফিরলাম। সব বলছি। আগে এক গ্লাস পানি দিতে পারবি মা?’ পানি আনার বদলে মেয়ে বজ্রাহতের মত দাড়িয়ে রইল। সাথে অন্যরাও। তারা বুঝতে পারছেন না, এই আবদুর রাহমানকে নিয়ে তারা কী করবেন?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৩৭