বর্ষা যাই যাই করছে। কোরবানীর ঈদ আসন্ন। তার আগেই পরিকল্পনা গোছানো শেষ। ঠিক করেছি এবারের বান্দরবান ট্যুরে আন্ধারমানিক পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করবো। এ যাত্রায় নবগঠিত ফেসবুক গ্রুপ ভ্রমতির ৩ সদস্যের (বাবু, মঞ্জু, জামাল) সাথে যুক্ত হলো ব্যাংকার মুরাদ আর ডাক্তার সাকিব। সহযাত্রী আছেন সম্মানিত তিন বড়ভাই- তারেক, রুবেল ও জহির। এই তিন সাংবাদিকের প্ররোচনায় শেষ পর্যন্ত ৮ জনের দায়িত্ব ভাগ হলো। রুবেল ভাইয়ের রুট প্ল্যান অনুযায়ী আন্ধারমানিকের অনুমতি না মিললে আমরা ঢুকবো থানচির রেমাক্রি হয়ে বেরোবো তিন দিনে যেখান দিয়ে পারি। সুতরাং ট্রেকিং হবে প্রচুর, হাই এক্সপেডিশনের জন্য প্রস্তুত সবাই। তাবু যোগাড় হলো জামালের বদৌলতে। বাজার সদাইয়ের দায়িত্ব জহির ভাইয়ের, টিকিট এবং যাতায়াত তারেক ভাই। বাকিরা তৈরি অনুসঙ্গ যোগাড়ে। ১১ সেপ্টেম্বর রাতে শুরু হলো বর্ষায় পাহাড় জয়ের অভিযান।
পথের সব প্রতিবন্ধকতা পেরোনো গেছে স্বাচ্ছন্দ্যে। বাসও নামিয়ে দিয়েছে সময়মত। থানচিতে তৈরি ছিল আমার পূর্ব পরিচিত গাইড আর ইঞ্জিন বোট। থানচির একমাত্র সাংবাদিক অনুপম দা জানালেন, আন্ধারমানিকের অনুমতি বন্ধ। বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি দল পাহাড়ের নিচের দিকে অবস্থান করছে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া না যাওয়ার পরামর্শ তার। সুতরাং আমাদের প্ল্যান ‘বি’ নিয়ে এগোতে হলো। বিজিবি আর পুলিশের অনুমতি পর্বে ঝক্কি পোহাতে হলো কিছুটা। অবশেষে দুপুর নাগাদ ২টা বোট নিয়ে রেমাক্রির দিকে রওয়ানা।
পথে তিন্দুর বর্ননাতীত পাথুরে মুগ্ধতা।
সাঙ্গুর স্রোতে একরকম রাফটিংও হয়ে গেল অভিযাত্রীদের। তখনও কি জানতাম এই আমুদে অভিজ্ঞতা একসময় কতটা পোড়াবে আমাদের?
রওয়ানা হয়েছিলাম খটখটে রোদে পুড়ে,রেমাক্রি বাজারে পৌছার আগেই ঝুম বৃষ্টি জানান দিল আগামী ক’টা দিন কেমন হতে পারে আবহাওয়া। বর্ষায় পাহাড়ের মর্জি মেনেই কাকভেজা হয়ে জুমের ভাত আর মুরগির মাংস ঝোলে সারলাম খাবারের আনুষ্ঠানিকতা। নেহায়েত ভ্রমন উদ্দেশ হলে রেমাক্রি খালের মুখে বসেই পুরো একটা দিন কাটিয়ে দেয়া যেত। যেহেতু আমাদের নির্দিষ্ট সময়ে রুট কাভার করতে হবে তাই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম রেমাক্রি খাল ধরে উজানে। হাঁটা পথে আমাদের গন্তব্য বিকেলের মধ্যে নাফাখুম পৌঁছানো। হাঁটাপথে ঝিরিপথের সৌন্দর্য আর পিচ্ছিল বোল্ডারগুলো পেছনে ফেলাম আমরা সহসাই। দেরি হয়ে যাবে বলে খুব একটা থামলাম না তেনেদং পাড়ায়। কেননা রাতে তাবু ফেলার লক্ষ্য ঠিক হয়েছে নাফাখুমের পরের পাড়াটিতে। তাই সবাইকে বললাম- পা চালাও। চললো সবার সমান তালে। প্রায় ৩ ঘণ্টা পর আমরা এলাম নাফাখুম। শীতে এ পথে চলা বেশ আরামদায়ক। বর্ষায় পিচ্ছিল ।আর বাড়ন্ত আগাছা ধীরগতি আনতে বাধ্য।তবে এত কষ্টের পর বর্ষায় নাফার রূপে মুগ্ধ আমরা অপলক।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সারাদিন দারুন ধকল গেছে। এ পথে একমাত্র জনপদ মারমাদের উহ্লা চিং পাড়া। নাফা থেকে সেখানে পৌঁছতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগলো। ততক্ষণে চারপাশে ঘন অন্ধকার নেমেছে। জুমের মৌসুম তাই পাড়াটি একপ্রকার মানুষ শুন্য। সবাই গেছে জুমের ফসল পাহাড়ায় কিংবা তোলায়। আমরা উঠলাম হেডম্যানের বাড়িতে। চুলা জ্বালিয়ে একদল বসে গেল রান্নায়। এক্ষেত্রে আমাদের বহন করা চিকন চাল, ডিম, ডাল ইত্যাদি চুলায় চাপানোর দায় পড়লো রাঁধুনি মুরাদের উপর। বাকিরা গোসল সেরে তাবু খাটালো।এতদূরে এসেও খিচুরী রান্না হলো মনের মত। সুস্বাদু। প্লেট নেই তাই কলাপাতা সংগ্রহে নামলাম আমি আর জামাল। অগত্যা ভোজন । আহা সাধু। রাতে তাবুতে ঢুকতেই টের পেলাম সারাদিনের ক্লান্তির সাথে চোষক, জোঁকের কামড় আর কাটা গুল্মের খোঁচার জ্বালা। তারউপর হেডম্যানের বাড়ি থেকে দেয়া কম্বলের ছাড়পোকা। দুই তাবুতে ৮ জন গাঁদাগাদি আর গরমে থাকতে না পেরে তিন মুরুব্বি ঘুমাতে গেল বাড়ির ভেতরে। তাবুতে রইলাম ৫ জন। এক্ষেত্রে মশা তাড়ানোর ক্রিম ওডোমাস মেখে শুয়ে পড়তেই সউন্ড স্লিপ।
ঘূম ভাঙলো ছাগল, শুকর আর শিশুদের চেঁচামেচিতে। খাবার ছাড়াই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আজ অনেকটা পথ হাটতে হবে বলে। আর বেলা বাড়লে লাল পাহাড়গুলোতে চলা খুবই কষ্টকর। সুতরাং আবারো হাটা। ঠিক করলাম পথে সাথে আনা শুকনো রুটি আর বিস্কুটের সাথে ট্যাং দিয়ে নাস্তা হবে। দুই ঘণ্টার এ পথে আমরা চাইলে থামতে পারতাম ঐহ্লাওয়া পাড়ায়। কিন্তু সময় বাঁচাতে আবারো হাটা। কেননা আমাদের গন্তব্য সকাল ১১ টার মধ্যে জিনা পাড়া। পারলাম না। সময় নষ্ট করলো সূর্যের প্রখর তাপ। ত্রিপুরাদের বসবাস জিনা পাড়ায় পৌছে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরোতে বেরোতে বেজে গেল ২ টা। গাইডের হিসাবে এখন রওয়ানা দিলে অমিয়খুম, সাতভাইখুম দেখে রাত ৮ টার মধ্যে ফিরে আসা যাবে। আবারও বৈরি আবহাওয়ায় দিলাম হাটা। প্রচণ্ড গরম, একটু হাঁটতেই হাপিয়ে উঠছে সবাই। জিনা পাড়ার উপরেই থুইস্যা পাড়ায় এখন থেকে কেবলই উপরে ওঠা। কাজেই এ পাড়া থেকে পানি ও শুকনো কিছু খাবার সংগ্রহ করে নিলাম। দেখলাম খিয়াংদের ছোট্ট এই পাড়ায় বিজিবি’র আউট পোস্ট আছে একটা।ঘর আছে হাতে গোনা ৮ পরিবার। গাইডের তাড়ায় তাড়াহুড়োয় হাটা দিলাম। লক্ষ্য পরবর্তী লোকালয় ত্রিপুরাদের আতিরাম পাড়া। ভরদুপুরে এ পথে খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠানামা করতে হলো বেশ কবার। আতিরাম পাড়ার আগেই দুটি পাহাড় ডিঙ্গিয়ে রণেভঙ্গ দিল বডি বিল্ডার জামাল, ইনজুর জহির ভাই, ক্লান্ত রুবেল ভাই আর সদ্য ডাক্তারি পাশ করে পাহাড়ের মজা নিতে আসা সাকিব। হারাধনের বাকি ৪ ছেলে অবিচল অমিয়খুম জয়ব্রতে। প্রচণ্ড গরমে একেকটি পাহাড় পার হচ্ছি আর গাইডকে জিজ্ঞাসা করছি- জয় আর কয়টা পাহাড় আছে? জয়ের নির্বিকার উত্তর এইতো আর দুইটা। কিন্তু আতিরাম পাড়া পার হওয়ার পর দেখলাম চারটি পাহাড় এরইমধ্যে ডিঙ্গিয়েছি আমরা। আর থানচির এদিকটায় যারা গেছেন তারা তো জানেনই পাহাড়ের সাইজ, মাশাল্লাহ। শেষ বিকালে বুঝলাম বৃষ্টি আসছে। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই পথে যদি বৃষ্টি হয় রাতে ফিরবো কী করে? বর্ষায় আগাছা বেড়ে যাওয়ায় এ পথে আর কেউ আসেনি অনেকদিন। বুঝলাম, ট্রেইল সহজ নয়। ঝোপঝাড় কেটে এগোতে হচ্ছে পাহাড়ের এদিকটায়। একসময় বুঝে গেলাম গাইড পথ হারিয়েছে। ত্রিশ মিনিট ঘুরপাক খেয়ে গয়ালের চোখ রাঙানি দেখে নামতে থাকলাম নাম না জানা একটা পাহাড়ের গা বেয়ে। প্রায় ২০ মিনিট নামতে দুশ্চিন্তা আরেক দফা ঘিরে ধরলো, উঠবো কী করে? পা তো এখনই চলছে না । তারেক ভাই অভয় দিয়ে চলেছেন, আরে আমি যদি ৪৩ বছর বয়সে পারি তোমরা পারবা না? এভাবে কয়েক দফা নামা ওঠা আর বুনো ঝোপ পেছনে ফেলে শব্দ শুনলাম অমিয়খুমের। একসময় চোখের সামনে দেখলাম পাথুরে দেয়াল আর বিছানায় পানির নির্মল বয়ে চলার হাজারবর্ষী অবিরতা। অমিয়খুম, অমিয়কুম কিংবা হামিয়াখুম। এই তো !!! পাশেই দেয়াল ঘেঁষে বয়ে চলা পানির স্রোত ধরে এগিয়ে গেলে সাতভাইখুম। দেরি করতে পালাম না।উঠিপড়ি করে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। আমিয়খুমের পেছন দিকের একটা ট্রেইল্আছে। দেখলাম ওই পথে রুমা, কেওক্রাডং, জাদিপাই হয়ে দুই জনের্একটা দল রেমাক্রির উদ্দেশে এসেছে। এতক্ষণে আকাশ কালো করে সন্ধ্যার ঝুম নেমেছে চারদিকে। ভয়ঙ্কর পাহাড়ের পাদদেশে এবার খাড়া ওঠার পালা। এই পাহাড়টা আনুমানিক ৭৫ ডিগ্রি খাড়া। বৃষ্টিতে পিচ্ছিল পাহাড়ে উঠতে সময় লাগলো নামার তিনগুন। ততক্ষণে ঘন অন্ধকার নেমেছে চারদিকে। টর্চের আলোয় ট্রেকিং চললো অবর্ননীয় কষ্টে। কীভাবে ঘোরের মধ্যে আতিরাম পাড়া পর্যন্ত এসেছি বলতে পারবো না। সাপ, জোক বন্যপ্রাণীর ভয় ততক্ষণে উবে গেছে।
রাত ৯ টা নাগাদ পৌঁছলাম বেস ক্যাম্প- জিনা পাড়ায়। কথা বলার শক্তিটুকু নেই ততক্ষণে ৪ জনের মুখে। স্মৃতিতে কেবলই তিন্দুর মসৃন ইঞ্জিন বোটের আরামদায়ক ভ্রমনের স্মৃতি। ভাবছি পুরো পথটা এমন হলো না কেন? খেয়েদেয়ে ওডোমাস মেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন গন্তব্য পাহাড় এড়িয়ে ঝিরিপথ ধরে তিন্দু।
সকালে প্রকৃতির সাথে কিছুক্ষণ আর খিচুরীর আপ্যায়ন নিয়ে পুরো দিন হাটার প্ল্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবার যাচ্ছি ঝিরিপথ দিয়ে। তুলনামূলক আরামদায়ক, কিন্তু ওই যে পাহাড়ের দেশে পাহাড় এড়িয়ে যাবেন কোন পথে। এ পথেও পাহাড় পেরোতে হলো অন্তত ৭টি। সাথে জোঁক আর বুনো লতার আচ্ছাদন। সত্যিই অপূর্ব ঝিরিপথ। একে স্থানীয়রা বলে পদ্মমুখ ঝিরি। এ পথে প্রায় ৯ ঘণ্টা হেটে আমরা পৌছলাম তিন্দুর একটি গ্রামের নিচে। পথে জুলু পাড়া পড়লেও সেখানে থামিনি সময় নষ্টের ভয়ে। শুধু চোখের দেখা আর হায় হ্যালো। তাও মানুষের বসবাস আর পাড়াটি চোখে পড়েছে একদম শেষ দিকে এসে। অবশেষে পদ্মমুখ থেকে একটি ইঞ্জিন বোট নিয়ে ত্রিশ মিনিটে থানচি বাজারে। ততক্ষণে সন্ধ্যা এবং যথারীতি ঝুম বৃষ্টি। সেদিন আর বান্দরবান শহরে ফেরা গেল না,থাকতে হলো থানচি রেস্ট হাউজে। পরদিন সকাল ৬ টায় মেঘের লুকোচুরি দেখতে দেখতে বান্দরবান শহরে।
আলোচিত ব্লগ
চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়
অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?
অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন
ঘুষের ধর্ম নাই
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।
হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।
পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update
মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-
গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??
সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন