somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুঘল সাম্রাজ্য এর ইতিহাস (পর্ব ১)

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মুঘল সাম্রাজ্য ছিল ভারত উপমহাদেশের একটি সাম্রাজ্য।ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলজুড়ে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। মুঘল সাম্রাজ্য পারস্যের ভাষায় শিল্প এবং সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল।পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহিম লোদির বিরুদ্ধে বাবরের জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কি মঙ্গোল বংশোদ্ভূত। তারা চাগতাই খান ও তৈমুরের মাধ্যমে নিজেদের চেঙ্গিস খানের বংশধর বলে দাবি করতেন। ১৫৫৬ সালে আকবরের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রুপদি যুগ শুরু হয়। আকবর এবং তার ছেলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতি বহুদূর অগ্রসর হয়। আকবর অনেক হিন্দু রাজপুত রাজ্যের সাথে মিত্রতা করেন। কিছু রাজপুত রাজ্য উত্তর পশ্চিম ভারতে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারি রাখে কিন্তু আকবর তাদের বশীভূত করতে সক্ষম হন। মুঘল সম্রাটরা মুসলিম ছিলেন তবে জীবনের শেষের দিকে শুধুমাত্র সম্রাট আকবর ও তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর নতুন ধর্ম দীন-ই-ইলাহির অনুসরণ করতেন।

মুঘল সাম্রাজ্য স্থানীয় সমাজে হস্তক্ষেপ করত না তবে প্রশাসনিকভাবে এসববের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হত।অনেক বেশি কাঠামোগত কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুঘল শাসনামলে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন মারাঠা, রাজপুত ও শিখরা সামরিক শক্তি অর্জন করেন।শাহজাহানের যুগে মুঘল স্থাপত্য এর স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। তিনি অনেক স্মৃতিসৌধ, মসজিদ, দুর্গ নির্মাণ করেন যার মধ্যে রয়েছে আগ্রার তাজমহল, মোতি মসজিদ, লালকেল্লা, দিল্লি জামে মসজিদ। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছায়। শিবাজী ভোসলের অধীনে মারাঠাদের আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের অবনতি শুরু হতে থাকে। আওরঙ্গজেবের সময় দক্ষিণ ভারত জয়ের মাধ্যমে ৩.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। সেসময় সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিয়নের বেশি যা তৎকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ এবং জিডিপি ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি।

১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগ নাগাদ মারাঠারা মুঘল সেনাবাহিনীর বিপক্ষে সফলতা লাভ করে এবং দক্ষিণাত্য থেকে বাংলা পর্যন্ত বেশ কিছু মুঘল প্রদেশে বিজয়ী হন। সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সৃষ্টি হয় যার ফলে বিভিন্ন প্রদেশ কার্যত স্বাধীন হয়ে পড়ে। ১৭৩৯ সালে কারনালের যুদ্ধে নাদির শাহের বাহিনীর কাছে মুঘলরা পরাজিত হয়। সেসময় দিল্লি লুন্ঠিত হয়। পরের শতাব্দীতে মুঘল শক্তি ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়ে পড়ে এবং শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কর্তৃত্ব শুধু শাহজাহানাবাদ শহরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সিপাহী বিদ্রোহের সমর্থনে তিনি একটি ফরমান জারি করেছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহীতার অভিযোগ এনে কারাবন্দী করে। শেষে তিনি রেঙ্গুনে নির্বাসিত হন এবং সেখানেই মারা যান।সমসাময়িকরা বাবরের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে তিমুরি সাম্রাজ্য বলে উল্লেখ করেছেন যা মুঘলরা নিজেরাও ব্যবহার করত।আইন-ই-আকবরিতে হিন্দুস্তান নামটি উল্লেখ রয়েছে। পাশ্চাত্যে মুঘল শব্দটি সম্রাট ও বৃহৎ অর্থে সাম্রাজ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হত।মঙ্গোল শব্দের আরবি এবং ফারসি অপভ্রংশ থেকে মুঘল শব্দটি এসেছে। তবে বাবরের পূর্বপুরুষরা সাবেক মঙ্গোলদের চেয়ে ফারসি সংস্কৃতি দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিলেন।


কুতুব মিনারের শীর্ষ দুই তলা সিকান্দার লোদি মার্বেল দিয়ে পুনর্নির্মাণ করেন।
সিকান্দার লোদি
সিকান্দার লোদি ছিলেন দিল্লির লোদি বংশীয় সুলতান। তার পিতা বাহলুল খান লোদির মৃত্যুর পর তিনি সুলতান হন। লোদি রাজবংশের সবচেয়ে সফল শাসক হওয়ার পাশাপাশি তিনি ফারসি ভাষার একজন কবিও ছিলেন। তিনি ৯০০০ পংতির দিওয়ান রচনা করেছিলেন।
সিকান্দার লোদি ছিলেন সুলতান বাহলুল খান লোদির পুত্র। তার মা ছিলেন সিরহিন্দের একজন হিন্দু স্বর্ণকারের কন্যা। পিতার দিক থেকে তিনি পশতুন বংশোদ্ভূত।

পিতার মৃত্যুর পর সিকান্দার লোদি সুলতান হন। ক্ষমতায় আরোহণের সময় তাকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কারণ তার প্রতি পিতা বাহলুল লোদির মনোনয়ন সত্ত্বেও তার বড় ভাই জাওনপুরের আঞ্চলিক শাসক বারবাক শাহ ক্ষমতা দাবি করেন। তবে ব্যাপক রক্তপাত ছাড়াই সিকান্দার লোদি ক্ষমতা গ্রহণে সফল হন এবং তার ভাইকে জাওনপুরে শাসন চালানোর অনুমতি দেন। চাচা আলম খানের বিরোধও তিনি মিটিয়ে ফেলেন।সিকান্দার লোদি সফল শাসক ছিলেন। তার সময় বাণিজ্যের উন্নতি হয়। তিনি লোদিদের শাসিত অঞ্চল গোয়ালিওর ও বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সাথে সিকান্দার লোদি সন্ধি করেছিলেন। ১৫০৩ সালে আগ্রা শহর নির্মাণের জন্য তিনি অনুমোদন দেন।গুলরুখি ছদ্মনামে সিকান্দার লোদি ফারসি কবিতা চর্চা করতেন। তিনি হিসাবরক্ষণে আলাদা পদ্ধতির সূচনা করেন। বিচার ও কৃষিকাজে তিনি বিশেষ যত্ন নেন এবং আবাদি জমি পরিমাপের ক্ষেত্রে গাজিয়ে সিকান্দারি নামক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। হিসাবরক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি ফারসি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

গোয়ালিওর দুর্গ জয়ের জন্য সিকান্দার লোদি প্রচেষ্টা চালান এবং তাতে পাঁচবার আক্রমণ করেন। তবে প্রতিবার তিনি ব্যর্থ হন। আগ্রাকে তিনি দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন। দিল্লি থেকে গোয়ালিওর পৌছাতে দীর্ঘ সময় লাগা এর কারণ হিসেবে কাজ করেছে। সিকান্দার লোদির সময় আগ্রা ভারতের শিরাজ বলে ক্ষেত ছিল। চূড়ান্ত পর্যায়ে গোয়ালিওরের কাছে নারোয়ার নামক ক্ষুদ্র অঞ্চল তিনি আক্রমণ করেন এবং নারোয়ার দুর্গ ১১ মাস ধরে অবরোধ করে রাখা হয়। তারপর খাদ্য শেষ হয়ে গেলে দুর্গ সিকান্দার লোদির কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর তিনি আবার গোয়ালিওর আক্রমণ করেন। তবে এবারও তিনি ব্যর্থ হন।১৫১৭ সালে সিকান্দার লোদি মৃত্যুবরণ করেন। দিল্লির লোদি উদ্যানে তাকে দাফন করা হয়।


ইবরাহিম লোদি
ইবরাহিম লোদি ছিলেন লোদি রাজবংশের শেষ সুলতান। ১৫১৭ সালে তার পিতা সিকান্দার লোদির মৃত্যুর পর তিনি সুলতান হন। পানিপথের যুদ্ধে তার পরাজয় এবং নিহত হওয়ার ফলে লোদি রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে।

ইবরাহিম লোদি জাতিতে পশতুন ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতায় আসেন। তবে শাসনকাজে তিনি দক্ষ ছিলেন না। তার সময় বেশ কিছু বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। মেবারের শাসক রানা সংগ্রাম সিং উত্তর প্রদেশের পশ্চিম পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তার করেছিলেন এবং আগ্রায় হামলার হুমকি সৃষ্টি করেন। তাছাড়াও পূর্বাঞ্চলেও বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। পুরনো এবং জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের স্থলে তার প্রতি অণুগত অপেক্ষাকৃত তরুণদের নিয়োগ করায় ইবরাহিম লোদির প্রতি অভিজাত শ্রেণীও অসন্তুষ্ট ছিল। সেসময় তার আফগান অভিজাতরা বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানায়। ১৫২৬ সালে বাবরের মুঘল সেনাবাহিনী ইবরাহিম লোদির বৃহৎ আকারের সেনাবাহিনীকে পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত করে। যুদ্ধে ইবরাহিম লোদি নিহত হন।পানিপথের তহশিল অফিসের কাছে ইবরাহিম লোদির মাজার অবস্থিত। এর কাছে বু আলি শাহ কালান্দারের দরগাহ রয়েছে। লোদি উদ্যানের শিশ গম্বুজকে অনেকে তার মাজার ভেবে ভুল করে।


সম্ভলে অভিযান প্রেরণের পূর্বে ইবরাহিম লোদির দরবারে অনুষ্ঠান।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১২:০১
৮টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×