somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরে দেখা ২১শে ফেব্রুয়ারির কিছু কবিতার জন্মকথা

১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি কবিতাটি ভাষা আন্দোলন নিয়ে লিখিত প্রথম কবিতা। এই জন্য কবিতাটিকে একুশের প্রথম কবিতাও বলা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কবিতাটি রচনা করেন ভাষাসৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী।১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষনের খবর শুনে সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে বসে কবিতাটি রচনা করেন ভাষাসৈনিক কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। একুশের এই কবিতার সাথে মিশে আছে অনেক আত্মত্যাগের ইতিহাস।


যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে
তাদের জন্য আমি ফাঁসি দাবি করছি।
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্য
ফাঁসি দাবী করছি।
ফাঁসি দাবী করছি যারা এই মৃতদেহের ওপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।
আমি তাদের বিচার দেখতে চাই
খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তিপ্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।

ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে,রসনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য, বাংলার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য, রমেশ শীলের গাঁথার জন্য
জসীমউদ্দীনের সোজন বাঁধিয়ার ঘাটের জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি বাউল কীর্তন গজল
নজরুলের ‘খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি’।

হে আমার মৃত ভাইরা,
সেইদিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার
ভেসে আসবে
সেইদিন আমাদের দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।

বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
-শামসুর রাহমান

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের পুত প্রদেশের শ্যামলিমা
তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সর্বদাই।
কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে শিউলী-শৈশবে
'পাখি সব করে রব' বলে মদনমোহন তর্কালঙ্কার
কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক।
তুমি আর আমি অবিচ্ছিন্ন পরষ্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁর নেচে নেচে, যেখানে কুসুমকলি সবই ফোটে
জোটে অলি ঋতুর সংকেতে।
আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গড়ে পলে পলে,
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে আমারই বন্দরে।
গলিত কাঁচের মতো জলে ফাৎ না দেখে দেখে
রঙিন মাছের আশায় ছিপ ধরে কেটে গেছে বেলা।
মনে পড়ে, কাঁচি দিয়ে নক্সা কাটা কাগজ এবং বোতলের ছিপি ফেলে
সেই কবে আমি 'হাসি খুশি'র খেয়া বেয়ে
পৌঁছে গেছি রত্নদ্বীপে কম্পাস বিহনে।
তুমি আসো আমার ঘুমের বাগানেও
সে কোন বিশাল গাছের কোঠর থেকে লাফাতে লাফাতে
নেমে আসো, আসো কাঠবিড়ালীর রূপে, ফুল্ল মেঘমালা থেকে
চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো ঐরাবত সেজে,
সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ মুখের মতোই
দুলে দুলে ওঠো বার বার কিংবা টুকটুকে লঙ্কা-ঠোঁট টিয়ে হয়ে
কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।
আমার এ অক্ষিগোলকের মধ্যে তুমি আঁখি-তারা।
যুদ্ধের আগুনে, মারীর তাণ্ডবে
প্রবল বর্ষায় কি অনাবৃষ্টিতে
বারবণিতার নূপুর নিক্বনে
বণিতার শান্ত বাহুর বন্ধনে
ঘৃণায় ধিক্কারে, নৈরাজ্যের এলোধাবাড়ি চিৎকারে
সৃষ্টির ফাল্গুনে, হে আমার আঁখিতারা
তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে।
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে কী থাকে আমার ?
উনিশশো' বাহান্নোর কতিপয় তরুণের খুনের পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। সে ফুলের একটি পাপড়িও আজ
ছিঁড়ে নিতে দেব না কাউকে।
এখন তোমাকে ঘিরে ইতর বেলেল্লাপনা চলছে বেদম।
এখন তোমাকে নিয়ে খেংরার নোংরামি
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষমাস।
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।


ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
লেখকঃ শামসুর রাহমান

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদী আন্দোলন। এখানে কবি স্বাধিনতাকামী মানুষের চেতনাবোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সাধারণ জনতাই ছিল এই প্রতিবাদের হাতিয়ার। এই কবিতায় জিবনের তাৎপর্যের দার্শনিকতার উন্মোচন ঘটেছিল।
১৯৬৯-এর পাকিস্তানি শাসকদের নির্মম অত্যাচার, স্বৈরতান্রিক মনোভাব, অমানবিক নিষ্ঠুরতায় পূর্ববাংলায় মাওনবিকতার ধ্বংসযজ্ঞ কবিতাটিতে বর্ণিত হয়েছে।

আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়- ফুল নয়, ওরা
শহিদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রং।
এ রঙের বিপরীতে আছে অন্য রং,
যে-রং লাগে না ভাল চোখে, যে রং সন্ত্রাস আনে
প্রাত্যহিকতায় আমাদের মনে সকাল-সন্ধ্যায়
এখন সে রঙে ছেয়ে গেছে পথ-ঘাট, সারা দেশ
ঘাতকের অশুভ আস্তানা।
আমি আর আমার মতোই বহু লোক
রাত্রি-দিন ভূলুণ্ঠিত ঘাতকের আস্তানায় কেউ মরা, আধমরা কেউ,
কেউ বা ভীষণ জেদি, দারুণ বিপ্লবে ফেটে পড়া। চতুর্দিকে
মানবিক বাগান, কমলবন হচ্ছে তছনছ।
বুঝি তাই উনিশশো উনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের চোখে আজ আলোচিত ঢাকা,
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।
দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই
জনসাধারণ
দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো
ঝরে অবিনাশী বর্ণমালা
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে
এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে
হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায় । সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ,
শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায় ।


আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও
নির্মলেন্দু গুণ

তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।

এই নাও আমার যৌতুক, এক-বুক রক্তের প্রতিজ্ঞা।
ধুয়েছি অস্থির আত্মা শ্রাবণের জলে, আমিও প্লাবন হব,
শুধু চন্দনচর্চিত হাত একবার বোলাও কপালে।
আমি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড়াব গাণ্ডীব,
তোমার পায়ের কাছে নামাব পাহাড়।
আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।


পায়ের আঙুল হয়ে সারাক্ষণ লেগে আছি পায়ে,
চন্দনের ঘ্রাণ হয়ে বেঁচে আছি কাঠের ভিতরে।
আমার কিসের ভয়?

কবরের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই কবর,
শহীদের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই শহীদ,
আমার আঙুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে
জনতার হাতে হাতে গিয়েছে ছড়িয়ে।
আমার কিসের ভয়?

তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও
এই দেখো অন্তরাত্মা মৃত্যুর গর্বে ভরপুর,
ভোরের শেফালি হয়ে পড়ে আছে ঘাসে।
আকন্দ-ধুন্দুল নয়, রফিক-সালাম-বরকত-আমি;
আমারই আত্মার প্রতিভাসে এই দেখ আগ্নেয়াস্ত্র,
কোমরে কার্তুজ,
অস্থি ও মজ্জার মধ্যে আমার বিদ্রোহ,
উদ্ধত কপাল জুড়ে যুদ্ধের এ-রক্তজয়টিকা।

আমার কিসের ভয়?
তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।


সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:২৫
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×