somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের খরতাপ

২৬ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চৈত্রের দুপুরের খরতাপ ছড়িয়ে পড়েছে সবর্ত্র। হাইওয়ের পীচ বরাবর তাকালে মনে হবে রাস্তায় জমে রয়েছে পানি। বাজারের প্রতিটি মানুষের গায়ের জামা ঘামে ভিজে গেছে। স্বস্তি পাচ্ছেনা কেউ। তবুও জীবন থেমে থাকেনা, থাকার নয়।
বাজারের এক জায়গায় একটা ছাতার নীচে বসে জুতা সেলাই করে চলেছে ১৫/১৬ বছরের একটা ছেলে। আনিস ওর নাম। একটু আগে ওদের স্কুলের এক স্যার সংবাদ দিয়ে গেছে, ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে ও। রেজাল্ট যে হয়েছে আজ, তা-ও জানতনা আনিস। কাজের মাঝেই ডুবে থাকতে হয় যে ওকে সারাক্ষন।
আনিসের বাবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছেন। ছোট ছোট দুই ভাইবোন ওর। ওরাসহ মাকে নিয়ে থাকে আনিস বস্তির মতো ছোট্ট একটা রুম ভাড়া নিয়ে। অভাবের সংসার ওদের, তবুও পড়ালেখার উপর ওর আজন্ম টান, এটা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারেনা ও। তাই শত কষ্টেও ওটা ছাড়তে পারেনি। বাসায় বিদ্যুৎ নেই, সে সামর্থও নেই ওদের। কেরোসিন কেনার পয়সায়ও টানাটানি, তাই সন্ধার পর রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় চলত ওর পড়াশোনা বেশ কিছুক্ষন।
স্টারমার্কস নিয়ে এসএসসি পাশ করেছে আনিস। শিক্ষকদের পরামর্শে জেলাশহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে। ঋণ নিয়ে একটা ভ্যান কিনেছে ও, যা চালিয়ে কলেজে যাতায়াত করে এবং আয়ও হয় তাতে, যে আয়ে সংসার চলে ওদের।
এখানেই পড়ে সঞ্চিতা। প্রচন্ড মেধাবী সে-ও। পাশের উপজেলায় বাড়ী। বাবা-মা কেউ নেই সঞ্চিতার, দরিদ্র খালার কাছে মানুষ। খালার সাথে সেলাইয়ের কাজ করে সঞ্চিতা। কলেজে ভর্তি ও পড়াশুনার খরচ বেড়ে যাওয়ায় দু’একটা টিউশনিও করতে হয় সঞ্চিতাকে।
একই জেলার মেধাবী এবং একই শ্রেণিতে পড়ে বলে পরিচয় হতে দেরী হয়না আনিসের সাথে সঞ্চিতার। কথাবার্তা খুবই কম হয় ওদের। যেদিন হরতাল থাকে, বাস বন্দ্ব থাকে, আনিসই পৌঁছে দেয় সঞ্চিতাকে, ওদের প্রায় দশ কিলোমিটারের মতো দুরের বাসায়।
লজ্জায় নত হয়ে বসে থাকে তখন সঞ্চিতা, কোন কথা বলেনা।
কথা কেন বলছনা সঞ্চিতা?
কী বলব? তুমি কষ্ট করে ভ্যান চালাচ্ছ, আমার খুব খারাপ লাগছে বসে থাকতে।
শব্দ করে হেসে উঠে আনিস, বলে, আমাকে তো এই কাজই করতে হয় সারাদিন। তাছাড়া ফেরার সময়তো আয় হবে আমার।
তাহলে এখন কেউ হাত তুললে উঠিয়ে নিও।
তা নেব, তবে এখন তোমার সাথে পড়াশুনার গল্প করতে করতে যাচ্ছি, এটাও তো উপকারই।
পড় কখন আনিস?
আসলে আমাকে পড়তে হয় কম। কারন ক্লাসে আমি স্যারদের কথাগুলো অত্যন্ত মনযোগ সহকারে শুনি এবং মনে রাখতে চেষ্টা করি।
খোদা তোমাকে স্পেশাল করে সৃষ্টি করেছেন আনিস।
এজন্যই তো মুচিগিরি করেছি আর এখন ভ্যান চালাচ্ছি।
অনার্স মার্কসও তো পেয়েছ, আর্টস্ থেকে এরকম, তা-ও শারিরীক প্রচন্ড শ্রম করার পরও। সত্যি তুমি আশ্চর্য আনিস।
হরতাল-ধর্মঘট থাকায় এর মধ্যে প্রায় ৫/৬দিন আনিসের ভ্যানে করে বাড়ী গেছে সঞ্চিতা। আনিসই ওকে এরকম দিনগুলিতে খুঁজে নিত। একদিন সঞ্চিতা বলে ওকে, কেন আমাকে খুঁজে নাও আনিস এরকম হরতালের দিনগুলিতে?
এটা আসলে আমার দায়িত্ব মনে করি আমি। তুমি অসহায় একটা মেয়ে, বাস বন্দ্ব, কেমনে বাড়ী যাবা! বলে আনিস।
কিছু বলেনা সঞ্চিতা। মনে মনে ভাবে, আনিস কী তবে ভালবাসে ওকে! হাবে-ভাবে তো তা মনে হয়না।
এভাবেই দিন চলতে থাকে ওদের। এইচএসসি পরীক্ষায় দু’জনই ওরা আবার অনার্স মার্কস পায়। এবার উচ্চশিক্ষা নেয়ার পালা।
কী করবে এখন? আনিসই প্রশ্ন করে।
আমার শিক্ষাজীবন বোধহয় আর এগুবেনা আনিস।
অসম্ভব, বলে আনিস। অন্য কোন উপায় যদি না থাকে, আমি তোমাকে পড়াব সঞ্চিতা তুমি নিশ্চিত থাক।
কেন পড়াবে আমাকে? আজ পেতেই হবে উত্তরটা, ভাবে সঞ্চিতা।
হেসে বলে আনিস, কেন, তুমি অতো সিরিয়াস হচ্ছো কেন, মেধাবী তুমি, কমপক্ষে টিউশনি করে হলেও নিজের খরচ চালাতে পারবে, অসুবিধা কোথায়?
না, এসব আমিও জানি, তুমি বলো আমার ব্যপারে তোমার কেন এতো কৌতুহল।
কিছুদিন থেকে আনিস লক্ষ্য করে আসছে সঞ্চিতা ওর উপর কেমন যেন দুর্বল। ক্লাসে হঠাৎ চোখ পড়লে অথবা ভ্যান চালাত চালাতে কোন কারনে পেছন তাকালে দেখতে পেত আনিস, কেমন উদাস মনে তাকিয়ে আছে সঞ্চিতা ওরই দিকে নিবিষ্টমনে। আজ এটার ফয়সালা হয়ে যাওয়া দরকার, ভাবে ও।
বলে, দেখ সঞ্চিতা, আমরা দু’জনেই দরিদ্র পরিবারের। আর দরিদ্রের দারিদ্র থেকে মূক্তির পথ পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া, তাই বলছিলাম—
আমাকে সাহায্য করবে, এইতো! কথা কেড়ে নিয়ে বলে সঞ্চিতা।
হা, তাইতো।
আর কী কিছুই না? সরাসরিই বলি, তুমি কী আমাকে ভালবাসনা?
দেখ সঞ্চিতা, তুমি যে ভালবাসার কথা বলছ, সেটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। খুবই সুন্দর একটা মেয়ে তুমি, কোনদিক দিয়ে তোমার কোন কমতি নেই।
তবে!
আসলে আমি দেশের কাছে দায়বদ্ধ। দেশের জন্য আমাকে কিছু করতে হবে।
জানি আনিস, দেশ আমাদেরকে দিয়েছে খুবই কম। তবে সেজন্য আমরা এটাও বলতে পারিনা যে, কিসের দেশ! তোমার মতো আমিও এদেশের কাছে আমার ঋণ রয়েছে বলে মনে করি। তবে শুধুমাত্র সেজন্য কাউকে ভালবাসা যাবেনা, আমি তা মনে করিনা।
তোমার উপর আমার অগাধ টান আছে সঞ্চিতা। কিন্তু আমি কোন সম্পর্কে জড়াতে চাইনা, যা আমাকে কর্তব্যে অবিচলিত হতে বাধা দিবে।
অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সঞ্চিতার ভেতর থেকে। বলে, জানি এখনও কোন সম্পর্কে জড়াওনি তুমি আনিস। তবে কোনদিন যদি সিদ্ধান্ত পাল্টাও, আমার কাছে না আসা কোরনা। বড় যে ভালবাসি আমি তোমায়।
আর দাঁড়ায়না ও। পিছে ঘুরে হনহন করে চলে যায় আর আনিস চেয়ে চেয়ে দেখে ওর চলে যাওয়া।
এর পাঁচ বছর পর ঘটে দু’টি ঘটনা। রাজশাহী মেডিক্যাল হতে ডাক্তার হয়ে বের হয় সঞ্চিতা আর আনিস ঢোকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। ততোদিনে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স করে ও বিসিএস পরীক্ষায় কোটাবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে এবং একদিন দায়িত্বরত ম্যাজিষ্ট্রেটকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করে জেলে ঢোকে।
জেলখানায় একদিন আগমন ঘটে সঞ্চিতার। পাঁচ বছর পর আবার ওরা মুখোমুখি হয়।
আমার যে তোমাকে ছাড়া আর চলবেনা আনিস।
চমকে ওঠে আনিস। বলে, দেখছনা আমি জেলে আর এরকম জেল আমার ভাগ্যে আরো হবে যে।
কেন, আরো হবে কেন?
দেখ সঞ্চিতা, মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান আমি, যে মুক্তিযোদ্ধা শত্রুর গুলি খেয়েও বুক চিতিয়ে দেশের মানচিত্র রক্ষায় এগিয়ে গেছে, থামেনি। এগিয়ে যেতে যেতে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়েন যিনি। সেই আমি কেমনে থামব বল?
থামতে তোমাকে হবে কেন আনিস? তোমার মতো তুমি এগিয়েই যাবে।
তার পরিণতি কী তুমি জান?
জানি হয় মৃত্যু অথবা সারাজীবনই জেল।
জেনে তবে আজ কেন এসেছ সঞ্চিতা?
তোমাকে আজ আমি আমার একান্তই নিজের করে নিতে এসেছি আনিস।
প্রশ্ন না করে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে আনিস ।
হাঁ, আমি তোমাকে জোর করে হলেও আমার একান্তই নিজের করে নিব আনিস, আজ এবং এখনই। প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি আমি।
না করেনা আনিস, জানে আজ না করে কোন লাভ হবেনা।
সঞ্চিতা আজ অনেক বড় ডাক্তার, মেডিসিনে এমডি করেছে ও। চিকিৎসা করে অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে। গরীবদের কাছে তো কোন পয়সা নেয়ই না, অন্যদের কাছ থেকেও অতি ন্যুনতম, জীবনধারনের জন্য যা না হলেই নয়।
আনিসের আর বের হওয়া হয়না জেল থেকে। সকলের সাথে তার যোগাযোগ বন্দ্ব শুধু স্ত্রী হিসেবে সঞ্চিতা ছাড়া। রাজনীতির কী জাল বুনে চলেছেন জেলে বসে তা শুধু তিনিই জানেন, আর কাউকে জানতে দেয়া হয়না।
দীর্ঘসময় ধরে তিনি জেলে আছেন, এটারও যে প্রতিক্রিয়া আছে একটা।

(২)
আজ আট বছর জেলে আছেন আনিস। পাঁচ বছর আগে তার মুক্তি হয়েছিল। কিন্তু অপর এক মামলায় জড়িয়ে আবার তাকে জেলগেট থেকেই এ্যারেষ্ট করা হয়। অনেক আশা করে রিসিভ করতে এসেছিল জোর করে তার স্ত্রী হয়ে-যাওয়া সঞ্চিতা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া যার কিছুই করার ছিলনা। হাত উঠিয়ে বিদায়ই জানিয়েছেন শুধু ওরা একে অন্যকে।
কয়েকদিন থেকে প্রিন্ট মিডিয়ায় একটি লেখা খুব আলোড়ন তুলেছে। এধরনের লেখা কোন মিডিয়াতেই প্রকাশ না করতে বলা আছে, বিশেষ করে আনিসের লেখা হাতে পেলেও প্রকাশ করার উপর অদৃশ্য এক বিধিনিষেধ রয়েছে। সেটা অবশ্য প্রকাশ্য নয়, কারন তাতে হেরে যাওয়ার একটা ব্যাপার থাকে। আর হেরে গেলে নিবির্ঘ্নে আয়েশ করায় আসবে একটা চাপের অনূভুতি, আসবে বাধা। স্বাচ্ছন্দে বাধা কে চায়?
সন্মিলিতভাবে পূরো এ-জাতি জোটবদ্ধ হয়ে সেরকম কিছু করা যায় কি-না, কীভাবে যায়, জেলখানায় বসে এসমস্তই আনিস ভাবেন সারাক্ষন। কারন তার রক্তে মিশে আছে যে রাজনীতি। বাবার উদ্বেলিত রক্তই যে বইছে তার শিরা-উপশিরায়। লিখেছেন আনিস-
”আমার বাবা ছিলেন একাত্তরের রনাঙ্গনের একজন অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের জুনে পাক হানাদারদের একটি ক্যাম্প ওরা দখলে নেন, বাবা ছিলেন কমান্ডার। ক্যাম্পটি দখলে নেয়ার পর এর অভ্যন্তরে দু’তিনটি বাংকার দেখতে পান ওঁরা। এরই একটার মধ্যে এক বিবস্ত্র নারীকে দেখেন বাবা। নিজের জামা এবং গামছা এগিয়ে দেন তিনি। দু’একদিন পর তার সন্মতিতে বাবা বিয়ে করেন ওনাকে, আমার মা-কে।
আমার মা নার্সিংয়ের কিছু কাজ জানতেন, তা দিয়ে সেবা করে যেতে থাকেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের। আর বাবা বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করে যান। পরে মা আমাকে আমার বাবার শহীদ হওয়ার গল্পটা বলেন।
ডিসেম্বরের দশ তারিখ ছিল সেদিন। পাক বাহিনীর শেষ সময় তখন। একটা একটা করে ক্যাম্প হাতছাড়া হচ্ছিল তাদের। পেছন পেছন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। এরকম একটি ক্যাম্প দখলের পর তারা দেখেন পেছনে কোত্থেকে যেন আরো পাকসেনা এসে ওনাদেরকে প্রায় ঘেরাওয়ের মত করে ফেলছে। ওনারা দেখেন, সম্মুখযুদ্ধ করেই পথ বের করতে হবে। যেদিক থেকে কম বাধা আসছে, সেদিকেরই পথ পরিষ্কার করা শুরু করলেন ওনারা। প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হল। বাবারা পথ বের করবেনই আর পাকিরা কোনমতেই তা করতে দেবেনা। হঠাৎ বাবার কাঁধের একটু নীচে একটা গুলি লাগে। বসে পড়েন উনি, কিন্তু তা ক্ষনিকের জন্য। উঠে দাঁড়ান আবার এবং এগোতে থাকেন গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে। এবার কোমরে গুলি লাগে উনার আরেকটা পেছন থেকে। পড়ে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়ান আর তখনই লাগে বুকে আরেকটা। ঐ অবস্থাতেও বুক চিতিয়ে বাবা দৌড়ানোর চেষ্টা করতে থাকেন সামনে, আরো সামনে। সবুজ পতাকা টাঙ্গিয়ে ওড়াতে হবে যে ওনাকে।
না, আর পারেননা তিনি। কতই আর পারবেন অফুরন্ত সাহস এবং প্রানের অধিকারী আমার বাবা! ঢলে পড়েন মাটিতে। এর সাত্ মাস পর জন্ম হয় আমার। এভাবে মারা গিয়ে বাবা আমার মধ্যে আসলে বিবেক জাগ্রত করে গেছেন। আমার বাবা শিখিয়ে গেছেন সাহস কী জিনিস এবং কীভাবে করতে হয় তা ব্যবহার। নিজেকে আজ আমি চিনেছি, বুঝেছি, আর জেনেছি কী করতে হবে আমাকে।
খুব বেশী সুন্দর ছিলেন আমার মা। দুঃখের জীবন তার, তবে এ-বিষয়ে কিছুই বলেননি উনি আমাকে। তবে বেশ উচ্ছ্বল যে ছিলেন ছোটকালে, তা বুঝেছিলাম আমার সাথে তার কিছু কথাবার্তায় আর বাল্যকালের উনার লুকিয়ে-রাখা সামান্য কিছু ছবি দেখে।
বাবার মৃত্যুর পর নানাবাড়ীতে চলে যান আমার মা। সেখানেই জন্ম হয় আমার। আমার দুই মামা থাকতেন ওখানে, যারা চাইতেননা আমরা থাকি ওখানে। কেমন যেন বাকা চোখে দেখতে থাকেন মাকে সবাই, কারন আমার মা যে বীরাঙ্গনা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বাবার সাহসিকতার কারনে আর নানার ভয়ে কিছু বলতে পারতেননা কেউ। ইতিমধ্যে জ্বালাতন শুরু করে দিয়েছে মাকে আরেক লম্পট, হাঁ, তাকে আমি লম্পটই বলব। অন্য এক জেলা থেকে এখানে কিছুদিনের জন্য তার এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল লোকটা।
মামাদের সহায়তায় আমার সরল মাকে বিয়ে করে ফেলে ও, আর নিয়ে চলে যায় ওর নিজ বাড়ীতে। কয়েকবছর পর যেদিন ও মায়ের একাত্তরের করুন ঘটনাগুলো জানতে পারে, আর দেরী করেনি মাকে পরিত্যাগ করতে। ফেলে রেখে গেছে মার কোলে তার দুই সন্তান। আমার বয়স তখন মাত্র সাত।
ঐ বয়সেই শিশুশ্রমের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি আমি। ক্ষুধার বিষময় জ্বালা আর ভাইবোন দু’টোকে বাঁচাতে ইট ভাঙ্গার কাজ শুরু করি আমি, রেলষ্টেশনে কুলিগিরি করি, যখন যে কাজ পাই, তা-ই করি। সন্ধায় কিছু নিয়ে আসি, মা রান্না করে আমরা তিন ভাইবোনসহ চারজনে মিলে ভাগাভাগি করে খাই। দ্বিতীয় বাবার সন্তান আমার ছোট ভাইবোনদের আমি ভালই বাসতাম, ওরা যে আমারই মায়ের সন্তানও। ওরাও আমাকে পর ভাবতনা। মনেই হতনা যে আমরা দুই বাবার সন্তান।
কেন যেন পড়াশোনার উপর ছিল আমার অগাধ আকর্ষণ। বাবা ওরকম শিক্ষানুরাগী ছিলেন কী-না, মাকে একদিন জিজ্ঞাসা করি। কিছু বলতে পারেননি তিনি। বলবেনই বা কীভাবে, যুদ্ধের সময় কতটুকুই আর জানাজানি হয়েছিল ওনাদের।
আমার কষ্টে মা নীরবে চোখের পানি ফেলতেন। দেখে ফেলি একদিন কাঁদতে তাকে। না, কিছু বলতে চাননি উনি। বুঝতে পারি, শ্রমের ফলে আমার শারিরীক ক্ষতির আশংকা উনার। আমাদের পাশে থাকতেন উদয় কাকা, পেশায় মুচি। উনার সাথে কাজে লেগে যাই পরদিন থেকেই, যেটা চলে আমার এসএসসি পাশ করা পর্যন্ত।
এসএসসি পাশ করার পর আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, বুঝে ফেলি এই কষ্টের সাথে জড়িত যারা, তাদের জন্য আমাকে কিছু করতেই হবে।
একাত্তর আর একানব্বই, এই দুই অধ্যায়ের পর আমাদের ভাল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের সেই অধ্যায়ে প্রবেশ করার কথা ছিল, যে-অধ্যায়ে প্রবেশ করে বিশ্বের অনেক দেশ দ্রুত নিজেদের নিয়ে গেছে ঈর্ষনীয় উচ্চতায়, তাদের উন্নয়ন হয়েছে।
উন্নয়ন কী শুধু দেশের বাহ্যিক চিত্র পরিবর্তন! শুধু অবকাঠামো নির্মানেরই নাম উন্নয়ন? মানুষের মধ্যে সহনশীলতা বিরাজমানতা এবং যেকোন অন্যায়কারীর সঠিক শাস্তি নিশ্চিত করাই হচ্ছে আসল উন্নয়ন। বিশ্বে উন্নয়নের ঈর্ষনীয় উচ্চতায় পৌছানো ঐসমস্ত দেশের মতো আমরাও ঐ উচ্চতায় পৌঁছব, পৌঁছতে আমাদের হবেই। এজন্য দরকার দেশের তরুন সমাজ, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ এবং সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের এ-বিষয়ক অটুট ও অবিচ্ছিন্ন এক বন্ধন। হতেই হবে এটা।
আমি স্বপ্ন দেখি, একাত্তর আর একানব্বইয়ের চেয়েও বড় একটা অধ্যায় দেশে শুরু হয়ে গেছে, আর তাতে দুঃশাসনের অধ্যায়গুলি উড্ডয়মান মেঘের মতো উড়ে উড়ে চলে যেতে শুরু করেছে কোথায়, কোন নীলিমায় যেন।”
সঞ্চিতার কাছে ছিল লেখাটা। আনিসকে ছাড়ানোর ব্যাপারে সঞ্চিতার চেষ্টা অব্যহত ছিল। অতি মানবিক একজন ডাক্তার সঞ্চিতা, তাই কিছুটা সফলতাও আসছিল। কিন্তু চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে একদিন সকল প্রিন্ট মিডিয়ায় ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দেয় ও লেখাটা। কিছু মিডিয়ায় এটা ছাপা হয়ে বের হয়। কর্তৃপক্ষ নিজের দুবর্লতা প্রকাশ যাতে হয়ে না পড়ে, এজন্যই আপাতত: মুক্তি দিয়ে দিল আনিসকে।
জেলগেটে দাঁড়িয়ে আছে সঞ্চিতা। সাধারন একটা ব্যাগ এবং সুতলী দিয়ে বাঁধা কাগজের ছোটখাটো একটা গাট্টি নিয়ে ধীর পদে বেরিয়ে এলেন তিনি। করবেন কী, ঠিক নেই তার। জানেন সঞ্চিতা আসবে। কী বলবেন তাকে, ভাবছেন এসবই।
কোমল একটা হাত স্পর্শ করে একসময় তার হাত। ভেজা চোখ দু’জনেরই।
পরিস্থিতিটাকে হালকা করতেই হঠাৎ বলে ওঠেন সঞ্চিতা, সাতটা বছর ঠেকিয়ে রেখেছ আমাদের বাসর, চলো।
পেছন ফিরে দেখে নেন আনিস একবার জেলখানাটাকে, কবে যে এখানে আবার আসতে হয়!

(৩)

দেশের প্রতিটা গ্রামের মত এখানেও সবুজের সমারোহ। যতদুর চোখ যায় শস্যের ক্ষেত, মাঝে মাঝে দেখা যায় দু’একটা বিরাট গাছ। দুরের পথিক গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে, গা’টা জুড়িয়ে নিয়ে শুরু করে আবার পথ চলা। মানুষের সাথে দু’টো কথাও হয় গাছের ছায়ায় বসে মানুষের। পরিচিতি হয়, জানাজানি হয়, হয় সম্পর্কও। হিন্দুতে হিন্দুতে হয়, হয় হিন্দু মুসলমানে ও।
রতনগঞ্জ নাম গ্রামটির। এর বুক চিরে চলে গেছে হাইওয়ে রাস্তা আর একপাশ দিয়ে খরস্রোতা নদী কপোতাক্ষ। এখানেই বাড়ী আনিসের নানার। সে অনেক বছর আগেকার কথা। একাত্তর শুরু হয়নি তখনও।
ঠিক মাতব্বর না হলেও আনিসের নানা মৌলভী ফরিদউদ্দিন ছিলেন মোটামুটি গ্রামের একজন প্রভাবশালী। খুব যে জমিজমার মালিক ছিলেন উনি তা নয়, তবে ব্যবহার ছিল তাঁর অত্যন্ত ভাল। আর মিথ্যা কথা তিনি বলতেননা মোটেও। গ্রামের প্রতিটি মানুষের সাথে তার ছিল সদ্ভাব। মানুষ তার উপর ভরসা খুঁজে পেত, যা না পেত মাতব্বরের উপর। আসরের নামাজের পর তাঁর একজন হিন্দু বন্ধুর ঘাড়ে হাত রেখে হাঁটতেন তিনি, কথা বলতেন হাইওয়ের ধারে কোন গাছের নীচে বসে।সত্য কথা বলতেন, সৎভাবে চলতেন, কেউ পরামর্শ চাইতে এলে সৎ এবং ভাল পরামর্শটাই দিতেন।
এসমস্ত গুনই তার কাল হয়ে দাঁড়াল একাত্তরে। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সাত্তার মিয়া ফরিদউদ্দিনকে দেখতে পারতেননা দু’চোখে মূলত: মানুষ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি করত বলে। গ্রাম থেকে কিছু দুরে একটা ক্যাম্প করে একদিন পাক আর্মীরা। সখ্য গড়ে তোলেন মেম্বার ওদের সাথে এবং যথারীতি মুক্তিযোদ্ধা নিধন শুরু করেন। কিন্তু ফরিদউদ্দিনের ছেলেরা তো মুক্তিযোদ্ধা নয়, কীভাবে তাঁকে হেনস্তা করা যায় এই চিন্তায় বিভোর থেকে হঠাৎ একদিন মনে হয তার যে, মৌলভীর তো সুন্দর একটা মেয়ে আছে। যেই ভাবা সেই কাজ, আর্মী নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধা খোঁজার নাম করে একদিন ধরিয়ে দেয় পাষন্ডটা আনিসের মা মমতাজ বেগমকে।
মিলিটারীদের পা ধরে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে অনেকদুর চলে গিয়েও যখন ছাড়িয়ে আনতে ব্যর্থ হলেন আদরের মমতাজকে, তখন ওখানেই অঞ্জান গয়ে পড়ে রইলেন মৌলভী ফরিদউদ্দিন। গ্রামের মানুষের সহায়তায় বাড়ী ফিরে এলেন বটে, তবে বিছানা নিলেন তিনি। পালা করে মানুষ তাঁর সেবা করে গেছেন দিনের পর দিন। অবশেষে সপ্তাহখানেক পর আবার ভাল হয়ে গেলেন তিনি যখন সুসংবাদটা এলো যে, মিলিটারীরা পরাজিত হয়ে ক্যাম্প উঠে গেছে এবং অসম সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজঘরে তুলে নিতে চেয়েছেন আদরের মমতাজকে বৌ করে।
জীবনে যতদুর মনে পড়ে এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেননি মৌলভী ফরিদউদ্দিন। তবুও কেন পরম করুনাময় খোদা তা’লা তাকে এতবড় আঘাত দিলেন ভেবে পাননা তিনি। জানেন খোদা মানুষকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু নিজ কন্যার এরকম অবস্থা দিয়ে খোদা তাকে পরীক্ষা করলেন? মনে মনে বলেন, জানিনা খোদা, তোমার মহিমা জানা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সবসময় খোদার কাছে চেয়েছেন তিনি খোদা যেন তাকে ছেলে অথবা মেয়ে, যা-ই হোক না কেন, একটি অতি সুসন্তান দান করেন, যে সন্তানের বদৌলতে তার বেহেস্ত-প্রবেশ সহজ হয়। আরো কামনা করেন, সন্তানটি যেন ভাল ও সৎ কাজ করে সবসময়, সেসমস্ত কাজের সুনাম যেন ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে।
মমতাজকে উদ্ধার করে তাঁর হবু জামাই কমান্ডার শহীদ যখন তার সামনে উপস্থিত হন এবং তার পাঁ ছুয়ে সালাম করতে উদ্যত হন, উল্টে তিনি-ই তাকে সালাম করতে যান। একমাত্র মেয়েকে উদ্ধার করার কারনে তিনি পাগল হয়ে পড়েন এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। কিন্তু পারবেন কেন মুক্তিযুদ্ধের অসম সাহসী এবং শক্তিমান এই কমান্ডারের সাথে? পরম শ্রদ্ধার সাথে শহীদ উঠিয়ে বসিয়ে দেন তাকে। প্রস্তাব তো দেওয়াই ছিল। মমতাজই বাবাকে একপাশে ডেকে বলেন, বাবা দেরী করবেননা, কাজী ডাকেন এখনই। ওর এবং আমাদের এখনই চলে যেতে হবে, বিশেষ করে ওর যে অনেক কাজ। না, দেরী করেননি মৌলভী সাহেব শূভকাজে এবং আনন্দের পর আবার কিছুটা শোকের আবহের মাধ্যমে বিদায় জানান মেয়ে এবং মেয়ে-জামাই কমান্ডার শহীদকে। অনেক পরে মমতাজ বেগম শুনেছিলেন, এরপর তার বাবা ওখানেই হাত তুলে মোনাজাত করেছিলেন, আল্লাহ্ আমার আশা একটি সুসন্তান তুমি দান করো আমাদের।
ডা. সঞ্চিতার বাসায় বসে এসবই ভেবে চলেন মমতাজ বেগম। চোখের পানি ফেলে অতি আদর করে এখানে নিয়ে এসেছে সঞ্চিতা ওঁকে। রেখেছে নিজের কাছে, শাশুড়ি হলেও একেবারে নিজের মা মনে করে ও ওঁকে। আরো আছেন সঞ্চিতার খালা। বয়স্ক দু’জনে গল্প করে কাটান ওঁরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেরই সঞ্চিতার কোয়ার্টারে থাকেন ওঁরা।
ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় থেকেই আনিসের সুবাদে এক আধবার গিয়েছিল সঞ্চিতা রতনগঞ্জে মমতাজ বেগমের বাড়ী। কথা হয়েছে তাঁর সাথে, আবেগের নীরব আদান-প্রদান হয়েছে, ওটুকুই তখন। মেডিক্যালে পড়ার সময়ও যখনই বাড়ী যেত সঞ্চিতা, যেতে ভুলতনা মমতাজ বেগমের বাড়ী। নিজের মা না থাকায় উনি-ই যে হয়ে উঠেছিলেন তার মা।
বড় একরোখা আনিস, এটা জানত সঞ্চিতা। আর এই একরোখাকেই কীভাবে যেন মনের সবটা-ই উজাড় করে দিয়েছিল ও! এমনই যে, মেডিক্যালে পড়ার দীর্ঘ সময়টাতেও এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি ও আনিসকে। বরং যত দিন গেছে, তত আরো বেশী করে আকর্ষনটা গভীর হয়েছে ওর প্রতি। আনিস তখন জেলে কোটাবিরোধী আন্দোলনে এক উগ্র ম্যাজিষ্ট্রেটকে লাঞ্ছিত করার কারনে।সঞ্চিতার অবস্থা তখন এমন যে, সবসময় আনিসের জন্য তার মধ্যে একটা অস্থিরতার ভাব কাজ করে। আনিসকে না পেলে কোনমতেই তার চলবেনা। মানসিকভাবে পযুর্দস্ত হয়ে পড়েছে ও অনেকটা। কিন্তু উপায় কী! বাইরে থাকলে তবুও হোত, কিন্তু আনিস যে অন্তরীন।
এরকম অবস্থায় আনিসের মা মমতাজ বেগমের স্মরনাপন্ন হয় ‍সঞ্চিতা। জানে, এই একটাই পথ খোলা আছে তার সামনে। সবই খুলে বলে তাঁকে, সেই কলেজে ভর্তি থেকে শুরু করে আনিসের ভ্যানে চড়ে বাড়ী যাওয়া এবং আর সবই। মমতাজ বেগম ভীষন চিন্তায় পড়ে যান, বলেন এ কী করলে মা তুমি! যেরকম ছেলে আমার, তোমার কথায় সাড়া দেয়নি, সমাধান হবে কী করে, ভেবে তো আমি আসলেই অস্থির হয়ে যাচ্ছি। চুপচাপ বসে থাকে দু’জনই, অনেক অনেকক্ষন।
সঞ্চিতাই বলে ওঠে একসময়, মা আমি আপনাকে নিয়ে জেলখানায় গিয়েই কাজটা সমাধা করতে চাই।
কিছুটা যেন চিন্তামুক্ত হলেন মা সমাধানের একটা সম্ভাব্য পথ পেয়ে। বলেন, দেখ মা, সম্পুর্ন চিন্তামুক্ত কিন্তু হতে পারছিনা আমি। আনিস আমার প্রথম সন্তান, জীবনে প্রথম ওর মুখেই ‘মা’ ডাক শুনি আমি। আর ও যখন একান্ত-ই শিশু, কতই আর বয়স তখন ওর, মাত্র সাত, সেই তখন থেকেই ও আমাদের অন্ন জুগিয়ে যাচ্ছে অতি কষ্টকর শ্রম করে। জেলখানায় তোমার সাথে আমাকে দেখে এবং তোমার আগমনের উদ্দেশ্য সফল করতেই আমার আসা, এজন্য যদি ও দু:খ পায়, তবে সেটা হবে আমার জন্য অতি হৃদয় বিদারক। আমি কেমন করে আমার এই অতি সুসন্তানকে ব্যথা দিব মা! ঝরঝর্ করে কেঁদে ফেলেন তিনি, বলেন আমার এই সন্তানের শিশুকালের শ্রমের কথাগুলো যখনই আমি মনে করি, কান্না সামাল দিতে পারিনা মা, তুমি মনে কিছু কোরনা।
কেঁদে ফেলে সঞ্চিতাও। স্বপ্ন তার ক্রমেই মিইয়ে যাচ্ছে সেজন্য নয়, মা-র কান্না দেখে, নীরব কতখনি বোঝাপড়া থাকলে একজন মা তার সন্তান সম্পর্কে এতো উচ্চ ধারনা পোষন করতে পারে তা দেখে। চিন্তাক্লিষ্ট মার সামনে আর কিছুক্ষন থেকে স্বপ্নভঙ্গের বিধ্বস্ততা নিয়ে উঠে চলে আসার জন্য উদ্যত হয় ও।
দাঁড়াও সঞ্চিতা, বলে ওঠেন মা। আনিসের দিকটাও আমি চিন্তা করি মা।তোমার কথায় আমার মনে হয়েছে, রাজনৈতিক কাযর্ক্রমে ওর যাতে কোন বাধা সৃষ্টি না হয়, সেজন্যই ও কোন অর্থাৎ তোমার সাথে সম্পর্কে জড়াতে চায়না। তবে তুমি যে বাধা, এটা হয়তো আর ভাবেনা ও, এরকমও তো হতে পারে। আর তোমাদের মধ্যে তো সেরকম যোগাযোগ নাই দীঘর্দিন, তাইনা!
এটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় হলো মা যে, বলেন মমতাজ বেগম, আমি আমার ছেলেকে বড় করেছি সেটা বলো, আর আমরা দীঘর্দিন একসাথে থেকেছি, যা-ই বলো আমাদের মধ্যে একটা প্রখর বোঝাবুঝি কিন্তু আছে মা। কোনদিন জ্বরের তোড়ে সারারাত বিছানায় পড়ে থাকলে আমার আনিস সারারাত জেগে আমার শিওরে বসে থেকেছে, কপালে বুলিয়ে গেছে হাত, কখনও বা পানি ঢেলেছে মাথায়। সকাল হয়েছে, আমি মৃদু বকেছি সারারাত ওর জেগে থাকার জন্য। ও বলেছে যদি তোমার কিছু লাগে মা, এজন্য না সরে আমি এখানে বসে ছিলাম। আবার ওর সৎবাবার ছেলেটাকে ও খুব ভালবাসত। একদিন ছেলেটা আমার সাথে একটা বেয়াদবী করেছিল। এজন্য ওর গালে একটা থাপ্পড় মেরে বসে আনিস। আমার খারাপ লেগেছিল। ও সেটা বুঝতে পেরে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে আদর করে ওকে। এ-ই হচ্ছে আমার আনিস মা। রাজনীতি ওর ধ্যান-গ্যান! অথচ আমার মনে হয়, ওকে যদি আমি রাজনীতি ছেড়ে দিতে বলি অথবা কমপক্ষে ও যদি বোঝে যে, আমি চাইনা ও রাজনীতি করুক, তবে ছেড়ে দেবে ও রাজনীতি। কারন ও জানে, মা অন্যায় কোন সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিবেনা। আর মা যে-সিদ্ধান্ত দিবে, জেনে-শুনেই সেটা দিবে এবং সেটা আমায় মানতে হবে।
আমার আনিস কখনও কোন খারাপ কাজ করেনি এবং খারাপ কোন কাজের সাথে ও কোনদিন জড়িত নয়, ছিলনা এবং থাকতে পারেনা। এই বিশ্বাসটা আমার আছে, ও জানে বলেই আমার যেকোন কথা ও কোনদিন অস্বীকার করেনা, মেনে নেয়।
একটু থেমে আবার বলেন তিনি, ঠিক আছে মা চলো, যাবো আমরা জেলখানায়। আমার আনিস ভাববেনা যে, আমি তোমাকে ওর সাথে বাঁধার জন্য জোর করতে এসেছি।
জেলখানায় শুভপরিনয়ের কথা শক্তভাবে যখন পাড়ে সঞ্চিতা আনিসের কাছে, কিছুক্ষনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যায় আনিস। সঞ্চিতার চোখ ফলো করে কিছুটা দুরে দাঁড়ানো মাকে দেখতে পায় ও তখন। বুঝে যায় সবকিছু। বুঝে নেয় মত দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই ওর। ঘটনা ঘটতে দেরীটা হয়না তখন আর।
(৪)
ঢাকা মেডিক্যালে ডুপ্লেক্স কিছু কোয়ার্টার আছে সাদা রংযের। বাসাগুলি কবে নির্মিত হয়েছে, কেনই বা ডুপ্লেক্স করা হয়েছে, জানা যায়না। তবে বেশ যে পুরোন বাসাগুলো, তা বোঝা যায়। উপরের ঘরগুলোর একটা বেশ বড়, ওটাতে একসাথে থাকেন সঞ্চিতার খালা এবং শাশুড়ি ছয় বাই সাত ফুটের বড় একটা খাটে। আরেকটা রুমে থাকেন সঞ্চিতা।
সঞ্চিতার শাশুড়ি আর খালা এবাসার স্থায়ী বাসিন্দা নন। গ্রামে সারাজীবন কাটানো মানুষজন, বিশেষতঃ একটু বয়ষ্করা গ্রাম ছেড়ে অন্যস্থানে বেশিদিন থাকতে পারেননা। তবে সঞ্চিতার পীড়াপীড়িতে খুব একটা বেশিদিন ওঁরা গ্রামে গিয়ে থাকতেও পারেননা। তবে একজনকে সবসময় থাকতেই হয় সঞ্চিতার সাথে। একা মেয়েটা থাকে কী করে! থাকতেই বা দেন কী করে ওনারা তাকে। অনেক আদরের যে মেয়েটা ওঁদের। নিজেরাই চলে আসেন সময়মতো।
আনিসের আজ মুক্তির দিন। সঞ্চিতা জেলখানায় গেছে আনিসকে আনতে। অনেকদিন পর দেখা হবে ওদের আনিসের সাথে আজ। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন ওরা। মমতাজ বেগম ছেলের জন্য ওর পছন্দের রান্না করছেন। যদিও জানেন খুব বেশি কিছু পছন্দের নেই আনিসের। কষ্ট-ই তো করে গেছে ছেলেটা সারাজীবন, পছন্দের খাবার বলতে কিছু নেই-ও ওর। পরম করূনাময় আনিসকে দান করে জীবনটা ওনার একেবারে ভরিয়ে দিয়েছেন। মনে হয়েছে সবই দিয়েছেন খোদা ওনাকে, কিছু নেয়ার নেই ওনার আর খোদার কাছ থেকে। ঝাপসা হয়ে উঠে সময় সময় চোখ দুটো তার।
অপেক্ষার পালা শেষ করে একসময় আনিস এসে পড়েন বাসায়। মমতাজ বেগম অভিভূত হয়ে পড়েন, মুহূর্তেই কত চিন্তা এসে পড়ে তাঁর মাথায়, এই ছেলের মুখেই ‘মা’ ডাক শোনেন তিনি জীবনের প্রথম, জীবনের অনেকগুলো বছর অর্থাৎ আনিসের সৎ বাবার অন্তর্ধানের পর মাত্র সাতবছর বয়সী এই ছেলেই তো কঠিন-কঠোর শ্রম করে মুখে আহার তুলে দিয়েছে তিনটি মানুষের। আবার এই ছেলেই তো বড় হয়ে কোনকিছুর সাথে কোন আপোষ না করে চাকুরী করে তাঁদের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে নিজস্কন্ধে এবং এমনকি দেশের দায়িত্ব–ও তুলে নিতে চায় ও। মনে মনে ভাবেন তিনি, কে ও! মনে হয় অনেক দুরের কেউ, একান্ত আপন হয়েও যাকে তাঁর মনে হয় অনেক দুরের একজন। কোন দায়িত্বের কথাই কেন ভোলেনা ও! শুধু ভোলেনা তা-ই না, দায়িত্বকে একান্ত-ই নিজেরও করে নেয় ও।
ভাবতে ভাবতে কেমন যেন আনমোনা হয়ে পড়েন মমতাজ বেগম। একদিকে কাত হয়ে পড়ে যেতে থাকেন হয়ত, তখনই আনিসের কাঁধে-বুকে নিজের মাথা এলিয়ে যেতে দেখেন তিনি। সকলের বিভিন্ন প্রশ্নে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ান। অনেক যত্ন করে বসিয়ে দেয় সবাই ওকে। আস্তে আস্তে ড্রয়িংরুমের পরিবেশ হাল্কা হয়ে উঠে। মা এবং খালাশাশুড়ির মাঝে বসে আছেন আনিস।
প্রশ্নটা এসেই পড়ে, করেন সঞ্চিতার খালা, জেলখানায় বসে দেশ-সমাজ নিয়ে না লিখলে এতোদিন তোমাকে জেলে থাকতে হোতনা বাবা।
থতমত খেয়ে যান আনিস প্রশ্নের ধাক্কায়, জানেন ইনি-ই ‍সঞ্চিতার খালা, বাবা-মা না থাকায় ইনি-ই সঞ্চিতার সব, এঁর কাছেই যে মানুষ সঞ্চিতা।
ওদিকে প্রশ্ন শুনে রান্নাঘর থেকে ‍সঞ্চিতা এসে পড়েন। প্রশ্নটা করে অপরাধ করে ফেললেন নাকি, এই চিন্তায় পেয়ে বসে তাঁকে। বলে উঠেন, কিছু মনে কোরনা বাবা, তোমাদের, বিশেষত: তোমার কষ্টের কথা মনে করে কথাটা বলে ফেলেছি আমি।
পায়ে হাত দিয়ে ওঁকে সালাম করে ম্লান হাসেন আনিস। কিছু বলেননা। বলবেনই বা কী! জানেন আপনজনেরা এসব বলবেনই। দেশের কাজ করতে হলে এসব কথা উঠবে। পৃথিবীতে যুগে যুগে কত মানুষ দেশের জন্য কাজ করেছেন, অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে গেছেন, মৃত্যুকে করেছেন আলিঙ্গন কত হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ, ভেঙ্গে গেছে তাঁদের সাজানো-গোছানো বাগানের মতো কত সংসার, নেই তার কোন ইয়ত্তা।
না খালা, কিছু মনে করেনি ও, বলে ওঠেন সঞ্চিতা।
আনিসের মা ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরে সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন অনেক অনেকক্ষন, কিছু বলেননা তিনি।
দোতলায় সঞ্চিতাদের রুমটা রাস্তার পাশেই, অর্থাৎ এরুমের জানালা দিয়ে বাইরের দিকের মেডিক্যালের পাশ বরাবর চলে যাওয়া রাস্তাটা দেখা যায়। সকালেই ডিউটিতে চলে যান সঞ্চিতা, আনিসের সময়টা কাটে তখন অখন্ড অবসরে। জানালার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। কয়দিন থেকে দেখতে পান, জনাকয়েক ছেলে বাসাটার দিকে তাকিয়ে আছে রাস্তার ওপার থেকে। দিনে দিনে ভীড়টা বাড়তে থাকে।
কী চাও তোমরা, একদিন জিজ্ঞেস করে বসেন আনিস।
আমরা ছাত্র, মানে ছাত্রত্ব এখনো শেষ হয়নি আমাদের, আমরা আপনার সম্পর্কে শুনেছি, আপনার সাথে পরিচিত হতে চাই যদি আপনার ইচ্ছা থাকে।
ছেলেগুলোকে ভেতরে আসতে বলেন আনিস এবং নীচের বসার ঘরে বসান ওদের।
ওদের কেউ ঢাকা ইউনিভার্সিটির, কেউ পাশের কলেজের ছাত্র, কেউ আবার ছাত্রত্ব শেষ করে চাকরী নামক সোনার হরিনের সন্ধানে রয়েছে। বলে, আমরা আপনার কথা এক মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি যদিও খুবই কম মিডিয়াতে আপনার সম্পর্কে বলা হয়। আপনি না-কি ইচ্ছে করে কারাবাস করছেন, আমরা শুনেছি, এটার কারন কী জানতে চাই।
দেখ, বলেন আনিস, ইচ্ছে করে কারাবাস যে কেউ করে, এটা আমি মনে করিনা। জেলখানা কোন স্বর্গ নয় যে ওখানে কেউ থাকতে চাইতে পারে। একাকী জীবন ওখানে বড়ই কষ্টের। আর শ্রম করতে হলে তো আরো অমানবিক ওই জীবন।
তবে যে আমরা শুনেছি…
ভুল শুনেছো তোমরা। আমি মূক্ত জীবনেই থাকতে চাই আর সবার মতো, কিন্তু আমাকে মূক্ত করে না দিলে কী করার আছে আমার বলো!
মমতাজ বেগম ছেলেগুলোর জন্য কিছু নাস্তা নিয়ে আসেন। তাঁকে দেখে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলে, উনি বোধহয় আপনার আম্মা আনিস ভাই!
হাঁ বলতেই ছেলেটি উবু হয়ে উনার পা ছুঁয়ে সালাম করতে উদ্যত হয় এবং সবাইকে বলে, উনাকে সালাম কর, কারন উনাকে সালাম করার ভাগ্য সকলের হয়না। সকলে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে আর ও বলে যায়, উনি আমাদের ”বীরাঙ্গনা মা”; অনেক উপরে স্থান উনার। নিজের জীবন বিজসর্ন দিয়ে হলেও এই মা-র সম্মান রক্ষা করতে আমরা নীতিগতভাবে বাধ্য। ”বীরাঙ্গনা” হয়ে উনারা আমাদের এদেশকে স্বাধীন করেছেন, আমরা তাঁদের কাছে এইভাবে বাঁধা।
মমতাজ বেগমের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলেগুলো উনাকে একে একে সালাম করে গেল। চোখের পানি লুকোতে মমতাজ বেগম সরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই একজন বলে ওঠে, আসেননা মা, আমরা একসাথে কাঁদি।
কান্না তোমাদের আসবেনা বাবা। তোমরাতো এযুগের ছেলে, কীসের দু:খ তোমাদের যে কাঁদবে তোমরা?
অনেক দু:খ আমাদের মা। আমরা বাসায় মুখ দেখাতে পারিনা বলে অতি প্রত্যুষে বেরিয়ে পড়ি বাসা থেকে। বাবা-মা আমাদের অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন অথচ আমরা না পাচ্ছি কোন চাকরী, না পাচ্ছি কোন কাজ। বাবা-মার কোন খেদমতই করতে পারছিনা আমরা। এর চেয়ে বড় দু:খ আর কী হতে পারে মা!
কাঁধে গভীরভাবে হাত দিয়ে ছেলেগুলোর দু:খে সমব্যথী হয়ে উঠেন মা।
আনিসের সাক্ষাৎকার গ্রহনের প্রস্তাব আসে সঞ্চিতার মোবাইলে একদিন। প্রস্তাবকারী একজন অথবা কোন একটি পত্রিকা অথবা প্রিন্ট মিডিয়ার একক কোন সাংবাদিক নন। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কয়েকজন সাংবাদিক এবং তাদের বন্ধু-বান্ধব মিলে ১২/১৪ জনের একটি দল সাক্ষাৎকার ঠিক নয়, আলাপ-আলোচনা করতে চান। ঘরোয়া বলে সঞ্চিতার বাসায়ই স্থান নির্ধারন করা হয়।
নির্দ্দিষ্ট দিন ও সময়ে আসেন সকলে। ছুটির দিন বলে সঞ্চিতা উপস্থিত ছিলেন সেদিন। আনিসের মা সামনে আসেননি। ছেলেগুলো সম্মান করবে, তাঁর ভাল লাগেনা এসব।
ছেলেদের একজন বলেন, আমরা আনিস ভাই আপনি কীভাবে অন্তরীন হলেন এবং মূক্তির দিন জেলগেট থেকে আবার গ্রেফতার হলেন জানি। কিন্তু কেন আবার গ্রেফতার হলেন জানিনা; এবিষয়ে যদি কিছু বলেন!
আমিও সুনির্দ্দিষ্টভাবে জানিনা দুই বছর পর মূক্তির দিন কেন আবার আমি গ্রেফতার হলাম। তবে আমি জেলে থেকে লিখালিখি করতাম এবং সেগুলি গোপন থাকতনা, সেই চেষ্টাও ছিলনা আমার। কিছু কিছু লিখা আমি আর খুঁজে পেতামনা। হতে পারে এসবই আমার দ্বিতীয়বারের গ্রেফতারের কারন।
কী লিখতেন আনিস ভাই আপনি?
দেখ আমি ছত্রিশে পড়েছি, তাই তুমি করে বলছি তোমাদের, আশা করি মনে কিছু করবেনা তোমরা। প্রচন্ড সাহসী এক মূক্তিযোদ্ধার সন্তান আমি, আর তোমরা জান আমার মা-ও একজন বীরাঙ্গনা। স্বাধীনতার এত বছর পর আজও আমাদের জীবনের পারিপার্শ্বিকতায় আসেনি কোন শুদ্ধতা। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের দিকে যদি তাকানো যায়, দেখা যাবে, অতি দ্রুত তারা এগিয়ে গেছে তরতর করে উন্নতির শিখরে। আর আমরা! আমরা পড়ে আছি যেইকার সেই তিমিরেই। তাহলে কেন আমি লিখবনা বল!
আরেকজন বলেন, লিখে আপনি কী করবেন আনিস ভাই?
লিখে কী করব, এটা আমি কী করে বলব বল। বিবেকের তাড়নায় আমি লিখি, লিখে যাই।
এমনকি এটা যদি আপনার জেলে যাওয়ার কারন হয় তবুও আপনি লিখেই যাবেন?
বিবেক তেড়ে নিয়ে বেড়ালে কী করব আমি!
আরে উনি নেতা হবেন..
থামিয়ে দেয় আরেকজন। বলে, আনিস ভাই, আপনি কি রাজনীতি করতে চান ভবিষ্যতে?
দেখ, চলমান রাজনীতি আমি বুঝিনা, করতেও চাইনা সে-রাজনীতি। তবে এদেশের তরুন সমাজসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ সম্পর্কে আমার আরো অনেক বেশী জানা দরকার।
মানে! উপহাসের সুরে বলে উঠে আরেকজন।
সেটা পাত্তা না দিয়ে সংক্ষেপে বলেন আনিস, এই, যেমন তাঁরা কী চান, শুদ্ধ রাজনীতি তাঁরা চান কী-না, নাকি চান দেশ যেরকম চলছে সেরকমই চলুক, এসব আরকি।
মানে জেনেশুনে একেবারেই আপনি লাগবেন। অনেকে বলেন আপনি নেলসন ম্যান্ডেলা হবেন, এজন্যই আপনি কারাবাস বেছে নিয়েছেন।
ইচ্ছে করে কারাবাস করা যায় না-কি? আমার জানা নেই ভাই।
আসলে নেতা হওয়ার প্রচন্ড একটা লোভ আপনার মধ্যে রয়েছে…
আর সহ্য হয়না মায়ের, এসে পড়েন তিনি বসার ঘরে সবার সামনে। উত্তাল কন্ঠে বলে উঠেন তিনি, হাঁ, আমার আনিস রাজনীতি করবে, আমার আনিস ওর বাবার মতো এদেশের জন্য প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দিবে, কারো কিছু বলার আছে? উত্তরের আশায় না থেকে আবার বলে উঠেন, তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও আমার আনিসের কোন অপরাধ তোমরা পাবেনা। ও বেসরকারী একটা চাকরী করেছে বছর দশেক, যেখানে ছিল লক্ষ-কোটি টাকার হাতছানি। কিন্তু কোন লোভে তাকে পেয়ে বসেনি। পদে পদে ছিল সেখানে নারী-বিষয়ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাতছানি, তা-ও হয়নি ও। পথে-ঘাটে বাসে চলতে চলতে যুবক আমার আনিসের পাশের সীটে যদি কোন মেয়ে বসত, যত কষ্টই হোক-না-কেন, উঠে ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেত, যাতে ছোঁয়া না লাগে। একদিন নাইটকোচে একারনে ও সারারাত দাঁড়িয়ে থেকেছে। খুবতো ঠাট্টা করছ তোমরা ওকে, তোমরা-ই বলো শুদ্ধতার রাজনীতি করতে এর চেয়ে আর কী যোগ্যতা লাগে?
তন্ময় হয়ে কথাগুলি শুনছিল সবাই। একটু থেমে মমতাজ বেগম আবার বলে ওঠেন, সচ্চরিত্রের অধিকারী কেউ হলে কেন তাকে তোমরা উপহাস করো বাবারা! জানি তোমরাও অসৎ নও, নতুবা এখানে আসতেনা। তবে.., তবে কেন তোমরা আলাদা হয়ে আছ? জান হয়ত, আমি একজন বীরাঙ্গনা। সেই অধিকারে আমি কী তোমাদের কাছে দাবী করতে পারিনা যে, তোমরা সম্মিলিতভাবে দেশটাকে শুদ্ধ করো!
সরি মা, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। মা থামলে একজন বলে উঠেন। আসলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাই এরকম হয়ে গেছে। কারন আমরা অসুস্থ পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠছি। অসুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠলে সুস্থতা কীভাবে থাকবে আমাদের মধ্যে মা?
আরেকজন বলেন, আমরা ভাল কাউকে দেখলেই কটাক্ষ করে বসি মা। আমরা এটার জন্য সবোর্তভাবে দায়ী, তা বলবনা, তবে দেশ-সমাজের বিরাজমান যে পরিস্থিতিতে আমরা বেড়ে উঠছি, সেই পরিবেশও অনেকাংশে দায়ী এটার জন্য। সে-পরিবেশটাই আমাদের পরিবতর্ন করতে হবে আসলে।
আপনাকে আমরা অনেক শ্রদ্ধা-ভক্তি করি মা, আমাদের আন্তরিক সশ্রদ্ধ সালাম আপনি গ্রহন করুন। মাথা নুইয়ে কথাগুলি সমর্থন করে যান কথাগুলো সকলে। আরো বলেন মাকে সবাই যে, আমরা আপনার সামনে বলে গেলাম মা যে, আমরা সবোর্তভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাব একেকজন শুদ্ধ মানুষ হতে। আমাদের অতি শ্রদ্ধেয় মায়ের প্রতি এ-ই রইলো আমাদের অঙ্গীকার। (সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×