somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্রীচৈতন্য দেব: যাঁর অন্তরে রাধা, বহিরঙ্গে কৃষ্ণ

৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ৯:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রাচীন ভারতের বৈদিক যুগের একজন প্রধান দেবতা হলেন বিষ্ণু। কৃষ্ণ, অর্থাৎ মথুরা-বৃন্দাবনের কৃষ্ণ ছিলেন সেই বিষ্ণুদেবতার অবতার। অর্থাৎ, মথুরা-বৃন্দাবনের মানুষ কৃষ্ণর মাঝে পেয়েছিল বিষ্ণুদেবতাকে। নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন তেুি কৃষের অবতার। অর্থাৎ, নবদ্বীপের মানুষ শ্রীচৈতন্যদেব মাঝে পেয়েছিল বৃন্দাবনের কৃষ্ণকে পেয়েছিল।
আর, কৃষ্ণ আর রাধার লীলার কথা কে না জানে। নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্যদেব যেহেতু কৃষ্ণের অবতার, তাই রাধা ছিল তাঁর আরাধ্য। শ্রীচৈতন্য দেব বলতেন আমার অন্তরে রাধা, বহিরঙ্গে কৃষ্ণ।
এই উক্তির ব্যাখ্যা অতীব গভীর।শ্রীচৈতন্য দেব ছিলেন পুরুষ। আমার অন্তরে রাধা মানে আমার অন্তরে নারীর অনুভূতি। নারীর অনুভূতিই যাবতীয় শিল্পের ভিত। শিল্প-সঙ্গীত পাশাপাশি থাকে। বাংলা গানের ভিতটি শ্রীচৈতন্যদেবের হাতেই গড়ে উঠেছিল। আমরা যে কীর্তনের কথা জানি- সেই কীর্তনের সঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেবের নাম জড়িত। লালন যে কীর্তন শুনতেন ছোটবেলায়। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে কাজী নজরুল সবাই কীর্তন অঙ্গে গান করেছিলেন।
শ্রীচৈতন্যদেবের বাবা জগন্নাথ মিশ্রর জন্ম হয়েছিল সিলেটে। পূন্যভূমি সিলেট বলার এও এক কারণ। সিলেটের সঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেবের মতন এক প্রেমময় মানুষের নাম জড়িত।
তরুন বয়েসে নদীয়ায় পড়তে এলেন জগন্নাথ মিশ্র। সে কালে নদীয়াই ছিল অন্যতম জ্ঞানতীর্থ। নদীয়ায় এসে শচী দেবীকে দেখে মুগ্ধ হলেন জগন্নাথ। সম্ভবত কোনও পন্ডিতের মেয়ে ছিলেন শচী। বিয়ে হল। ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দ। ফেব্র“য়ারি মাস। ১৮ তারিখটি ছিল ফাল্গুন জ্যোøার রাত। শচী দেবীর ঘর আলো করে এক শিশু জন্মাল। শখ করে নাম রাখল নিমাই। নদের নিমাই। মানে নদীয়ার নিমাই। লালনের একটি গান আছে না-

তিন পাগলের হল মেলা নদে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।

ওই তিন পাগলের একজন হলেন শচীপুত্র নিমাই, আমাদের শ্রীচৈতন্যদেব।
তো পাগল কেন জানেন?
তা হলে লালন কি বলেছেন শুনুন-

একটা পাগলামী করে/ জাত দেয় অজাতেরে দৌড়ে
আবার হরি বলে পড়ছে বলে পড়ছে ঢলে ধূলার মাঝে ...

তার মানে যার জাত নেই, সমাজ যার জাত দেয়নি, তাকে কতগুলি শিল্পমনস্ক পাগল জাত দিচ্ছে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে ...
এই তো বাংলা।
যার প্রতিটি বাঁকে এমন উদার মানবিকতার কিরণ-দূত্যি ছড়িয়ে রয়েছে।
যাক। শিশু নিমাই ক্রমে ক্রমে বালক হল।
আর সে কী দূরন্ত বালক। গাছে চড়ে, পাখির বাসা ভাঙ্গে তো দুপুর বেলা ঢিল ছুঁড়ে বামুনের কলসি ফুটো করে দেয়। আরও কত কি যে করে। নবদ্বীপের লোকে অতিষ্ঠ।
নবদ্বীপ নগরটি ঘেঁসে গঙ্গা নদীটি বইছে।
গঙ্গার ঘাটে কিশোরীরা জল নিতে আসত, নাইতে আসত।
নিমাই তখন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘাটে বসে আখ খেত আর ছড়া কাটত মেয়েদের উদ্দেশ্য করে।
এমনই দুষ্ট ছিল নিমাই।
কিন্তু, দুষ্ট হলে কি হবে- পড়াশোনা ঠিকই মন ছিল। মেধাবী বলে খ্যাতি ছড়ালো। তরুন বয়েসে এক পন্ডিতের ব্যকরণ ভুল ধরে আলোরণ তুললেন
তরুন বয়েসেই একদিন গঙ্গার ঘাটে দেখলেন এক মেয়েকে। গোলপানা মুখ, শ্যামলা গড়ন, এক মাথা চুল, মায়াবী চোখ। কে এ? কেঁপে উঠল তরুন নিমাই। খোঁজখবর করে দেখলেন মেয়ের নাম লক্ষ্মী, লক্ষ্মী দেবী। বিয়ে করবেন ঠিক করলেন। মা শচী দেবী বেঁকে বসলেন। কী কারণ কে জানে। নিমাই জেদ ধরল। বিয়ে হল।
বিয়ের পর বউকে রেখে পূর্ব বঙ্গে বেড়াতে বেরুলেন নিমাই। নৌকা করে। (নারীবাদীরা লক্ষ করুন-নিমাই কিন্তু লক্ষ্মীদেবীকে সঙ্গে নিলেন না!) নিমাইয়ের সঙ্গে ক’জন বন্ধুবান্ধব ছিল। আগেই বলেছি,তাঁর বাবা জগন্নাথ মিশ্র ছিলেন সিলেটের। সেই পিতৃভূমি যদি একবার ঘুরে দেখা যায়।
নিমাই নাকি পূর্ববঙ্গের মানুষের উচ্চারণে আমোদ পেয়েছিলে।
নবদ্বীপ ফিরে দুঃসংবাদ পেলেন।
লক্ষ্মীদেবী বেঁচে নেই। সাপে কেটেছিল।
নিমাইয়ের মাথায় বাজ পড়ল। তার সর্বাঙ্গ পুড়ে গেল। গভীর ভাবে ভালোবাসতেন লক্ষ্মীদেবীকে। সেই বেঁচে নেই। এখন বিরহ সম্বল। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান। গঙ্গার ঘাটে বসে থাকেন। একা। শান্তি পান না। ছটফট করে মন।
মায়ের মন। ছেলেকে দেখে উতলা হলেন। শচীদেবী ছেলের আবার দ্বিতীয়বার বিয়ের আয়োজন করলেন। কনের নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। বিয়ে হল। নতুন নারীতে মন বসল না। কেননা, বিয়ের রাতে নিমাই লক্ষ্মীকে বলেছিলেন, তুমি আমার রাধা।
রাধা দুজন হয় কি করে!
নিমাই পথে নামবেন বলে ঠিক করলেন।
তাই করলেন। পথে নামলেন। তীর্থে র্তীর্থে ঘুরলেন। নবদ্বীপ থেকে বৃন্দাবন। বৃন্দাবন থেকে নীলাচল। (এটি বর্তমান উড়িষ্যার পুরী)
নিমাইয়ে সঙ্গে অজস্র ভক্তশিষ্য। নিমাই একে পন্ডিত তার ওপর সুগায়ক। তাঁর ভক্তশিষ্য জোটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া ক্রমিক বিরহ তাঁকে আরও রুপবান করেছিল। গম্ভীর এক মাধুর্য ঝরে ঝরে পড়ত।
কীর্তন গাইতে গাইতে হাঁটছে নিমাই। তাকে ঘিরে ভক্ত শিষ্যরা; তারা খোল করতাল বাজাচ্ছে। মুখে রাধাকৃষ্ণ বোল।চলতে চলতে পথে কদম গাছ দেখে মূর্চ্ছা যায় নিমাই। বহুকাল আগে রাধাও অমন মূর্চ্ছা যেত কদম গাছ দেখে। এমনই ঘোর অবস্থা।
নিমাইয়ের খুব নাম ছড়াল।
লোকে তাঁকে ভক্তিভরে নাম দিল শ্রীচৈতন্যদেব।
আলাউদ্দীন হোসেন শাহ তখন বাংলার সুলতান ।তাঁর কানেও শ্রীচৈতন্যদেব নামটা পৌঁছেছিল। তিনি খোঁজখবর নিলেন। সব শুনে সন্তুষ্ট হলেন। আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ছিলেন উদার মনের মানুষ। বাংলায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারে তাঁর আপত্তি ছিল না।
১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ।
শ্রীচৈতন্যদেব ঘন ঘন মূর্চ্ছা যাচ্ছেন। বারবার লক্ষ্মীদেবীকে দেখছেন। রাধার মাঝে লক্ষ্মীদেবীকে দেখছেন। আবার লক্ষ্মীদেবীকে মনে হচ্ছে রাধা।
নীলাচলে সমুদ্রের পাড়।
একদিন। সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
মনে হল লক্ষ্মী যেন ঢেউয়ের ওপর ভেসে আছে।
ডাকছে।
তিনি সমুদ্রে নেমে যেতে লাগলেন।

তথ্যসূত্র:
দীনেশচন্দ্র সেন; বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (প্রথম খন্ড।)
বাংলাপিডিয়া
বাংলা অভিধান: শব্দসঞ্চয়িতা
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৪২
২৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×