somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কারা ছিল আজীবিক ?

২৩ শে নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৪:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই ছবিটি একালের একজন বৃদ্ধর। ইন্টারনেটে পেয়েছি। তবে আমার কেন যেন মনে হয়- আজীবিক ধর্মসম্প্রদায়ের গুরু গোশাল মংখলিপুত্ত দেখতে কতকটা এরকমই ছিলেন।

যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে কথা।
প্রাচীন ভারতে তখন এক নতুন সময়ের আগমনী সুর বাজছিল। পুরনো ট্রাইবাল জীবনধারা ভেঙ্গে পড়ছিল; তার জায়গায় গড়ে উঠছিল-রাষ্ট্র। গঙ্গার দুপাশের তীরে তীরে গড়ে উঠছিল পেশাভিত্তিক সব নগর, গড়ে উঠছিল বানিজ্যকেন্দ্রিক সব জনপদ।
নগর-জনপদের বাইরে ছিল অবারিত ফসলের মাঠ। সে মাঠে কৃষিকাজ হত। শূদ্রকৃষক খাটত সেসব মাঠে। মাঠের পাশে ছিল চওড়া ধূলিময় পথ । সে পথে চলত হাজার হাজার গরুর গাড়ি: সার্থবাহের দল যেত দূর নগরের উদ্দেশ্যে। হয়তো, রাজগৃহ থেকে শ্রাবস্তী।
পথে সাধু সন্ন্যাসীদেরও দেখা যেত। দলবেঁধে কিংবা একা। যে কালের কথা বলছি- সে কালে সাধুসন্ন্যাসীর ভীষন সম্মান ছিল। অবারিত প্রান্তরের কোণে কিংবা নির্জন অরণ্যে ধর্মালোচনায় মগ্ন কিংবা ধ্যানে বসে থাকতে দেখা যেত সাধুসন্ন্যাসীদের।
সে সময়টায় গড়ে উঠছিল শত শত ধর্মীয় মঠ; শত শত সন্ন্যাসী সংঘ। এমন কী সাব্বী (নারী) সংঘও গড়ে উঠেছিল তৎকালীন ভারতবর্ষে। জৈনধর্মের ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর স্বাধীন নারী (সাব্বী) সংঘ স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধের অনেক আগেই; এমনই বিস্ময়কর যুগ ছিল সেটি ।
যে সময়টার কথা বলছি, সেই সময়টায় ব্যবসাবানিজ্যে সামরিক শক্তিতে উন্নত এক রাজ্য ছিল মগধ (বর্তমান বিহার)। মগধের রাজধানী ছিল রাজগৃহ। সে সময়কার লোকের মুখের ভাষা ছিল মাগধী (বা অর্ধমাগধী) মগধ। মগধের ভাষাই মাগধী। মগধের রাজা ছিলেন বিম্বিসার; ভারি প্রজাবৎসল রাজা। অধিকন্তু, সাধুসন্ন্যাসীদের পৃষ্টপোষকতা করতেন। রাজগৃহ নগরে ছিল সাধুসন্ন্যাসীদের ভিড়। রাজগৃহ নগরের লোকেরা জাগতিক শ্রীসম্পদের পাশাপাশি জানছিল নতুন নতুন ধর্মমতের কথা। জৈন, বুদ্ধ আজীবিক-আরও কত মত, কত পথ। বৌদ্ধ গ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকায়, মহানিদ্দেস ও চুল্লনিদ্দেসে সেই সময়কা কয়েকটি স¤প্রদায়ের নাম উল্লেখ আছে। যেমন- নির্গ্রন্থ জটিলক পরিব্রাজক অবিরুদ্ধক মুন্ডুশ্রাবক মাগন্ডিক ত্রৈদন্ডিক গৌতমক (বৌদ্ধ নয়) দেবধার্মিক প্রভৃতি।
এরা সবাই ছিল বেদপ্রামাণ্যবিরোধী।



এইসব বেদপ্রামাণ্যবিরোধী মতের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল বৌদ্ধ ও জৈনমত।
তবে সেই সময়ে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মতো আজীবিক মতটিও প্রাধান্য পেয়েছিল ভারতীয় সমাজে। বলাবাহুল্য, মতটিও ছিল নাস্তিক ও বেদপ্রামাণ্যবিরোধী।
একজন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক আজীবিক ধর্মের উত্থান সম্বন্ধে লিখেছেন-
About the time of the rise of Buddhism, there was a sect of religious mendicants, the Ajivikas, who held unorthodox views. In the strict sense, this name is applied to the followers of one Makkhali Gosala, but in a wide sense it is also applied to those who taught many different shades of heretical teachings. Primary sources of knowledge about these are the Digha Nikaya, Anguttara Nikaya, Samyutta Nikaya, the Sutrakrtanga-sutra, Shilanka's commentary on the Sutrakrtanga-sutra, the Bhagavati-sutra, the Nandi-sutra, and Abhayadeva's commentary on Samavayanga-sutra.
Ajivika শব্দটার মানে ভীষন ঘোলাটে। মনে হয় “অজীব” শব্দ থেকে আজীবিক শব্দটা উদ্ভূত। অ-জীব মানে জীব নয়; প্রাণশূন্য। মানে, যারা জীবিত নয় মৃত।
এই কথার সামান্য ব্যাখ্যা দরকার।
আজ তক আজীবিক সম্প্রদায়ের নিজেদের কোনও লেখা (ধর্মগ্রন্থ) পাওয়া যায়নি। যাও বা পাওয়া গিয়েছে তা সবই জৈন ও বৌদ্ধ সূত্রে উল্লেখিত। জৈন ও বৌদ্ধদের সঙ্গে আজীবিকদের ছিল দা-কুমড়ো সম্পর্ক। কাজেই আজীবিকদের বিরুদ্ধে কুৎসা তারা রটাতেই পারে। সম্প্রদায়ের নাম দিতে পারে আজীবিক। তারা বলতেই পারে আজীবিক মত হল ফালতু, প্রাণশূন্য বা আজীব (!)
যাহোক। আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোশাল মংখলিপুত্ত। তিনি ছিলেন বুদ্ধ ও মহাবীরের সমসাময়িক। গোশাল মংখলিপুত্ত প্রখর নিয়তিবাদী ছিলেন বলেই বুদ্ধ ও মহাবীর তার ওপর ভীষন চটে ছিলেন।



মংখ মানে চারণ কবি ও চিত্রকর। তাহলে মংখলিপুত্ত মানে মংখ-এর ছেলে। কাজেই গোশাল মংখলিপুত্তর বাবা ছিলেন একজন চারণ কবি ও চিত্রকর। মংখলিপুত্ত-এই শব্দটা পালি। সংস্কৃতে কথাটা মংখলিপুত্র। গোশাল মানে বোঝা যায়। যার জন্ম গোয়াল ঘরে। হতে পারে। আজও গ্রামের বাড়িতে আঁতুর ঘর আর গোয়াল ঘরের পার্থক্য কী এমন! আর জগতের শ্রেষ্ট এক মানুষের জন্ম হয়েছিল গো-শালায়। অবশ্য, মংখলিপুত্তর জন্ম গোশালায় না ও হতে পারে। আগেই বলেছি- জৈন ও বৌদ্ধদের সঙ্গে আজীবিকদের ছিল দা কুমড়ো সম্পর্ক। কাজেই, তারা আজীবিকগুরুর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেই পারে।
বৌদ্ধ ধর্মের এক বিখ্যাত টীকাকার ছিলেন বুদ্ধঘোষ। বুদ্ধঘোষ একবার বলেছিলেন, আরে, গোশাল মংখলিপুত্ত! ছোঃ সে ছিল এক পলাতক দাস!
কাজেই -অহিংসপন্থীদের মনে সামান্য হলেও হিংসা ছিল?



যা হোক, অনুমান করা যায় যে যথা সময়ে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিল গোশাল। সম্ভবত তরুন বয়েসেই।
তারপর?
তারপর আর কি? বহু বছর ঘুরল প্রাচীন ভারতের পথে পথে গোশাল। যে পথের দুপাশে ছিল অরণ্য কিংবা অবারিত ফসলের মাঠ। আর সে পথ ছিল চওড়া ও ধূলিময়। পথে সার্থবাহের দল চলেছে দূর নগরের উদ্দেশ্যে। অযোধ্যা কিংবা অবন্তী।
সে পথেই হাঁটছিল গোশাল মংখলিপুত্ত। ইষৎ বিভ্রান্ত। সে জানতে চায় জীবন ও জগতের মানে। জীবনে কেন এত দুঃখ। কেন এত শীর্ষসুখ। কেন ভিজে চুম্বনসুখ! কেন নীল দংশনবিষ!
মাথায় কত কথা ঘোরে।

ক.

আমি কে?
কে আমি?
একা আমি?
ভিড়ের আমি?
তুমি কে?
কে তুমি?
তুমি আমি
আমি তুমি
আমি তুমি
তুমি আমি

খ.

সাপ কেন
এঁকে বেঁকে আসে?
বিষ ঢেলে চলে যায়
শেষে?

রমনীর জংঙ্ঘাগুহা
কামার্ত। ডাকে।
কেন সুখ হয়
মাংশের
কোমল
সংঘাতে?



প্রাচীন ভারতের ধর্মমত নিয়ে গবেষনা করেছেন বিশিস্ট গবেষক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি লিখেছেন- “তাঁর (গোশালের) পূর্ববর্তী দু’জন আজীবিক গুরুর নাম পাওয়া যায়। নন্দ বচ্চ ও কিস সংকিচ্চ। ” (দ্র:ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট। পৃষ্ঠা, ৭৪)
অতএব কল্পনা করি-
হাঁটতে হাঁটতে একদিন গোশাল এক অরণ্যের কাছে চলে এল। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। অঘ্রান মাস। দুপুর রোদে শীতার্ত হাওয়ার মৌন কাঁপন। সোনালি রোদে কত যে পাখপাখালি ডাকছিল। আশেপাশে কত যে গাছ। নিম, কড়ই, হরীতকী। হঠাৎ চোখে পড়ল: একটা হরীতকী গাছের নিচে দুজন সন্ন্যাসী বসে ছিলেন। দুজনেই বৃদ্ধ। দুজনেই শীর্ণ কালো ও হাড্ডিসার। চুলে জট। নগ্ন। নগ্ন সাধু যে আগে গোশাল দেখেনি- তা নয়। তবু কী এক কৌতূহলভরে গোশাল তাদের কাছে এগিয়ে গেল। সাধুদের মুখোমুখি বসল। নগ্ন সন্ন্যাসী দুজন তাকে দেখল। কিছুক্ষণ মৌন কাটল। তারপর গোশাল তার পরিচয় জানাল। সন্ন্যাসীদের একজন বললেন, আমার নাম কিস সংকিচ্চ। অন্যজন বললেন, আমার নাম নন্দ বচ্চ। গোশাল বলল, আমি জ্ঞান তৃর্ষাত। জগৎ সম্বন্ধে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি লাভের উদ্দেশ্যে আমি গৃহত্যাগ করেছি। আমাকে বলুন। আপনারা কী বিশ্বাস করেন।
গোশালের কথায় বৃদ্ধ সন্ন্যাসীরা সন্তুষ্ট হলেন। জ্ঞানীমাত্রেই জ্ঞানের আলোচনা পছন্দ করেন। কাজেই কিস সংকিচ্চ বললেন, মহারাজ সত্ত্বগনের সংক্লেশের হেতুও নাই, প্রত্যয় নাই; হেতু ও প্রত্যয় বিনা সত্ত্বগণ সংক্লিষ্ট হয়। সত্ত্বগণ শুদ্ধির হেতুও নাই। প্রত্যয়ও নাই। হেতু ও প্রত্যয় বিনা তাহাদের শুদ্ধি হয়। আত্মা-কার নাই, পর-কার নাই, পুরুষ-কার নাই, বল নাই, বীর্য নাই,পুরুষ-স্থাম নাই, পুরুষ পরাক্রম নাই, সর্বসত্ত্ব, সর্ব প্রাণি, সর্ব ভূত, সর্ব জীব অবশ, অবল, নির্বীর্য। তাহারা নিয়তি ও সংযোগ পরিচালিত এবং ষড়বিধ জাতিভুক্ত হইয়া স্বীয় স্বীয় জাত্যানুসারে সুখদুঃখ অনুভব করে।
কথাগুলি শুনতে শুনতে গোশাল কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল গোশাল। সবই কি নিয়তি? গ্রামের শান্ত জীবন আর নেই। সবাই নগরমুখী। নগরে ভিড়। কাম। লোভ। রিরংশা। সবই কি নিয়তি?
নন্দ বচ্চ এবার বললেন, কেহ কেহ মনে করিতে পারেন ‘আমি এই শীল, এই ব্রত, এই তপ, অথবা এই ব্রহ্মচর্যের দ্বারা আপরিপক্ক কর্মের পক্কতা সাধন করিব, অথবা পরিপক্ক কর্মকে ভোগ করিয়া উহার অন্ত করিব।’ কিন্তু তাহারা কৃতকার্য হইবেন না। সংসারে দ্রোণ-তুলিত সুখদুঃখের পরিবর্তন হয় না। উহার হ্রাসও নাই, বৃদ্ধিও নাই, উৎকর্ষ নাই,অপকর্ষও নাই, যেমন সূত্রগুল ক্ষিপ্ত হইলে তাহার গতি বেষ্টনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, সেইরুপ, মূর্খ ও পন্ডিত সকলেই পুন: পুন: জন্মগ্রহন করিয়া দুঃখের অন্ত করিবে।
(বৌদ্ধ গ্রন্থ দীগ নিকায়ে গোশাল মংখলিপুত্তর জবানীতে এই কথাগুলি রয়েছে; আমি কেবল নাট্যদৃশ্যের মত করে উপস্থাপন করলাম।)
কিস সংকিচ্চ আর নন্দ বচ্চর কথাগুলো খুব টানল গোশালকে। মায়ের কথা মনে পড়ল তার। মাকে সাপে কেটেছিল; অথচ মা ছিল পরের দুঃখে কাতর। গ্রামের সবার খোঁজ খবর নিত। নিজের মুখের ভাত তুলে দিত ক্ষুধার্তকে। সেই মাকেই কিনা সাপে কাটল! ঈশ্বর বলে কেউ নেই। সবই নিয়তি।
গোশাল কিস সংকিচ্চ আর নন্দ বচ্চর নিয়তিবাদ গ্রহন করবে বলে ভাবল। তাঁর সম্বন্ধে এক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লিখেছেন-Makkhali's views may be thus summarized. There is no cause of the depravity of things; they become depraved without any reason or cause. There is also no cause of the purity of beings; they become pure without any reason or cause. Nothing depends either on one's own efforts or on the efforts of others. All things are destitute of power, force, or energy. Their changing states are due to destiny, environment, and their own nature. Thus, Makkhali Gosali denies sin, or dharma, and denies freedom of man in shaping his own future. He is thus a determinist, although scholars have held the view that he might leave room for chance, if not for freedom of will. He is supposed to have held an atomistic cosmology and that all beings, in the course of time, are destined to culminate in a state of final salvation. He believes not only in rebirth but also in a special doctrine of reanimation according to which it is possible for one person's soul to be reanimated in the dead bodies of others. Thus, the Ajivikas are far from being materialists.
গোশাল জিজ্ঞেস করল, আপনারা নগ্ন কেন?
কেন আর।জীবনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নন্দ বচ্চ বললেন।
জীবন তো আমরা চাইনি। এ জীবনের সুখও না, দুঃখও না। কিস সংকিচ্চ বললেন।
কী ভেবে গোশাল উঠে দাঁড়াল।
শরীরের কাপড় খুলে ফেলল।
তারপর নন্দ বচ্চ ও কিস সংকিচ্চ কে প্রণাম করে আবার পথে নামল।



নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন-“ মহাবীর তার সন্ন্যাসজীবনের তৃতীয় বর্ষে গোশালের সাক্ষাৎ পান এবং তাঁর সাহচর্যে ছয় বৎসর কাটান।” ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট। (পৃষ্টা, ৭৫)

এক ধর্মশালায় আহারের সময় এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হল গোশালের। বৈশালীর সেই যুবকের নাম: মহাবীর। প্রথম দৃষ্টিতেই পরস্পর পরস্পরকে কেমন টানল। বন্ধুত্বও হল। তারপর মহাবীরের সঙ্গে বছর ছয়েক কাটল গোশালের। তারপর দুজনের মধ্যে মতবিরোধ হয়। গোশাল মংখলিপুত্ত প্রখর নিয়তিবাদ মেনে নিতে পারছিল না মহাবীর। গোশালের ওপর প্রথম থেকেই বিরক্ত ছিলেন। এই যে বণিকেরা জনপদে জনপদে এত যে প্রভূত উন্নতি করছে-এ কি প্রচেস্টা ও কোনও কর্মফলের জন্য নয় ?
ক’জনের লাভ হয় বল? বেশির ভাগই তো পথে বসে। গোশালের উত্তর।
এই সব অক্রিয়বাদী কথাবার্তার কারণে গোশালের ওপর ভয়ানক ভীষন চটে উঠল মহাবীর।
দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল।
তবে অনেকই মনে করেন যে মহাবীরকে প্রভাবিত করেছিলেন গোশাল। মহাবীরের নগ্নতা নাকি গোশালেরই প্রভাব। পরে মহাবীরের সে নগ্নতার ওপর আরোপিত হয়েছিল অহিংসবাদ। এমন কী যা প্রেরণা যুগিয়েছিল পরবর্তীকালের জৈন দিগম্বরদের।



নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন- “শ্রাবস্তীতে এক কুম্ভকুম্ভকারণীর গৃহ তার (গোশালের) প্রচারের কেন্দ্র হয়। ” ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট। (পৃষ্টা, ৭৫)

গোশাল মংখলিপুত্ত আবার পথে নামল।
একা।

আমি কে?
কে আমি?
একা আমি?
ভিড়ের আমি?
তুমি কে?
কে তুমি?
তুমি আমি
আমি তুমি
আমি তুমি
তুমি আমি

একা ও নিয়তিবাদী।
মনের ভিতর ভয়ানক তিক্ততা। মহাবীর মেধাবী। সে কেন বুঝল না-আত্মা-কার নাই, পর-কার নাই, পুরুষ-কার নাই, বল নাই, বীর্য নাই,পুরুষ-স্থাম নাই, পুরুষ পরাক্রম নাই, সর্বসত্ত্ব, সর্ব প্রাণি, সর্ব ভূত, সর্ব জীব অবশ, অবল, নির্বীর্য। তাহারা নিয়তি ও সংযোগ পরিচালিত এবং ষড়বিধ জাতিভুক্ত হইয়া স্বীয় স্বীয় জাত্যানুসারে সুখদুঃখ অনুভব করে।
হাঁটছিল গোশাল। প্রাচীন ভারতের পথে পথে । যে পথের দুপাশে ছিল অরণ্য কিংবা অবারিত ফসলের মাঠ। আর সে পথ ছিল চওড়া ও ধূলিময়। পথে সার্থবাহের দল চলেছে দূর নগরের উদ্দেশ্যে। উজ্জ্বয়নী কিংবা অশ্মক।
অনির্দিষ্টভাবে ঘুরতে ঘুরতে শ্রাবস্তী নগরের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন গোশাল।
ওই নগরেই ছিল এক কুমাড়পাড়া। কুমাড়পাড়ায় ছিল এক কুম্ভকারণীর বাড়ি। সেই মধ্যবয়েসী কুম্ভকারণীর নাম ছিল- ধরা যাক, বিমলা। ধরা যাক বিমলা ছিল বিধবা। একদিন ভোরবেলা দিঘিতে জল আনতে গেছিল বিমলা।
ফেরার পথে পথের ধারে নগ্ন সাধুকে বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল বিমলা। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। সাধু যে দিগম্বর। বিমলা সাধুর দিকে এগিয়ে যায়। তবে সবেমাত্র রোদ ফুটতে শুরু করেছে। কলসিটা মাটিতে নামি রেখে বসল সাধুর মুখোমুখি। মুখ তুলে তাকাল সাধুটি। কে এই নারী? একেবারে মায়ের মুখের আদল। মা আবার ফিরে এলেন? সবই নিয়তি।
আমি যে সময়টার কথা বলছি-সে কালে সাধুসন্ন্যাসীর বিস্তর সম্মান ছিল। সুতরাং, বিমলা বলল, বাবা। আমার ঘরে দিনকত বাস করলে ভারি কেতার্থ হতুম।
কোথায় তোমার ঘর গো? গোশালের কন্ঠস্বরে ঝরে ঝরে পড়ে কৌতুক।
হাত তুলে বিমলা বলল, ঐ যে গো। কুমোড়পাড়ায়। কাছেই। স্বামী বেঁচে নেই। একাই থাকি। আমায় তুমি কেতার্থ কর না বাবা।
এবারে গোশাল বলল-তুমি ঘর পেয়েছ বুঝি মা? আমি এখনও পাইনি। বলছ যখন- চল তা'লে। দেখি কেমন তোমার খুপরি। বলে উঠে দাঁড়ালেন গোশাল। ততদিনে বয়স হয়েছিল গোশালের। শরীরও চলছিল না । কোথাও থিতু হবেন ভাবছিলেন। স্থান জুটল। নিয়তি?
গোশালকে ঘরে নিয়ে গেল বিমলা।
ঘটনাটির ফ্রয়েডিও ব্যাখ্যা থাকলেও থাকতে পারে। তবে আমরা এও জানি যে-কোনও কোনও নারীর ভিতর ধর্মপালনে কেমন এক উদগ্র তাড়না থাকে। বিমলা হয়ত সেই ধরনেরই।
তো, কুম্ভকারণীর ঘরে দিন কাটছে গোশালের।
খবর রটল: কুমারপাড়ার বিধবা বিমলা কোন্ এক যোগী নগ্ন অলীক সাধুকে নাকি ঘরে তুলে এনেছে। খুব নাকি যতœ নিচ্ছে সাধুটির।
বিধবা কুম্ভকারণীর ঘরে লোকেরা ভিড় করল এসে। বেশির ভাগই নিুকায়। জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন সব। নগ্ন সাধুটি যদি উদ্ধারের পথ দেখাতে পারে। লোকে গোশালের কাছে এল। তিনি যা বলার বললেন। There is no cause of the depravity of things; they become depraved without any reason or cause. There is also no cause of the purity of beings; they become pure without any reason or cause. Nothing depends either on one's own efforts or on the efforts of others.লোকে শুনল সে কথা । আত্মা-কার নাই, পর-কার নাই, পুরুষ-কার নাই, বল নাই, বীর্য নাই,পুরুষ-স্থাম নাই, পুরুষ পরাক্রম নাই, সর্বসত্ত্ব, সর্ব প্রাণি, সর্ব ভূত, সর্ব জীব অবশ, অবল, নির্বীর্য। তাহারা নিয়তি ও সংযোগ পরিচালিত এবং ষড়বিধ জাতিভুক্ত হইয়া স্বীয় স্বীয় জাত্যানুসারে সুখদুঃখ অনুভব করে।



বিদ্যমান শ্রেণিকাঠামোর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন গোশাল। গোশালের ব্যাখ্যায় বৈদিক সমাজের নিুবর্গীয় শূদ্ররা শান্ত্বনা পেয়েছিল প্রভূত। গোশাল মংখলিপুত্ত শিষ্যদের মধ্যে শূদ্ররা ছিল বেশি। প্রথম দিকে বৌদ্ধদের চেয়ে আজীবিক সংখ্যা ছিল বেশি। গোশালের কথা ছিল সহজ সরল । সুতরাং, গোশাল-মত জনপ্রিয় হয়েছিল। আদর্শিক বিরোধ নিয়ে বৌদ্ধদের সঙ্গে আজীবিকদের প্রতক্ষ সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল । পরে অবশ্য বৌদ্ধরাই জিতেছিল।
এর একটা কারণ, গোশালের মত ছিল একপেশে। অদৃষ্টবাদী। অদৃষ্টবাদ নতুন বণিক কেন্দ্রিক সমাজের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগের প্রাচীন ভারতের ওই সময়টার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল বণিক শ্রেণির উত্থান। বণিক শ্রেণির কার্যকলাপই ষোলটি জনপদের ভিত রচনা করে দিয়েছিল। নগরজীবন হয়ে উঠেছিল গুরুত্বপূর্ন। পুরনো ট্রাইবাল আদর্শ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। কিস সংকিচ্চ এবং নন্দ বচ্চর মতো সন্ন্যাসীরা নতুন আর্দশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিল না; কাজেই তারা হয়ে উঠেছিল নিয়তিবাদী। নবতর জীবনবোধের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি গোশালও। কিস সংকিচ্চ এবং নন্দ বচ্চর প্রভাবে গোশাল হয়ে উঠেছিল নিয়তিবাদী । তৎকালীর সামাজিক পরিবর্তনের তাৎপর্য উপলব্দি করতে পারেন নি বলেই গোশাল নিয়তিবাদী হয়ে পড়েছিলেন। বললেন: মানুষ অসহায়। সৎ কাজ করে মানুষ তার ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। কেননা, ঈশ্বর বলে কেউ নেই। আর সবই নিয়তি নির্দিস্ট। মানুষকে দুখের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ৮৪০০০০০ বার জন্ম নিতে হবে। এ বিষয়ে জ্ঞানী মূর্খের মধ্যে পার্থক্য নেই।
অথচ। নতুন জীবনবোধের সঙ্গে বুদ্ধ ও মহাবীর ঠিকই খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিলেন। কাজেই দেখা গেল- বৌদ্ধ ও জৈনরা ছিল বণিক শ্রেণির স্বার্থের প্রতি সদয়। ঋণদান সুদগ্রহন ও দাস রাখা বৌদ্ধ ও জৈনরা অনুমোদন করেছে। কর প্রদানকে বলা হয়েছে গুণ !
নতুন রাষ্ট্রের উপযোগী হয়ে উঠেছিল বেদপ্রামাণ্যবিরোধী ধর্মদুটি। বলল, প্রানিহত্যা মহাপাপ। বলল, হে অজ্ঞ ব্রাহ্মণগন, যজ্ঞে অত ষাঁড় মেরো না। তা হলে বণিকেরা তাদের পণ্য নিয়ে কী ভাবে এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে যাবে?



একদিন বিমলার মুখে ভয়ঙ্কর এক দুঃসংবাদ শুনলেন গোশাল।
মগধের সম্রাট ছিলেন বিম্মিসার। তাঁর ছেলে অজাতশক্র । বাবাকে হত্যা করেছে অজাতশক্র। আহারে। মগধের রাজা বিম্বিসার। ভারি প্রজাবৎসল। সাধুসন্ন্যাসীদের পৃষ্টপোষকতা করতেন।
গোশাল বিষন্ন হয়ে পড়লেন।
কয়েক মাস পর। শিষ্যদের মুখে আরেকটি ভয়ানক দুঃসংবাদ শুরে ভারি মুষড়ে পড়লেন গোশাল।
গঙ্গার উত্তরের ছত্রিশটি গনরাজ্য অজাতশক্রর বিরুদ্ধে মিত্রসংঘ গঠন করেছে।
যুদ্ধ আসন্ন।
উন্মাদ হয়ে গেলেন গোশাল।
বিমলাই হয় তো আগলে রেখেছিল সে সময়টা।
গোশালের মৃত্যু। ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্ব।



গোশাল মংখলিপুত্তর মৃত্যুর পরও তাঁর নিয়তিবাদী আজীবিক মতটি টিকে ছিল আরও অনেক অনেক বছর। মৌর্য যুগে ভারি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল আজীবিক ধর্মমতটি । স্বয়ং মৌর্য সম্রাট বিন্দুসার ছিলেন গোশাল মংখলিপুত্তর একনিষ্ট ভক্ত। সম্রাট অশোকের পিতা ছিলেন বিন্দুসার। অশোকের এক পৌত্র ছিল। নাম দশরথ। আজীবিক স¤প্রদায়ের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছিলেন দশরথ।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর মতে- ত্রয়োদশ শতকের পর নবজাগ্রত বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে মতবাদটি লুপ্ত হয়ে যায়।

১০

ভারতে আজীবিকরা আজও রয়ে গেছে!
সে দিন নব্য আজীবিকদের একটা ওয়েবসাইট দেখলাম।
http://www.rev.net/~aloe/ajivika/
গোশাল মংখলিপুত্ত আজও তাই একেবারেই বিস্মৃত হননি।
বেঁচে রয়েছেন। অন্যভাবে।

তথ্যসূত্র:

বই

১) নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখিত-ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট।
২) সুনীল চট্টোপাধ্যায় লিখিত-প্রাচীন ভারতের ইতিহাস। (১ম খন্ড)

ওয়েবসাইট-

Click This Link
Click This Link


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৫৯
২৭টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×