আমরা জানি, মওদুদীবাদীরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের দখল নিতে চায়। রাষ্ট্রের দখল নিতে চায় জেহাদীপন্থায়। কিন্তু তা কতটুকু ইসলাম সম্মত? এই প্রশ্নটি উঠতেই পারে যখন যুদ্ধাপরাধী মওদুদীপন্থিদের আমরা বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছি।
মওদুদীবাদীরা রাষ্ট্রের দখল নিতে চায়: অথচ রাষ্ট্রের ধারনাটি আধুনিক। জনৈক ঐতিহাসিকের মতে, State, in political science, generally a group of people inhabiting a specific territory and living according to a common legal and political authority; a body politic or nation. In this definition, the term state includes government; in another usage, the two terms are synonymous.(Microsoft ® Encarta ® 2008. © 1993-2007 Microsoft Corporation. All rights reserved.) এসব কারণেই মধ্যযুগে রাষ্ট্রের ধারনা ছিল না। কেননা, মধ্যযুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে অঞ্চলসমূহ অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ছিল। পরবর্তীতে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে- যা জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে ।
ইসলামের উদ্ভব মধ্যযুগে বলেই ইসলামের দিকনির্দেশনাগুলি ব্যাক্তিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চর্চার জন্য নয়। অর্থাৎ, শরীয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল অনিবার্য নয়। মাওলানা মওদুদীর চিন্তার ভ্রান্তি এখানেই। কুড়ি শতকে বাস করে ইনি ইসলামকে কুড়ি শতকী করার চেষ্টা করেছেন। কেন? মূল কারণ-ইসলামী বিশ্বের অবক্ষয় ও পশ্চিমে অগ্রগতি। মধ্যযুগের উন্নত ইসলাম কুড়ি শতকে অচল। যে কারণে কামাল পাশা তুরস্কে পুরনো ধ্যানধারনার অনুসারী খেলাফত ধ্বংস করলেন। আমরা জানি, ১৩ শতক থেকে অটোমান তুর্কিরা প্রায় ৬০০ বছর তুরস্ক শাসন করেছে। সে যুগে এক রাজ্য অন্য রাজ্য দখল করত। অটোমান তুর্কদের লক্ষ্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ছিল না। তারা মুসলিম বলেই তাদের রাষ্ট্রপরিচালনায় ইসলামী রীতিনীতি গ্রহন করেছিল।
তা সত্ত্বেও মাওলানা মওদুদী রাষ্ট্র নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন কেন?
সেই প্রেক্ষাপটটি বোঝার দরকার আছে।
ইউরোপে আমরা জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ লক্ষ্য করি অস্টাদশ উনিশ শতক থেকে। অর্থাৎ, তখন থেকেই ইউরোপে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠতে থাকে। সে সময় খ্রিষ্টান ধর্মকেও আধুনিক ইউরোপের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এক ব্যাপক সংস্কার আন্দোলনের ফলে ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করার দাবী উঠেছিল। ষোড়শ শতক থেকেই ইউরোপের পন্ডিতরা রাষ্ট্র সংক্রান্ত নিজেদের ধারনা ব্যক্ত করে আসছেন। ফলত ক্রমশ উনিশ শতকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানও পৃথক শাখার মর্যদা লাভ করে। যার ফলে উনিশ শতকের অন্যতম মতাদর্শ হয়ে ওঠে মার্কসবাদ। মার্কসবাদ শেখায় কী করে রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বহারাদের কল্যাণে অধিকৃত করা যায় বিপ্লবের মাধ্যমে। মার্কবাদী চিন্তাধারা প্রসারের ফলেই কুড়ি শতকের প্রারম্ভে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ঘটল- ১৯১৭ সালের সোভিয়েত বিপ্লব। সেই অক্টোবর বিপ্লবের দশটি দিন পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল। যা অনিবার্যভাবে বিশ্বের ইসলামী চিন্তাবিদদেরও প্রভাবিত করেছিল। যেমন, মিশরে হাসান আল বান্না, সৈয়দ কুতুব। পাকিস্থানে আবুল আলা মওদুদী। তারা লক্ষ করলেন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে শ্রেণিগত মতার্দশ প্রয়োগে করা যায়। তারা উদ্বুদ্ধ হলেন। এক্ষেত্রে সর্বহারার একনায়কত্ব নয়-ওয়াহাবীবাদ। তারা 'জেহাদ' শব্দটির নতুন ব্যাখ্যা দিলেন। আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন- জায়ামাত ই ইসলামী ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করে। ক্যাডার পদ্ধতিটির উদ্ভব করেছেন মহামতি লেনিন। কাজেই মওদুদী যে ইসলামী বিপ্লবের কথা বলেন তা আসলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবেরই ইসলামীকরণ। তারা উপলব্দি করলেন-রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে প্রতিষ্ঠা করা যায় ইসলাম। এক্ষেত্রে সুফিবাদ নয়-ওয়াহাবী ইসলাম। ওয়াহাবীদের সম্বন্ধে নিয়াজ জামান এবং এ টি এম মুসলে উদ্দীন লিখেছেন, Wahabis a Muslim sect dominant in Saudi Arabia and Qatar, named after its founder, Muhammad ibn Abd al-Wahhab (1703-1787). Wahabis interpret Islam in the light of opinions expressed by the Prophet muhammad (Sm) and his companions. They consider the practices of later generations as be-daat or innovations, and hence unacceptable. Wahabis do not recognise esoteric approach and mysticism and do not believe that the walis have any special spiritual powers. They also do not believe in constructing tombs and mausoleums in memory of the dead. Accordingly, graveyards in Saudi Arabia are kept open and unmarked. Wahabis frown upon visits to tombs and mausoleums. The only exception they make is with regard to the tomb of the Prophet. They, however, are not inclined to honour the Prophet's grave as a holy place or one of special spiritual benefit to visitors. Wahabis are also opposed to observing milad. Wahabis are not many in number in Bangladesh. (দ্র;বাংলাপিডিয়া)
ওয়াহাবীবাদ গ্রহন করে কুড়ি শতকে বাসবাস করার ফলেই ইসলামকে কুড়ি শতকী করার চেষ্টা করেছেন আবুল আলা মওদুদী। এর আরেকটি কারণ ছিল। ইসলামী বিশ্বের অবক্ষয় ও পশ্চিমের বিস্ময়কর অগ্রগতি। কুড়ি শতকের বিশ্বে মানুষের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মূলে ছিল রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ। মওদুদী যে কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারনা গড়ে তুলেন। আরব জাতীয়তাবাদ আর প্রযোজ্য নয় বলেই তার বদলে ইসলামী জাতীয়তাবাদ প্রচার করেন । ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি ও তার দল ভারতীয় উপমহাদেশে নানান অঘটন ঘটান। ওয়াহাবীবাদী মওদুদীদের রাষ্ট্র দখলের অপতৎপরতার কুফল ভারতীয় উপমহাদেশে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। প্রথমত, মওদুদী পঞ্চাশের দশকে পাকিস্থানে হয়ে উঠেছিলেন প্রভাবশালী। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল না করেই তিনি পাকিস্থানী সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করে আহমেদীয়দের নিশ্চিহ্ন করার জন্য লেলিয়ে দিয়েছেন। এমনই অসহিষ্ণুতা তার! ধরে নিলাম আহমেদীয়রা বিপথগামী অমুসলিম। তাই বলে তাদের গ্রাম ট্যাঙ্কের নিচে গুঁড়িয়ে দিয়ে হত্যা করতে হবে! দ্বিতীয়ত, ৭১-এর মওদুদীপন্থিদের রাষ্ট্রের খেদমত করার সুযোগ এল পূর্ব পাকিস্থানে। তথাকথিত পাকিস্থানী রাষ্ট্রটির অখন্ডতা রক্ষার্থে পাকিস্থানী সৈন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা কী জঘন্য অপকর্ম করেছে সে সম্বন্ধে নতুন করে আর কি বলব!
এখন প্রশ্ন এই- মওদুদীর দাবী অনুযায়ী ইসলাম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক কি। এই প্রশ্নটাই অযৌক্তিক। যদি প্রশ্ন করেন ঢাকার রাজধানী কি- সেরকম অযৌক্তিক। কেননা, আমি আগেই বলেছি রাষ্ট্রের ধারনাটিই আধুনিক, মধ্যযুগে রাষ্ট্রের ধারনাই ছিল না। কাজেই, ইসলামের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা হাস্যকর ও গভীর ষড়যন্ত্র মাত্র। বিগত হাজার বছর ধরে সূফীসাধকগন রাষ্ট্রের ধার না ধেরেই আল্লাহ্ র জিকির করেছেন-তারা কি মুসলিম নয়? তারা কি বে-দ্বীন? এবং, আমরা জানি বাংলাদেশ সুফীসাধকদের দেশ। অথচ, একটু আগেই পড়েছেন-Wahabis do not recognise esoteric approach and mysticism and do not believe that the walis have any special spiritual powers.
অনেক মুসলিমের বিশ্বাস এই রকম যে- ইসলালী শরীয়ত চর্চার ক্ষেত্র হচ্ছে সমাজ-রাষ্ট্র নয়। ইসলামী শিক্ষার মূলে এক আল্লাহ তে বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে, আল্লাহ্র রসুলে বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে-ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। অথচ, মওদুদীপন্থিরা জেহাদের নতুন ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্র দখলের ওপরই জোর দেয় বেশি। রাস্ট্র নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে বলেই তারা ইসলাম থেকে বিচ্যূত হতে বাধ্য। এরা গনতন্ত্রীদের সঙ্গে হাত মেলায়-যাদের লক্ষ্য কখনোই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নয়।
John L. Esposito লিখেছেন-Islam has exercised considerable political and social influence throughout its history. Early rulers in the Middle East and elsewhere claimed legitimacy for their authority in the name of Islam, and Islamic teachings gave structure to almost every facet of society. But these early Muslim states and empires were not theocracies—that is, governments ruled by or subject to religious authority. There never was a theocratic or clergy-run state in the Middle East until the creation of the Islamic Republic of Iran in 1979.
(Microsoft ® Encarta ® 2008. © 1993-2007 Microsoft Corporation. All rights reserved.)
পরিশেষে বলব। ওয়াহাবীপন্থি মওদুদীবাদ বাঙালির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে- ১৯৭১ -এ এবং তার পরে। আজ অবধি উপমহাদেশে সব ক’টি জঙ্গিগোষ্টীর প্রেরণাদাতা মওলানা মওদুদী। জে এম বি-ও মূলত জায়ামাত ই ইসলামীর বি-টিম। এরাই রমনা বটমূলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি এদের ঘৃনা তীব্র ও অপরিমেয়। এরা বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চায়। কাজেই, বাঙালির শক্র মওদুদীবাদকে পরিহার করার অর্থ হল মওদুদীবাদের চিন্তাধারার কুফল সম্বন্ধে সচেতন থাকা।
আমি মনে করি, জায়ামাত ই ইসলামী মূলত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদেরও পরিপন্থি। কাজেই, নতুন প্রজম্মের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তরুণ নেতাদের উচিত অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের কুসঙ্গ পরিত্যাগ করার জন্য বি এন পির বর্ষিয়ান নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। বাংলাদেশে একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ক্ষমতা বি এন পি-র আছে। তবে তার আগে দলটিতে দলীয় দুনীর্তি প্রতিরোধ ও জায়ামাত ই ইসলামীকে পরিত্যাগ করতে হবে।
আমি মনে করি, ২০১৪ সালে আমরা তেমনটিই দেখতে যাচ্ছি।
তথ্যসূত্র:
Microsoft ® Encarta ® 2008.
এবং
ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



