somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তিতুমীর ও ফকির মজনু শাহ্: একটি তুলনামূলক আলোচনা ও মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যৎ।

১৪ ই জানুয়ারি, ২০০৯ সকাল ৯:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফকির-দরবেশদের কামানের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অমানবিক শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলার ফকির-সন্ন্যাসীরা। তাদের আন্দোলনে বাংলার আপামর জনসাধারন ও কৃষককুলের সমর্থন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বাংলায় ফকির-বিদ্রোহে ফকির মজনু শাহ ও সায়্যিদ মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীরের ভূমিকা ছিল অনন্য।

বাংলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংগঠিত করেছিলেন ফকির মজনু শাহ। অবশ্য তাঁর প্রকৃত নাম জানা যায়নি-তিনি ফকির মজনু শাহ নামেই বাংলার জনগনের কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর জন্ম দিল্লির কাছাকাছি হলেও আমৃত্যু তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল বাংলায়।
অস্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ফকির মজনু শাহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে। এ লক্ষ্যে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বিশাল এক যোদ্ধাবাহিনী গঠন করেছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে প্রায়ই মুখোমুখি সংঘাত বাঁধত। ১৭৮৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের কাছে এক তুমুল যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যদের কাছে মজনু শাহ পরাজিত হন। যুদ্ধে তাঁর বহু সংখ্যক অনুসারী নিহত হয়। ১৭৮৬-এর পর মজনু শাহ আর অভিযান পরিচালনা করেননি। ১৭৮৮ সালে মজনু শাহ মৃত্যুবরণ করেন।



মজনু শাহ যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রত -সেই সময় ১৭৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার জেলার বশিরহাটের চাঁদপুর গ্রামে তিতুমীরের জন্ম হয়। তিতুমীরের পরিবারের লোকেরা নিজেদের হজরত আলীর বংশধর বলে দাবি করতেন। যা হোক। ১৮২২ সালে হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কাশরীফ যান। বিখ্যাত ইসলামি ধর্মসংস্কারক ও বিপ্লবী নেতা সায়্যিদ আহমদ বেরেলভী সে সময় মক্কা শরীফে ছিলেন। তিতুমীর তাঁর চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হন। সায়্যিদ আহমেদ তিতুমীরকে বোঝালেন: 'বাংলায় মুসলমানেরা শরীয়ত পালন করে না। তুমি তাগো গিয়া বুঝাও। আল্লায় বেদাত সহ্য করব না। বেরেলভী সাহেব আরও বললেন যে বিদেশি শক্তির কবলে পড়ে বাংলা পরাধীনতা হয়ে আছে। তুমি তারও একটা ব্যবস্থা কর।'



হুজুরের দোওয়া নিয়ে ১৮২৭ সালে দেশে ফিরে এলেন তিতুমীর। তারপর বাংলার মাটিতে সহি ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নানান পদক্ষেপ নিলেন। বিশেষ করে তাঁতি ও কৃষকদের মধ্যে তাঁর প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তাঁতি ও কৃষকদের প্রকৃত সমস্যা উপলব্দি করতে পেরেছিলেন তিতুমীর- উপলব্দি করতে পেরেছিলেন জমিদারি শোষনের কদর্যরুপ; কাজেই, স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে তাঁর সংঘাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। ইংরেজরা যেহেতু জমিদারের করের ওপরই নর্ভরশীল। কাজেই সে সংঘাতে অবিলম্বে ইংরেজরাও জড়িয়ে পড়ে। দিন দিন সংঘাতের তীব্রতা বাড়ছিল।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১৮৩১ সালে অক্টোবর মাসে নারকেল বাড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন তিতুমীর। যদিও ঐ বছরই ব্রিটিশ সৈন্যরা কামানের গোলায় কেল্লাটি মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়।



তিতুমীরের স্থায়ীভাবে বাঁশের কেল্লা নির্মান ছিল এক হঠকারী সিদ্ধান্ত। কেননা, বিদ্রোহীর স্থির থাকতে নেই-তাকে অবিরত স্থান পরিবর্তন করতেই হয়। যে কারণে ফকির মজনু শাহ সম্বন্ধে মুয়ায্যম হুসায়ন খান লিখেছেন, He (ফকির মজনু শাহ)
organised the sufi saints and the yogi sannyasis under a common platform, reported to have moved frequently between the western part of Bihar and the eastern extremity of Bengal mobilising the scattered fakirs and sannyasis and floating the spontaneous support of the professional classes and the common people of Bengal in his fight against the east india company. (বাংলাপিডিয়া)
কাজেই, সেই সময়কার পরিস্থিতি বিশ্লেষন করে মনে হয় যে ফকির মজনু শাহর সামরিক কলাকৌশল তিতুমীরের তুলনায় অধিকতরো উন্নত ছিল । তিতুমীর কিছু বিষয় বিবেচনায় আনেননি। (১) ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফকির মজনু শাহর সামরিক কলাকৌশল বিশ্লেষন। (২) ইংরেজরা কামানের গোলায় যখন মুগলদের প্রস্তরনির্মিত দূর্গ ভেঙ্গে দিচ্ছিল তখন বাঁশের প্রাচীরের শক্তি আর কতটুকু?
তিতুমীর ছিলেন গোঁড়া শরীয়তপন্থি। পক্ষান্তরে, ফকির মজনু শাহ ছিলেন মাদারিয়া তরিকার সুফীসাধক। এই দুপক্ষের চিন্তার পার্থক্য আমরা আজও টের পাই।গোঁড়া শরীয়তপন্থিদের চিন্তাভাবনা ইষৎ ঘোলাটেই মনে হয়-যখন আমরা ইসলামী মিস্টিসিজমের প্রতি দিনদিন কৌতূহলী হয়ে উঠছি লালনের জন্যই। বিশিষ্ট লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী গ্রন্থ পাঠ করে জানা যায়- লালনের নিয়ন্ত্রনেও বিশাল লাঠিয়ালবাহিনী ছিল; এবং লালনও কৃষকের ওপর স্থানীয় জমিদারদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন।
তিতুমীর স্থানীয় জমিদারদের কেবলি ‘হিন্দু’ মনে করেছেন-যা অযৌক্তিক। আগেও আমি একবার বলেছি, বিশেষ করে তাঁতি ও কৃষকদের মধ্যে তিতুমীরের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাঁতি ও কৃষকদের প্রকৃত সমস্যা উপলব্দি করতে পেরেছিলেন তিতুমীর- উপলব্দি করতে পেরেছিলেন জমিদারি শোষনের কদর্যরুপ; কাজেই, স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে তাঁর সংঘাত হয়ে ওঠে অনিবার্য। স্থানীয় জমিদাররা বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। তবে মুসলিম হলেও ফল একই হত-এটা তিতুমীর জানতেন কিনা-আমার প্রশ্ন এই। উত্তরটা আমাদের অল্পবিস্তর জানা: গোঁড়া শরীয়তপন্থিদের চিন্তাভাবনা ইষৎ ঘোলাটেই হয়ে থাকে।
যা হোক। তিতুমীরের ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকার মূল্যায়ন অবশ্যই করবে। তবে তাঁর হঠকারী বাঁশের কিল্লা strategy নিয়ে মুসলমানের গর্ব করার কিছুই নাই। কেননা,
বিধ্বংসী কামানের অধিকারী ব্রিটিশ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাঁর সামরিক কৌশলের অসারতা সহজেই বোঝা যায়। যে কারণে, পরবর্তী যুগের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীরা তিতুমীরের পথ নয়-বরং মাদারিয়া তরিকার মহান সুফীসাধক ফকির মজনু শাহর পথই বেছে নিয়েছিলেন। (এক্ষেত্রেও বাংলায় সুফীরাই এগিয়ে থাকল তথাকথিত শরীয়তপন্থিদের চেয়ে। ) ... reported to have moved frequently between the western part of Bihar and the eastern extremity ofBengal mobilising the ক্ষুদিরাম থেকে মাস্টারদা সূর্যসেন-এঁরা সবাই ফকির মজনু শাহর পথ অনুসরণ করে ক্রমাগত চলমান ছিলেন। কেননা, এঁরা সবাই জানতেন বিদ্রোহীর স্থির থাকতে নেই-তাকে অবিরত স্থান পরিবর্তন করতে হয়। এবং কামানের অধিকারী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বাঁশের কেল্লা নির্মান এক হঠকারী সিদ্ধান্ত।



ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেন উত্তর কোরিয়ায় মার্কিন সৈন্যরা অনুপ্রবেশ করতে পারে নাই-আফগানিস্থানে প্রায় বিনা বাধায় করতে পেরেছে-সমকালীন ইতিহাসের এই ধাঁধাটি নিয়ে যখন আমি গভীর ভাবনায় মগ্ন হই-তখন আমার বারবার সায়্যিদ আহমদ বেরেলভী এবং তাঁর সুযোগ্য শিষ্য সায়্যিদ মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীরের নামটি কেন যেন মনে পড়ে যায়।
এবং আমার মনে এই প্রশ্ন জাগে- হাজার হাজার বছর ধরে ফিলিস্তিনের জনগন ফিলিস্তিনে বাস করেও যা পারেনি মাত্র ৫০ বছরে ইহুদিরা সেখানে অনুপ্রবেশ করে তা পারল কী ভাবে?
এবং আমি এই প্রশ্নে বিস্মিত হয়ে যাই যে, আশির দশকে কেন ইরান-ইরাক নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতি যুদ্ধে লিপ্ত হল? সেই আত্মঘাতি যুদ্ধের বদলে গোপনে দুপক্ষই অভিন্ন তহবিল গঠন করে পারমানবিক অস্ত্র নির্মান করার উদ্যোগ গ্রহন করে নিজেদের প্রতিরক্ষা সূদৃঢ় করল না কেন-যে পরমানু প্রযুক্তি পেতে পারত ফিলিস্তিনও ? ফিলিস্তিন পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হলে ইসরাইল তাকে আক্রমন করার সাহস পেত কি?
এসব প্রশ্নে আমি বিদ্ধ হতে হতে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুসলিম বিশ্বের করুন ভবিষ্যৎটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকলে আমিও শিউরে উঠতে থাকি।

তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৮:৩৬
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×