somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুভ জন্মদিন: শাহ আবদুল করিম

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাটি অঞ্চলের সুরসাধক শাহ আবদুল করিম বাওরের আদিগন্ত জল ও জলের গন্ধের সঙ্গে আজন্ম পরিচিত। সুনামগঞ্জের ধিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের জেলেরা যেমন বাওরের আদিগন্ত জলে জাল ফেলে মাছ ধরে, করিমও তেমনি তাঁর মনের অভ্যন্তরীন আকাশে অদৃশ্য জাল ফেলে কথা ও সুর ধরেন। মাছ ধরা শেষ হলে জেলেরা, গ্রামের জনমানুষের পুষ্টি ও স্বাদ যোগাবে বলে, সে মাছ নিয়ে হাটে যায় বেচতে । করিমও ঠিক তেমনি গান রচনা করে রসিক বাঙালির আত্মার খোরাক যোগান । বাঙালি বড় তৃষ্ণার্ত। করিমের গানে তাদের তৃষ্ণা মেটে আবার মেটেও না। সে কারণেই কি তারা করিমকে ভক্তিভরে কখনও ‘জীবন্ত কিংবদন্তী’, কখনও ‘বাউলসম্রাট’ বলে ডাকে?

যখন ক’জন লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি মিউজিশিয়ান শাহ আবদুল করিমের গান তাদের পার্সোনাল স্টুডিওতে যত্ন নিয়ে রেকর্ড করেন- আমি দূর থেকে শিহরণ বোধ করি। ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি’-করিমের এই দীর্ঘশ্বাসময় গানটি লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি মিউজিশিয়ানরা কী যত্ন নিয়ে রেকর্ড করেছেন-তা সামান্য মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায়। করিমের এই প্রবল বিলাপময় গানটির শুরু অ্যাকুয়েস্টিক গিটারে অল্টারনেটিভ রিদম দিয়ে। বিট শুরু হয়েছে অনেক পরে-কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি/ কেমনে রাখিব তোর মন আমার আপন ঘরে বাধি গো বন্ধু-এই দুটি লাইন গাওয়ার পর। কথাগুলি শেষ হলে বিটের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকুয়েস্টিক গিটারে রিদম ও অ্যাকুয়েস্টিক গিটারেই মেজর স্কেলে ছোট মেলোডিক পিস বাজল কিছুক্ষণ। এরপরে পিয়ানো, বাঁশী ও গিটারের ত্রিমূখি আলাপ শোনা গেল। অল্প পরে বেহালার একটু একটু ছড়ের টান। এবার এই কথাগুলি- পাড়াপড়শী বাদি আমার বাদি কালননদী/মরম জ্বালা সইতে নারি দিবানিশি কাঁদি রে বন্ধু। কথা শেষ হলে আকস্মিক তবলা বোল - সঙ্গে পুরুষ কন্ঠের ক্যাসিকাল স্বরবিস্তার। সা রে গা পা /সা ধা পা। স্বরগুলোয় ডিজিটাল ভোকোডারের ( ভোকোডার=যা কন্ঠস্বরকে স্কেলে রেখেও শ্র“তিমধুরভাবে ডিসটরটেড করে) সার্থক প্রয়োগ। তাই বলছিলাম লন্ডনপ্রবাসী মিউজিশিয়ানরা অসম্ভব যত্ন নিয়ে শাহ আবদুল করিমের গানটি রেকর্ড করেছেন । প্রবাসজীবনে তাদের এই নিষ্ঠা করিমের প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধারই নিদর্শন ।
তো, বাঙালি সমাজে করিমের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ এই গানটির কথা আর সুরেই স্পস্ট।

কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি।
কেমনে রাখিব তোর মন আমার আপন ঘরে বাদি গো বন্ধু।
পাড়াপড়শী বাদি আমার বাদি কালননদী
মরমজ্বালা সইতে নারি দিবানিশি কাঁদি রে বন্ধু
কারে কী বলিব আমি- নিজে অপরাধী
কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বহাইলাম নদীরে বন্ধু
পাগল আবদুল করিম বলে হল একী ব্যাধি
তুমি বিনে এভূবনে কে আছে ঔষধি রে বন্ধু।

প্রেমভালোবাসা নিয়ে কে কতটা বিপর্যস্ত তা নিয়ে বাঙালির কৌতূহল অপরিসীম। বিপর্যস্ত হৃদয়ের কথা তাঁর গানে ব্যক্ত করেছেন করিম-‘কারে কী বলিব আমি- নিজে অপরাধী/ কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বহাইলাম নদীরে বন্ধু।’ কোনওরকম রাখঢাক না করেই এ ধরনের সরল স্বীকারোক্তি কারণেই অনেক অনেক আগেই বাঙালির হৃদয়ে ঠাঁই হয়ে গেছে করিমের । বাঙালি ভনিতা কি রাখঢাক পছন্দ করে না, আন্তরিক কথায় তার আসক্তি সহজাত। করিমও রাখঢাক করেন না। যা বলার তিনি সরাসরিই বলেন-রঙের দুনিয়া তোরে চাই না চাই না/দিবানিশি ভাবি যারে তারে যদি পাই না। রঙের দুনিয়া তোরে চাই না চাই না। উপরোন্ত, আমাদের সমাজে বিরহ চর্চার রেওয়াজ আছে। বাওর পাড়ের করিম তো জাত বিরহী। কাজেই, বিরহকাতর বাঙালির হৃদয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ করিমের বসবাস। যে কারণে করিমকে তারা ভক্তিভরে ‘জীবন্ত কিংবদন্তী’, ‘বাউলসম্রাট’ ইত্যাদি নামে ডাকে।
আমি বাঙালি সমাজে করিমের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করছিলাম।
কেবলমাত্র বয়স্কজন না- স¤প্রতি নতুন প্রজন্মের কাছেও করিম দারুন পপুলার হয়ে উঠেছেন। কী এর কারণ? আমরা মতে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বুদ্ধিমান ও সজৃনশীল। তারা ভালো মন্দের পার্থক্যটা বেশ বুঝতে পারে। তারা বোঝে কারা যুদ্ধাপরাধী আর কারা দিনরাত খেটে ‘মুক্তির গান’ তৈরি করে। তারা বোঝে- গানের পথ আর শাস্ত্রের পথ কোনওদিনই একসঙ্গে মিশে যাবে না। এসব কারণে তারা রবীন্দ্রনাথের নির্দেশিত গানের পথই বেছে নিল এবং আজ থেকে বছর কয়েক আগে যখন একজন বিলেতফেরত মিউজিশিয়ান (হাবিব) নতুন প্রজন্মের হাতে ফোকফিউশন গানের অ্যালবাম (কৃষ্ণ) তুলে দিয়ে বলল-দেখ, সুনামগঞ্জের ধিরাই উপজেলায় উজানধল গ্রামে একজন বিস্ময়কর গানের মানুষ বাস করেন-যিনি মুসলমানের ঘরে জন্মেও ভীষন কৃষ্ণভক্ত। নতুন প্রজন্ম সেকুল্যার বলেই সেই বিস্ময়কর গানের মানুষের প্রতি ভীষন কৌতূহলী হয়ে উঠল। তারা শুনল সেই গানের মানুষের বিস্ময়কর গান-

গান গাইয়া আমার মনরে বুঝাই মন করে পাগলপারা
আর কিছু চাই না আমি গান ছাড়া গান ছাড়া।

নতুন প্রজন্মও গান ছাড়া কিছু চায় না। যে কারণে তাদের পকেটে এমপিথ্রি প্লেয়ার, কানে হেডফোন, গান রাখার জন্য তাদের মোবাইলে কমপক্ষে ১ জি বি স্লট চাই। ওদিকে বাওর পাড়ের করিমও গান ছাড়া আর কিছু চান না। সুতরাং, গান পাগল নতুন প্রজন্ম আরেক গান পাগলের প্রতি ঝুঁকল। আর সময়টা এমন- বাংলাদেশে যখন একটা রোম্যান্টিক (সেক্যুলার) বিপ্লব চলছে, নতুন প্রজন্ম যখন রোম্যান্টিক হয়ে উঠছে -তারা তো রোম্যান্টিক করিমের গান শুনবেই। হ্যাঁ, করিম আপাদমস্তক রোম্যান্টিক।

গানে বন্ধুরে ডাকি/ গানে প্রেমের ছবি আঁকি
পাব বলে আশায় থাকি/ না পেলে যাব মারা।

এবং, এই বন্ধুকে ঈশ্বরও মনে করতে হবে। কেননা, করিম মূলত বাউল। বাংলার বাউলরা গানে গানেই ঈশ্বরসাধনা করেন। রবীন্দ্রবাউলও তাইই করেছেন জীবনভর। ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে/ তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে।’ লালনেরও একটা গান আছে, বড় মারাত্মক সে গান, ‘বীণার নামাজ তারে তারে/ আমার নামাজ কন্ঠে গাই।’ সেরকম, নতুন প্রজন্ম সৃজনশীল ও বুদ্ধিমান বলেই সজ্ঞানে অসার শাস্ত্রের পথ পরিত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশিত গানের পথটি বেছে নিল বলেই করিমকে তারা চিনতে পারল। করিমকে চিনেছিলেন মওলানা ভাসানীও । ১৯৫৭ সাল। ৬-১০ ফেব্র“য়ারি টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে চলছে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন। সে সম্মেলনে মঞ্চে উঠে জনসমুদ্রের সামনে করিম গাইলেন-

জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে বল ওগো সাঁই।
এ জীবনে যত দুঃখ কে দিয়াছে বল তাই।

করিমের গান শুনে মুগ্ধ মওলানা বলেছিলেন, ‘সাধনায় একাগ্র থাকলে তুমি একদিন গনমানুষের শিল্পী হবে।’ আজ আমরা জানি সেই জ্ঞানীবৃদ্ধের ভবিষ্যৎবানী সফল হয়েছে। করিমের একটি দেশের গান এরকম-

আমি বাংলা মায়ের ছেলে
জীবন আমার ধন্য যে হায়,
জন্ম বাংলা মায়ের কোলে।

শেষ চরণটির সুরে দ্বিজেন -অতুলপ্রসাদ উঁকি দেন। আমি শিহরণ টের পাই। মাত্র তিনটি চরণ। আর তাতেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সমস্ত কৈফিয়ৎ দেওয়া হয়ে গেছে। এরকম আন্তরিক সুরের ছোট ছোট বাক্যে মনের অনুভূতির সুরাশ্রয়ী প্রকাশ- এইই করিমের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি এরই মধ্যে পৌঁছে গেছেন বৃহত্তর বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের খেটে খাওয়া মানুষের বিশ্রামের চা স্টলের স্টিরিও, টিভি থেকে ইয়ং জেনারেশনের সেলফোনে, এমপিথ্রি প্লেয়ারে। করিমের অনুভূতির মূলে প্রেম। সেই চিরকালীন অনুভবের এত সহজসরল সুরময় ছন্দময় প্রকাশে বাঙালি সমাজের হাইক্লাসের সফিকটিকেটেড নাক উঁচু মানুষ অবধি বিমুগ্ধ! ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতেই হয়-করিম যখন বলেন-

না আসিলে কালো ভ্রমর, কে হবে যৌবনের দোসর?
সে বিনে মোর শুন্য বাসর-আমি জিয়ন্তে মরা।
আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা।

দোসর, বাসর, মরা, ভ্রমরা। করিমের গানের কথাতেও ছন্দের সমাহার-যা বাংলা গানের নিজস্ব বৈশিস্ট্য । আর, লক্ষ করুন, করিম নিজেকে ফুল (নারীবাচক) কল্পনা করেছেন। প্রেমিকাকে (পুরুষবাচক) ভ্রমর। কিছু ভাববিপর্যয় হয়ে গেল না কি? না। করিম সচেতনভাবেই ভাববিপর্যয় ঘটিয়েছেন। কেননা, বাংলা গানের আবহমান স্রোতধারার পাশেই করিম দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাখ্যা করি। বাংলা গানের শুরুটা হয়েছিল দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেব এবং পঞ্চদশ শতকে শ্রীচৈতন্যদেব-এর হাতে। শ্রীচৈতন্য বলেছিলেন, ‘আমার অন্তরে রাধা, বহিরঙ্গে কৃষ্ণ।’ এই কথার সরল মানে- পুরুষদেহে নারীর অনুভূতি, প্রকারন্তরে জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নতা। আর, করিম আবহমান বাংলার ভাবের ধারায় লিপ্ত থেকে নিজেকে (নারীবাচক) ফুল কল্পনা করেছেন। প্রেমিকাকে (পুরুষবাচক) ভ্রমর। এক্ষণে বলি, করিমের প্রেমিকার নাম ছিল সরলা (আফতাবুন্নেছা)। বাউলের সাধনমার্গে স্থিত থেকে সরলা ও ঈশ্বরকে অভিন্ন মনে করতেন করিম? নিশ্চয়ই। কখনও তাঁর ঘোর লাগত। একবার সেই ঘোরে গেয়েই উঠলেন-

মায়া লাগায়ছে, পিরিতি শিখাইছে, দেওয়ানা বানাইছে
কী জাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছ

করিমের এই তুমুল জনপ্রিয় এই গানটিকে কি কেবলি লাভ সং?
বিলক্ষণ নয়। বাংলা এখানেই স্বতন্ত্র বিশ্বের অন্যান্য ‘সংস্কৃতি’ থেকে। ফারসী ‘দেওয়ানা’ শব্দটি লক্ষ করুন। কে মায়া লাগাল? নারী? সরলা? যে করিমের প্রেমিকাও বটে। কেননা, তিনি নারীর ধর্ম পালন করেন-ছলেবলে পিরিতি শেখান- সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখতে হবে তো! কাজেই নারীপ্রেমিকার রুপ ধরে ঐশ্বররিক শক্তির বশে কবি পুরুষকে দেওয়ানা করেন, পাগল করেন, জাদু করেন, মায়া লাগান। কে সে? ঈশ্বর? নাকি ঈশ্বরী? এই প্রশ্নে বাউল তো ছিন্নভিন্ন হবেই। এবং, এই প্রশ্নের ফলে যে গানের জন্ম হল সেই গানটিই কেন করিমের সবচে লোকপ্রিয় গান-এই ভেবে ভেবে এ শঝের গবেষকও দীর্ঘদিন দিশেহারা- দিশেহারা লন্ডন প্রবাসী করিমভক্ত মিউজিশিয়ানরাও। যে কারণে তারা প্রবাসজীবনের শত বিপত্তি সত্ত্বেও গান যত্ন নিয়ে বাউল সম্রাটের গান নিজস্ব স্টুডিওতে রেকর্ড করেন। উপরোন্ত- ‘মায়া লাগাইছে’ গানটি লোকসঙ্গীত হলেও গানটির শরীরে রাগ ‘মন্দ’-এর আবেশ মিশে আছে। ঘটনা এইখানেই। উত্তর ভারতীয় উচ্চকোটির রাগসঙ্গীত করিমের গানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়- তাও করিমের সবচে বিখ্যাত গানে! ঈশ্বর বিরহ যেখানে প্রবল-

বসে ভাবি নিরালায়/ আগে তো জানি না বন্ধুর পিরিতের জ্বালা।
হায় গো নিজের ভাট্টায় কয়লা দিয়া আগুন জ্বালাইছে।

নিজের ভাট্টায় কয়লা দিয়া আগুন জ্বালাইছে? বাংলা গানে এই ধরনের উপমার প্রয়োগ একেবারেই অভাবনীয়। রবীন্দ্রনাথ কি কখনও ভেবেছিলেন যে একদিন বাংলা গানে ইটের ভাঁটার উপমা দেবেন ভাটি অঞ্চলের একজন কবি ও সুরসাধক? কিন্তু, বিসদৃশ উপমাটি মানিয়ে যায়নি কি? গেছে? কেন? যেহেতু গানটিতে স্বয়ং ঈশ্বর ভর করেছেন; যেহেতু ঈশ্বর নিজে ধরা না দিলেও নিজেকে প্রকাশ করতে সদা তৎপর। ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরী। বাউলের সাধনমার্গে স্থিত থেকে সরলা ও ঈশ্বরকে অভিন্ন মনে করতেন করিম। গানটি ঐশ্বরিক। অন্যকারণে। করিম সবাইকে বিরাট এক ফাঁকি দিয়েছেন। সবাই ভেবে বসে আছে গানটি নিছক বিরহের গান। আসল ঘটনা অন্যরকম। গানটি ইনটেন্স ম্যাটাফিজিকাল সং। কেবলমাত্র ঐশ্বরিক শিল্পেই এ ধরনের ফাঁকির ঘটনা ঘটে। অবশ্য, এই কথাগুলোন ইউরোপীয় নন্দনতাত্ত্বিকদের জন্য নয়। তাদের কিছু বিষয় ঠিক বোঝানো যাবে না কোনওকালেই।
আর, করিমের গানের সুরও কখনোই কৃত্রিম নয় তো নয়ই বরং আন্তরিক লোকজ সুর।

চলে গাড়ি হাওয়ারই ভারে, আজব কল গাড়ির ভিতরে।
নিচ দিকেতে চাকা ঘুরে, সামনে বাতি জ্বলে না।
আমি তোমার কলের গাড়ি, তুমি হও ড্রাইভার।

আর করিমের সৃজনশীলতার দিক? সেও আছে। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা’ -এই বহুলপ্রচারিত গানটির তালটি বাওরের আদিগন্ত জলে নৌকাবাইচের ছন্দকে ধারন করেছে। তরুণ বয়েসে যে করিম গ্রামের বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে নাও দৌড়ায়তেন-গানে সে কথাও রয়েছে। গানটি করিমের আত্মজীবনী ও জীবনদর্শনের সংমিশ্রণ বলেই মনে হয়। বাউলের জীবনদর্শন। করিম বলেছেন, ‘কে হবে মেম্বার কেবা গ্রামসরকার/আমরা কি তার খবর লইতাম ভাইরে?’ সত্যিই তো, প্রকৃত শিল্পী কেন মোড়লদের ভিড়ে যাবেন। সন্ধ্যার পর সব ধান্দাবাজ লোকেরা কমিশনারের অফিসে বসে থাকে না? তারা চা খায়, বিড়ি টানে। করিমের ভিতরে শিল্পীসত্তা রয়েছে বলেই গানের বই প্রকাশ করার জন্য জমি অবধি বেচেছেন। তাতে সরলার সায় ছিল মহাকালের কর্তা নিজে ধরা না দিলেও নিজেকে প্রকাশ করতে সদা তৎপর বলেই এবং চতুদর্শ শতকের কবি চন্ডীদাসের প্রেমিকা শ্রীরামীর সঙ্গে দেবী সরলার তুলনা করে বিস্মিত হয়ে যাই। ১৯৮১ সালে গানের বই (কালনীর ঢেউ) প্রকাশ করার জন্য করিম সর্বশেষ সম্বল নয় বিঘা জমি অবধি বেচেছেন যখন বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা নানান ফন্দি ফিকির করে জমিজিরেত বাড়ায়। সে কথা করিমই বলেছেন, ‘মানুষ ছিল সরল ছিল ধর্মবল/ এখন সবাই পাগল কেমনে বড়লোক হইতাম।’ করিমের আংশকা-

করি যে ভাবনা, সেদিন আর পাব না
ছিল বাসনা সুখি হইতাম।
দিন হতে দিন আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন্ পথে যাইতাম?



ঠিক গানের জন্য নয়। আমি করিমের প্রতি অন্য কারণে উৎসুক । করিমের বিশ্বাস ও জীবনদর্শনের ভিতরে আমি অন্যতর প্রসঙ্গ খুঁজে পেয়েছি-যা এক কথায় বিস্ময়কর। করিমের জীবনবোধ আবহমান বাংলার ভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। খুলে বলি। বাংলা মাতৃতান্ত্রিক এবং তাঁর দর্শন বা ভাবটিতে নারীপ্রাধান্য বিদ্যমান- বাংলার সাধকপুরুষদের সাধনায় কথাটিই প্রতীয়মান হয়। এমনকী সপ্তম শতকের বাঙালি তান্ত্রিক বৌদ্ধদের কবিতায় সে ইঙ্গিতটি স্পস্ট। দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেব লিখলেন ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্য। সে কাব্যেই প্রথম রাধা-কল্পনা করলেন কবি জয়দেব। জয়দেবের কাব্যপ্রেরনার মূলে ছিলেন তাঁর দক্ষিণভারতীয় স্ত্রী পদ্মাবতী। বাংলায় দূর্গা (নারী বা মা) পূজার উদ্বোধন হল চতুদর্শ শতকে -কী আশ্চর্য! ঠিক সেই শতকেই পশ্চিমবঙ্গের নান্নুর গ্রামের এক সাব-অলর্টান নারী রামী -শাস্ত্রভক্ত পুরোহিত চন্ডীদাসকে আপন নারীশক্তি বলে (নারী ও শাস্ত্র পরস্পরবিরোধী বলে) চন্ডীদাসকে টান দিয়ে মন্দির থেকে বের করে প্রেমময় সেক্যুলার কবিতে রুপান্তরিত করলেন! তখন বলছিলাম, ... নারীপ্রেমিকার রুপ ধরে ঐশ্বররিক শক্তির বশে কবি পুরুষকে দেওয়ানা করেন, পাগল করেন, জাদু করেন, মায়া লাগান। অনেককের মনে হতে পারে আমি হয়তো সাধারনীকরণ করছি। আমি মনে করি আমি বাংলার নারীবন্দনার ধারাবাহিক সূত্রটি আবিস্কার করার চেষ্টা করছি। ইসলাম যে বঙ্গদেশে এত ব্যাপক পপুলারিটি পেয়ে গেল- তার কারণ কি? বঙ্গদেশে ইসলামের ব্যাপক পপুলারিটি লাভের অন্যতম কারণ নারীর প্রতি পীরদরবেশ, ওলি আউলিয়াদের শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
Click This Link
বায়োজিদ বোস্তামির অচলা মাতৃভক্তির কথা কে না জানে। সে প্রসঙ্গে কবিশেখর কালিদাস রায়ের আবেগমথিত উচ্চারণ-বায়েজিদ বোস্তামি/শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী। (মাতৃভক্তি) বাংলায় বাউল মার্গের উদ্ভব বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া মত ও সুফিবাদের সম্মিলনে। বৌদ্ধ ধর্ম সমস্তরকম লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিরোধী। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বুদ্ধের অবস্থান ছিল অত্যন্ত কঠোর। উপরোন্ত বুদ্ধ মনে করতেন, নারীও বোধিলাভে সক্ষম। এসব কারণেই মাতৃতান্ত্রিক বাংলার সঙ্গে বাউলসাধনার যোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ট এবং শাহ আবদুল করিম সে ধারা থেকে কোনওমতেই বিচ্ছিন্ন নন। যেহেতু আমি পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে নারীর ইতিহাসের প্রতি গভীর উৎসুক, যে ইতিহাস তুষার যুগের অন্তে নগরসমূহ গড়ে ওঠার প্রাক্কালে নারীকে ক্ষমতাচ্যূত করারই ইতিহাস- সে সমস্ত পূর্বাপর কথা মাথায় রেখেই আমি করিমের একটি মন্তব্যে রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যাই। করিম বলেছেন, ‘আমি সরলাকে (করিমের স্ত্রী) আমার মুর্শিদ (পথপ্রদর্শক) জ্ঞান করি।’ (ভারত ও ভারততত্ব। এটি মূলত প্রবন্ধ সংকল। সুধীর চক্রবর্তীর প্রবন্ধের শিরোনাম: ‘ভাটি অঞ্চলের গণগীতিকার শাহ্ আবদুল করিম।’ পৃষ্ঠা, ৪৩৩) নারী মুর্শিদ কিংবা পথপ্রদর্শক হতে পারেন- এই হচ্ছে করিমের বিশ্বাস। একুশ শতকে পৌঁছে অনেকেরই মনে হতে পারে- এ এক যথার্থ অনুভূতির সঙ্গত প্রকাশ। সঙ্গত-এই কারণে যে- সেই তুষার যুগ থেকেই মানবসমাজে নারীর ক্ষমতায়ন অক্ষুন্ন থাকলে সভ্যতার নিষ্ঠুর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলি অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে হ্রাস পেত এবং পুরুষতন্ত্রের অনভিপ্রেত উত্থান ঘটনা না, পুরুষতন্ত্রের যূপকাষ্ঠে অজস্র নারীর প্রাণ বলি হত না। করিমের বিশ্বাসটি যথার্থ এই কারণেই যে- নারীর ওপর স্বয়ং ঈশ্বরও নির্ভরশীল তার সৃষ্টিকে বহমান রাখার জন্যই! নারীর প্রসবযন্ত্রণা কি ঈশ্বর সহ্য করেন? করেন না। তা হলে নারীই কি ঈশ্বর? এই প্রশ্নটি সিদ্ধ। হিব্র“ভাষী প্রাচীন পুরুষেরা মনে করতে যে- ঈশ্বর পুরুষ। কেননা, সকল গ্রন্থরচয়িতারাই পুরুষ। হোয়াট আ প্যারাড´! এসব বিভ্রান্তি এড়িয়ে করিম প্রকৃত সত্যটি উপলব্দি করেছেন। প্রকৃত সত্য উপলব্দি অবশ্যি অনেক আধুনিক প্রগতিশীল পুরুষই করেন তবে সুশীল সমাজে খাটো হয়ে যাবার ভয়ে সত্যটি প্রকাশ করতে তারা অত্যন্ত সঙ্কোচ বোধ করেন। এখানেই করিম অনন্য। তাঁর অমূলক সঙ্কোচ নেই, অহংবোধ নেই-তিনি সৃষ্টির মানে জেনেছেন। শুধুমাত্র এই কারণেই, অন্তত আমার কাছে, পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ একদিকে- করিম অন্যদিকে। আজ সবাই তাঁর গানে আচ্ছন্ন। একদিন সবাই করিমের গানকে ছাড়িয়ে করিমের জীবনবোধের সত্যটা উপলব্দি করবে: করিম তাঁর সৃস্ট সঙ্গীতের চেয়েও উর্ধে। যে কারণে, হাজার বছর ধরে যাঁদের জীবনসাধনার ফলে বাংলা জগতের অন্যন্য স্থানের চেয়ে স্বর্গের অন্তত দু’ধাপ হলেও কাছে -শাহ আবদুল করিম তাদেরই একজন।



১৩২২ বঙ্গাব্দে ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার জন্মেছিলেন করিম। সে হিসেবে ইংরেজি ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি ১৫। আজ ফেব্রুয়ারি ১৫। এই বিরাট ও অনন্য পুরুষটির ৯৪তম জন্মদিন। আজও তিনি বেঁচে আছেন সুনামগঞ্জের ধিরাই উপজেলার উজান ধল নামে একটি গ্রামের বাওরের আদিগন্ত পানির পাড়ে। কারা কারা এখনও উজান ধল গ্রামের ওই পবিত্র তীর্থে যান নি? সত্ত্বর রওনা দিন- উজানধলে ভিড় বাড়ার আগেই। আজ যেমন ইচ্ছে থাকলেও মধ্য ডিসেম্বরে কক্সবাজারে হোটেলের রুম আপনারা খালি পান না- আর দশ কি পনেরো বছরের মধ্যেই বিশ্বের তাবৎ শান্তিবাদী কবি আর জিজ্ঞাসুদের ভিড়ে ওই উজানধল গ্রামের হোটেলের রুম খালি পাবেন না বলে রাখলাম । আর দশ-পনেরো বছরের মধ্যেই উজানধল গ্রামে করিমের শ্বেতপাথরের একটি আকাশছোঁওয়া ভাস্কর্য স্থাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্বের তাবৎ শান্তিকল্যাণবাদী মানুষের উদ্যোগে। কেননা, ততদিনে আর্ন্তজাতিক মহলে এই কথা রটে যাবে যে- অল্প বয়েসে করিম ছিলেন রাখালবালক। বাড়ির কাছের বাওরের আদিগন্ত পানির পাড়ের ঘাসের মাঠে করিম গোরু চড়াতেন ছেলেবেলায়। সবকিছু মিলে যাচ্ছে যে! মানবসভ্যতার সবচে শুদ্ধ আত্মার অধিকারীরাই যে মেষপালক!
তাইই বলছিলাম-কারা কারা এখনও উজান ধল গ্রামের ওই পবিত্র তীর্থে যান নি?
ভিড় বাড়ার আগেই সত্ত্বর রওনা দিন।

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৩৬
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×