somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথ ও আনা আখমাটোভা

১৪ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ৮:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান রুশ কবি আনা আখমাটোভা । রুশ ভাষায় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। এটাই ওঁর প্রতি আমার আগ্রহের মূল কারণ। দ্বিতীয় একটি কারণও আছে: আনা আখমাটোভাকে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ স্তালিনের নির্দেশে নানাভাবে মানসিক পীড়ন করেছিল। অথচ, স্তালিন আমৃত্যু যে আর্দশে বিশ্বাসী ছিলেন- আমিও সেই স্যোসিয়ালিষ্ট আদর্শের খুব একটা বিরোধী নই। বরং আমি শ্রমিকশ্রেণির ন্যয্য অধিকারের প্রতি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল-এমন কী এই বাজার অর্থনীতির যুগে বেঁচেবর্তে থেকেও আমি স্রোতের বিপরীতে অবস্থান করে উৎপাদনযন্ত্রের ওপর রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী-যেটি সমাজতন্ত্রের অন্যতম মূলমন্ত্র।
এ জন্যই আমি বুঝতে চেষ্টা করছি দু’ পক্ষকেই- কবি আনা আখমাটোভা কে এবং স্তালিন আমলের ব্যাক্তিপীড়নবাদী সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোটিকে ।
মধ্যিখানে অনিবার্যভাবেই রয়েছেন রবীন্দ্রনাথও ।
বললাম। আনা আখমাটোভা রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। সেজন্যই মনে একটি প্রশ্ন জাগে: রবীন্দ্রবলয়ে দাঁড়িয়ে আখমাটোভা রবীন্দ্রপ্রতিভায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন কি? যে রকম, আমরা হই। ১৯১৩ সালে লেখা আখমাটোভার In the Evening কবিতাটি পাঠ করা যাক।

The garden's music ranged to me
With dole that's beyond expression.
The frozen oysters smelled with freshness
And sharpness of the northern sea.

He told me, "I'm the best of friends!",
And gently touched my gown's laces.
Oh, how differs from embraces
The easy touching of these hands.

Like that they pet a cat, a bird...
Or watch the girls that run the horses....
And just a quiet laughter poses
Under his lashes' easy gold.

And the distressing fiddles' voice
Sings me from haze that's low flowed,
"Thank holly heaven and rejoice --
You are first time with your beloved."

দেখি কবিতাটির বাঙলা মানে করলে কি রকম দাঁড়ায়-

মনে হয়, উদ্যানসংগীত আমার কাছে আসে
অনির্বচনীয় এক বিষন্নতা নিয়ে ।
আর, উত্তর সমুদ্রের তীক্ষতাসহ
জমাট ঝিনুকের গন্ধ বড় সজীব।

সে আমায় বলেছিল,‘আমিই প্রকৃত বন্ধু।’
বলে সে ছুঁয়েছিল আমার আমার পোশাকের হেম।
ও হাতের সহজ স্পর্শ,
আলিঙ্গনের মতো সে তো নয়।

যেন তারা বেড়াল কি পাখি পোষে ...
কিংবা দেখে ঘোড়ায় চড়া মেয়েটিকে...
তার চাবুকের নিচের সহজ স্বর্ণ থেকে
শান্ত হাসির ভঙ্গিমায়।
(এ চারটে লাইন অনুবাদ সম্ভব হয়নি ...)

আর নৈরাশ্যময় বেহালাবাদকের সুর
নিচের আবছা বহমানতা থেকে আমার কাছে আসে।
‘ধন্যবাদ পবিত্র স্বর্গ এবং আনন্দ কর’
প্রথমবারের মত তুমি তোমার প্রিয়জনের সঙ্গে।’

এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গেল কি? মনে হয় না। অথচ তখন আমি বলছিলাম যে- আনা আখমাটোভা রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন ...আর আমি সেই চিহ্ন খুঁজছি-এতো বছর পর-যদিও ওপরের ‘ইন দ্য ইভিনিং’ কবিতায় রবীন্দ্রছাপ তেমন পাওয়া গেল না বোধহয়। আখমাটোভা এমন একটি সন্ধ্যার ছবি এঁকেছেন-যা আমাদের বোঝার বাইরে রয়ে গেল। আখমাটোভার এই কবিতাটি ১৯১৩ সালের দিকে লেখা । রবীন্দ্রনাথ এরপরও আরও গান/কবিতা লিখেছেন। আখমাটোভা সেসব গান/কবিতা পড়ে রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন। সেই সময়কার ছাপ কি আখমাটোভার মনের ওপর পড়েছিল?
হতে পারে। কেননা, নিচের কবিতার শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথকে পাই। কবিতার নাম:I came here, in idleness.

I came here, in idleness.
Where I am bored: all the same to me!
A sleepy hilltop mill, yes,
here years pass silently.

Over convolvulus gone dry
the bee swims past, ahead,
I call to that mermaid by
the pond: the mermaid ís dead.

Thick with mud, and rusted,
the wide pondís shallows:
over the trembling aspen
a weightless moon glows.

I see everything freshly.
The poplars smell moist.
I’m silent. Silent, ready
to be yours again, earth.

এবার কবিতাটি বাংলা অনুবাদ করা যাক।

আমি এই নির্জনতায় আসি

আমি এই নির্জনতায় আসি
এখানেও একঘেঁয়ে লাগছে!
পাহাড়ের ওপর ঘুম ঘুম মিল
এখানে বছরগুলি নিঃশব্দে বয়ে যায়।

ওপরের সবুজ উদ্ভিদ গেছে শুকিয়ে
সামনেই, মৌমাছির ঝাঁক ।
পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে মৎস্যকুমারীটিকে ডাকি-
মৎস্যকুমারীটি মৃত।

ঘন কাদায় মোড়ানো পুকুরটি।
বড়। আর বড় অগভীর।
ওপরের ঝিরঝিরে গাছটি
ওজনশূন্য চাঁদটিও বাড়ছে।

আমি সবই সজীব দেখি।
গাছের শিশিরভেজা গন্ধ।
আমি নির্জন; নির্জন
তোমার জন্য-হে পৃথিবী।

এ কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে যেন পাই। বিশেষ করে শেষ চারটি চরণে-

I see everything freshly.
The poplars smell moist.
I’m silent. Silent, ready
to be yours again, earth.

আবার সেরকম নাও হতে পারে। মিলে গেছে মাত্র-কবিদের স্বভাবই এই। তবে বেশ বোঝা যায়। আখমাটোভা গভীর এক বিষাদে আক্রান্ত হয়েই শহর থেকে দূরে নির্জন বনপথে যেতেন প্রায়ই। বললাম, গভীর এক বিষাদে আক্রান্ত হয়েই ...কেন? তখন আমি বলছিলাম। ...সে জন্যই আমি বুঝতে চেষ্টা করছি দু’ পক্ষকেই- কবি আনা আখমাটোভা কে এবং স্তালিনের আমলে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজের ব্যাক্তিপীড়নকে।
মধ্যিখানে রবীন্দ্রনাথও রয়েছেন।





আখমাটোভার জন্ম ইউক্রেইনের ওডেসায়।কিয়েভ হল ইউক্রেইনের রাজধানী। কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন কিছুকাল।



কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়

তরুণী বয়সে আখমাটোভা সেন্ট পির্টাসবার্গএ গিয়েছেন। কেননা, ওটাই ছিল রাশিয়ার প্রাণকেন্দ্র। আর, মফস্বলের কবিদের কেন যেন বড় বড় শহরগুলি টানে। যে কারণে সেন্ট পির্টাসবার্গ শহরেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছিল আখমাটোভার।



সেন্ট পির্টাসবার্গ। সেন্ট পির্টাসবার্গ-এ পৌঁছেই আখমাটোভা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কবিতার কারণেই। যে কারণে/পরবর্তীতে এই সেন্ট পির্টাসবার্গ শহরেই আখমাটোভাকে স্তালিনের নির্দেশে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের পীড়ন করেছিল। করেছিল মানসিক নির্যাতন। কারণ-

সে আমায় বলেছিল,‘আমিই প্রকৃত বন্ধু।’
বলে সে ছুঁয়েছিল আমার আমার পোশাকের হেম।
ও হাতের সহজ স্পর্শ,
আলিঙ্গনের মতো সে তো নয়।

কিংবা-

আমি এই নির্জনতায় আসি
এখানেও একঘেঁয়ে লাগছে!
পাহাড়ের ওপর ঘুম ঘুম মিল
এখানে বছরগুলি নিঃশব্দে বয়ে যায়।

আখমাটোভার এই সমস্ত কবিতায় সমষ্টিকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে কেবল ব্যাক্তিকে। অথচ, স্তালিনের আমলে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের ভাবনাচিন্তা ছিল ব্যাক্তিকেন্দ্রিক নয়-সমষ্টিকেন্দ্রিক। অথচ, কবি একা হতে চাইতেন।

আমি সবই সজীব দেখি।
গাছের শিশিরভেজা গন্ধ।
আমি নির্জন; নির্জন
তোমার জন্য-হে পৃথিবী।



রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানকার স্তালিনপন্থি জীবনধারা দেখে এসে রচলেন অবিস্মরণীয় এক যুগমন্ত্র-

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
আমরা যা খুশি তাই করি, তবু তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান,
মোদের খাটো ক’রে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
আমরা চলব আপন মতে, শেষে মিলব তাঁরি পথে,
মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।

তত্ত্ব হিসেবে সমাজতন্ত্র কিন্তু ভারি সুন্দর। কে না সাপোর্ট করে এটিকে। হালের অক্সফোর্ড-পন্ডিত অমর্ত্য সেন অবধি। কমরেড মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে ১৯২০ সালের দিকে নজরুলও লাল খাতায় নাম লেখাতে গিয়েছিলেন কলকাতার এক গলিঘুঁজির ভিতরে। লিখেছিলেন: ‘গাহি সাম্যের গান ...’নজরুল কবি। কবিরা মানুষের দুঃখদারিদ্র সইতে পারেন না। আখমাটোভাও ...অনুমান করি। আখমাটোভাও সম্ভবত কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন প্লেটোর মতন -অবশ্য সে কল্যাণরাষ্ট্রে উপনীত হওয়ার পথটি সম্বন্ধে স্তালিনপন্থিদের সঙ্গে পোষন করতেন দ্বিমত।



আনা আখমাটোভা

বললাম যে- রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। তখন নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আখমাটোভা দেখা করেছিলেন। যে রকম কলকাতা থেকে জয় গোস্বামীরা ঢাকায় এলে কিংবা আগরতলা থেকে দীপঙ্কর সেনগুপ্তরা এলে জুবেরিরা দেখা করে ...আমার সর্বশেষ প্রশ্ন এই। যদি ... যদি আখমাটোভার সঙ্গে কবিগুরুর দেখা হয়ে থাকেই-তা হলে রবীন্দ্রনাথ কি আখমাটোভার সেই দুচোখে যন্ত্রনার ছাপ টের পেয়েছিলেন?


সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ১২:৪২
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×