আর্তুর র্যাঁবো। ফরাসি কবি। জীবনের অনেকটা সময় বেহিসেবী জীবন কাটিয়েছেন, মৃত্যুর আগে জীবনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন; মাত্র ৩৭ বছরে মারা যান র্যাঁবো । কৈশরেই অনন্য কাব্য প্রতিভার কথা সবাই জেনেছিল; যে কারণে ভিক্তর হুগো র্যাঁবোকে বলতেন, ‘শিশু শেকসপীয়ার।’ আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্য শিল্পকলা ও সংগীতে র্যাঁবোর প্রভাব অপরিসীম । তবে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনটিও কম বৈচিত্র্যপূর্ন নয়।
র্যাঁবোর পুরো নাম জা নিকোলাস আর্তুর র্যাঁবো (আমার ফরাসি প্রতিবর্ণীকরণ ক্ষমা করবেন) ২০ অক্টোবর, ১৮৫৪ সালে ফ্রান্সের শার্লিভেল-এ জন্ম । র্যাঁবোর পরিবারটি ছিল মধ্যবিত্ত। বাবা সৈন্য, মা গৃহিনী। ইসাবেলি নামে এক বোন ছিল র্যাঁবোর । বড় এক ভাইও ছিল। বোনের কথা পরে আবার আসবে।
শার্লিভেল জায়গাটা ফ্রান্সের উত্তরে
শার্লিভেল
অল্প বয়েসেই র্যাঁবোর মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। বাবা নয়, র্যাঁবোর ছেলেবেলা জুড়ে ছিল মায়ের কঠোর শাসন। মায়ের শাস্তিও ছিল অদ্ভূত রকমের, পড়া না পারলে ১০০ লাইন লাতিন কবিতা মুখস্ত করতে হত। এরপরও আবৃত্তি ভুল হলে খাবার জুটত না। ৯ বছর বয়েসেই ৭০০ লাইন লাতিন কবিতা ঠোটস্থ হয়ে গেছিল।
যখন ১২ বছরের বালক
তবে র্যাঁবো স্কুলের নিরস পাঠ্যসূচি ও মায়ের বিচ্ছিরি শাসন পছন্দ করত না। যদিও কাব্যের দিকে ঝোঁক। ভিতরে ভিতরে কাব্যের উদগীরণ টের পাচ্ছিল বালক; ১৭ বছর বয়েসেই লিখে ফেলল ‘মাতাল তরণী’-র মতন বিস্ময়কর কবিতা।
পল ভার্লেইন ছিলেন তখনকার দিনে ফ্রান্সের নামকরা কবি; তিনি প্রতীকবাদী ধারার পথিকৃৎদের একজন। ফরাসি কাব্যের ইতিহাসে তাঁর স্থান অনন্য। পল ভার্লেইন-এর ‘গোধূলি’ কবিতাটি পাঠ করা যাক।
গোধূলি
কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে লাল চাঁদ
নৃত্যরত আবছা তৃণভূমি
ধোঁওয়ার ভিতরে ঘুম, ব্যাঙের ডাক
নলখাগড়ায় সবুজ শিহরণ।
লিলি ফুলেরা ঢাকনা ঢাকে
পপলার ছড়ায় দূরে
দীর্ঘ ঘনিষ্ট, তাদের ভৌতিকতা ছড়ায়
জ্বোনাক পোকার মিটিমিটি আলো ঝোপে
প্যাঁচারা জেগে, তাদের নিঃশব্দ উড়াল
বাতাসে সারিবদ্ধ ভারী পাখনা
আর শীর্ষদেশে পরিপূর্ন নিরানন্দ আলো
ফ্যাকাসে, শুক্রের উত্থান ...যেহেতু এখন রাত্রি।
( এই কবিতায় আমরা বাংলার জীবনানন্দকে খুঁজে পাই কি?)
ভার্লেইন
বলছিলাম। ভিতরে ভিতরে কাব্যের উদগীরণ টের পাচ্ছিল বালক; ১৭ বছর বয়েসেই লিখে ফেলল ‘মাতাল তরণী’-র মতন বিস্ময়কর কবিতা। ভার্লেইন চিঠি লিখলেন র্যাঁবো; সাড়া মিলল না। (জীবনানন্দও চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে , সম্ভবত ১৫ বছর বয়েসে) র্যাঁবো এবার কবিতা পাঠালেন, পড়ে ভার্লেইন বললেন, ‘দেখা কর, অপেক্ষা করছি।’ ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে প্যারিস পৌঁছলেন র্যাঁবো । উঠলেন ভার্লেইন এর বাড়িতেই। বাড়িতে তখন ১৭ বছর বয়েসি পোয়াতি বউ -মাতিলদে। ভার্লেইন চাকরি করতেন; সদ্য চাকরি ছেড়ে বিস্তর মদ খাওয়া ধরেছেন।
১৮৭১ সালের প্যারিস। প্যারিস তখন উত্তাল। শ্রেনিসংগ্রাম চরিতার্থ করে সংগ্রামী জনগন ক্ষমতা গ্রহন করেছে, যাকে বলা হয়- প্যারী কমিউন। যে ঘটনা নিয়ে কার্ল মার্কস লিখেছেন, ‘দ্য সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স।’ যে বিপ্লবী সরকারের প্রতি র্যাঁবোর বিপুল সমর্থন ছিল।
যা হোক। র্যাঁবো ও ভার্লেইন এর মধ্যে তৈরি হল উষ্ণ সম্পর্ক । দুজনকে কথায় পেল আর নেশায় পেল। অ্যাবসিন্থ আর হ্যাসিস হল দুটি ফরাসি নেশা। প্রথমটি তরল আর ২য়টি উদ্ভিজ। দুজনেই বেশ কিছুকাল নেশারাজ্যে ডুবে রইলেন। তাতে বিভ্রম হত, কবিদ্বয় বিভ্রমবশত প্রতীকবাদী পদ্য লিখতেন। আর ছিল উদ্দাম জীবন। যাতে ফরাসি সাহিতচক্র রীতিমতো দিশেহারা।
ছবিটি শিল্পী হেনরি ফাতিন লাতোঁ এর আঁকা ...
র্যাঁবো ও ভার্লেইন এর মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হল, তাকে বলা হয় - সমকাম। র্যাঁবোর দুর্নীবার টানে সদ্যজাত পুত্র ও স্ত্রীকে ত্যাগ করার কথা ভাবলেন ভার্লেইন । পরের বছর, অর্থাৎ ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বরে দুজনই লন্ডন চলে গেলেন। থাকতে শুরু করলেন ব্লুলসব্যারি ও কেমডেন টাউন শহরে। স্বেচ্ছা নির্বাসিত কবিদ্বয়ের জীবনে নেমে এল দারিদ্র । তবে আয় হল পড়িয়ে, মানে ইংরেজদের ফরাসি ভাষা শিখিয়ে। তা ছাড়া ভার্লেইন-এর মা টাকা পাঠাতেন। র্যাঁবো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পড়াশোনা করে কাটালেন ।
তবে দুজনের সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠতে থাকে।
ভার্লেইন এর আঁকা র্যাঁবোর ক্যারিক্যাচার
১৮৭৩ সালের জুনে ভার্লেইন প্যারিস ফিরে যান। তবে অচিরেই র্যাঁবোর জন্য বিরহ টের পেলেন প্রতীকবাদী কবিটি। প্যারিস থেকে ব্রাসেলস এ গেলেন ভার্লেইন, দেখা করলেন র্যাঁবোর সঙ্গে । লাভ হল না। কথায় কথায় ঝগড়া চলতেই থাকে। যার ফলে ভার্লেইন মদে ডুবে যেতে থাকলেন। সেই ঘোরেই সম্ভবত রিভলবার কেনেন । গুলি করেন র্যাঁবোকে; গুলি লাগল বাঁ কবজিতে । প্রতীকবাদী কবিটিকে পুলিশ গেরেপতার করল । ভার্লেইন মানসিক রোগী কিনা -জিজ্ঞাসাবাদ চলল। র্যাঁবো অভিযোগ তুলে নিলেও ভার্লেইন কে টানা ২ বছর কারাগারে কাটাতে হয়।
মানসিকভাবে বিধ্বস্ত র্যাঁবো শার্লিভেল ফিরে যান। কোনও কিছু ভুলতে হলে লেখার মতন কিছু নেই। ‘নরকে এক ঋতু’ লিখে শেষ করেন। এটি ৯ ভাগে বিভক্ত র্যাঁবোর একটি বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা। । ৩য় পর্ব ‘নরকে রাত্রি’-র অংশ বিশেষ পাঠ করা যাক।
এইমাত্র আমি মুখভর্তি ভয়ানক বিষ গিলেছি, আর্শীবাদপুষ্ট, আর্শীবাদপুষ্ট, আমার উপদেশদাতাকে করা হোক আর্শীবাদপুষ্ট । আমার অস্তিত্বের মূলে অগ্নি। বিষের দহন আমার হাত-পা মুচড়ে দিচ্ছে, পঙ্গু করে দিচ্ছে, আমাকে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে। তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি আমি, আমার দম আটকে আসছে। আমি কাঁদতে পারছি না। এই শ্বাশত নির্যাতন। দেখ যে কীভাবে আগুন জ্বলে উঠছে। আমি জ্বলছি আমার জ্বলা উচিত। চালিয়ে যাও শয়তান!
র্যাঁবোর ‘নরকে এক ঋতু’ আধুনিক প্রতীকবাদী সাহিত্যের উৎকৃষ্ঠ নমুনা।
১৮৭৪ সালে র্যাঁবো আবার লন্ডন যান। প্রকাশ করেন কাব্যগ্রন্থ Illuminations;এর মানে রঙিন খোদাই বা রঙের পাত্র। কাব্যগ্রন্থটি র্যাঁবোকে বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছিল। ‘ভোর’ কবিতাখানি পাঠ করা যাক।
জড়িয়ে ধরি গ্রীষ্মের ভোর । প্রাসাদগুলোয় এখনও সাড়াশব্দ নেই। মৃত জল। ছায়ারা এখনও অরণ্যপথে ক্যাম্প করে আছে। হাঁটছি, উষ্ণ নিঃশ্বাস নিচ্ছি, ঝলমলে রত্ন ... শব্দহীন ডানার ঝাপটানো; প্রথম জন ছিল একটি সতেজ ফ্যাকাশে মেয়ে ফুল যে তার নামটি বলেছিল। পাইন বনে হালকা রঙের জন্তু দেখে আমি হেসেছিলাম। রুপালি শীর্ষে চিনতে পারলাম দেবীকে । তারপর একে এক আমি তার আবরণ উম্মোচন করি । গলিতে হাত নাড়লাম। সমতলে দেখি মোরগ। নগরে গম্বুজ ও গির্জের ভিড়ে হারিয়ে গেল। মার্বেলের জেটিতে দৌড়াল ভিক্ষুকের মতো, আমিও পিছন পিছন গেলাম। লরেল বনের ধারে রাস্তায় আমি তাকে আচ্ছাদিত করি । আমি তার অপরিমেয় দেহ পাই টের । ভোর ও শিশু বনের ধারে পড়ে যায় । জেগে উঠে দেখি দুপুর।
ভার্লেইন
জার্মানির স্টুটগার্টে ১৮৭৫ সালের মার্চ মাসে ভার্লেইন এর সঙ্গে র্যাঁবোর শেষ দেখা । জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ভার্লেইন, গ্রহন করেছেন ক্যাথলিক ধর্ম । র্যাঁবোও জীবনে পরিবর্তন চাইছিলেন, হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আত্মমগ্ন হয়ে পায়ে হেঁটে সারা ইউরোপ ঘুরে বেড়ালেন। লেখা ছেড়ে কোনও সিরিয়াস কাজে জড়াবেন ভাবলেন-অর্থ চাই, বিত্ত চাই। নিজের মনের মত লিখতে হলে প্রচুর অর্থ উপার্যন করা দরকার। ১৮৭৬ সালের মে মাসে ওলন্দাজ সৈন্যদলে যোগ দিয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাভা গেলেন। ভালো লাগল না। পরে অবশ্য ইউরোপ ফিরে এলেন। ১৮৭৮ সালে সাইপ্রাসে এলেন। ফোরম্যান হিসেবে পাথরের কোয়ারিতে কাজ নিলেন । বিধি বাম। টাইফয়েড হওয়াতে সাইপ্রাস ছাড়তে হল।
১৮৮০ সালে ইয়েমেনের এডেন বন্দর এলেন কবি। সে নগরীতেই সেটল করলেন। কাজ নিলেন বারডে এজেন্সি তে। স্থানীয় নারীর সঙ্গে মিশতে লাগলেন ঘনিষ্টভাবে; সেই সময় ইথিওপিয়ার এক রক্ষিতা ছিল কবির।
ব্যবসা করবেন বলে চাকরি ছেড়ে দিলেন কবি। ইথিওপিয়ার হারার শহরে এলেন। সেই ইথিওপিয় রক্ষিতার অনুপ্রেরণায় কিনা কে জানে! কফি ও অস্ত্রের ব্যবসায় জড়ালেন। হারার এর গর্ভনর এর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হল।
১৮৯০ সালের ফেব্রুয়ারি। ডান হাঁটুতে ব্যাথা অনুভব করলেন। পরে তীব্র যন্ত্রনা। ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলেন। এডেন বন্দরে এক ব্রিটিশ ডাক্তার দেখলেন। ডাক্তার বললেন অপারেশন করতে। ফ্রান্সে ফিরে অপারেশন করালেন। ডান পা’টি কেটে ফেলতে হল। পরে দেখা গেল ক্যান্সার। কিছুদিন শার্লিভেল থাকলেন। আফ্রিকা ফিরে যেতে চাইলেন। তখনই স্বাস্থ্যের অবনতি হল। আবার হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ইসাবেলি নামে এক বোনের কথা বলছিলাম। সেই দেখা শোনা করল। লাভ হয়নি। ১৮৯১ সালের ১০ নভেম্বর মারা গেলেন কবি। মাত্র ৩৭ বছর বয়েসে।
‘প্রস্থান’ কবিতায় কবি লিখেছেন:
অনেক দেখেছি। প্রতিটি আকাশের নিচে ফিরেছে
দৃষ্টি ।
পেয়েছি অনেক। নগরসমূহের কোলাহল,সন্ধ্যা, এবং
আলোয়, আর সর্বদা।
অনেক জেনেছি। জীবনের সিদ্ধান্ত। ওহ্, শব্দ ও দৃশ্য।
নতুন মায়ায় ও শব্দে প্রস্থান!