তেরো বছর পর দূর থেকে নীলুফারকে দেখে চমকে উঠলেন ফিরোজ আহমেদ।
হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ছিল। খসে পড়ল । নীলুফারের পাশে ফরিদা। পাশাপাশি হেঁটে দুজন এদিকেই আসছে । নীলুফারের কাঁধে সাদা রঙের শাল জড়ানো। মাথায় ঘোমটা। চশমা নিয়েছে। তা সত্ত্বেও ১৩ বছর পর দেখে চিনতে মোটেও অসুবিধে হয়নি।
পীরবাড়ির উলটো দিকে একটা চায়ের স্টল। তার ঠিক পাশেই একটা বিশাল আমলকী গাছ। তারই তলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ফিরোজ আহমেদ। সিগারেট টানছিলেন। এখন বিকেল প্রায় শেষ । সোনালি রোদ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। একটা রিকশা চলে যায় টুংটাং শব্দে। স্টেশনটা এখান থেকে কাছেই। শান্টিংয়ের আওয়াজ শোনা যায়। বাতাসে কেমন একটা আষঁটে গন্ধ ভাসছিল । কাছেই একটা সর-পরা পুরনো পুকুর। এদিকে একটা মুদী দোকান । তার পাশে চায়ের স্টল। একটু আগে ওখানেই বসে পরপর দু-কাপ চা খেয়েছেন ফিরোজ আহমেদ।
রাস্তার ওপারে পীরজাদা সাঈয়িদ আলী মোত্তাক্কীর সাদা চুনকাম করা তিনতলা বাড়ি। স্থানীয় লোকে বলে পীরবাড়ি । ঘন্টা খানেক আগে ফরিদা পীরবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকেছে। একতলার বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছিলেন ফিরোজ আহমেদ। সেখানে বেশ ভিড়। আতর আর গোলাপ পানির গন্ধ ভালো লাগছিল না । তা ছাড়া সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। বাইরে চলে এসেছেন। স্টেশন রোডের এ জায়গাটি ভারি নিরিবিলি। ব্যাঙ্কে চাকরি করেন ফিরোজ আহমেদ। সদ্য বদলি হয়ে এই মফঃস্বল শহরে এসেছেন। ভালোই লাগছে। ছিমছাম শহর। পীরজাদা সাঈয়িদ আলী মোত্তাক্কীর জন্য দেশজুড়ে শহরটা পরিচিত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন আসে তদবিরের জন্য । ফরিদাকে নিয়ে আজই প্রথম এলেন ফিরোজ আহমেদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রমৈত্রী করতেন; পীর-ফকির তেমন পছন্দ করেন না ফিরোজ আহমেদ । ফরিদাই নিরুপায় হয়ে পীরের দিকে ঝুঁকেছে। আশেপাশে পরামর্শদাতার তো অভাব নেই!
ফরিদার পাশাপাশি নীলুফার হেঁটে আসছে এদিকে। এই মুহূর্তে তেরো বছর পর নীলুফারকে দেখছেন ফিরোজ আহমেদ; ... তেরো বছর পর ... ফিরোজ আহমেদ এর বাবা চাকরি করতেন রেলওয়েতে। সৈয়দপুর রেলওয়ে কলোনি ... নীলুফাররাও থাকত সেই কলোনিতে । ফুটফুটে ফরসা নীলুফার হলুদ পরীর মতন কিশোর ফিরোজের চোখের সামনে উড়ত। কল্পনায় নীলুফারকে নগ্ন করলেও স্পর্শ করা যেত না। কলেজে উঠে হাবভাব বদলে যায় নীলুফার, আকারে ইঙ্গিতে প্রেম নিবেদন করে। ফিরোজ আহমেদ তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। ফুটফুটে পরীকে নিয়ে কে না ঘরসংসার করতে চায়। গুড়ে বালি। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সংসারে ময়-মুরুব্বীদের ভীষণ দাপট। নওগাঁ থেকে ফিরোজ আহমেদের এক বৃদ্ধ আত্মীয় এসে নীলুফারের এক মামার কুকীর্তির রেফারেন্স দিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে যান: অথচ নওগাঁর সেই বুড়োর নাম শুনলেও জীবনে দু-একবারের বেশি দেখেন নি ফিরোজ আহমেদ! নাঃ, নীলুফার প্রেম সফল হয়নি। এরপর ফিরোজ আহমেদের বাবা অন্যত্র বদলি হয়ে যান । নীলুফার ও অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। যেমন হয়, দুটি পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমে আসে। তারপর একটা সময়ে পাস করে, চাকরি নিয়ে ফরিদাকে বিয়ে করেন ফিরোজ আহমেদ... নীলুফার একখানি চিঠি লিখেছিল। চিঠিখানি এখনও ফিরোজ আহমেদের কাছে আছে। মাঝেমধ্যে বার করে দেখেন, তখন কেমন উদাস উদাস লাগে। সৈয়দপুর রেলওয়ে কলোনির ওপর মেঘ জমা দুপুর। একটি কিশোর জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। নিচের কলোনির মাঠে রবীন-তকিউল্লারা ফুটবল খেলছে। মাঠের ওপাশে ছোট দেওয়াল, সার সার নাড়িকেল গাছ, রেললাইন, বিহারী বস্তি। এক দুপুরে সিঁড়িঘরে নীলুফারকে একা পেয়েছিলেন ফিরোজ আহমেদ, সদ্য কলেজে উঠেছে নীলুফার; সে কারণেই কি নিজেকে মেলে ধরেছিল? নীলুফারকে আঁকড়ে ধরে চুমু খাওয়ার সময় ভূমিকম্প হচ্ছে মনে হচ্ছিল। ভীষন টেনশনে ঘেমে উঠেছিল তরুণ ফিরোজ । চুমুর স্বাদ ভালো লাগেনি। বুকের ভিতর অসম্ভব ধুকধুকানি, ভীষণ তোলপাড়, সারা মুখে কেমন একটা তাপ, একটা কেমন ভাপ। ভীষণ কাঁপছিল সে। নীলুফার হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপর পালিয়ে যায়। নীলুফারের স্তনের কাছে অল্প ছুঁয়েছিল তরুণ ফিরোজ, ঐ প্রথম। এমন টেনশন হলো কেন? হাত-পা কাঁপছিল। কিছুক্ষণের জন্য ইরেকশন হয়েছিল। পর মুহূর্তেই আবার শিথিল হয়ে গিয়েছিল। লিঙ্গমুখে অল্প পানিও এসেছিল ।
এসব কারণে লজ্জ্বায় নীলুফারকে এড়িয়ে ছিলেন কতদিন।
এরপরও নিজেকে মেলে ধরার ইঙ্গিত দিয়েছিল নীলুফার, আমাদের তো বিয়ে হবেই, ভাবটা এমন। তখনকার দিনে সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যেত। সিনেমা হলে পাশের সিটে বসত নীলুফার। অন্ধকারে নীলুফারের স্তনে হাত রাখার মুহূর্তেই বুকের ধরফড়ানি শুরু। তখন থেকেই অত্যধিক নার্ভাসনেসের কারণ নিয়ে ফিরোজ আহমেদ বিব্রত। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই প্রেমিকা কিংবা খালাতো বোন কিংবা মামাতো বোনের সঙ্গে ঘনিষ্ট ভাবে মিশছে। অতিরিক্ত কামপ্রবণ বন্ধুরা যাচ্ছে বেশ্যাপাড়ায় । ফিরে এসে রগরগে বর্ননা দিচ্ছে, যেন সেক্স এক সহজ আর স্বাভাবিক খেলা। অথচ নীলুফারের কাছে গেলেই ফিরোজ আহমেদেরই কেবল হাত-পা কাঁপে? ঐ সময়ই একবার খোঁচা মেরে নীলুফার বলেছিল, সিগারেট খাওয়া আর রাত জেগে বই পড়া ছাড়েন । তাহলেই পারবেন। নীলুফারের মন্তব্যে ফিরোজ আহমেদে বিব্রত বোধ করেন। নীলুফার এত ম্যাচিউরড? মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। তবে ওর অনেক বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। পরামর্শটি তাদেরই কারও? অবশ্য নীলুফারের কথাগুলি ঘুরত মাথার ভিতরে। আমি কি তা হলে ...প্রায়শ বিষন্নতায় আক্রান্ত হতেন। ফিরোজ আহমেদের বই পড়তে ভালোবাসেন, ছেলেবেলা থেকেই স্বাস্থ ভালো । রাত জেগে বই পড়েন কৈশর থেকেই। সিগারেট ধরেছেন ক্লাস সেভেনে। জোরতালে ধূমপান চলে। কিন্তু, এসব নার্ভাসনেসের কারণ হবে কেন?
নীলুফার দেখতে ছিল ফুটফুটে ফরসা । তন্বী । তুলনায় ফরিদা দেখতে কিছুটা শ্যামলা কিছুটা পৃথুলা। তবে মুখের ছিরিছাঁদ চলনসই। রংপুরের মেয়ে । কথা বলে কম। আবেগ-টাবেগ বাইরে থেকে বড় একটা বোঝা যায় না। নিঃশব্দে সংসারে কাজ করে যায়। প্রেমও করে অনেকটা যান্ত্রিক। কেমন অসার হয়ে পড়ে থাকে। যৌনক্রিয়াকে সম্ভবত পাপই মনে করে ফরিদা, মনে করে যৌনক্রিয়া কেবলি সন্তান উৎপাদনের জন্য। এসব কারণে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেন ফিরোজ আহমেদ। ভাগ্যিস! ফরিদা অ্যাগ্রেসিভ না। দ্রুত স্খলন সম্ভবত ফরিদা টের পায় না। নিজের পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে ফিরোজ আহমেদের। মিলনের সময় হলেই বুকের ধুকধুকানি, ভীষণ তোলপাড় অবস্থা, সারা মুখে তাপ ছড়িয়ে পড়ে । যা টের পেয়েছিল নীলুফার এবং ধার-করা বুদ্ধিপরামর্শ দিয়েছিল ... ফিরোজ আহমেদের পুরুষত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েনি ফরিদা। ফরিদা কেবল মা হতে চেয়েছে।
ওটাই সম্ভব হয়নি।
তীব্র আত্মগ্লানীতে ভুগছিলেন ফিরোজ আহমেদ। আমার অক্ষমতার জন্যই কি ফরিদা মা হতে পারছে না? পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে গোপনে ঢাকায় এসে চর্ম ও যৌনরোগের ডাক্তারের চেম্বারে ভিজিট করেছেন । ডাক্তারকে সব খুলে বলেছেন। ডাক্তার পাত্তা না দিয়ে বলেছেন, সন্তানের পিতা হওয়ার জন্য ওসব কোনও সমস্যাই না। অনেক সময় হাইপার টেনশন থেকে প্রিম্যাচিওর ইজাকুলেশন হতে পারে। বাচ্চা না হলে গাইনির বড় ডাক্তার দেখান। সম্ভব হলে স্ত্রীকে নিয়ে ইন্ডিয়া যান।
ফরিদাকে নিয়ে বেশ ক’বার ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন ফিরোজ আহমেদ। ঢাকা-কলকাতা-মাদ্রাজ করেছেন। লাভ হয়নি। এ শহরে বদলি হয়ে এসে ব্যাঙ্কের এক কলিগের মুখে শুনলেন পীরজাদা সাঈয়িদ আলী মোত্তাক্কীর গায়েবী ক্ষমতা; নারীর দীর্ঘকালীন বন্ধ্যাত্ব তিনি দূর করতে পারেন। বন্ধ্যা নারীদের পানি পড়া দেন । পীর সাহেব নাকি বন্ধ্যা নারী ছাড়া অন্য কোনও রোগী দেখেন না। উল্লেখ্য, পীর সাহেবের ফি খুবই কম। ২৪৭ টাকা ৮ আনা আর এক প্যাকেট আগরবাতি। কাজ হয় কিনা কে জানে । দেখা যাক।
ফরিদার কি আরও দেরি হবে?
ফিরোজ আহমেদ সামান্য অস্থির হয়ে ওঠেন। শেষ বিকেলের সোনা রং আলো ছড়িয়ে আছে স্টেশন রোডে। কাছেই একটা ‘স’ মিল। তার যান্ত্রিক শব্দ। আর বাতাসে কাঁচা কাঠের গন্ধ । রেলষ্টেশনের দিক থেকে হুইশেল শোনা যায়। রিকশার টুংটাং। জোরে হর্ণ দিয়ে রড ভরতি একটা ট্রাক চলে যায়।
ধীরেসুস্থে রাস্তা পেরুলেন ফিরোজ আহমেদ । পীর সাহেবের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন । ফরিদা আর নীলুফার পাশাপাশি হেঁটে আসছে। দুজনে কথা বলছিল। নীলুফারের হাতে একটা বোতল। পানি পড়া সম্ভবত। ও রকম একটি বোতল ফরিদার হাতেও রয়েছে ।
১৩ বছর পর নীলুফারকে দেখছেন ফিরোজ আহমেদ।
হাতে জলন্ত সিগারেট ছিল।
খসে পড়ল।
মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইল নিবীর্য এক ক্লীব-পুরুষ!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




