somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: স্পর্শ

২৩ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১০:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাসে স্টেলাকে বলছিলাম, রবীন্দ্রনাথের মতো কবির কেন পশ্চিম বাংলায় জন্ম হয়েছে জান?
কেন?
পশ্চিমবাংলার তিনটে নদীর নাম ময়ূরাক্ষী, রুপনারায়ন ও সুবর্ণরেখা। যে দেশের নদীর নাম এত সুন্দর আর এত কাব্যিক সে দেশে তো রবীন্দ্রনাথের মতো কবির জন্ম হবেই।
স্টেলাকে কিছুটা বিমূঢ় দেখাল। এমন সব বিস্ময়কর ইতিহাস-পুরাণ বলে বলে ক’দিন ধরে ওকে বিমূঢ় রাখছি। বললাম, দেখ যে ক’দিন পর পৃথিবীর সবাই বলবে যে-বাংলা ভাষাই পৃথিবীর সবচে মধুর ভাষা।
ওহ্ ।
স্টেলা আজ নীল পাড়ের সাদা রঙের সুতীর একটা শাড়ি পরেছে, সেই সঙ্গে কালো ব্লাউজে চমৎকার মানিয়েছে ওকে। মার্কিনী তরুণীর পরনে বাঙালি নারীর ভূষন - বাঙালি পরিচ্ছদের মহিমাই যেন তুলে ধরে। সোনালি চুলগুলি পিছন দিকে টানটান করে বাঁধা। সাদা কপালে বড় লাল টিপ। কানে লাল রঙের মাটির দুল। গোল ফ্রেমের চশমাটা গাম্ভীর্য় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাসের জানালা দিয়ে ভ্যান দেখেছে। ভ্যানে চড়ব। দশ মাইল বাজারে বাস থেকে নেমেই স্টেলা বালিকাদের মতো আব্দার করে বসল । আমি মুচকি হাসলাম। চারিদিকে বৈশাখের রোদ থইথই করছে। সেই সঙ্গে বাংলার বিখ্যাত উথাল-পাথাল বাতাস। ধুলোও কিছু কম উড়ছে না। অদূরে ভ্যানের জটলা। সেদিকে যেতে থাকি।
চ্যাংড়া মতন দেখতে একজন ভ্যানওয়ালার সঙ্গে কথা হল। আঠারো-উনিশ বছরের ঝকঝকে শ্যামল মুখ। পরনে চেক লুঙ্গি ও ছেঁড়া গেঞ্জি। নাম বলল, মইনুল ইসলাম জুয়েল। বাড়ি এই সুন্দরপুর ইউনিয়নেই-ঢেপা নামে একটি নদীর পাড়ে । নদীটা নাকি এখান থেকে প্রায় এক মাইল পশ্চিমে।
কান্তজিউ মন্দিরে যাব। বলে দু’জনে ভ্যানে উঠে পড়লাম, তারপর পা ঝুলিয়ে পাশাপাশি বসলাম। জুয়েল ভ্যান ঘুরিয়ে নিল। বিদেশিনীকে দেখে উৎসাহ পেয়েছে। ছেলেটি এখনও জানে না আর কিছুক্ষণ পর বিদেশিনী ওর ঘামে ভেজা কালো কপালটি গভীর মমতায় স্পর্শ করবে ।
আমি সিগারেট ধরাতে যাব- ধরালাম না। মেয়েদের শরীর ফুলগাছের মতো, এই মুহূর্তে স্টেলার শরীর থেকে কী রকম বেলী ফুল বেলী ফুল গন্ধ ছড়াচ্ছে। বৈশাখের রক্ষুসী বাতাস সে সুগন্ধকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। গন্ধটা আরও নষ্ট করতে আর সিগারেট ধরালাম না ।
সাত সকালে দিনাজপুর শহর থেকে ঠাকুরগাঁওগামী বাসে উঠে দশমাইল নেমেছি। দিনাজপুর শহরে আমরা দু’জন গতকাল সন্ধ্যায় এসে পৌঁছেছি। উঠেছি রাধারানী মাসীর বাড়ি। রাধারানী মাসী মঞ্জু খালার সই, ষাটের দশকের শেষের দিকে মঞ্জু খালা আর রাধারানী মাসী ইডেন কলেজে পড়তেন। ভারি হাসিখুশি মহিলা, ঢাকায় অনেকবারই দেখেছি, আমি কখনও দিনাজপুর শহরে এলে রাধারানী মাসীর বাড়িতেই উঠি। রাধারানী মাসী স্টেলাকে মুহূর্তেই আপন করে নিয়েছেন। স্টেলার গলায় যে রামনগরী পুঁতির মালা ঝকমক করছে, সেটি রাধারানী মাসীর গিফট । রাধারানী মাসী আদর করে ওর নাম রেখেছে শ্রাবণী। স্টেলাকে আমি কখনও-সখনও বলি, বর্ষন। যেহেতু স্টেলার নবজন্ম হয়েছে।
ক’দিন ধরেই স্টেলাকে বাংলার ইতিহাস বলে যাচ্ছি। এখন বললাম, অস্টাদশ শতক ছিল বাংলার জন্য পালা বদলের কাল।
পালা বদলের কাল? কেন?
কারণ অস্টাদশ শতকে বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে আর ইংরেজ শাসন শুরু হয়।
ও।
অস্টাদশ শতকে এই দিনাজপুর জেলার মহারাজা ছিলেন প্রাণনাথ রায়। তিনি কৃষ্ণের আরাধনা করতেন। এই ফাঁকে বলে নিই যে বিষ্ণু হলেন ভারতবর্ষের অন্যতম বৈদিক দেবতা আর কৃষ্ণ হলেন বিষ্ণুর অবতার।
বুঝেছি।
বাংলার নদীয়ার শ্রীচৈতন্যদেব আবার কৃষ্ণর অবতার। যা হোক, সেসব কথা অন্য সময়ে বলব। কৃষ্ণর জন্ম হয়েছিল উত্তর ভারতের মথুরায়। সেই কৃষ্ণের উপাসনা করতেন দিনাজপুরের মহারাজা প্রাণনাথ রায়। দীর্ঘদিন ধরে কৃষ্ণর আরাধনা করছেন, মনের ইচ্ছে কৃষ্ণর নামে একটি মন্দির নির্মান করবেন । কোথায় করা যায়। অনেক ভেবেচিন্তে কান্তপুর গ্রামকেই কান্তজিউ মন্দির নির্মাণের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
কান্তজিউ?
কান্তজিউ মানে কৃষ্ণজী বা শ্রীকৃষ্ণ।
ওহ্ ।
স্থান নির্বাচনের পর কৃষ্ণ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তার আগে বাংলার নানা প্রান্ত থেকে শিল্পীরা নির্মাণ শ্রমিকেরা মহারাজা প্রাণনাথ রায়ের দরবারে ছুটে আসে। তাদের বেশির ভাগই মুসলিম। যা হোক। মহারাজ ঘুনাক্ষুরেও টের পাননি একদিন দেশবিদেশ থেকে পর্যটক এসে কান্তজিউ মন্দির দেখে মুগ্ধ অভিভূত হয়ে যাবে। কান্তজিউ মন্দির হয়ে উঠবে দিনাজপুরের গৌরব। বাননগর জায়গাটি দিনাজপুরের গঙারামপুরের কাছে । সেখানে নাকি একটি প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ছিল। সেই ধ্বংসাবশেষ দিয়েই নাকি নির্মাণ উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছিল। সত্যমিথ্যা জানি না। লোকে বলে। এর আগেরবার যখন এসেছিলাম, তখন শুনেছি। যা হোক। মহারাজা প্রাণনাথের স্ত্রীর নাম রুকমিনি দেবী। প্রাণনাথ-রুকমিনি দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন।
আহা।
তবে একটি পুত্র সন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। সেই ছেলের নাম ছিল রামনাথ।
রামনাথ?
হ্যাঁ। রামনাথ। যাহোক। মন্দিরের কাজ অসমাপ্ত রেখে ১৭২২ সালে মহারাজা প্রাণনাথ মারা যান। এরপর তাঁর দত্তকপুত্র রামনাথ রাজা হন। মহারাজা প্রাণনাথ রায়ের মৃত্যুর ফলে মন্দিরের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মহারাজা প্রাণনাথের স্ত্রী রুকমিনি দেবী তখন গভীর শোকে শোকাচ্ছন্ন। তা সত্ত্বেও তিনি প্রবল শোক কাটিয়ে উঠে ছেলেকে বললেন, তুই তোর বাবার আরাব্ধ কাজ শেষ করবি নি রাম? ছেলে বলল, করব মা। মন্দিরের নির্মাণ কাজ আবার শুরু হল। যা হোক। ১৭৫২ সালে মন্দিরের কাজ শেষ হয়। তোমাকে আমি ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের কথা বলেছি না সেদিন?
হ্যাঁ।
কান্তজিউ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ভাষা আন্দোলনের ঠিক ২০০ বছর আগে।
ওহ্ ।
এর আরও ৫ বছর পর অর্থাৎ ১৭৫৭ সালে বাংলা ব্রিটিশ বেনিয়াদের দখলে চলে যায়।
ওহ্ ।
এই পর্যন্ত বলে আমি চারিদিকে তাকালাম। স্টেলা গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। গায়ে রোদ পড়ছে। অপরিসর রাস্তাটি বেশ আঁকাবাঁকা। দু’পাশে নাগলিঙ্গম গাছ, নাড়িকেল গাছের সারি, দীর্ঘ দীর্ঘ কড়–ই গাছ, তার মনোরম ছায়া। প্রবল বাতাসের বিরুদ্ধে প্রাণপন যুদ্ধ করে ভ্যান টানছে জুয়েল । এদেরই পূর্বপুরুষ সম্ভবত এখানকার রাজরাজড়াদের পালকি টানত । কত বছর আগে এ পথেই মহারাজা প্রাণনাথ, রাজা রামনাথ পালকি করে গিয়েছেন । মহারাজা প্রাণনাথ রায়ের স্ত্রী রুকমিনি দেবী কি পালকি কিংবা হাতীর পিঠে চড়ে মন্দির আসেন নি? নিশ্চয়ই এসেছেন। কিন্তু মহারাজা প্রাণনাথ রায়ের রাজবাড়িটি কোথায় ছিল? আশেপাশেই সম্ভবত। মহারাজা প্রাণনাথ রায়ের বসতভিটে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অথচ তাঁর কীর্তি আজও টিকে রয়েছে। কী আশ্চর্য!
স্টেলার মোবাইলটা বাজল। কার সঙ্গে কথা বলল কিছুক্ষণ। তারপর ফোন অফ করে বলল, মনিকা চাকমা।
ওহ্ ।
মনিকা চাকমা রাঙামাটির মেয়ে। আমরা যখন রাঙামাটির সাপছড়ি যাই তখনই ওর সঙ্গে পরিচয়। মেধাবী ঝকঝকে এক কিশোরী। স্টেলার সঙ্গে মনিকার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হয়ে উঠেছে। মনিকা চাকমার ছোট ভাইয়ের নাম অঢং চাকমা- বারো বছরের নাদুসনুদুস বালক। অঢং -এর একটি পোষা ময়না ছিল, সেটি কী ভাবে যেন পালিয়ে যায় -আমরা যখন সাপছড়িতে ওদের বাড়ি ছিলাম তখনকার ঘটনা। অঢংয়ের সে কি কান্না, আর সবার মন খারাপ। সেই ময়নাই নাকি আবার ফিরে এসেছে। মনিকা চাকমা তাই জানাল ফোনে। যাক। স্টেলাকে কেমন নিশ্চিত লাগছে।
আশ্চর্য! এক মার্কিনী মন কী ভাবে যেন বাংলার বনপাহাড়ী সত্তায় ক্রমশ মিশে যাচ্ছে।
কান্তজিউ মন্দিরের সামনে একটা পুরনো বটগাছ। তার সামনে ভ্যান দাঁড় করালো জুয়েল। এই সকালেও বেশ ভিড়। ভ্যানের জটলার পাশে ইউএনডিপির একটা মাইক্রোবাস থেমে আছে। মনে পড়ল ফ্রান্সের কারিগররা কান্তজিউ মন্দিরের স্থাপনা অক্ষুন্ন রেখে সংস্কার করেছিল। কয়েক জন ফরেনার দাঁড়িয়ে আছে মাইক্রোবাসের সামনে। বিদেশি মহিলারা স্টেলার দিকে তাকাল। স্টেলা কে শাড়ি পরা কেল্টিক দেবীর মতন লাগছে। (স্টেলার পূর্বপুরুষরা ছিল আইরিশ) ...অদূরের ৫২ বর্গফুট আয়তনের মন্দিরের লালচে অবয়বের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে স্টেলা । বেশ বুঝতে পারছি পাঁচতলা উঁচু মন্দিরের লাল রঙের স্থাপত্য স্টেলার চোখ কেড়েছে।
জুয়েলকে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য কুড়ি টাকা দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। চারিদিক বৈশাখি রোদে ডুবে আছে। মন্দিরের সামনে সিমেন্টের চত্তর, সেই সিমেন্টের চত্তরের এপাশে ঘাস, একটি বাছুর চড়ে বেড়াচ্ছে। সিমেন্টের চত্তরের পর ভিত। ৩ ফুট উঁচু ভিতের ওপর পুরো মন্দির দাঁড়িয়ে। তিনটি ধাপে উঠে গেছে। তিনটে খিলান-দরজার ওপর চোখ রাখতেই মুহূর্তেই সময় যেন আড়াই ’শ বছর পিছনে চলে গেল।
স্টেলা অভিভূত হয়ে দেখছে। মুখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। ওকে বললাম, এই মন্দিরটি কিন্তু নবরতœ মন্দির নামেও পরিচিত।
নবরতœ মন্দির? কেন?
মন্দিরের চারপাশে ৯টি শিখর ছিল। এখন আর নেই। ১৮৯৭ সালে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে হয়েছিল। তখন ধ্বংস হয়ে যায়।
ওহ্ ।
মন্দিরটি এখন মাটিতে ধীরে ধীরে ডেবে যাচ্ছে ।
ওহ্ ।
আমরা আরও এগিয়ে যাই। স্টেলা ওর ক্যামেরার প্যারামিটার অ্যাডজাস্ট করছে। মন্দিরের ভিত থেকে শুরু করে চূড়া পর্যন্ত দেয়ালের ভিতরে বাইরে প্রতিটি ইঞ্চিতে পোড়ামাটির অলঙ্করণ। পোড়ামাটির এই অলঙ্করণই মন্দিরের মূল আকর্ষন। পোড়ামাটির অলঙ্করণ ফুল-ফল-লতা-পাতাসহ নানা পৌরানিক কাহিনী ফুটে উঠেছে।
খুব কাছ থেকে টেরাকোটার অপূর্ব সব কাজ দেখে স্টেলা অস্ফুট স্বরে বলল, আশ্চর্য!
বললাম, মন্দিরের কাজ শেষ করতে সব মিলিয়ে তিরিশ বছর লেগেছে। পৌরানিক কাহিনীর চিত্রগুলি ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ন ও মহাভারত থেকে নেয়া। দেখ যে ... রাধাকৃষ্ণর কাহিনীও ফুটিয়ে তুলেছে। সেই সময়ের মানুষের সাধারন জীবনের ছবিও আছে। আর দেখ ... এই যে ... মুগল বাদশাদের জীবনযাত্রা। সেদিন তোমায় মুগলদের সম্বন্ধে বলেছি না?
হ্যাঁ।
মনে আছে-তখন আমি বলেছিলাম যে অস্টাদশ শতক ছিল বাংলার জন্য পালা বদলের কাল। কারণ অস্টাদশ শতকে বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে আর ইংরেজ শাসন শুরু হয়।
হ্যাঁ।
এই যে দেখ ... সৈন্যদের পরনে ইউরোপীয় পোশাক। মোট কথা তখনকার দিনের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবন ফুটে উঠেছে পোড়ামাটির কারুকাজে । আর, একটা কথা এই মন্দিরের পোড়ামাটির মৃৎশিল্পীরা কিন্তু মুসলিম ছিল।
হ্যাঁ। তখন একবার বলেছিলে।
রাজা প্রাণনাথ রায় ও রামনাথ রায় দু’জনই কিন্তু মানুষ হিসেবে অত্যন্ত উদার ছিলেন। মন্দিরের অলঙ্করণের কাজ মুসলমান শিল্পীদের দিয়ে করিয়েছেন। ভাবলে অবাক হতে হয় ধর্মপ্রাণ মুসলিম শিল্পীরা রামায়ন-মহাভারত রাধাকৃষ্ণের লীলার ছবি এঁকেছে। ধর্মপ্রাণ বললাম এই কারণে যে মুসলিম শিল্পীরা নামাজ পড়ার জন্য নিজেরাই একটি মসজিদ নির্মান করেছিল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তারাই আবার সেই মসজিদের দেয়ালে পোড়া মাটির অলঙ্করণ করেছে ।
কোথায় সেটি? স্টেলার মুখেচোখে গাঢ় বিস্ময় ফুটে উঠতে দেখলাম।
এখান থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। নয়াবাদ বলে একটি জায়গায়। গতবার যখন এসেছিলাম, তখনই একবার গিয়েছিলাম।
আমি যাব।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
স্টেলা ঘুরে ঘুরে দেখছে। ছবি তুলছে। এরই এক ফাঁকে ওকে বললাম, সবাই জানে ভারতবর্ষ মন্দিরের দেশ।
হ্যাঁ। তাই তো।
কিন্তু এখন সবাই জানে, কান্তজিউ মন্দিরের চেয়ে সুন্দর মন্দির ভারতীয় উপমহাদেশে আর একটিও নেই।
ওহ্ । আসলেই। আমি ভীষন ... ভীষন মুগ্ধ। বাংলাদেশের একটি নিভৃত গাঁয়ে পোড়ামাটির এমন অপরুপ কারুকাজ দেখব ভাবতেই পারিনি ...মানে মানে ...আমি কি বলব বুঝতে পারি না ...
আমি চুপ করে থাকি। তারপর বললাম, কান্তজিউ মন্দির কেবল সুন্দরই নয় এর তাৎপর্যও অনেক গভীর।
যেমন?
যেমন মন্দিরটি ব্রিটিশ-পূর্ব সময়ের বাংলার আন্ত;ধর্মীয় স¤প্রীতির অন্যতম নিদর্শন। বিশ্বজুড়ে যার বড় অভাব আজ।
স্টেলা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু, আমি ভাবছি কান্তজিউ মন্দিরে পোড়ামাটির কারুকাজের ভাবনাটা কার মাথায় এসেছিল- মহারাজা প্রাণনাথ রায়ের না রাজা রামনাথ রায়ের?
বললাম, যারই হোক, শিল্পীর মন ছিল তাঁর। মহারাজা প্রাণনাথ রায়, রাজা রামনাথ রায়-এরা দু’জনই ছিলেন অস¤প্রদায়িক। ভাবলেই অবাক হতে হয় প্রায় তিরিশ বছর ধরে একটি কৃষ্ণমন্দির গড়ে উঠছিল কয়েকজন মুসলমান মৃৎশিল্পীর হাতে! সেই মুসলিম শিল্পীরা নামাজ আদায়ের জন্য একটি মসজিদ নির্মান করে। নয়াবাদে সেই মসজিদেও পোড়া মাটির অলঙ্করণ করেছে তারা। নিশ্চয়ই রাজা রামনাথ এর অনুমোদন ছিল, সেজন্য অর্থও বরাদ্ধ করেছিলেন রাজা। আরও গভীরে যাই। মহারাজা প্রাণনাথের স্ত্রী রুকমিনি দেবী, দত্তকপুত্র রাজা রামনাথ এর ওপর যাঁর গভীর প্রভাব ছিল। মুসলমান কারিগরেরা নয়াবাদে একটি মসজিদ নির্মাণ করবে যে মসজিদের দেওয়ালে থাকবে পোড়ামাটির কারুকাজ ... সেই বিষয়ে রুকমিনি দেবীর সম্মতি নিশ্চয়ই ছিল।
স্টেলা শ্বাস টানল। তারপর গভীর আবেগে বলল, শুধুমাত্র ... শুধুমাত্র এই একটি মাত্র কারণেই দুই বাংলার প্রতিটি বাঙালিরই জীবনে অন্তত একবার এই কান্তনগর আসা উচিত তাদের...তাদের উদার মহৎ পূর্বপুরুষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।
স্টেলার আবেগ আমাতেও সংক্রমিত হয়েছে। উত্তরে কি বলতে যাব-বিজবিজ বিজবিজ করে আমার পুরনো নকিয়াটা বাজল । অপরিচিত নম্বর। আমি অবাক। কে হতে পারে? বললাম, হ্যালো।
নমস্কার দাদা। আমি মনোরঞ্জন শীল গোপাল। স্থানীয় সংসদ সদস্য।
জ্বী। বলুন।
একটু আগে রাধারানী সরকার আমায় আপনার নম্বর দিলেন।
রাধারানী সরকার? ওহ্, রাধারানী মাসী ...হ্যাঁ বলুন।
আজ দুপুরে আমার এখানে চারটা ডালভাত খেলে খুউব খুশি হতাম। দুদিন ধইরে আমি দশ মাইলে আছি। কালও থাকব। তারপর কাহারোল চলে যাব, বুইঝলেন। ইরিগেসন সমস্যা চইলছে, বুইঝলেন না?
বললাম, অনেক ধন্যবাদ দাদা। বিদেশি গেস্ট নিয়ে আপনাদের এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখছি, কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই। পরে আপনার সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ করব।
ঠিক আছে। তালে আমার নম্বরটা সেভ করে রাখেন। কোনও সমস্যা হলি পর জানাবেন।
ওকে।
ফোনটা অফ করে স্টেলার দিকে তাকালাম। মুখে ঘাম জমেছে। রুমাল বের করে মুছিয়ে দিতে পারছি না। আমরা দু’জন ঠিক এখনও অতটা ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে উঠিনি যে কৌশলে বলব রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিলে হয় না। আমি বড়জোড় একজন গাইড। হ্যাঁ, গাইড। যে কি না এই মার্কিনী তরুণীকে কৌশলে জানিয়ে দিচ্ছে এই পৃথিবীরই আশ্চর্য এক লোকালয়ের বিস্ময়কর উপকথা ...যে লোকালয়ের মানুষের জীবনধারা ও চিন্তাভাবনা নিয়ে পৃথিবীর লোকের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে ...ফ্রান্সের প্যারিসের লালনের ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে। তারপরও কি এই মার্কিনী মেয়েটাকে সবটা বলা যাবে? যায়? যদি বলি আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে খুব কাছেই ‘পুনর্ভবা’ নামে একটি নদী বয়ে চলেছে, যে নদীর নাম হাজার বছরের পুরনো একটি শিক্ষিত জনসমাজের কাব্য রুচির প্রতিফলন ...অথচ ...অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠা এই সেদিন ১৯২১ সালের পর ...
আচ্ছা মন্দিরের শিল্পীরা কি সবাই দিনাজপুরের?
স্টেলার প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এলাম। বললাম, না, না, তা কি করে হয়। শিল্পীরা তো এক জায়গায় থাকে না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তবে শিল্পীরা সবাই বাঙালি। অনেকেই কৃষ্ণনগর বলে একটা জায়গার। কৃষ্ণনগর জায়গাটা এখন পশ্চিম বাংলায়।
বলতে বলতে মন্দিরের মূল প্রাঙ্গন থেকে বাইরে বেড়িয়ে এসেছি। নয়াবাদে যে মসজিদ আছে, ওটা চোখে দেখার আগ্রহ স্টেলার মুখেচোখে প্রবল। মসজিদ দেখে আবার এখানেই ফিরে আসব। বিকেলের আগেই আবার দশ মাইল বাজার থেকে দিনাজপুরের বাসে উঠব।
ভ্যানের জুয়েল দাঁড়িয়ে ছিল। আইসক্রিম খাচ্ছিল। আমাদের দেখে হাসল। কি রে জুয়েল। তুই নয়াবাদের মসজিদটা চিনিস না?
জুয়েল মাথা ঝাঁকাল।
ওখানে যাব। আমাদের নিয়ে যাবি?
জুয়েল মাথা ঝাঁকাল। হাসল।
রসিকতা করে বললাম, যাব তো। কিন্তু, দুপুরে খিদে পেলে-তখন?
জুয়েল হাসল।
তোদের বাড়িতে আজ কি রেঁধেছে রে?
টাকি মাছের ভর্তা।
ঢেপা নদীর টাকি?
হয়। মেজ ভাই ধরিছে।
আজ যদি দুপুরে তোদের বাড়িত যাই তো ? ... আমাদের দু’জনের পাতে ভাতের সঙ্গে অল্পখানি টাকি মাছের ভর্তা
জুটবে তো?
জুয়েল মাথা ঝাঁকাল। হাসল।
স্টেলা আমাদের কথা শুনছিল। আগামাথা বুঝছিল না কিছু। বোঝার কথাও না, এ গভীর মধুর বুঝতে হলে ওকে আরও হাজার বছর বাংলার এই বিস্ময়কর জলহাওয়ায় বেঁচে থাকতে হবে। ঘুরে একবার ক্যামেরায় মন্দিরের শট নিল স্টেলা। তারপর আপন মনে বলল, সে যুগের বাংলার সমাজ এত অসাধারন উদার শিল্পীর জন্ম দিয়েছে যারা প্রার্থনার জন্য মসজিদ তৈরি করেছিল আবার কৃষ্ণমন্দিরে মাটি পুড়িয়ে রাধকৃষ্ণের লীলার ছবি ফুটিয়ে তুলেছিল ... ভাবলে কেমন যেন লাগে ...
হ্যাঁ। মুহূর্তেই আমার জয়নুল আবেদীন আর এস. এম সুলতানের কথা মনে পড়ে গেল। সে কথা ভেবে বললাম, এই জুয়েলও কিন্তু সেই সমাজেরই একজন। বলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করলাম। অনেকক্ষণ ধোঁয়া গিলছি না, মাথাট টলছে।
কথাটা স্টেলা শুনল। ওর মুখের ঘোর তখনও কাটেনি। অভিভূত স্টেলা সামান্য ঝুঁকে জুয়েলের ঘামে ভেজা কালো কপালটি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্পর্শ করল।
আমি আর সিগারে ধরালাম না।
র্স্পশের এই সুন্দর দৃশ্যটি তামাকের কটূ গন্ধে ম্লান করার অধিকার আমার বিন্দুমাত্র নেই।

উৎসর্গ; রেজওয়ানা আর সোহামনি।
৩৮টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×