somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: আশ্রয়

০৮ ই মে, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ড্রইংরুমে টিউবলাইট জ্বলে ছিল। আদিবা পা ঝুলিয়ে সোফার ওপর বসে ছিল। টিভি চলছিল, আদিবার চোখ টিভির দিকে, ভারি মিস্টি চেহারা মেয়েটির । নীল রঙের ফ্রক পড়েছে আজ। ফরসা গোল মুখটায় জাপানি পুতুলের মতন ভারি উজ্জ্বল আর দূত্যিময় দু’টি চোখ বসানো। অনেকদিন পর আদিবাকে দেখলাম। ওর দু-বছরের জন্মদিনে একবার এ বাড়িতে এসেছিলাম। সে সময় আদিবাকে একটা জাপানি পুতুল গিফট করেছিলাম। সে পুতুলটি কি ওর কাছে আজও আছে? না কি হারিয়ে গেছে? বয়স কত হল আদিবার ? এখনও চার হয়নি মনে হল।
অথচ, এই বয়েসেই মেয়েটি এ পৃথিবীতে কেমন একা হয়ে গেল!
ভাবতেই আমার বুকের ভিতরে ঠান্ডা হিমস্রোত টের পেলাম।
আমার দিকে চেয়ে আদিবা অল্প হাসল। তারপর বলল, আঙ্কেল, আঙ্কেল আমাকে অগির কার্টুন এনে দাও তো।
ঝুঁকে টেবিলের ওপর থেকে রিমোট তুলে নিতেই রওশন খালা ড্রইংরুমে এলেন। বয়স হলেও এখনও বেশ সুঠাম আছেন; ফরসা ধবধবে চেহারা, নীল পার সাদা শাড়ি পরেছেন, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। আমাকে দেখেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আদিবা এক দৌড়ে ভিতরে চলে যায়। ভারি বুদ্ধিমতি মেয়ে তো ...
আমি রিমোট টিপে টিভি অফ করে দিই। অনেক দিন এ বাড়িতে আসা হয় না। আজও অফিসে আমার কাজের চাপ ছিল, তা সত্ত্বেও আজ আর না-এসে পারলাম না। রওশন খালার ছোট ছেলে শাকিলের সঙ্গে স্কুল-কলেজে এক সঙ্গে পড়েছি। সেই সূত্রেই শাকিলদের পরিবারের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের যোগাযোগ, রওশন খালা আমার মায়ের মতন।
দু-এক কথার পর রওশন খালা বললেন, তুমি তো সবই জান সজীব। আমি এখন কি করি বল তো বাবা । এ মাসেই ফরহাদের কাছে চলে যাচ্ছি। এখন মেয়েটাকে নিয়ে কি যে করি । এমন বিপদে পড়লাম ...বাচ্চার দায়িত্ব কেউই নিতে চায় না।
রওশন খালার ফরসা মুখে কালো ছোপ পড়েছে। দেখে খারাপই লাগল। ফরহাদ ভাই রওশন খালার বড় ছেলে, আমেরিকা থাকে। রওশন খালা ওখানেই চলে যাচ্ছেন। ভিসার কি সমস্যা নাকি আছে, না গিয়েও উপায় নেই। এদিকে আদিবাকে নিয়ে যেতেও পারছে না।
রওশন খালা বললেন, শাকিল আর জেসমিনের সব কীর্তিকান্ড শুনে ফরহাদ আর ওর বউ ওদের ওপর ভীষণ বিরক্ত।
স্বাভাবিক। আমি চুপ করে থাকি। আমিও কি ওদের ওপর কম বিরক্ত। আজকাল চারিদিকে এত ঘর ভাঙছে। বিশেষ করে মিডিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের। শাকিল বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করে, বেশ নাম-ডাকও করেছে। ওর একেকটা কাজ সত্যিই দেখার মতো। তবে এটুকু বুঝেছি যে ... প্রতিভা আর প্রবৃত্তি এক জিনিস নয়। শাকিলের বউ জেসমিনকেও ওদের বিয়ে আগে থেকেই চিনতাম, মডেলিং করত জেসমিন; ওদের সম্পর্কটা টিকল না। শাকিল মাস কয়েক হল এক উঠতি মডেলকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। জেসমিনও এক মধ্যবয়েসি বিপতœীক ব্যাংকারের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে, তাকে নাকি বিয়েও করেছে। বিয়ের আগে থেকেই জেসমিন খানিকটা উড়নচন্ডী গোছের ছিল। বাবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই ওর । এখন এ সবের খেসারত দিচ্ছে অবুঝ মেয়েটি। জেসমিন চলে যাওয়ার আগে আদিবাকে রেখে গেছে শাশুড়ির কাছে।
রওশন খালা প্রায় নিস্তেজ কন্ঠে বললেন, আদিবাকে তোমার কাছে কিছু দিন রাখ না বাবা।
আমার কাছে! রওশন খালার কথা শুনে ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম।
হ্যাঁ, অন্তত নভেম্বর পর্যন্ত আদিবা তোমার কাছে থাকুক। তখন ফরহাদও আসবে। বিষয়সম্পত্তি ভাগবাঁটোয়ারা হবে। তখন যা হোক একটা ব্যবস্থা করব।
অতি সঙ্কোচে বললাম, জানেনই তো খালা আমি একা ।
জানি বাবা।
খালার নিরুপায় অবস্থা দেখে খারাপ লাগল। আদিবার পুতুলের মতো মুখটিও চোখে ভাসছে। কি করা যায়। বললাম, আদিবার দেখাশোনা কি আপনিই করেন? কাজের মেয়ে-টেয়ে নেই?
কাজের মেয়ে আগে একটা ছিল। গত সপ্তাহে মেয়েটা দেশের বাড়ি চলে গেছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বুঝলাম আদিবা সত্যিই দুঃখী। আমাকেই ওর দায়িত্ব নিতে হবে। তাছাড়া রওশন খালা আমার মায়ের মত, খালার কথা অমান্য করা কি ঠিক হবে? তবে আদিবাল দায়িত্ব নেওয়া কঠিন হবে। আমি এখনও সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারিনি বলে বিয়ে করিনি ... আদিবাকে আমি নিয়ে যাব ঠিক আছে, কিন্তু আদিবা কার কাছে থাকবে? আমি সকাল সকাল অফিস চলে যাই। সে সময় তো ফ্ল্যাট ফাঁকা হয়ে যায়। নভেম্বর মাস আসতে আরও সাত মাস বাকি ...
রওশন খালার মুখের দিকে চেয়ে আমাকে আদিবার দায়িত্ব নিতে রাজী হতে হল।
আদিবার ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে দিলেন রওশন খালা, মুখ থমথম করছে, হাজার হলেও মায়ের জাত তো ...
আদিবাকে নিয়ে নিচে নেমে এলাম।
বেশি খুঁজতে হল না, গলির মুখেই একটা সি এন জি পেয়ে গেলাম।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। কলাবাগান থেকে সেগুনবাগিচা যেতে বেশ সময় লাগল।
সারা পথে আদিবা চুপচাপ বসে ছিল। একবার কেবল জিগ্যেস করল, আঙ্কেল, আঙ্কেল আমরা কি অগিদের বাড়ি যাচ্ছি?
আমি মিথ্যে করে উত্তর দিলাম।
হঠাৎই আমার মনে হল আজ রাতে দীপা বউদির ফ্ল্যাটে দাওয়াত। দীপা বউদিরা পাশের ফ্ল্যাটের থাকে। ভারি ভালো মানুষ। ব্যাচেলার দেবরের প্রতি বউদির অগাধ টান, প্রায়ই রান্না করে এটা-ওটা খাওয়ায়, বৌদির রান্নার হাত অতুলনীয়।
আজ আদিবাকে দেখে দীপা বউদি নিশ্চয়ই ভারি অবাক হয়ে যাবে।
ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের সামনে একটি ঝলমলে বিলবোর্ডের ওপর দু-মুহূর্তের জন্য আমার চোখ আটকে গেল। দেশের বিখ্যাত এক ডেভেলাপারের বিজ্ঞাপন; নাম:- ‘আশ্রয়’। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম- কার যে কোথায় আশ্রয় কেউ বলতে পারে না। ভাবতেই জেসমিনের মুখটা ভেসে উঠল । শ্যামলা মতন সুশ্রী একটা মুখ। আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল... মা হওয়া কেন মায়ের দায়িত্ব পালন না করতে পারলে ? প্রসব বেদনা সহ্য করে গর্ভে সন্তান ধারণ করে আবার সেই সন্তানকে ফেলে রেখে যাওয়াই-বা কেন? ভাবতেই শরীরময় কেমন এক ক্রোধ টের পেলাম। আধুনিক যান্ত্রিক জীবন কি মানুষের মৌলিক স্বভাব পালটে দিচ্ছে? রওশন খালাকে আজ কিছুটা নিষ্ঠুরও মনে হল। স্বার্থের জন্য মানুষ কত কিছুই না করে। এটুকু মেয়েকে ফেলে আমেরিকা চলে যাচ্ছেন ।
লোড শেডিং চলছিল।
সি এন জিটা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থামতেই আলো এল।
আদিবা কেমন ঘুমে ঢলছে। ওকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বয়স্ক একজন কাজের লোক রাখতে হবে। কিন্তু, সেরকম বিশ্বাসী লোক কোথায় পাব? এ মুহূর্তে এরকম হাজারটা চিন্তা মাথায় খেলা করছে।
দীপা বউদিদের ফ্ল্যাটের দরজটা খোলা। দরজার কাছে দীপা বউদি দাঁড়িয়ে । চমৎকার একটা লাল পার হলুদ শাড়ি পরেছে। বউদি ঠিক হাউসওয়াইফ না, সকালবেলায় বাচ্চাদের একটা স্কুলে পড়ায় । দীপা বউদির স্বামী অজিতদাও ভীষণ অমায়িক একজন মানুষ, অজিতদা ব্যাংকার। দাদা-বউদি নিঃসন্তান। এ জন্য দীপা বউদি প্রায়ই আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করেন। বলেন, ভগবান আমাদের এত কিছু দিয়েছেন ... এখন যদি একটা সন্তান দিতেন ...
আমার কোলে আদিবাকে দেখে দীপা বউদির মুখে চোখে বিস্ময়। বলল, ওমাঃ, এ কে সজীব?
আমি কিছু বলার আগেই আদিবা ‘মা’ ‘মা’ বলে আমাকে অবাক করে দিয়ে দীপা বউদির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এর আগে খেয়াল করিনি দীপা বউদির সঙ্গে জেসমিনের চেহারার অনেক মিল আছে ...
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×