সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ। ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবার সময় জেরিন আপা চোখের ইশারায় শান্তাকে ডাকলেন। শান্তা এগিয়ে যায়। জেরিন আপা বললেন, টিফিন টাইমে আমার সঙ্গে একবার দেখা ক’রো তো। তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
জেরিন আপার কথা শুনে শান্তা অবাক হয়ে যায়।
আমি টিচার্সরুমে থাকব কেমন।
শান্তা মাথা নাড়ল।
থার্ড পিরিয়ড ইংরেজি ক্লাস। দূর থেকে মহসিন স্যার কে আসতে দেখল শান্তা। ওদের পাড়াতেই থাকেন মহসিন স্যার, কোচিং করান। ক্লাস টেনে উঠে মহসিন স্যারের কাছে কোচিং করবে, বাবাকে অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছে শান্তা । তার কারণ আছে। এস.এস. সিতে ভালো রেজাল্ট করতে চায় আর মহসিন স্যারের পড়ানোর স্টাইল অসাধারণ। ক্লাস এইটের ইংরেজি একটু হার্ড, তবে মহসিন স্যার এমন ভাবে পড়ান যে বুঝতে অসুবিধে হয় না ।
আজ ক্লাসে ইলোরা কাকে যেন মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিল । মহসিন স্যারের চোখে পড়তেই ইলোরার ওপর ভয়ানক রেগে গেলেন । ইলোরাকে বকাঝকা করলেন। মোবাইল জব্দ করলেন। ইলোরা তো কেঁদেকেটে অস্থির। মহসিন স্যার বললেন, ফালতু মেয়ে। স্কুলে মোবাইল নিয়ে আস! কাল গার্জেন নিয়ে এসো। নইলে মোবাইল ফেরৎ পাবে না।
টিফিন টাইমে টিচার্সরুমের দিকে যেতে থাকে শান্তা। কিছুটা উদ্বেগ বোধ করছে। তখন জেরিন আপা বললেন, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। কী এমন জরুরি কথা। জেরিন আপা বাংলা পড়ান। স্কুলের দেয়াল পত্রিকা ‘বহ্নিশিখা’ বের হয় জেরিন আপার তত্ত্বাবধানেই । শান্তার লেখা একটি ছড়া গতবারের সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। জেরিন আপা ছড়ার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন । জেরিন আপা কি নতুন লেখা চান? শান্তা রূপাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছে। রূপা ওর খালাতো বোন, খুলনায় থাকত, মাস তিনেক আগে বখাটের অত্যাচারে আত্মহত্যা করেছে ...
টিচার্সরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল শান্তা। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখল ভিতরে টিচারা সব বসে আছে । শান্তার অস্বস্তি লাগে। জেরিন আপার চোখে পড়তেই ইশারায় বললেন, আসছি।
একটু পর জেরিন আপা বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা খাতা। চাপাস্বরে বললেন, শোন শান্তা, তোমাকে কয়েকটা কথা বলি।
শান্তা অবাক। জেরিন আপার মুখের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল।
জেরিন আপা বললেন, আমি স্কুল লাইফ থেকে কারাতে শিখতাম । ইউনিভারসিটি পর্যন্ত কনটিনিউ করেছি। বিয়ের পর স্বামীর জন্য ছাড়তে হয়েছে। লোকটাকে আমি ঘেন্ন করি, তারপরও যাক- আমি চাই তুমিও কারাতে শেখ। বলে চুপ করে রইলেন।
জেরিন আপার কথা শুনতে শুনতে শান্তা অবাক হয়ে যায়। জেরিন আপা বললেন, কারাতে শেখা ভালো। কাজে লাগবে। এখন চারিদিকে এত বখাটেদের উৎপাত।
এই কথায় শান্তার চোখে জল আসে। মুহূর্তেই মনের পর্দায় রূপার নিষ্পাপ মুখটি ভেসে উঠল। রূপার আত্মহত্যার পর পেপারে এ নিয়ে কত লেখালেখি হল-কই রুবেল কি ধরা পড়ল। রুবেলই তো রূপাকে জ্বালাত।
জেরিন আপা বললেন, খালি হাতে আত্মরক্ষার কৌশল আমি যা যা শিখেছি তার সবই ছবিসহ এই খাতায় লিখে রেখেছি। লেখাগুলি মন দিয়ে পড়লে একা একা প্র্যাকটিস করতে অসুবিধে হবে না। বলে শান্তাকে খাতাটা দেখালেন। খাতাটা তোমায় দেব, তবে একটা শর্ত আছে।
শর্ত? শান্তা অবাক হয়ে যায়।
দু-বছর পর যখন ভালো করে খালি হাতে আত্মরক্ষার কৌশল শিখে যাবে তখন তোমার মতো কোনও মেয়েকে এই খাতাটা দিয়ে দেবে।
শান্তা মাথা নাড়ল।
জেরিন আপা খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, যাও এটা ব্যাগে ভরে ফেল। কাউকে দেখানোর দরকার নেই।
শান্তা কাঁপা- কাঁপা হাতে খাতাটা নিল।
২
ছুটির পর শান্তা বাড়ি ফিরে আসে। তারপর সময় সুযোগ মতো খাতা খুলে। বেশ মোটা খাতা। জেরিন আপার হাতের লেখা মুক্তোর মতো। ঝকঝকে। লেখার সাথে সাথে ছবিও আছে। জেরিন আপার আঁকার হাতও ভালো। কী ভাবে অনুশীলন করতে হবে বুঝতে অসুবিধে হয় না। অনুশীলনের পাশাপাশি ধ্যান করতে হবে। তিন পাতা পর পর ধ্যানের কিছু ছবি ও নির্দেশাবলীও আছে। অনেকটা যোগ ব্যয়ামের মত। মাঝে-মাঝে ফাঁকা পৃষ্টায় অদ্ভূত কিছু কথা লেখা। যেমন, (১) সচেতনতা ও পরিশ্রম ছাড়া সুখ আশা করা যায় না। (২) জীবন হল যুদ্ধক্ষেত্র। সুতরাং অন্যায় আঘাত প্রতিহত করাই শ্রেয়। (৩) তারা আঘাত করলে তুমি বসে থাকবে কেন? তুমি তো অহসায় নও। তুমিও খালি হাতে আত্ম রক্ষার অনুশীলন কর।
পড়তে পড়তে শান্তা ওর সমস্ত শরীরে শিহরণ স্রোত টের পায়।
রাতে ঘুমাতে যাবার সময় সমস্ত মনোযোগ পায়ের পাতায় স্থির করে। ধীরে ধীরে মনোযোগ উঠিয়ে আনে। শরীর কেমন অবচেতন শীতলস্রোতে ভেসে যেতে থাকে। মনোযোগ নাভীর কাছে আসতেই হঠাৎই মনে হল যেন অনেক নিচের খাদের পড়ে গেল ...
পরদিন ঘুম ভাঙল অনেক ভোরে।
শান্তা অবাক হল। কেননা, প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। বাবা গালাগালি করে। অনুশীলনের কথা মনে হতেই শান্তা চুপিসারে ছাদে উঠে যায়। তখনও অন্ধকার কাটেনি। গতকাল রাতেই প্রথম অনুশীলন মুখস্ত করে নিয়েছে।
অনুশীলনে ডুবে গেল ও।
তারপর তন্ময়তা ভেঙে গেলে আজান শুনতে পেল। আজানের পরপরই আলো ফুটতে থাকে। ছাদ ভর্তি টব। টবে নানা জাতের ফুলের গাছ। কী মনে হতে নিচে নেমে গেল। বালতিতে পানি এনে গাছগুলিতে ছিটালো। মনে খুশি খুশি ভাব টের পেল। শান্তার বাবা নামাজ সেরে ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। ভদ্রলোকের ডায়াবেটিস আছে। আজ ভোরে ছাদে এসে মেয়েকে ফুলগাছের যতœ নিতে দেখে খুশি হলেন তিনি ।
৩
দু’বছর পরের কথা।
জেরিন আপা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তার আগে একদিন বিষন্ন কন্ঠে বললেন, আমার স্বামী চায় না আমি স্কুলে চাকরি করি। লোকটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং পীরের পিছনে ছুটছে।
জেরিন আপার সঙ্গে মাঝে-মাঝে টেলিফোনে কথা হয়। এখনও ইন্সট্রাকশান দেন। একদিন জেরিন আপা বললেন, সালোয়ার খানিকটা ঢোলা করে বানিও, তাতে পা স্ট্রেচ করতে সুবিধে।
শান্তার কারাতে অনুশীলন অব্যাহত থাকে।
কখনও ভোরের আধো-অন্ধকারে ছাদে, কখনও গভীর রাতের নিকষ আঁধারে ঘরের মেঝেতে, কখনও দুপুরের অঝোড় বৃষ্টিতে ...শরীর আগের তুলনায় অনেক হালকা লাগে ওর। সব সময় মাথার রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে বলে দীর্ঘক্ষণ পড়া মনে রাখতে পারে।
ক্লাস এইটে রোল ছিল ১৮; ক্লাস নাইনে উঠে হল ৩ ...
হায়েস্ট নাম্বার ইংরেজিতে ...
এ নিয়ে ক্লাসে ফাস্ট গার্ল সঞ্চিতা ওকে ঈর্ষা করে ...
শান্তা মুচকি হাসে।
কখনও কখনও শান্তা দীর্ঘক্ষণ ওর খালাতো বোন রূপার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে । কাঁদে। মাস কয়েক আগে বাড়ি সবাই খুলনায় গেল। শান্তা গেল না। খুলনায় গেলে রূপার স্মৃতি মনে পড়বে। কিছুতেই রূপার আত্মহত্যা মেনে নিতে পারছে না শান্তা। রূপার ঘাতক রুবেল এখনও ধরা পড়েনি। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুলে একটাই সংবাদ তন্ন তন্ন করে খোঁজে- রুবেল কি ধরা পড়ল ...
৪
টেস্ট পরীক্ষা চলছে। এসএসসির বেশি দেরি নেই।
এক বিকেলে মহসিন স্যারের কোচিং থেকে ফিরছিল শান্তা। আজ সামান্য বিষন্ন ছিল ও। আজ জেসমিন ওকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদল। জেসমিন ক্লাস এইটে পড়ে, মহসিন স্যারের কাছেই কোচিং করে, জেসমিনরা থাকে খিলগাঁও। অদ্ভূত সুন্দরী দেখতে জেসমিন, পাড়ার এক ছেলে ওর পিছনে লেগেছে। প্রায়ই বিরক্ত করে। অশালীন মন্তব্য করে। জেসমিন বুঝতে পারছে না কি করবে।
এই শান্তার বিষন্নতার কারণ ...
পাড়ার চায়ের স্টলের সামনে কতগুলো ছেলের জটলা। তারা কেউ কেউ সিগারেট টানছিল। কারও কারও হাতে চায়ের কাপ।
শান্তাকে দেখে একজন শিস দিল। একজন গান গেয়ে ওঠে।
ভ্র“ক্ষেপ না-করে এগিয়ে যায় শান্তা ।
ছেলেদের মধ্যে লম্বা মতন দীর্ঘ চুলের কালো জিনস আর নীল জ্যাকেট পরা একজন এগিয়ে আসে।
শান্তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়।
রাস্তায় লোকজন জড়ো হয়ে গেল মুহূর্তেই। কেউই এগিয়ে এল না। সবাই তামাশা দেখবে। অন্য বখাটেদের মধ্য কেউ কেউ মোবাইল ফোন তাক করে ধরেছে। এক্ষুনি যে মজার দৃশ্যটি সংঘটিত হতে যাচ্ছে, তার ভিডিও করবে।
আমাকে যেতে দেন। শান্তা শান্ত স্বরে বলল।
যেতে না দিলে কি করবি তুই! বলে বখাটেটা শান্তার হাত ধরে টান দেয়।
শান্তার হাত থেকে বইখাতা পড়ে যায়।
তারপর সবাই দেখল শান্তার শরীর চোখের নিমিষে শূন্যে উঠে যায় তারপর ওর পা দুটো শূন্যেই প্রসারিত হয়ে যায় আর ডান পাটা বখাটের মুখে বিদ্যুৎ গতিতে আঘাত করে।
বখাটের চোয়ালে হাড় স্পস্টতই শব্দ করে ভাঙ্গল।
শান্তা যখন চমৎকার ভঙ্গিতে মাটিতে নেমে এল তখন করতালির তুমুল আওয়াজ শুনতে পেল।
যেন কিছুই হয়নি ...এমন ভাবে শান্তা বইখাতা তুলে নেয় ...জেরিন আপার কথা মনে পড়ল ... দু-বছর পর যখন ভালো করে খালি হাতে আত্মরক্ষার কৌশল শিখে যাবে তখন তোমার মতো কোনও মেয়েকে খাতাটা দিয়ে দেবে ...
কালই কারাতে শেখার খাতাটা জেসমিনকে দিয়ে দিবে ঠিক করল। কিংবা বাবা-মাকে বলে জেসমিনদের বাড়িতে গিয়ে ক’দিন বেড়িয়ে আসবে। শান্তার রেজাল্ট ভালো হচ্ছে। মা-বাবার তো এখন রাজী হওয়ার কথা ...
বাড়ি যেতে যেতে শান্তা টের পেল ওর পায়ে মোটেও ব্যথা লাগেনি। তবে বখাটের চোয়াল ভেঙে দরদর করে রক্ত বেরুচ্ছে নিশ্চয়ই... শান্তা আরও জানে এই মুহূর্তে বখাটেকে ঘিরে থাকা লোকজনের কারও শান্তার বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করার মানসিক শক্তি নেই ...না, সে সাহস নেই কারও ...
শান্তা শ্বাস টানে। এস এস সি পরীক্ষার পর এ পাড়ার প্রতিটি ঘরে যাবে ও। স্কুল পড়–য়া মেয়েদের নিয়ে কারাতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলবে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করার আগেই এ ভঙ্গুর দেশটার দখল নিয়ে নেবে ...
উৎসর্গ: বাংলাদেশজুড়ে বখাটেদের নিষ্ঠুর আচরনের ফলে যারা অসময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে ...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




