শ্বেত পাথরের পেয়ালায় আনার রঙের ফালুদা। তাতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বাদশা আকবর বললেন, ফুপু, তুমি বাবার জীবনকাহিনীটি লেখ না।
আমি লিখব? বাদশা আকবরের ঠিক সামনে বসা গুলবদন বেগম-এর মাঝবয়েসী গুলাবী গন্ডদেশে যেন রং ছড়াল। মুগল হেরেমের এই কক্ষে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে। তাতে গুলবদন বেগম-এর ঐশ্বর্যময়ী রূপ থেকে রূপালি আভা ছড়িয়েছে।
হ্যাঁ, তুমি লিখবে। বাদশা আকবর বললেন। তুমি কত সুন্দর করে আমাদের ছেলেবেলায় গল্প শোনাতে-কেন তোমার মনে নেই? আমরা যখন কাবুলে ছিলাম।
পুরনো দিনের কথা ওঠায় গুলবদন বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ভাইয়ের এই ছেলেটি তিনি ভারি স্নেহ করেন। হিন্দুস্থানের কত বড় বাদশাহ, অথচ বিন্দুমাত্র অহংকার নেই, একেবারে সেই ছেলেবেলার মতোই আছে। গুলবদন বেগম বললেন, আচ্ছা লিখব। এত করে যখন বলছিস। গুলবদন বেগম ভাইয়ের ছেলেকে আশ্বাস দিলেন।
আরও কিছুক্ষণ পর জরুরি সংবাদ পেয়ে আকবর প্রস্থান করে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে উঠেছে। এক রাজস্থানী বাঁদি এসে সেজ বাতি জ্বেলে দিয়ে গেল।
গুলবদন বেগম লিখতে বসলেন। বুকে চাপা কান্না টের পেলেন। কত কথা, কত স্মৃতি। এখন বুক চিড়ে সে সব কথার উত্থান হবে। কষ্ট তো হবেই। সে কালের রীতি অনুযায়ী প্রথম পাতায় দীর্ঘ শিরোনাম লিখলেন:“ আহওয়াল হুমায়ুন পাদশাহ জামাহ কারদম গুলবদন বেগম বিনতে বাবুর পাদশাহ আম্মা আকবর পাদশাহ।” পরে এটিই ‘হুমায়ুননামা’ বা ‘দি হিস্ট্রি অভ হুমায়ুন’ নামে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে।
গুলবদন বেগম ভাইয়ের জীবনীটি সহজ সরল ভাষায় লিখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। লিখতে লিখতে সহসা বাবার কথা মনে পড়ে গেল। গুলবদন বেগম এর বাবা সম্রাট বাবর (১৪৮৩/১৫৩০) ‘বাবরনামা’ লিখেছিলেন । সে বইটিও সম্রাট বাবর সহজসরল ভাষায় লিখেছিলেন ...
... গুলবদন বেগম এর বাবা বাবর ভারতবর্ষে মুগল বংশের প্রতিষ্ঠাতা। পিতার দিক থেকে তৈমুর লং ও মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের সঙ্গে সর্ম্পকিত ছিলেন বাবর। তিনি ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিস্থানের খোকন্দে জন্মগ্রহন করেন। বাবরের পিতা উমর শেখ মির্জা ফরগানার অধিপতি ছিলেন। বাবর তাঁর পিতার মৃত্যুর পর অল্প বয়েসে ক্ষমতা লাভ করেন। তবে বারবার ক্ষমতা চ্যূত হলে মধ্য এশিয়া ত্যাগ করেন এবং কাবুল জয় করেন। ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ উপাধি গ্রহন করেন। ওই বছরের ১৭ মার্চ বাবর এর জ্যেষ্ঠ পুত্র হুমায়ুন কাবুলে জন্মগ্রহন করেন। যা হোক। এরপর মধ্য এশিয়ায় কর্তৃত্ব করতে চাইলে ব্যর্থ হন। ভারতবর্ষ জয়ের চেষ্ট া করেন। ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল জয় করেন। এরপর ১৫২২ সালে কান্দহার জয় করেন। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মুগল বংশের সূচনা করেন।
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাবর মৃত্যুবরণ করেন।
বাবর এর মৃত্যুর সময় তাঁর একমাত্র কন্যা গুলবদন বেগম-এর বয়স ছিল ৮ বছর। এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র হুমায়ুন-এর বয়স ২২। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাবরের মৃত্যুর পর আগ্রায় এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হুমায়ুনের মুগল বংশের শাসনভার গ্রহন করেন। এবং অবিলম্বে পশ্চিমে স্থানীয় মুসলিম অধিপতিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। পূর্বদিকেও উদীয়মান আফগান নেতা শেরখান শক্তি শালী হয়ে উঠছিলেন। ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে শেরখান-এর জন্ম; পিতার নাম হাসান খান শূর। শেরখান বিহারের অর্ন্তগত সাসারামের জায়গিরদার। যা হোক। শেরখান ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দের এক যুদ্ধের পর বিহারের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হন। এবং ক্রমান্বয়ে ১৫৩৮ সালে গৌড় (সে সময়কার বাংলার রাজধানী) দখল করেন। এতে হুমায়ুন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি সসৈন্য পূর্বদিকে অগ্রসর হলেন। হুমায়ূন গৌড়ে প্রবেশ করেন। (গুলবদন বেগম এসব ঘটনাই লিখেছেন হুমায়ুননামায় ...) ...বাংলাপিডিয়ায় কে. এম করিম লিখেছেন: “সম্রাট হুমায়ুন বাংলার রাজধানীর নতুন নামকরণ করেন ‘জান্নাতাবাদ’ এবং হুমায়ুন এখানে ছয়মাস অবস্থান করেন। ” ...তৎকালীন গৌড়ের অবস্থান বর্তমান পশ্চিম বাংলার মালদহ জেলায় গঙ্গা নদীর পশ্চিম পাড়ে। বাংলা হুমায়ুনের কাছে বেহেস্তের মতন মনে হয়েছিল। কাছেই গঙ্গা। রাজশাহীর মতই মালদহে প্রচুর আম ফলে। মুগল বাদশা হুমায়ুন বাংলার কিছু হলেও অপার-মর্ম টের পেয়েছিলেন ... ‘জান্নাতাবাদ’ -এর বাংলা স্বর্গনগর ...
ওদিকে চতুর আফগান শেরখান বিহার পুনরুদ্ধার করে পশ্চিমে অনেক দূর এগিয়ে যায়। জান্নাতাবাদে কিছু সৈন্য রেখে সম্রাট হুমায়ুন পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন এবং ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের নিকটবর্তী চৌসা নামক স্থানে পৌঁছেন। শেরখান এর সৈন্যবাহিনী হঠাৎই মুগল সৈন্য দের ওপর আক্রমন করে বসে । মুগল সৈন্যরা হতভম্ব হয়ে যায়, চতুর্দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। সম্রাট হুমায়ুন পরাজিত হন। শেরখান ‘শেরশাহ’ উপাধি ধারণ করে নিজেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসক বলে পরিচয় দেন । এরপর আফগান সৈন্যরা মুগল প্রতিরোধ ধ্বংস করে দিয়ে বাংলা দখল করে। শেরশাহ ভারতবর্ষে শূর বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ওদিকে হুমায়ুন প্রতিশোধের পথ খুঁজছিলেন। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে কনৌজে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সে যুদ্ধেও হুমায়ুন পরাজিত হন এবং দিল্লির সিংহাসন ত্যাগ করেন। শেরশাহ আফগান সালতানাত পুনরুদ্ধার করেন। এরপর সম্রাট হুমায়ুন প্রায় ১৫ বছর গৃহহীন যাযাবরের জীবন যাপন করেন। সিন্ধুর মরু এলাকায় ঘুরছেন। এ সময়ই ১৩ বছর বয়েসি হামিদা বানু বেগম নামে এক কিশোরীর প্রেমে পড়ে যান। সেই কিশোরীর সঙ্গেই বিয়ে হয় হতভাগ্য সম্রাটে (এরকম অভূতপূর্ব বিষয়ই লিখেছেন সম্রাট হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগম ) ... ১৫৪২ সালে হামিদা বানু বেগম অমরকোটে এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। সেই ছেলের নাম রাখা হয় আকবর। পুত্রের জন্মের পর সম্রাট হুমায়ুনের ভাগ্য যেন বদলে যেতে থাকে। তিনি পারস্যের দিকে অগ্রসর হন। পারস্যের শাহ তখন তামাস্প ... তিনি সম্রাট হুমায়ুনকে আন্তরিক ভাবে গ্রহন করেন, সামরিক সাহায্যের আশ্বাস দেন;...এর পর হুমায়ুন আফগান বাহিনীকে পরাজিত করেন দিল্লি ও আগ্রা পুনর্দখল করেন। তবে সাম্রাজ্য সংহত করার জন্য দীর্ঘকাল বেঁচে থাকেননি । ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে এক গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন।
লিখতে লিখতে কত কথা মনে পড়ে যায় ...
গুলবদন বেগম-এর জন্ম কাবুলে ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে । যখন ভারতবর্ষে এলেন তখন বয়স ৬। ১৭ বছর বয়েসে বিবাহ। স্বামী চাগতাই মুগল- খিজির খাজা খান। একটি ছেলেও হয়েছিল। ভাই হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয়ের সময় গুলবদন বেগম কাবুলে ছিলেন-সেই সময়টা হেরেমেই কেটেছে। হুমায়ুন দিল্লি ও আগ্রা পুনর্দখল করার পর গুলবদন বেগম আগ্রায় ফিরে আসেন নি। ফিরে এলেন আকবরের শাসন যখন আরম্ভ হয়, তখন। আকবর হুমায়ুনের মৃত্যুর দু বছর পর শ্রদ্ধেয় ফুপুর ভরনপোষনের দায়িত্ব গ্রহন করে আগ্রায় নিয়ে আসেন। হজ্জব্রত পালন বাদে গুলবদন বেগম-এর বাকি জীবন আগ্রা ও ফতেহপুর সিক্রিতে কেটেছিল।
১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ। হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশে গুলবদন বেগম-এর অন্যান্য মুগল নারীদের সঙ্গে ৩ হাজার মাইল দূলংঘ্য পাহাড় ও বিস্তীর্ণ মরুভূমি পাড়ি দেন। হারেমের অভিজাত মহিলারা এরকম কষ্টকর যাত্রা এর আগে করেনি। হজ্জব্রত পালনের ব্যবস্থা বাদশাহ আকবরই করে দেন। ফুপুরকে দান করার জন্য প্রচুর ধনরত্ন দান করেন। গুলবদন বেগম প্রায় চার বছর মক্কা-মদিনায় কাটান। সে সময় তাঁর এই সফর নিয়ে আলোরন উঠেছিল। সিরিয়া ও এবং তুরস্ক থেকে দানসামগ্রী গ্রহন করতে লোকে ছুটে গিয়েছিল তাঁর কাছে। ফেরার পথে এডেন বন্দরে নৌদূর্ঘটনায় পড়েন। অবশেষে যাত্রার ৭ বছর বাদে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আগ্রায় ফেরেন।
এসব কথাই সহজ সরল ভাষায় লিখেছিলেন। বাবা লিখে ছিলেন বাবরনামা। সুযোগ্য কন্যা সে রীতিই অনুসরন করেছেন। সে কালে লেখায় অলংকারিক ভাষা প্রয়োগ করা হত, গুলবদন বেগম সেসব বর্জন করেন। তিনি কেবল হুমায়ুনের শাসনামলের কালপঞ্জী রচনা করেন নি, হেরেমজীবনের কথাও লিখেছেন। হুমায়ুননামায় গুলবদন বেগম ১৫৫২ সাল অবধি সম্রাট হুমায়ুনের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা লিখেছেন। এর চার বছর পর সম্রাট হুমায়ুনের দিল্লির পুরান কিল্লার সিঁড়ি থেকে পড়ে মৃত্যু হয়।
হুমায়ুননামা ষোড়শ শতকের একমাত্র মুগল অভিজাত নারীর রচনা।
গুলবদন বেগম নামাজ রোজা বাদেও গরীব দুঃখীর পাশে ছিলেন। নিয়মিত দান করতেন। এই অসাধারণ নারীর মৃত্যু হয় ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্র“য়ারি মাসে । বয়স তখন আশি। জ্বর হয়েছিল। বাদশাহ আকবর-এর মা হামিদা বানু বেগম মৃত্যুকালে গুলবদন বেগম এর পাশে ছিলেন। গুলবদন বেগম তাঁকে অস্ফুটস্বরে বললেন, আমি চলে গেলাম। তোমরা বেঁচে থাক।
হামিদা বানু বেগম উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলেন।
স্বয়ং বাদশাহ আকবরও উচ্চস্বরে রোদন করেছিলেন। ফুপুর খাটিয়া বহন করেছিলেন। (আকবর বাদশা নদী পাড় হওয়ার সময় মা (হামিদা বানু বেগমের ) পালকি বহন করতেন। (রবীন্দ্রনাথ এ তথ্যটি উল্লেখ করেছেন) অনেক শেখার আছে আমাদের এই সিংহহৃদয়ের বাদশার কাছ থেকে ...)
ফুপুর মৃত্যুর দু বছর পর ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের মৃত্যু ঘটে ।
আসলে গুলবদন বেগম ছিলেন কবি । কবিতা লিখেছিলেন তুর্কি ও ফারসি ভাষায়। তবে সে কবিতা পাওয়া যায়নি। যা হোক। গুলবদন বেগম ছিলেন স্বশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা। পড়াশোনা করতে ভালোবাসতেন। উপরোন্ত তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল, গভীর জ্ঞান ছিল সমরবিদ্যা সম্বন্ধে । তবে পিতা বাবর সম্বন্ধে ‘হুমায়ুননামায়’ তেমন কিছু লেখেননি। এর কারণ হয়তো বাবরের মৃত্যুর সময় গুলবদন বেগম এর বয়স ছিল ৮। মুগল হেরেমের নারীদের কাছ থেকে শোনা নানা কথা হুমায়ুননামায় উল্লেখ করেছেন, এতে লেখা প্রাণবন্ত হয়েছে। আর, মুগল হেরেমের খুঁটিনাটি বর্ননা তো ছিলই।
‘হুমায়ুননামা’ ফরাসি ভাষায় রচিত। তবে মূলগ্রন্থে ফারসি ও তুর্কি শব্দাবলির মিশ্রণ ছিল। হুমায়ুননামার এক মাত্র কপিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এ . এস বেভারেজ গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। তিনি
ভালোবেসে গুলবদন বেগম এর নাম দিয়েছেন: Princess Rosebud!
আজ আমরা জানি, গুলবদন বেগম এর হৃদয়খানিও ছিল গোলাপের মতোই সুন্দর।
তথ্য: বাংলাপিডিয়া ও ইন্টারনেট।
হুমায়ুননামা পড়তে চাইলে ...
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১০ বিকাল ৪:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





