somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: নীলবর্ণের পাহাড়ের কাছে

১৭ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পিদিম বলল, জান রাকা রথকে না ইংরেজীতে বলে চ্যারিওট।
তাই?
হ্যাঁ।
তা তুমি এত ভালো ইংরেজি কোথায় শিখলে পিদিম?
পিদিম বলল, আমি তো শহুরে ভূত। আমি একটা বাড়ির ছাদে থাকতাম আগে। সেই বাড়ির ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যেবেলায় পড়তে শুরু করলে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। তখনই শিখেছি।
তুমি শহরে কই থাকতে? রাকা জিগ্যেস করল।
পিদিম বলল, আগে ছিলাম ভূতের গলি। তারপর সিদ্ধেশ্বরী কালিমন্দিরের কাছে। জায়গাটা মৌচাক আর বেইলি রোডের খুবই কাছে।
রাকা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল, ও। আমি কিন্তু শহরে কখনও যাই নি।
পিদিম বলল, আচ্ছা, একদিন আমি তোমায় শহরে নিয়ে যাব।
বেশ। তাই নিয়ে যেও।
রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে রথ চলেছে। মানে রাজপ্রাসাদটা এখন হাতের বাঁয়ে। পথের দুপাশে বড় বড় অনামা গাছ বলেই পথটা ছায়ায় ঢাকা। । পাতা আর ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে আলো এসে পড়েছে নীচে। নীচে অনেক শুকনো পাতা। বাতাসে সরসর করেও উঠল। একটা চিত্রময় হরিণ চলে গেল। কাছাকাছি একটা জলস্রোতও রয়েছে মনে হল। পানির সরসর শব্দও শোনা যাচ্ছিল।
সারথীবুড়ো আন্দালিব সুন্দর শিস দিচ্ছিল। সুরটা চেনা চেনা লাগল পিদিমের । সিদ্ধেশ্বরী থাকার সময়ই শুনেছে।

এলাটিঙ বেলাটিঙ তেলাটিঙ চোর
মাইফোর ডিফোর ফরটিফোর
এককাঠি চন্দন কাঠি
চন্দন বলে কা কা প্রজাপ্রতি উড়ে যা।

দেখতে দেখতে রথটা প্রাসাদের পিছনে চলে এল। আসতেই তুষার ছড়ানো বিশাল এক নির্জন প্রান্তর দেখা গেল। দূরে একটা নীল রঙের আবছা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। প্রান্তরের ওপর দু একটা গাছ। সেই প্রান্তর আর পাহাড়ের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ একটা আকাশ । নীল রঙের। আর সেই নীল রঙের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা মেঘ । পিদিমের মনে হল যেন মেঘের মধ্যেই পরির দেশটা। কিংবা পরির দেশের আকাশে মেঘেদের রাজ্য। তারই একপাশেই তো সেই সোনারবরণ রঙধনুর মতন বাঁকানো আকাশপথটা। যেখানে চাঁদের কিরণ ঝরে ঝরে পড়ে আর তুষার প্রান্তরের হিম ।
ধু ধু প্রান্তরের দিকে হাত তুলে রাকা বলল, ওই দেখ।
কী?
রাকা বলল, ওই মাঠটাকে আমরা তুষারপ্রান্তর বলি। আর ওই যে দেখ তুষারপ্রান্তরের পিছনে একটা পাহাড় ...
হ্যাঁ।
আমরা ওই পাহাড়কে বলি নীলবর্নের পাহাড়। পাহাড়ে অনেক গাছপালা আছে।
হ্যাঁ, সত্যিই খুব সুন্দর। পিদিম মাথা নেড়ে মন্তব্য করল।
রাকা বলল, ওই যে দেখ ঝিকিমিকি নদী।
হ্যাঁ, তাই তো।
আর তার ওপর যে সেতুটি দেখছ, তার নাম সোনারবরন সেতু। এই নদীর চিতল মাছের কথাই আমি তোমায় বলেছিলাম।
পিদিম অবাক হয়ে দেখল, নীল মখমলের মাঠের কোনে ঝিকিমিকি নদীর ওপর বাঁকানো সোনার সেতু। সেতুর দুপাশের রুপোর তৈরি ঘোড়ার মূর্তি। নদীর পাড়ে, যেখানে সেতুর শুরু, সেখানে গিজগিজে ভিড়। অবশ্য ঝিকিমিকি নদীর ওপর ভেসে থাকা নৌকাগুলি সব ছবির মতন সুন্দর। নৌকা ভরতি চিতল মাছ। সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছে। নদীর ওপাড়ের গাছগুলিও সুন্দর। পথগুলি কুয়াশায় ঢাকা। দূরে একটা পাহাড়। মেঘের ভিতরে চূড়াটা ডুবে আছে।
পিদিম স্বীকার করতে বাধ্য হল, আমি অমনটা কখনও দেখিনি।
রাকা হাসল।
একটু পর ঘন্টা বাজল।
রাকা বলল, সারথীদাদু ঘন্টা বাজিয়েছে, তার মানে এখন আকাশ থেকে চকোলেট পড়বে। সারথীদাদু রাস্তার ওপরে বাঁক নিলেই ঘন্টা বাজায়। আর তখনই আকাশ থেকে চকোলেট পড়ে।
সত্যিই তাইই হল। পিদিম আর রাকার কোলের ওপর গুনেগুনে আটটা চকোলেট পড়ল।
খাও পিদিম, দুধ আর বাদাম দেওয়া। রাকা বলল।
খাচ্ছি। বলে একসঙ্গে দুটো চকলেট তুলে নিল পিদিম ।
রাকা বলল, সারথীদাদু, তুমি বাঁক নিলে যে? কে গেল রথে করে?
বুড়োদাদু বলল, অন্ধ জ্বিন।
কী সর্বনাশ! অন্ধজ্বিন।
চকলেট মুখে পুড়ছিল পিদিম, থামিয়ে বলল, কেন কেন অন্ধ জ্বিনে সর্বনাশ কেন?
রাকা বলল, অন্ধজ্বিন হল পরিরাজ্যের সবচে দুষ্টু একটা জ্বিন। অনেক বছর আগে জ্বিনটাকে ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল নীলবর্ন পাহাড়ের চূড়ার কয়েদখানায়। সেই ছাড়া পালিয়েছে বোধ হয়। কিন্তু আমি ভাবছি অন্ধজ্বিনটা ছাড়া পেল কী করে।
পিদিম বলল, ভয় নেই। আমি আছি না।
পিদিমের মুখের দিকে তাকিয়ে রাকা বলল, অন্ধজ্বিন আমাদের আক্রমন করতে এলে তুমি কী করবে?
পিদিম চকলেট মুখে ফেলে বলল, আগে আক্রমন করতে আসুকই না। তখন দেখা যাবে।
পিদিমের কথা শুনে অবাক হয়ে কিছুক্ষন পিদিমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রাকা। তারপর বলল, এখানে কোথাও নামবে পিদিম?
পিদিম বলল, হ্যাঁ। নেমে ঘুরেফিরে দেখি। ফিরে গিয়ে আবার চিরি আর গড়ানদের গল্প বলতে হবে। নইলে ওরা বিশ্বাস করবে না আমি সত্যি সত্যি পরির দেশে এসেছিলাম।
রাকা আদুরে গলায় বলল, সারথী দাদু, সারথী দাদু, রথটা একটু থামাও না।
বলতেই সারথী দাদু আন্দালিব রথটা থামল। ঘোড়াগুলি চি হি হি হি করে উঠল।
এসো। বলে রাকা নামল।
নামছি। পিদিম বলল।
ওরা রথ থেকে নেমে এসে একটা গাছের নীচে দাঁড়াল। সামনেই ঘাসের মাঠ। তারপর একটা অতল খাদের কিনারা শুরু হয়েছে। ওপারেই সেই নীলবর্ণের পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে । বরফমাখা চূড়াটা মেঘের ভিতরে ডুবে যাচ্ছে আবার মেঘ সরে গেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে অনেক গাছপালা। নীচেই অতল খাদ। ধোঁওয়া উঠছে।
কী সের ধোঁওয়া রাকা?
রাকা বলল, নীচে ঝিকিমিকি নদী। তার পাশে অনেক গ্রাম। সেখানকার ধোঁওয়া।
ও। ওটাই কী নীলবর্ণের পাহাড়? পিদিম জিগ্যেস করল।
হ্যাঁ। রাকা বলল।
হঠাৎ বাঁশীর সুর শোনা গেল। ওরা চমকে তাকিয়ে দেখল বুড়োসারথী একটা বাঁশী বার করে বাজাতে শুরু করেছে। কী সুন্দর সুর। সেই সুর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
দূরের ওই পাহাড়ের থেকে একটা ঈগল পাখি উড়ে এল। ঈগল পাখির নখরে ভেড়ার ছানা। মাথার ওপর দিয়ে ওটা তুষার মাঠের দিকে ঝিকিমিকি নদীর দিকে চলে গেল।
রাকার মন খারাপ হয়ে গেল। ও বলল, জান পিদিম ওই নীলবর্নের পাহাড়ে অনেক নেকড়ে আছে।
ওরা কামড়ে দিলে?
রাকা বলল, না। কামড়াবে না। ওগুলি আসলে ছবি।
ছবি!
রাকা বলল, হ্যাঁ। ছবি। সত্যি না।
পিদিম ভীষন অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, সেটা আবার কেমন?
রাকা বলল, আমি এখনও জানি না। বড় হয়ে জানব। আমি তো এখনও ছোট।
বড় হলে বুঝবে?
হ্যাঁ।
কী করে তুমি বুঝবে যে তুমি বড় হয়ে গেছ।
রাকা বলল, আমি বড় হয়ে গেলে আমার মা-ই তখন বলে দেবে যে আমি বড় হয়ে গেছি।
ও।
সারথীদাদু এখন বাঁশী বাজানো থামিয়ে গান ধরেছে:

সারথী দাদু, সারথী দাদু, রথটা একটু থামাও না।
আমাদের একটু নামাও না।

গান শুনে রাকার কী হাসি। পিদিমও হাসল। হাসতে হাসতে ওর পেটে খিল ধরে গেল।

তো, রাকা স্বপ্ন দেখেই চলেছে। ওর স্বপ্নটা কিন্তু বেশ বড় আর মজার। সে জন্যই আমি তোমাদের ওর স্বপ্নের সবটা লিখে জানাচ্ছি। তবে একটা কথা। স্বপ্নের সবখানে রাকা নিজে নাও থাকতে পারে। যেমন একটু পর দেখা যাবে পিদিমের ভয়ানক সর্দি হয়েছে। তখন পিদিমের পাশে রাকাকে নাও দেখা যেতে পারে।
কেন এমন হয়?
পরিদের স্বপ্ন এমনই হয়।
হ্যাঁ, এটাই নিয়ম।


বৃষ্টি পড়েই চলেছে। উঠান অন্ধকার। পিদিম যে কাকের মতন করে ভিজে যাচ্ছে সে খেয়াল নেই। ও পায়ে-পায়ে কাদাভর্তি উঠান পেরিয়ে দাওয়ায় উঠে এল।
দাওয়ার ওপাশে একটা দরজা আর সেটা ভেজানো। দরজায় উঁিক দিয়ে দেখল ঘরটা অন্ধকার। দিনটা মেঘলা বলেই। এজন্য মাটির মেঝের ওপর একটা পিদিম জ্বলে আছে। মেঝের ওপর চাটাই পাতা। সকাল বেলায় দেখা সেই সবুজ হাফ প্যান্ট পরা খালি গায়ের ছেলেটা পাটির ওপর মুখ ভার করে বসে আছে। আর ওর পাশে ছোট একটি মেয়ে বসে। মেয়েটা কাঁদছিল। চাটাইয়ের ওপর একজন মহিলা শুয়ে রয়েছে। দেখেশুনে মনে হল মহিলাটি এদেরই মা। মহিলাকে অসুস্থ মনে হল পিদিমে।
ছোট মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলছে, এ এ, খিদে পেয়েছে, ভাত খাব, এ এ, ভাত দাও, এ এ।
অন্যদিন হলে এতক্ষনে মনোয়ার বৃষ্টি হোক আর নাই হোক হাটে দুধ বেচে চালডাল কিনে এনে রাঁধতে বসত। আজ যে কে দুধ খেয়ে গেল! তাই এখন না খেয়ে মরার দশা। ঘরে কিছু নেই। মুড়িও না। ওরা তো দিন আনে দিন খায়। ফরিদা তাই কাঁদছিল।
মনোয়ার বিরক্ত হয়ে বলল, বললাম না ঘরে ভাত নেই। সকাল বেলায় দুধ চুরি করে কে যেন খেয়ে ফেলেছে। তাই দুধ বিক্রি করতে পারিনি। চালডালও কিনতে পারিনি। এই ফরিদা, কাঁদবি না বলে দিচ্ছি। এখন চুপ করে থাক।
ফরিদা তবু কাঁদতে কাঁদতে বলছে, এ এ খিদে পেয়েছে। ভাত খাব। এ এ । ভাত দাও। এ এ।
ওরে বকিস না মনো। চাটাইয়ের ওপর শুয়ে থাকা মনোয়ারের মা জমিলা দূর্বল গলায় বলল।
মনোয়ার চেঁচিয়ে উঠে বলে, বকব না তো কী । একটু বুঝতে চেষ্টা করে না কী করে সংসার চালাচ্ছি। বাবা কালীগঙ্গায় ডুবে মরল। নইলে আমি ইশকুলে পড়তাম, সংসারের ঘানি টানতে হত না। বলে মনোয়ার ফুঁপিয়ে উঠল।
জমিলা নিস্তেজ গলায় বলল, এসব আর বলে কী লাভ। সবই কপালের ফের।
পিদিম সবকথা শুনছিল। পিদিম ভূত হলেও আসলে ও খুব ভালো ভূত। ওদের কথা শুনে ওর মনটা বিষম খারাপ হয়ে গেল। ওর বুকটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে লাগল। ইস, আমি এদের এতবড় সর্বনাশ করলাম! ভাবতেই ওর অনেক কষ্ট হতে লাগল। আমি এদের দুধ খেলাম বলেই তো এরা না-খেয়ে আছে। ইস কী অন্যায়ই না করেছি। এক্ষুনি এর একটা বিহিত করতে হবে।
পিদিম ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকল।
এই তুমি কে? কী চাও এখানে? মনোয়ার ছেলেটা সাহসী বলেই তেড়ে এল।
পিদিম হাত তুলে বলল, আহা, থাম তো। আগে আমার কথা শুনবে তো । না শুনেই মিছিমিছি তেড়ে আসছ।
মনোয়ার তবু সিদে হয়ে বসে জিগ্যেস করল, আগে বলো তুমি কে? তুমি কেন এখানে এসেছ?
আরে বাবা আস্তে, আস্তে, অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? দেখছ না আমি ভিজে গেছি। বলে পিদিম পাটির ওপর বসে পড়ল। ফরিদা কান্না ভুলে অবাক হয়ে পিদিমের দিকে চাইল। জমিলাও পিদিমের দিকে তাকিয়ে থাকল।
পিদিম এবার চাটাইয়ের এককোণে জুত করে বসে বলল, আমার নাম পিদিম। আমি হলাম একটা সাদা ভূত। ইয়ে মানে ...মানে আমি স্বীকার করছি আজ ভোরবেলা আমিই তোমাদের গরুর দুধ সব খেয়ে ফেলেছি। সে জন্য আমি ভীষন লজ্জ্বিত ভাই। আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। স্বীকার করছি, কাজটা অন্যায় করেছি। তোমরা সব আমার জন্য না খেয়ে আছো। আমি এক্ষুনি তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
বলেই সাঁই করে দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে গেল পিদিম।
মনোয়ার আর ফরিদা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
কে রে ছেলেটা? জমিলা জিগ্যেস করল।
বলল তো ভূত, মা। ফরিদা বলল। ওর কান্না থেমে গেছে। খিদেও মরে গেছে।
জমিলা বলল, ভূত হলেও বড় ভালো ভুত। দোষ করে ক্ষমা চাইতে এল। আবার খাবার আনতে গেল। ওকে দুপুরে খাইয়ে দেব ভাবছি।
মায়ের কথাটা মনোয়ারকে মানতেই হল। যদিও মনোয়ারের এই মুহুর্তে মনের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। ও গতকাল সন্ধ্যার কথা ভাবছিল। কাল বিকেল থেকে রাঘবদের দিঘীর পাড়ের মাঠে ঘাস খাচ্ছিল মালা। গতকাল সন্ধ্যের মুখে কারা যেন মালাকে ছেড়ে দিল। তো, ছাড়া পেয়ে মালা তো মহাখুশি। কদ্দিন ধরে ভাবছিল গড়পাড়া গ্রামটা একটু ঘুরেফিরে দেখবে। সুযোগ হয়নি। এখন হল। মালা ছাড়া পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে সালমাদের আমবাগানে চলে গেল। মালার আর দোষ কী বল? যে কেউ ছাড়া পেলে তো হাঁটতে হাঁটতে দূরে চলে যাবেই। তখন ভর সন্ধ্যা। মনোয়ার রাঘবদের দিঘীর পাড়ে মাঠে এসে দেখল মালা নেই। ওর বুকটা ধক করে উঠল। ওর চোখে জল ভরে এল। ও রুমাল বার করে চোখ মুছে নিল। তারপর মালাকে খুঁজতে শুরু করল। কারা মালাকে ছেড়ে দিল? কারা মনোয়ারদের পথে বসাতে চায়। কারা আমাদের ক্ষতি করতে চায়? মালার দুধ বেচে কোনওমতে সংসার টিকে আছে। কী মনে করে সালমাদের বাগানের দিকে গেল। সালমার সঙ্গে ও একই ক্লাশে পড়ত। বাবা মারা যাওয়ার পর পড়ালেখা ছেড়ে দিতে হয়েছিল মনোয়ারকে। তাই সালমাকে দেখলেই ওর সঙ্কোচ হয়। পারতপক্ষে ও আমবাগানের দিকে যায় না। আজ মালার খোঁজে যেতেই হবে। কী আর করা।
ওদিকে মালা যখন বকুলবাগানে উকিঁঝুঁকি মারছিল সালমা তখন বাগান থেকে পায়রাগুলিকে ঘরে তুলছিল সালমা। ও এক পলক দেখেই মনোয়ারদের গরুটাকে চিনতে পারল। ও মালার কাছে এসে মালার গলার দড়ি ধরে বলল, কী রে মালা, তোকে আবার ছাড়ল কে?
মালা হাম্বা করে ডাকল।
সালমা বলল, চল তোকে রেখে আসি। মনো নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। তিতা আর কটূ তোকে ছেড়ে দিয়েছে না রে মালা?
মালা মাথা নাড়ল।
হ্যাঁ। সালমাদের গ্রামে তিতা-কটূ নামে দুটি দুষ্ট ছেলে বাস করে। ওরা ভীষন দুষ্ট আর ভারি পাজী। ওরা গড়পাড়া ইশকুলে পড়লেও ঠিক মতন ইশকুলে যায় না । ইশকুল পালিয়ে সারাদিন দুষ্টুমি করে বেড়ায়। ওদের জ্বালায় গড়পাড়া গ্রামের লোকেরা সব সময় অস্থির হয়ে থাকে।
ওরা কি কি দুষ্টুমি করে?
ওরা, এই ধরো পুকুর থেকে হাঁস চুরি করে, কারও ডাবগাছে উঠে ডাব চুরি করে, কারও-বা গরু-ছাগল চুরি করে নিয়ে যায় ...এই রকম কত কী করে। ওদের কিছু বলাও যায় না। বলতে গেলে তেড়ে আসে। তিতাটা লিকলিকে হলেও কটূটা আবার এই বয়েসেই বেশ দশাশই হয়ে উঠেছে। ওর গায়ের জোর সাঙ্ঘাতিক। ওর লড়াই করে পারা পারা যাবে না। কটূর প্যান্টের পকেটে একটা গুলতি থাকে, ওর হাতের টিপ ...এই তো সেদিন পেয়ারা খাওয়ার জন্য গালমন্দ করার জন্য সাহা বাড়ির নীপা সাহার সাধের কলসীটা দিল ফুটে করে। নীপা সাহা রাঘবদের দিঘীতে জল নিয়ে সাহাবাড়ি ফিরছিল, তখন। ওদের বাড়িতে নালিশ করে কোনও লাভ নেই। বাড়ির লোকেরাও ওদের ভয় করে। আর ওদের বাবা হারুন মন্ডল এ অঞ্চলের নাম করা কাঠের ব্যবসায়ী। বেশীর ভাগ সময়ই বাড়ি থাকে না। মহা ধূর্ত লোক এই হারুন মন্ডল। লোকে বলে, যেমন বাবা তেমন তার ছেলেরা।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে সালমা মালার দড়ি ধরে হাঁটছিল। ততক্ষনে সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। সাহাদের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ বাতাসে ভাসছিল। কালীবাড়ির পাশে কাঁঠাল গাছের তলায় মনোয়ারকে দেখল সালমা। মনোয়ার মালাকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সালমা গরুর দড়িটা মনোয়ার কে দিয়ে বলল, তিতে কটূর জ্বালায় দেখছি আর টেকা যাবে না।
মনোয়ার বলল, কাজটা ওরাই করেছে, না?
সালমা বলল, আবার কে। সন্ধে হয়ে এসেছে, চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মনোয়ার বলল, না না আমি একাই যেতে পারব। তোমার আসার দরকার নাই।
সালমা বলল, আহা চল না। পথে আবার ও দুটোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেলে, তখন?
মনোয়ার বলল, তখন আর কী। যুদ্ধ করব। চোরের মতন এসে মালার খুঁটি তুলে দিল। কত বড় বাহাদুর। সামনাসামনি আসুক না। কষে ঘুঁষি দিয়ে দাঁত ফেলে দেব না।
মনোয়ারের কথায় ভারি খুশি হল সালমা, ও বলল, ঠিকই আছে। তিতা-কটূরে একদিন শায়েস্তা করা দরকার।
মনোয়ার বলল, হ্যাঁ।
সালমা বলল, ওরা হারুন মন্ডলের ছেলে বলে মাথায় চড়ে বসেছে। একদিন সবাই মিলে ধরলে ওরা পার পাবে
মনোয়ার বলল,তাই তো
সালমা বলল, আমরা এক মামা শহরে বড় চাকরি করেন। ভাবছি মামাকে নেমতন্ন করে সব খুলে বলব।
মনোয়ার বলল, তা হলে তো ভালো হয় সালমা।
সালমা বলল, হ্যাঁ। তিতে-কটূদের শায়েস্তা করতেই হবে। আজ তোর গরু ছেড়ে দিল। ভাগ্যিস গরুচোর দের হাতে পড়েনি। পড়লে গড়পাড়া নিয়ে হাটে বেচে দিত না?
মনোয়ার কাতর স্বরে বলল, তা হলে যে কী হত। মাবোনকে নিয়ে পথে বসতাম।
সালমার বাবা আফজাল মাষ্টার গড়পাড়া গাঁয়ের স্কুল শিক্ষক। খুবই ভালো মানুষ। মনোয়ারের বাবা মারা যাওয়ার পর নিয়মিত মনোয়ারদের খোঁজখবর নেন। সালমা বলল, বাবার কাছে শুনলাম তিতা-কটূর বাবা হারুন মন্ডল ঝিলিমিলি নদীর ধারে অশথর গাছটা কেটে নিতে চায়।
মনোয়ার অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
সালমা বলল, হ্যাঁ। তাই তো শুনলাম।
মনোয়ারের মুখে কালো ছায়া ঘনাল।ও বলল, গাছ কাটা কি ভালো সালমা?
সালমা দৃঢ় স্বরে বলল, নাঃ, কক্ষনোই না। তা ছাড়া ওখানে আমার বন্ধুরা বাস করে। চিরি নামে ফিঙ্গে পাখি, কুটুস নামে কাঠবেড়ালি, গড়ান নামে একটা দাঁড়কাক। এরা সব আমার বন্ধু । গাছ কাটলে ওদের যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ওরা তখন কোথায় যাবে বল্ তো?
মনোয়ার কাতর স্বরে বলল, গাছ যেন না কাটে সেজন্য কিছু করা যায় না?
সালমা বলল, গত কদিন ধরে তাই তো ভাবছি।
কথা বলতে বলতে ওরা মনোয়ারদের বাড়ির উঠান পর্যন্ত পৌঁছে গেল।
সালমা বাড়ি ফিরে গেল।
এসবই গতকালের কথা। যদিও মনোয়ারের এই মুহুর্তে মনের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। ও গতকাল সন্ধ্যার কথা ভাবছিল।
ওদিকে এখন পিদিম মনোয়ারদের জন্য দইমিষ্টি আনার জন্য গাঁয়ের হাটের পৌঁছে গেছে। এই ফাঁকে বলে রাখি এই গ্রামের নাম গড়পাড়া। আর হাটের নাম গড়পাড়ার হাট। আজ বৃষ্টিবাদলা বলেই গড়পাড়ার হাট তেমন জমেনি। হাটের লোকজন কম। বেশির ভাগ দোকানের ঝাঁপ ফেলা। দোকান বন্ধ করে সব ঘুমোচ্ছে ভিতরে।
পিদিম একটা মিষ্টির দোকানে চলে এল। দোকানের ওপর সাইনবোর্ড। তাতে লেখা: সুপ্রিয় মিষ্টান্ন ভান্ডার। পিদিমের জানার কথা না এই মিস্টির দোকানটা মধুময়রার। পিদিম দোকানে ঢুকে গেল। মিষ্টির দোকানে ঝাঁপ ফেলা। তাতে কী। পিদিমের জন্য এসব কোনও ব্যাপারই না। দেখা গেল ভিতরে একটা লোক নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। এইই হল মধুময়রার ছেলে যদুময়রা। সে মেঘলা দিন বলেই ঘুমিয়ে ছিল। তার পাশে বড় একটা কড়াইভরতি রসে ভেজানো গরম গরম রসগোল্লা। পিদিমের রসগোল্লা আবার ভীষন প্রিয়। ও ঠিক করল রসগোল্লাই নেবে।
পিদিম একটা মাটির হাঁড়ি খুঁজে বার করে তাতে সের দুয়েকের মতন রসগোল্লা ভরে সাঁই করে মনোয়ারদের ঘরে চলে এল। আসলে পিদিম খুব জোরে ছুটতে পারে। বাতাসের গতিতে। আসলে ও একটা ভূত তো। সাদা ভুত।
ঘরে ঢুকে পিদিম রসগোল্লার হাঁড়িটা ফরিদার সামনে রেখে লক্ষ্মী ছেলের মতন শীতল পাটির ওপর বসে হাঁড়ির মুখ খুলতে খুলতে বলল, আজ শুধু রসগোল্লাই খাও । দই আর কালোজাম অন্যদিন খাওয়াব কেমন?
ফরিদা খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা। এতগুলি রসগোল¬া দেখে ওর ভাতের খিদে মরে গেল রসগোল্লা খাওয়ার খিদেটা জেগে উঠল।
মনোয়ার ঝাঁঝের সঙ্গে জিগ্যেস করল, তুমি মিষ্টি কোত্থেকে আনলে পিদিম? চুরি করে আননি তো? তুমি তো আবার চুরির উস্তাদ।
মনোয়ারের কথা শুনে পিদিমের কান দুটো লাল হয়ে গেল। ও মাথা নীচু করে দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। তাই তো রসগোল্লাগুলিও তো গড়পাড়া হাট থেকে ...এখন কী হবে। ইস, বারবার যে ভুল হয়ে যাচ্ছে। মাথা আবার ঝিমঝিম করবে নাতো? পিদিম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, না মানে ...মানে ...
ফরিদা একটা মিষ্টি তুলে মুখে দিতে যাবে এমন সময় মনোয়ার কঠিন স্বরে বলল, এই ফরিদা, একটা মিষ্টিও ছুঁবি না বল। ছিঃ! চোরই মাল ... মনোয়ার পিদিমের দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে কড়া গলায় বলল, যাও ওসব ফেরত দিয়ে এস।
আমি কি এর আগে বলিনি পিদিম রসগোল্লা খেতে ভারি ভালোবাসে?
এ জন্য ও মনোয়ারের কথায় কান না দিয়ে হাঁড়ি থেকে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি রসগোল্লা তুলে মুখে পুরে দিল।
তারপর ঘর থেকে শাঁই করে বেরিয়ে গেল বৃষ্টির ভিতর।

আগের পর্বের লিঙ্ক

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ৯:৪৩
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×