somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: যে-কারণে সর্দি হল পিদিমের

১৮ ই আগস্ট, ২০১০ সকাল ৭:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব

ডালপালার ফাঁক দিয়ে চোখের ওপর ভোর বেলাকার আলো এসে পড়তেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল পিদিমের। তবুও কিছুক্ষন পড়ে রইল ডালের ওপর। হঠাৎ কী মনে পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসল। ওর মনে পড়ে গেল গতকাল রাতে ঝিলিমিলি নদীর পাড়ে রাকা নামে একটা নীলপরির সঙ্গে ঘাসের বনে দেখা হওয়ার পর বন্ধুত্বও হয়েছিল। এমন কী রাকা যে অশথ গাছে থাকবে তাও বলল। কিন্তু, রাকা এখন গেল কোথায়? আশেপাশে কোথাও রাকাকে দেখল না পিদিম। অশথ গাছের পাতার আড়াল দিয়ে ভোরের ধূসর আলো দেখল শুধু। ওর মন খারাপ হয়ে গেল। গালে হাত দিয়ে বসে পিদিম ভাবল, আসলে রাকা নামের কোনও নীল পরিই নেই, আমি আসলে ওই নীলপরিটাকে স্বপ্নে দেখেছি। কী আর করা। ওর আড়মোড়া ভাঙ্গল। ইস, স্বপ্নটা কী সুন্দর ছিল। রাকার সঙ্গে কথা বলে ভালোই লাগছিল, একা-একা থাকার দুঃখটা মুছে যাচ্ছিল। ইস, স্বপ্নটা যদি সত্যি হত। ওর নাক দিকে ভোঁস করে একটা গরম ধোঁওয়া বেরুল।
ভূতেদের আফসোস হলে কিন্তু এমনই হয়!
অশথ গাছটার নীচে খানিকটা অন্ধকার হয়ে থাকলেও এরই মধ্যে চারিদিক ফরসা হতে শুরু করেছে। সবে ঝিঁঝি পোকাদের ডাকাডাকি বন্ধ হয়েছে। বাতাস এসে গাছতলায় পড়ে থাকা ভিজে পাতাগুলিকে মাঝে-মাঝে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল আর গাছের পাতার ওপর রাতভর যে শিশিরগুলি নিথর হয়ে জমে ছিল কখন সূর্যের তাপে শুকিয়ে যেতে শুরু করবে।
গড়ান নামের সেই দাঁড়কাকটার ভারি খিদে পেয়েছে। ও আকাশে উড়ল --যদি কোথাও মাছ কি মাংশের টুকরো মেলে, বাসী ভাত হলেও চলবে। গড়ান উড়ে চলে গেল, নইলে ও পিদিমকে বলতে পারত ও শেষরাতের দিকে একটা নীল পরিকে ঝিলিমিলি নদীর দিকে উড়ে যেতে দেখেছিল।
একটু পর আকাশে উড়ল চিরি নামের ফিঙেটা পাখিটও। ওরও খিদে পেয়েছে খুব।
কুটুস নামের কাঠবেড়ালীও কুতকুতে চোখে এদিক -ওদিক চাইল -- যদি কোথাও একটুখানি গাজর পাওয়া যায়। ও গাজর খুঁজতে বেরোবে বলে ঠিক করল।
ভূতুম নামের কাছিমটা ছিল গাছের গুঁিড়তে। ওটা এখন মরা ঝিনুকের খোঁজে ধীরে ধীরে গুটিশুটি মেরে ঝিলিমিলি নদীর ধারে যেতে লাগল । ঝিনুকের বদলে অবশ্য কলা পেলেই ভালো হয়। কিন্তু এই সাতসকালে কই কলা পাবে ভূতুম? তাই কলার চিন্তা বাদ দিয়ে ধীরে ধীরে ঝিলিমিলি নদীর ধারে যেতে লাগল ও।
লালসারি নামে পিঁপড়েরর দলটাও চলতে শুরু করেছে, কোথাও যদি একদলা চিনি জোটে, এই আশায়।
পিদিম বুঝতে পারল না কী করবে । খিদেয় যদিও ওর নাড়িভূঁিড়গুলোন জ্বলে যাচ্ছিল। একটু দুধ পেলে মন্দ হত না। ভাবতেই ওর মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আপন মনেই হাসল পিদিম। তারপর হাসি থামিয়ে সরসর করে গাছ থেকে নেমে এল । গ্রামের পথ ধরল।
পুব কোণের বেশ খানিকটা ওপরে সূর্যিটা ততক্ষনে উঠি উঠি করছিল। এদিককার বাতাসটা বেশ খানিকটা গরম। আবার নদীর ধার থেকে আসছিল ঠান্ডা বাতাস। অবশ্য পিদিম এসব কেয়ার করে না। ও হেলেদুলে খালের ওপর বাঁশের বাঁকানো সাঁকোটা পেরিয়ে গেল। খালের ওপারে সামান্য গাছপালা। ধান ক্ষেত। গ্রাম। ধানক্ষেতের ওপর রোদ হেসে উঠবে একটু পরই। পিদিম ওসব দেখল না। ওর এখন ভীষম খিদে পেয়েছে। যে করেই হোক এখন কিছু খেতে হবে। তবে দুধ হলে ভালো হয়। হঠাৎই কেন ওর যে দুধ খেতে ইচ্ছে হল? অবশ্য শহরে থাকার সময় রোজ সকালে দুধ খেত পিদিম। ও শহরে ভূত বলেই জানত দুধ হল দারুন পুষ্টিকর এক খাবার। ও তাই সকালবেলায় খালিপেটেই অনেক খানি দুধ যোগারটোগার করে খেয়ে নিত। পেটটা তখন ভারি ঢলঢল করত পিদিমের। ও তখন অনেকক্ষন পানির ট্যাঙ্কির ওপর শুয়ে থাকত।
ধুলোজমা পথে হাঁটতে হাঁটতে এদিক-ওদিক চাইল পিদিম । কাছেই তালগাছে ঘেরা ছোট্ট একটা ঘাসের মাঠের ওপর সকাল বেলাকার মিষ্টি রোদ পড়ে ঝলমল করছিল। মাঠের ওপাশে একটা টলটলে জলের পুকুর। সেই পুকুর ঘিরে আবার কলার ঝোপ, ডুমুর গাছ আর আমগাছ। কলাঝোপের ওধারে খড়ের ছাউনি-দেওয়া একটা বাড়ি চোখে পড়ল। কাদের বাড়ি কে জানে।
পিদিমের তো জানার কথা নয় যে ওই বাড়িটাই মনোয়ারদের। মনোয়াররা খুবই গরীব। মনোয়ারের বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন অবশ্য মনোয়াররা এত গরীব ছিল না। ওর বাবা ছিল জেলে। গেল বছর কালিগঙ্গা নামে নদীটায় ভীষন ঝড় উঠল বলেই মনোয়ারের বাবা ভেসে গেলেন। না, তাঁর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপরই মনোয়ারদের সংসারে দেখা দিল অভাব । বাবা বেঁচে থাকতে মনোয়ার ইশকুলে পড়ত, বাবা মারা যাওয়াতে আয়রুজি বন্ধ হয়, কাজেই ওকে ইশকুলে পড়া ছাড়তে হল। ভাগ্যিস মনোয়ারদের মালা নামে ভীষনই ভালো আর শান্তশিষ্ট একটা লাল রঙের গরু ছিল, তাই রক্ষে। কারণ, মালার দুধ বেচেই এখন কোনওমতে মা আর ছোটবোনকে নিয়ে মনোয়ারদের সংসারটা টিকে আছে। মনোয়ারই গাঁয়ের হাট থেকে প্রতিদিনকার চাল-ডাল তরিতরকারি যা লাগে কিনে আনে।
মাঠের একপাশ দিয়ে পায়েচলা পথ। সে পথ দিয়েই দ্রুত হাঁটছিল পিদিম। একটু পর পুকুরের ধার দিয়ে হেঁটে জামরুল গাছের তলা দিয়ে উঠানের একপাশে গোয়াল ঘরের সামনে চলে এল ও। গোবরচোনার গন্ধ পেল পিদিম। উঁিক মেরে দেখল উঠানে কেউ নেই। ও নিশ্চিন্ত হল। উঠানে কেউ নেই, কিন্তু গোয়ালঘরে কি কেউ আছে? দেখাই যাক। দেখেশুনে টুপ করে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ল পিদিম। গোয়ালঘরটা বেশি বড় না। আর কেমন জানি অন্ধকার-অন্ধকার । অন্ধকারে গোবরচোনার গন্ধটাও বেশ তীব্র হয়ে উঠেছে। মেঝেতে ভিজে খর বিছানো। এককোণে একটা লাল রঙের একটা গরু দাঁড়িয়ে। গরুটার পায়ের কাছে একটা পুরনো টিনের বালতি। এক লাফে ও বালতির কাছে এসে দেখল দুধভরতি। কে দুধ দুইল? কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। পিদিমের তো জানার কথা না, ঘর থেকে ছোটবোন ফরিদার কান্না শুনে মনোয়ারই একটু আগে মালার দুধ দুইয়ে রেখে ঘরে চলে গিয়েছিল ।
পিদিম আর দেরি করল না। ও ঝুঁকে পড়ে এক চুমুকে খেয়ে ফেলল সবটুকু দুধ। তারপর নীল একটা রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিল। পিদিমের আবার একটু সাজগোছের সখ আছে। দ্যাখো না, এই সাত সকালেই ও কেমন একটা কালো রঙের একটা রোদ চশমা পরেছে। আসলে ও তো একটা শহুরে ভুত। তাই।
বিপদ বুঝে হাম্বা করে ডেকে উঠল মালা । গরুদের এই সব হাম্বাটাম্বা আবার পিদিম কেয়ার করে না কিনা। তবে ভাবল, গরুটা ডাকল যখন তখন নিশ্চয়ই এক্ষুনি কেউ এসে পড়বে। খালি-খালি ঝামেলা পাকিয়ে কী লাভ। দুধ যখন খাওয়া হল তখন মানে-মানে সটকে পড়াই ভালো।
ভাবতেই ও সুরুত করে উঠানে চলে এল।
না উঠানে কেউ নেই। সূর্য অবশ্য এখন অনেকটাই উঠে গেছে। গোয়াল ঘরের পিছনের সজনে গাছে অনেক পাখি ডাকছে। উঠানে একধারে লাউমাচার পাশে একটা টিউবওয়েল। দুধ খাওয়ার পরও কেন যেন পানির পিপাসাও পেল পিদিমের। ও একবার ভাবল পানি খাবে কিনা। পরে ভাবল, থাক দরকার নেই, পানি পরেও খাওয়া যাবে। এমন সময় ঘরের ভিতরে বাচ্চা মেয়ের কান্না শুনতে পেল পিদিম। পিদিম ওদিকে তাকিয়েই দেখল ওদিককার ঘরের দাওয়ায় হাফ প্যান্ট পরা খালি গায়ে একটা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটা এদিকেই আসছে। এখন এখান থেকে সরে পড়তে হবে।
ভাবতেই পিদিম বাতাসের রুপ ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পিদিম চলে যেতেই মনোয়ার গোয়ালঘরে এসে ঢুকল। দুধের বালতির দিকে চোখ যেতেই জমে গেল। এ কী! দুধ খেল কে! দুধের বালতিটা খালি। কে যেন সবটুকু দুধ খেয়ে গেছে। সর্বনাশ! এখন তা হলে কী হবে। মনোয়ারের খুব কান্না পেল। ও কি করবে ভেবে পেল না। ও চারিদিকে তাকাল। সাপ এসেছিল কি? মাঝে-মাঝে গোয়াল ঘরের পিছনের সজনে গাছের তলার ঝোপঝাড় থেকে সাপ এসে দুধ খেয়ে যায়। মনে হয় সাপই এসেছিল। ইস, আজ তা হলে না-খেয়েই থাকতে হবে। ফরিদা ওদিকে ভাত খাবে বলে এই ভোরেই কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। ঘরে চাল নেই। দুধ বেচে তবেই না চালডাল কিনতে হবে। এখন? তা ছাড়া মনোয়ারের মায়ের দুদিন ধরে ভীষন জ্বর। মনোয়ার ভাবছিল আজ দুধ বেচে মায়ের জন্য এক হাঁড়ি দই কিনে আনবে। হল না। দুষ্টু সাপেরা এসে মালার সব দুধ খেয়ে গেল। ইস, তখন কেন যে বালতিটা ঘরে সরিয়ে রাখলাম না। ফরিদা তখন কাঁদল বলেই তো ঘরে যেতে হল। ফরিদার ওপর রাগ করবে কি না ভাবল মনোয়ার।
মনোয়ার যখন গোয়াল ঘরে দাঁড়িয়ে এইসব ভাবছিল পাজি পিদিমটা ততক্ষনে ঝিলিমিলি নদীর ধারে ঘাসের বনের কাছাকাছি চলে এসেছে। যাক, বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম। আরেকটু হলেই ধরা পড়ে যেতাম। না, এখন একটু ঘুমিয়ে নিই। দুধে ভরা পেটে ঘুমাতে বেশ ভালোই লাগবে। ভাবতে ভাবতে ঘাসের বনে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল পিদিম। অনেকখানি দুখ খেয়েছে। পেটটা তাই ঢলঢল করছে। শুয়ে পড়তেই পিদিমের চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠল।
পিদিম ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালবেলায় রোদ উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু সময়টা এখন বর্ষাকাল বলেই কখন যে ঝলমলে রোদটা মরে গেল আর চারপাশটা আঁধারে ডুবে যেতে লাগল। নদীর ওপারের তালের বন থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে ঘাসের বনকে দুলিয়ে দিতে লাগল। দেখতে দেখতে আকাশও কালো হয়ে উঠল। ঝিলিমিলি নদীর পানিও কালো হয়ে উঠল। কালো পানির গভীরে নদীর মাছেরা পথ হারিয়ে ফেলল বলে যে-যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ঝড় থামলে আবার চলতে শুরু করবে। জলের ওপরের কালচে আকাশের কোণেও তখন আলোর ঝলকানি। পাখিরা ঝড়ের আভাস বুঝে গাছের ডালে বসে পড়ল। বসেও কি স্বস্তি আছে? গাছের ডালও যে ভয়ঙ্কর ভাবে দুলছে। একটু পর কড়াৎ-কড়াৎ করে বাজ পড়তে লাগল আর সেই সঙ্গে প্রথমে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা আর তারপর কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি ।
সেই বৃষ্টির ফোঁটা মুখেচোখে পড়তেই পিদিমে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে জেগে উঠে কেমন হতভম্ব হয়ে গেল ও। এই রে, একেবারে ভিজে গেলাম যে। বলেই ধড়মড় করে উঠে এক দৌড়ে অশথ গাছের তলায় এসে দাঁড়াল। গাছতলায় এত অন্ধকার! গাছের গুঁড়িতে বসে সেই নীল রুমাল বার করে ভিজে মাথা-ঘাড় মুছতে লাগল । গাছের পাতায় সরসর সরসর বৃষ্টির শব্দ। মাতাল হাওয়ায় গাছের পাতারা দুলছিল । ঘাড়-মাথা মুছে নীল রুমালটা আবার পকেটে রাখার সময় পিদিম শুনতে পেল কে যেন বলছে, উঃ, কী ঝুম বৃষ্টিরে বাবা। মনে হচ্ছে আকাশে আজ বান ডেকেছে। আর আমার ভীষন শীত শীত করছে।
পিদিম মুখ তুলে ওপরে তাকাল। কন্ঠস্বরটা চিরি নামের ফিঙে পাখিরই বলে মনে হল। হ্যাঁ, তাইই।
এবার কুটুস নামের কাঠবেড়ালীটা বলল, তুই ঠিকই বলেছিস চিরি। সত্যিই আকাশে আজ বান ডেকেছে।
চিরি জিগ্যেস করল, কী রে কুটুস, আজ কী খেলি?
কুটুস গাজর চিবোতে চিবোতে বলল, এই যে গাজর খাচ্ছি চিরি ।
চিরি অবাক হয়ে বলল, গাজর? গাজর কই পেলি?
গাজর চিবোতে চিবোতে কুটুস বলল, কেন, আজ ভোরেই তো সালমাদের আমবাগানে গেলাম। দেখি সালমা শিউলি ফুল তুলছিল মালা গাঁথবে বলে। তখন আমাকে দেখেই তো তখন সালমা গাজর দিল খেতে।
ও।
সালমাকে আসলে চিরি নামে ফিঙে পাখিটাও চেনে। এই তো কিছুদিন আগে চিরি উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে সালমাদের আমবাগানে একটা বকুল গাছের ডালে বসেছিল। তখন দুপুর। সালমা তখন বকুল গাছের নীচে উবু হয়ে বসেছিল। আসলে ও মাছ ধরবে বলে কেঁচো খুঁজছিল। সবুজ রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা ছিল সালমা। পিঠের ওপর কালো চুলের ঢল নেমেছে। ভারি সুন্দর দেখতে সালমা।
বকুল গাছের ডালে বসে চিরি সালমাকে ডাকল, এই সালমা শোন।
ভারি অবাক হয়ে সালমা চিরির ডাকটা শুনল ঠিকই কিন্তু বুঝতেই পারল না কে ওকে ডাকছে। অবাক হয়ে এদিক-ওদিক চাইল সালমা।
চিরি তখন বলল, এই যে আমি এখানে, গাছের ডালে। ওপরে তাকালেই আমাকে দেখতে পাবে।
সালমা ওপরে তাকাতেই চিরিকে দেখতে পেল। উঁচু একটা ডালে বসে লেজ নাড়ছে। চিরি তখন জিগ্যেস করল, তুমি কি কুটুসকে খুঁজছ?
সালমা অবাক হয়ে বলল, কুটুসকে? না তো। কিন্তু তুমি কে?
চিরি বলল, আমি চিরি। কুটুসটা রাত্রিবেলা যে গাছে ঘুমায় আমি সেখানেই থাকি। আমি হলাম একটা ফিঙে পাখি।
সালমা হেসে বলল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তা কুটুস কই?
চিরি বলল, ও উত্তরপাড়ায় তালপুকুরের পাড়ে একটা ঝোপের ভিতরে ঘুমোচ্ছে দেখে এলাম।
ও। বলে সালমা উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, আমি এখন যাই ভাই, আমার আবার মাছ ধরতে হবে কিনা। পরে সময় করে তোমার সঙ্গে গল্প করব কেমন? বলে হাঁটতে-হাঁটতে পুকুরের ওদিকে চলে গেল সালমা।
আচ্ছা। বলে চিরিও উড়ে গেল গড়পাড়া গ্রামের দক্ষিণে বিলাইমারী জঙ্গলের দিকে।
হ্যাঁ, এই গ্রামটার নাম গড়পাড়া। আর গড়পাড়া গ্রামের আফজাল মাষ্টারের মেয়েই হল সালমা । সালমা মেয়েটা খুব ভালো । ও গড়পাড়া স্কুলে ক্লাশ সেভেনে পড়ে। গ্রামের পশুপাখি ভালোবাসে। ওদের মাঝেমধ্যে খেতেটেতে দেয়। আজ যেমন কুটুসকে গাজর খেতে দিল। এইজন্যেই ভারি ভালো মেয়ে সালমা। তো এই সালমাদের আমবাগানে কুটুসটা প্রায়ই যায়। আমবাগানটা এখান থেকে খুব একটা দূরে না। খালের ওপরে বাঁশের সাকোঁটা পেরিয়ে বাঁ দিকের পথ ধরে ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে চলে গেলে রাঘবের দিঘীর পরেই সালমাদের আমবাগান । অনেক বড় বাগান, একেবারে আমগাছে ভরতি। সালমাদের আমবাগানে আমগাছ ছাড়াও অবশ্য অন্যান্য গাছটাছও রয়েছে। যেমন বকুল গাছ, সজনে গাছ, বেলগাছ ইত্যাদি। রয়েছে একটা বড় পুকুরও। পুকুরের ধারে গোয়াল ঘর, উঠান। ওখানেই সালমাদের লম্বা টিনের বাড়িটা।
সে সব কথা মনে পড়তে চিরি বলল, জানিস কুটুস, সালমাকে আমিও চিনি।
কুটুস অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি ?
হ্যাঁ।
সরসর সরসর করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে তো পড়েই যাচ্ছে । চারপাশ অন্ধকার হয়ে আছে। অশথ গাছের পিছনের খালে অনেকগুলি ব্যঙ থাকে। তারাই এখন মহানন্দে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে সমানে ডেকে চলেছে। ওদের ডাক শুনে পিদিমের বিরক্তি ধরে যাচ্ছে। বিরক্তি ধরলেও কিছু করার নেই। বেঙেদের খাল থেকে হটানো সহজ নয়। ওটা ওদের রাজ্য।
ঠিক এমন সময় পিদিম জোরে হেঁচে উঠল।
চিরি আর কুটুস চমকে উঠল। কে হাঁচল? ও মুখ নামিয়ে দেখল পিদিম নামের সাদা ভুতটা গাছের গুঁড়িতে বসে। পিদিম অশথ গাছে নতুন এলেও এরই মধ্যে চিরি-কুটুসদের সঙ্গে ভাব হয়েছে। চিরি ভাবল, আহা, পিদিম নিশ্চয়ই আজ বৃষ্টিতে ভিজেছে। নিশ্চয়ই ওর প্রচন্ড সর্দি হয়েছে।
চিরি নীচে নেমে এসে বলল, পিদিম তোমার দেখছি ভয়ানক সর্দি ভাই।
পিদিম মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ ভাই ঘাসের বনে শুয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটা তখন এল বলেই ভিজলাম। বলে হেঁচে উঠল পিদিম।
কুটুসও নেমে এসেছে। সব দেখেশুনে গম্ভীরভাবে মাথা দুলিয়ে বলল, জান না বর্ষাকালে দিনে দুপুরে ঘাসের বনে কখনোই শুতে নেই। কারণ কখন লক্ষ্মীচ্ছাড়া বৃষ্টি এসে নাকে ঢুকে আর তখনই নিতো সর্দি হয়।
পিদিম মুখ কাঁচুমাঁচু করে বলল, মনে ছিল না ভাই ... ভাই ... হ্যাঁচ্চো।
ইস। তোমার কী কষ্ঠ হচ্ছে। তা অষুধ খেয়েছ ভাই? চিরি জিগ্যেস করল।
পিদিম বলল, না ভাই, অষুধ এখনও খাইনি। সর্দিটা এইমাত্র ধরল কিনা।
চিরি বলল, ইস, তোমার জন্য আমার ভীষম খারাপ লাগছে।
কুটুস গাজর খাওয়া থামিয়ে বলল, দেরি করো না ভাই, বুকে বেশ করে সর্ষের তেল মেখে শুয়ে থাক। দেখবে ঝড় থেমে রোদ উঠলে সর্দিও পালিয়ে গেছে।
পিদিম ভাবল, এখন সর্ষের তেল পাব কোথায়। বৃষ্টিতে চারধার অন্ধকার।
পিদিমের মন খারাপ হয়ে যেতে থাকে। ভেজা বাতাসে গাছের পাতা সরসর করে উঠছিল আর সেই সঙ্গে ভীষন শীতও করছিল পিদিমের। মাথার ওপর বিদ্যুৎ ঝলছে উঠল। একটু পরই কড়াৎ-কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল। ডালপালা কাঁপিয়ে বাতাস এল। মনে হচ্ছে আজ সারা দিনই বৃষ্টি পড়বে। তাহলেই তো মুশকিল। সর্ষের তেলের জন্য হাটে যাওয়া হবে না। এদিকে সর্দিটা দারুন ভাবে জেকে বসে যাচ্ছে। হাঁচ্চো।
এবং আশ্চর্য, ওর মাথাও ঝিমঝিম করছিল।
মাথাটা থেকে থেকেই চিলিক চিলিক করে উঠছে। কী ব্যাপার? আমার এমন লাগছে কেন? আমার তো কখনও তো এমন হয় না। হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল - আজ ভোরে না-বলে গ্রামের একটা অচেনা বাড়ি থেকে দুধ খেয়েছে।
সেজন্য এমন হয়নি তো?
ভাবতেই পিদিমের মাথাটা আরও বেশি করে ঝিমঝিম করতে লাগল। হ্যাঁ, তাই তো। এখন মনে হচ্ছে না বলে দুধ খাওয়া উচিত হয়নি।
তা হলে যাই, সেই বাড়ির লোকেদের কাছ থেকে না-বলে দুধ খাওয়ার জন্য মাফ চেয়ে আসি।
ভাবতেই পিদিম চোখের নিমিষে বৃষ্টির ভিতরেই মনোয়ারদের বাড়ির উঠানে চলে এল।

ক্রমশ ...
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×