somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: কী আজব সার্কাস এন্ড কোং

১৮ ই আগস্ট, ২০১০ বিকাল ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব

এইবার শোন, কদিন ধরে গড়পাড়া গ্রামে কী মজার কান্ড হয়েছে।
দিন সাতেক হল একটা সার্কাসের দল এসে উত্তরপাড়ার তালপুকুরের পাশে ময়নার মাঠের ওপর সারি সারি তাবু ফেলেছে। সার্কারে নাম -- কী আজব সার্কাস এন্ড কোং । সার্কাসের লোকেরা যে কত রকম খেলা দেখায়। ঘোড়ার খেলা, হাতির খেলা, বাঘের খেলা, দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার খেলা- এরকম কত কী । রঙচঙা ভাঁড় ডিগবাজী খেয়ে কতরকম কসরত দেখায়। গ্রামের মানুষ হাসতে হাসতে এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ে। হ্যাঁ, বিকেল হলেই গ্রামের ছেলেবুড়ো ভেঙ্গে পড়ে তালপুকুরের পাশে ময়নার মাঠে।
তা, এই কী আজব সার্কাস এন্ড কোং-এর সত্ত্বাধিকারীর নাম গোলাম হায়দর রাব্বানী। সংক্ষেপে তাকে অবশ্য গো. হা রাব্বানী বা শুধু রাব্বানী বললেই চলবে। মাঝবয়েসি লোকটা ছ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট দশাশই চেহারার এক তাগড়াই যোয়ান। শুধু তাইই নয় তার একটি ইয়া বড় গোঁফও রয়েছে থ্যাবড়া নাকে নীচে আর মাথাটা নিখুঁতভাবে কামানো বলেই চকচকে । সব মিলিয়ে কী আজব সার্কাস এন্ড কোং-এর সত্ত্বাধিকারী রাব্বানী দেখতে ষন্ডাপ্রকৃতির। গুজব এই, তার ভয়ে নাকি সার্কাসের নখ-দাঁত পড়ে-যাওয়া বুড়ো বাঘ আর হাড়জিরজিরে ঘোড়াগুটা নাকি এক গামলায় পানি খায়। কথাটা সত্যি কি মিথ্যে তা পরে জানা যাবে।
আর ভীষন বেঁটে আর উটকো মতন দেখতে গাবু হল কী আজব সার্কাস এন্ড কোং-এর সত্ত্বাধিকারী গোলাম হায়দয় রাব্বানীর ডানহাত। বলাই বাহুল্য যে, সে একটা ভারি বদ লোক। মাথায় কোঁকড়া চুলে বাংলা সিনেমার এক হিট নায়কের মতন ব্যাক ব্রাশ করা । ব্যাক ব্রাশ করা চুলের ওপর বাহারি টুপি। শোনা যায় লোকটা কোন্ পিরের মুরিদ। গাবুর মুখ-ভরতি গোটা-গোটা ব্রনের দাগ। সব সময় উটকোটা গাঢ় হলুদ রঙের পাঞ্জাবী পরে থাকে। দিনেরাতে চোখে তার কালো রোদচশমা থাকবেই।
তো সকাল বেলায় ইশকুল ফাঁকি দিয়ে তিতা আর কটূ তালপুকুরের পাশে ময়নার মাঠে ঘুরঘুর করছিল। কী ভাবে ওরা ভিতরে ঢুকেছে তা ওরাই জানে। হয়তো ময়নার মাঠের উত্তরদিকের আমগাছে চড়েই ঢুকেছে। কেউ খেয়াল করেনি। এখন সার্কাসের লোকজন অলস ভঙ্গিতে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিল। কারণ, সার্কাস শুরু হয় বিকেলের দিকে।
সার্কাসের হাতিটা একপাশে বাঁধা ছিল। দূর থেকে হাতি দেখিয়ে তিতা বলল, দেখেছিস কটূ কী বিশাল শরীর।
যেন হাতি পোষে এমন ভঙ্গি করে কটূ বলল, হাতিদের এমনই হয়। বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, চল বাঘটা দেখে আসি।
চল।
ওদের মাথায় অনেক দুষ্টুবুদ্ধি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু একটাও প্রয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছিল না। সার্কাসের মালিক রাব্বানী যা বদরাগী। যদি ওদের টুটিঁ চেপে খোদ বাঘের খাঁচায় ছুঁড়ে দেয়, তখন?
এই তো সামনেই রাব্বানীর হলুদ রঙের তাবুটা দেখা যাচ্ছে। লোকটার সামনে না পড়াই ভালো। হয়তো এমনি এমনি গর্দান নিয়ে নেবে। ওরা ভয়ে ভয়ে জায়গাটা পেরিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় পিছন থেকে বাজখাই কন্ঠ শুনে ওদের পিলে চমকে উঠল। এই তোরা এখানে কী করছিস? এখানে ঢুকলি কী করে?
সর্বনাশ! এতো সার্কাসের মালিক রাব্বানীর ভয়াবহ কন্ঠস্বর। ওরা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে চোখ বুঁজে ফেলেছিল। চোখ খুলে দেখল যেখানে বাঘের ভয় ... হলুদ রঙের তাবুর সামনে বুক টানটান করে রাব্বানী দাঁড়িয়ে। কালো রঙের চামড়ার জ্যাকেট পরা। হাতে একটা চাবুক। কামানো মাথাটা সূর্যালোকে চকচক করছে। পাশে গাবু দাঁড়িয়ে। আজ একেবারে বাঘের মুখে পড়েছে।
তিতা হাত জোর করে কোনওমতে বলতে পারল, মানে ...মানে একটু ঘুরে ফিরে দেখছিলাম আর কী।
এই গাবু ও দুটোকে ধরে নিয়ে আয় তো। বলেই বিশালদেহী রাব্বানী হলুদ তাবুর মধ্যে ঢুকে গেল।
অতি বেটে হলেও কিছু বোঝার আগেই গাবু ওদের চ্যাঙ্গদোলা করে তাবুর ভিতরে নিয়ে থপ করে ফেলল। ওরা ব্যথা পেয়ে কুঁই কুঁই করে উঠল। কটূ ফিসফিস করে তিতার কানে কানে বলল, এবার নিশ্চয়ই আমাদের আস্ত খেয়ে ফেলবে। কেন যে মরতে এসেছিলাম।
ওরা ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল।
হুম। সার্কাসের মালিক রাব্বানী হুঙ্কার ছাড়ল।
ওরা দেখল সার্কাসের মালিক রাব্বানী টেবিলের ওপর পা তুলে বসে চুরুট টানছে, গলার কাছে হলুদ রঙের তোয়ালে। আর একটা কালো করে শুকনো মতন লোক রাব্বানীর মাথাটা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই লোকটা হল নাড়ু নাপতে, হাটের দিন বটতলায় বসে। নাড়ু নাপতেকে দেখে ঠিকই চিনল তিতা-কটূ। মনে হল নাড়ু নাপতে সার্কাসের মালিক রাব্বানীর মাথা চেঁচে দেবে আজ। হ্যাঁ, তাই। শুকনো মতন লোকটা হাতে একটা কালো রঙের সেভিং ব্রাশ তুলে নিল। টেবিলের ওপর থালাভর্তি জিলেপি। এখন সকাল ১১টা বাজে ওদের খিদে পেয়েছে। ওরা জিলেপির দিকে কেমন করে তাকাল।
এই তোরা কই থাকিস রে? রাব্বানী জিগ্যেস করল। গলার স্বরটা এখন তত বাজখাঁই নেই।
তিতা এক ঝলক জিলিপী-ভরতি পে¬টের দিকে তাকিয়ে কোনওমতে বলতে পারল, আমরা এই গাঁয়েরই ছেলে। আমাদের বাবা নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। হারুন মন্ডল।
রাব্বানীর মুখটা নরম হল। ও, তোরা তাহলে হারুন মন্ডলের ছেলে। হ্যাঁ, তোদের বাবাকে ভালই চিনি। এখানে সার্কাস বাসানো আগে তাঁর পারমিশন নিতে হল। বেশ, ভালো ভালো। তোরা জিলিপী খাবি? এই নে খা। বলে পা দিয়েই থালাটা ঠেলে দিল রাব্বানী।
বাবার কথায় তাহলে কাজ হল। কটূ ভীষন অবাক হয়ে তিতার মুখের দিকে তাকাল। তিতাও।
খা। অত ভয় খাচ্ছিস কেন? আমি বাঘ না ভাল¬ুক না উল¬ুক?
দুটোই। না না তিনটেই। মনে মনে বলল কটূ। তিতা একসঙ্গে দুটো জিলিপী তুলে নিল। কটূ তিনটে।
শুকনো মতন লোকটা রাব্বানীর মাথায় সেভিং ক্রীম ঘঁষে চলেছে। রাব্বানীর চোখটা আরামের চোটে ছোট ছোট হয়ে এল। রাব্বানী জিগ্যেস করল, এ্যই,তোদের গ্রামে কি কি মজার মজার জিনিস আছে বল তো ?
প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে ওরা রাব্বানীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রাব্বানীর ডান হাত গাবু তখন মোচে তা দিতে দিতে বলল, তোরা হুজুরের কথা বুঝতে পারলি নাতো? শোন, তাহলে আমিই সব খুলে বলছি। সার্কাসে এসে এখন আর লোকে বস্তাপচা পুরনো খেলা দেখে মজা পায় না। লোকে নতুন নতুন খেলা দেখতে চায়। হাতি-বাঘ-ঘোড়া-বানর, এইসব এখন বস্তাপচা হয়ে গেছে বুঝলি। এসব দেখে দেখে গ্রামের হদ্দ লোকেরও অরুচি ধরে গেছে। এখন আর তেমন লোক জোটে না। ভাবছি শেষে সার্কাসই না তুলে দিতে হয়। হুজুর তাই জানতে চাইছিলেন, তোদের গ্রামে কি কি মজার মজার জিনিস আছে যা দেখালে লোকে মজে যাবে।
আরেকটা জিলিপী মুখে পুরে তিতা জিগ্যেস করল, একেবারে অন্য কিছু কী?
গাবু লালা রুমালে মুখ মুছে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, অন্য কিছু মানে, এই ধর সাপ-ব্যাঙ- ইঁদুর- বিলাই- জ্বীন- ভুত, মানে এর আগে সার্কাসে যা দেখানো হয়নি।
ও বুঝিছি। তিতা বলল। বলে ভাবল গড়পাড়া গ্রামে কি কি অদ্ভূত জিনিস আছে। এদের যে করেই হোক খুশি রাখতে হবে। তা হলে নিশ্চয়ই সার্কাসে ঢোকার ফ্রি টিকিট ছাড়াও অনেক টাকা পয়সা পাওয়া যাবে। টাকার দরকার। দুষ্টুমি করে বেড়ায় বলে বাসা থেকে হাতখরচ বন্ধ করে দিয়েছে। ওরা ভালো করেই জানে পূর্ণিমার রাতে ঝিলিমিলি নদীর পাড়ের বালুচলে পরিরা নামে। ফস করে জানতে চাইল কটূ, পরি হলে চলবে?
পরি? বলিস কী! কোথায়? সার্কাসের মালিক রাব্বানী সিধে হয়ে বসতেই উঃ করে উঠল। কেটে গেল বোধ হয়। শুকনো দেখতে লোকটা হাতে এখন একটা চকচকে ধারালো ক্ষুর।
চোখে কালো রোদচশমা পরা গাবুটাও দুপা এগিয়ে এল।
একসঙ্গে দুখানা জিলেপী মুখে পুরে তিতা বলল, আছে।
কোথায়?
বললাম তো আছে।
আহা বলনা কোথায়?
বলব। তবে পরি ধরে দিলে কী পাব সেইটে আগে শুনি?
তোরা কী চাস?
তিতা-কটূর অনেক দিন ধরে ঘোড়ার শখ। একটা ঘোড়া জোগার করে বিকেলের দিকে গ্রামের পথে পথে ঘোরালে বেশ হয়। লোকে তাকিয়ে দেখবে। তা ছাড়া আগামী বছর ওদের বাবা হারুন মন্ডল ইলেকশানে দাঁড়াবে। তখন ঘোড়াটা কাজে লাগবে। তিতা বলল, সাদা রঙের ঘোড়াটা চাই।
সার্কাসের মালিক রাব্বানী কী যেন ভাবল। ঘোড়াটা এমনিতেই হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। দুদিন পর এমনিতেই ওটাকে তাড়িয়ে দিতে হবে। রাব্বানী বলল, সত্যিই পরি ধরে দিতে পারবি?
হ্যাঁ পারব। কটূ দৃঢ় স্বরে বলল।
যা তাহলে, এক্ষুনি পরি এনে দে। দেখি তোদের মুরোদ কেমন?
কটূ বলল, আঙুল চাটতে চাটকে বলল, সার, এখন তো প্রায় দুপুর। পরিরা আসে রাতদুপুরে। যদি জোছনা থাকে তবেই। তাই এব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই সার, আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে সার।
রাব্বানী বলল, হুঁ। ঠিক আছে, আমি না হয় অপেক্ষা করলাম।
আমরা তাহলে যাই সার।
যা।
তিতা-কটূ হুড়মুড় করে তাবু থেকে বের হয়ে গেল।

ক্রমশ ...
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×