অনেক অনেক দিন আগের কথা ...ঈশ্বর মানবরূপ ধারন করে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে এক বসন্তকালের শেষে বাংলায় এসে উপস্থিত হলেন। মাধুর্যময়ী বাংলার রূপ অপরূপ । ঈশ্বর মুগ্ধ হলেন । এমন সবুজ শ্যামল ও নির্জন স্থান এর আগে তিনি পৃথিবীর আর কোথাও দেখেননি।
আপন সৃষ্টির লাবণ্য মায়ায় ঈশ্বর মুগ্ধ হলেন।
বাংলার পথেপ্রান্তরে ঘুরে ঘুরে একদিন এক নির্জন নদীতীরে উপস্থিত হলেন ঈশ্বর।
তখন মধ্যাহ্নবেলা।
নদীর তীরে পুরনো বটবৃক্ষ, নদীর ওপরে ঝুঁকে রয়েছে। তারি নিবিড় ছায়ায় এক কৃষ্ণবর্ণের তরুণ একতারা হাতে মোহাচ্ছন্ন ভঙিতে
বসে। তরুণটি বৈষ্ণব বলেই বোধ হল। ঈশ্বর কান পাতলেন। তরুণটি গান গাইছে:
এমন মানব জনম আর কি হবে।
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।।
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানবের তুলনা কিছুই নাই ।
দেব-দানবগণ,
করে আরাধন
জনম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি,
মন রে, পেয়েছ এই মানব-তরণী
বেয়ে যাও ত্বরায়
তরী সুধারায়,
যেন ভরা না ডোবে।।
এই মানুষে হবে মাধুর্য্য ভজন,
তাইতে মানুষ রূপ গঠলেন নিরঞ্জন,
এবার ঠিকিলে আর
না দেখি কিনার,
লালন কয় কাতর ভাবে।।
গানটি ঈশ্বরের অসম্ভব ভালো লাগল । এই মানুষে হবে মাধুর্য্য ভজন/তাইতে মানুষ রূপ গঠলেন নিরঞ্জন। হুমম। ঠিকই ধরেছেন লালন। এই গানটির কর্তা তাহলে লালন। কোথায় থাকে সে? একবার লালনদর্শনের প্রবল ইচ্ছা জাগল ঈশ্বরের মনে। ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিলেন ... অচিরেই একটি সোনার বরণ ‘হলুদিয়া’ পাখি হয়ে লালনের কাছে উড়ে যাবেন।
পাখির প্রসঙ্গে ঈশ্বর মুখ তুলে রংশূন্য আকাশের দিকে তাকালেন। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি। বিস্তীর্ণ আকাশটি ঝকঝক আরশীর মতো দেখায়। তাতে খন্ড খন্ড শুভ্রমেঘমালার ভাসান ও পাখনা-মেলা চিলপাখির উড়াল। নদীর দু’পাড়ের চরাচর কেমন স্তব্দ হয়ে রয়েছে। বাতাসেরা উষ্ণ আর উতল হয়ে রয়েছে বলে মনে হল। চৈত্রের রোদে চিকচিক করছে নদীর জল । নদীর ওপারে ঘাট, বটগাছ, আমবন, তালতমালের বন, দিগন্ত অবধি ফসলের মাঠ।
ঈশ্বরের নদীর ওপারে যেতে ইচ্ছে হল।
পাখি হয়েই উড়ে চলে যাওয়া যায়, তবে ঈশ্বর মানবরূপ ধারন করে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
কাজেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন ঈশ্বর।
মুখ তুলে চেয়ে দেখলেন সেই কৃষ্ণবর্ণের বৈষ্ণব তরুণটি উঠে দাঁড়িয়েছে।
এখন সে কোথায় যাবে কে জানে!
এমন উদাস মানুষ, দু-চোখে ঘোর লেগেছে
দু-চোখে গভীর মায়া, পথেতে কায়ার ছায়া ...
এই ভরদুপুরে নদীর ঘাটে একটি মাত্র খেয়া নৌকা। গলুয়ের ওপর একজন মাঝি বসে রয়েছে। মাঝিটি বৃদ্ধ। মাথায় টুপি। পাকা চুলদাড়ি। মাঝিটিকে মুসলমান বলে বোধ হল। মাঝির পরনের ফতুয়াটি ছেঁড়া, লুঙ্গিটিও শতছিদ্র। গায়ের রংটি তামাটে। গলায় ও বাহুতে তাবিজ বাধা।
ঈশ্বর বললেন, ওহে মাঝি, আমি ওপারে যাব।
মাঝি বৈঠা তুলে নিয়ে বলল, ওপারে যাবেন তো নৌকায় উইঠে বসেন।
তা উঠব। কিন্তু- আমার কাছে যে পাড়ের কড়ি নেই।
মাঝি হেসে বলল, পাড়ের কড়ি নেই তো কি হয়েছে। এক জীবনে অত হিসেব কইরলে চলে? এখন নৌকায় উইঠে বসেন তো।
ঈশ্বর আশ্বস্ত হয়ে নৌকায় উঠলেন।
মাঝি নৌকা ছাড়ল।
ঈশ্বর এই পৃথিবীর মানুষের জীবনের প্রতি কৌতূহলী। তিনি অশেষ যত্নে মানুষ-পুতুল সৃষ্টি করেছেন। সে পুতুল সুখ ও দুঃখ বোধ করে। কখনও সুখে ভাসে, কখনও ধ্বংসের মুখোমুখী দাঁড়ায়। আশ্চর্য সে সৃষ্টি। পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিতে চান তাঁর পুতুলের ভিতর-বাহির। কাজেই ঈশ্বর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কোথায় থাকা হয় গো মাঝি?
থাকি কাছেই, ওই নদীর পাড়ে কৃষ্ণচৈতন্যপুর গাঁয়ে।
তা সংসারে তোমার আর কে আছে?
আমার তিন মেয়ে আর দুই ছেলে হৌজুর। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরাও বিয়েথা করে সব পৃথক অন্ন হয়েছে। এখন আমরা বুড়িবুড়ি মিলে আছি কোনওরকম।
সংসার চলে?
চলে। আবার চলে না।
সে কী রকম শুনি?
বয়েস হয়েছে। দাঁড় তেমন বাইতে পারি নে। কড়িও তেমন মেলে না। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।
ওহ্ ।
ঈশ্বর বিষন্ন হলেন।
মাঝি বলল, দুঃখের কথা আর কী কব। আমার ঘরের ছাউনি ফেঁইসে গেছে। বর্ষাকালে পানি গড়ায় হৌজুর, কাঁথা-বালিশ, মাটির মেঝে ভিজে যায়। আমার বুড়ির আবার এদানীং শ্বাসকষ্ঠের রোগ হয়েছে। এলাজের জন্য কোবরেজের কাছে যাব কিন্তু হাতে বাড়তি কড়িই যে নেই। বুড়ি আমার রাতভর কেবল ফোঁপায় আর ফোঁপায়।
ওহ্ । ঈশ্বর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, তাহলে তো তোমার অনেক দুঃখ দেখছি।
মাঝি হাসল। মাথা নাড়ল। বলল, তা আমি দুঃখী মানুষ বটে।
তা অত দুঃখে নিজেকে কি বলে বুঝ দাও মাঝি?
গান গেয়ে হৌজুর।
তুমি আবার গানও গাও নাকি?
আজ্ঞে,হ্যাঁ। বাংলার মাঝিকূল অল্পবিস্তর গান জানে হৌজুর।
তাহলে একখানা গান শোনাও দিকি।
বৈঠা বাইতে বাইতে মাঝি গান ধরল:
আয় কে যাবি ওপারে।
দয়াল চাঁদ মোর দিচ্ছে খেয়া
অপার সাগরে।।
যে দিবে সে নামের দোহাই
তারে দয়া করবেন গোঁসাই
এমন দয়াল আর কেহ নাই
ভবের মাঝারে।।
গান শুনতে শুনতে মিটমিট করে হাসছেন ঈশ্বর। কী সুন্দর করে আমার কথা লিখেছে গানে। যে দিবে সে নামের দোহাই/তারে দয়া করবেন গোঁসাই/এমন দয়াল আর কেহ নাই/ভবের মাঝারে।। ...কই, আমি এত দেশ এত রাজ্য পাড়ি দিলাম ... এমন করে তো কাউকে গাইতে শুনলাম না ...বাংলা বড় অপরূপ দেশ। অপরূপ দেশের অপূর্ব গান।
ঈশ্বর ধন্য হলেন।
তাঁর স্বর্গে ফেরার সময় হল।
মাঝি গাইতে থাকে-
পার কর জগৎ বেড়ি
নেয় না পারের কড়ি
সেরে সুরে মনের দেড়ি
ভার দেনা তারে।।
দিয়ে ঐ শ্রীচরণে ভার
কত অধম হল পার
সিরাজ সাঁই কয়, লালন তোমার
বিগার যায় না রে।।
গান শেষ হল। ঈশ্বর মনে মনে ভাবলেন: আমায় নিয়ে এক সুন্দর গান লিখেছে লালন! তাহলে তো লালনকে আর্শীবাদ করতেই হয়। হ্যাঁ। একদিন পৃথিবীর তত্ত্বজিজ্ঞাসু মানুষ তাঁর কথা জানবে। তাঁকে শ্রদ্ধা করবে।
ঈশ্বর এই বারতা আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিলেন।
এসবি অনেক অনেক দিন আগের কথা ...
তখন চৈত্রমাস ...
নৌকা ঘাটে ভিড়ল।
ঈশ্বর ছোট্ট লাফ দিয়ে নৌকা থেকে পাড়ে নামলেন।
মাঝি নৌকা ঘোরানোর উদযোগ করছে।
ঈশ্বর বললেন, মাঝি?
বলেন হৌজুর।
এই যে আজ আমায় নদী পাড় করিয়ে দিলে- এতে আমি ভারি খুশি হয়েছি।
মাঝি হাসল। কাঁধের গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলল, এ কতা জেনে আমারও বড় আনন্দ হৈল হৌজুর।
ঈশ্বর গভীর আনন্দ অনুভব করলেন। একবার পশ্চিমের উদীয় নামের এক দেশের এক মাঝি পাড়ের কড়ি না পেয়ে নদী পাড় করেনি। ঈশ্বর সারাবেলা নদীপাড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ঈশ্বর। অথচ এই বাংলায় ...
ঈশ্বর জিজ্ঞেস করলেন, এবার বল-তুমি কি চাও ?
মাঝি বিস্মিত হল। তারপর হেসে বলল, আপনার কাছে তো পারাপারের কড়িটিও নেই; আপনি আবার আমায় কি দিবেন শুনি?
ঈশ্বর দু-হাত ছড়িয়ে দিলেন। চোখ বুজলেন। তারপর আত্মসরূপ প্রকাশ করলেন।
বাতাসে তীব্র সুগন্ধ ছড়ালো।
চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল। তাতে চৈত্রের খর রৌদ্রালোক যেন কিছু ম্লান হয়ে উঠল ।
মাঝি অভিভূত হয়ে গেল। মাঝির বয়েস হয়েছে। সে যা বোঝার বুঝতে পারল। দয়াময় ঈশ্বর মানবরূপ ধারন করে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘুরতে ঘুরতে এই বেলায় বাংলায় এসে পড়েছেন।
মাঝি নৌকা থেকে পাড়ে এসে নামল। ভরদুপুরের নির্জন ঘাট। এমন অলীক দৃশ্য দেখার কেউ নেই।
এবার বল তুমি কি চাও? ঈশ্বর জিজ্ঞেস করলেন।
মাঝির সামনে এখন কেবলি আলো। গভীর সুগন্ধী আলো। সে আলোর দিকে চেয়ে মাঝি বলল, আমার একটাই প্রার্থনা দয়াময়।
আলোর ভিতর থেকে প্রশ্ন ভেসে আসে-কি প্রার্থনা শুনি?
মাঝি খানিক ভাবল। বাংলায় একজন বিখ্যাত কবি বাস করেন। সে কবির নাম ভারতচন্দ্র রায়। বাংলার মানুষ কাব্যপ্রিয় বলে কবির বাণী লোকের মুখে মুখে ফেরে। বিশেষ করে কবির একখানি পদ মাঝির কানে এসে পৌঁছেছে। পদটি ভারি স্পর্শকাতর ...
আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।
মাঝি দয়াময় ঈশ্বরের সামনে নতজানু হয়ে এই পবিত্র প্রার্থনামন্ত্র উচ্চারণ করল।
ঈশ্বর কেঁদে ফেললেন।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনও তাঁকে কাঁদতে হয়নি।
একমাত্র এই বাংলায় এসেই ঈশ্বর কে কাঁদতে হল।
দ্রষ্টব্য: কবি ভারতচন্দ্র রায়ের সময়কাল আনুমানিক ১৭১২-১৭৬০। জন্মেছিলেন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হাওরা জেলায়। ওই মহাত্মা কবির উপাধি ছিল রায়গুণাকর।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ১০:৩৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





