somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একদিন, খলিফা হারুন আল রশীদ

০৬ ই আগস্ট, ২০১১ সকাল ১১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিস্তব্দ বাগদাদের রাত্রি। সফর মাস। ৮০০ খ্রিস্টাব্দ। সফেদ চাঁদনির আলোয় ডুবে আছে ঘুমন্ত বাগদাদ নগরী। নগরের পাশে প্রবাহিত দজলা (তাইগ্রিস) নদী। সে নদীর ঢেউগুলি এই মধ্যরাতে কেমন ধবল দেখায় । দজলা নদীর পাড় থেকে ছুটে আসা অস্থির লোনা বাতাস ধাক্কা খায় নগরের সুরম্য ভবনসমূহের শক্ত দেয়ালে, জামে মসজিদের বৃত্তাকার গম্বুজে আর রাজপথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সার সার খেজুর গাছের শক্ত ডালপালায়। নগরীর সংকীর্ণ গলিপথের মুখেও পড়ে আছে চাঁদনির আলো। গলির ভিতর থেকে শোনা যায় প্রহরীর হাঁকডাক, রাজপথে শোনা যায় অশ্বক্ষুরধ্বনি। বলিষ্ঠ আরবি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার জওয়ান খেলাফত সৈন্য।
নির্জন রাজপথে দুজন ভ্রাম্যমান মুসাফিরকে দেখা যায় । ধীর পদক্ষেপে অনুচ্চ স্বরে কথা বলতে-বলতে পাশাপাশি হাঁটছিল তারা। প্রশস্ত রাজপথে তাদের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। ভ্রাম্যমান দুজন মুসাফিরের একজন বৃদ্ধ, অন্যজন তরুণ। তাদের পরনে মলিন পোশাক। এদের দুজনকে অনিদ্রা রোগী বলেও মনে হতে পারে। মনে হতে পারে যেন শীতল বাতাসের খোঁজে সরাইখানার বদ্ধ কুঠরী থেকে বেরিয়ে এসেছে এরা ।
বস্তুত বৃদ্ধ স্বয়ং বাগদাদের খলিফা হারুন আল রশীদ!
এবং তরুণটি খলিফাপুত্র আল মুহতাসিম। আল মুহতাসিম-এর পুরো নাম অবশ্য আবু ইশহাক আব্বাস আল মুহতাসিম ইবনে হারুন । সে যাই হোক। খলিফা হারুন আল রশীদ প্রায়ই মধ্যরাতে ছদ্মবেশ ধারন করে বাগদাদ নগরীর অলিগলি রাজপথে হেঁটে-হেঁটে সাধারণ নগরবাসীর প্রকৃত অবস্থার খোঁজখবর নেন।
পুত্রসহ আজও বেরিয়েছেন ...


হঠাৎ শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে খলিফা থমকে দাঁড়ালেন।
কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে দেখলেন পথের বাঁ পাশে একটি সুউচ্চ পাথরের প্রাচীর। ওপাশে হয়তো কোনও ধনী শেখের উদ্যান ভবন। এপাশে খেজুর গাছ। অস্থির বাতাসে খেজুর গাছের ডালপালা নড়ছে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় খেজুর গাছের তলায় পাথরের মাঝখানে একটি চুলায় একটি ঢাকনা-চাপা হাঁড়ি । কিছু রান্না হচ্ছে মনে হল। চুলার সামনে উবু হয়ে একজন তরুণী বসে আছে। তরুণী কালো বোরখায় আবৃত। কেবল মুখখানি দেখা যায়। তামাটে মুখে দুঃখযন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। চুলার কাছেই দুটি ছোট ছোট শিশু উবু হয়ে বসে আছে। শিশু দুটি কাঁদছে। খিদেয় সম্ভবত। মেয়েটি ধমক দিয়ে বলল, এই, কান্না থামা। রান্না শেষ হলেই তোদের খেতে দেব।
খলিফা হারুন আল রশীদ গভীর কৌতূহল বোধ করলেও ধৈর্য্য ধরে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তারপর কন্ঠস্বর সামান্য উচুঁ করে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললেন, কই, তোমার রান্না তো শেষ হচ্ছে না।
মেয়েটি মুখ তুলে চাইল। মুসাফির বৃদ্ধ দেখে মনে হল আশ্বস্ত হল। চুলার পাশ থেকে দ্রুত পায়ে উঠে এল। তারপর খলিফার কাছে এসে চাপাস্বরে করে বলল, আজ রাতে রান্না আর শেষ হবে না।
কেন? আল মুহতাসিম অবাক হয়ে জিগ্যেস করে।
হাঁড়িতে যবের বদলে পাথর সিদ্ধ হচ্ছে। বলে মেয়েটি কপালের ঘাম মুছে নিল।
পাথর? পাথর সিদ্ধ করছ কেন? খলিফার মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠেছে।
মেয়েটি দ্রুত আরবিতে বলতে থাকে, আজ সারাদিন অনেক চেষ্টা করেও এক মুঠো দানপানি জোটাতে পারিনি বাবা। আমার স্বামী ছিল সৈন্য। আল আমিন যুদ্ধে মারা গেছে। তারপর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। সন্তান দুটি নিয়ে পথে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি। আমার দুঃখের কথা শুনে আপনি কি করবেন? বলে আবার কপালের ঘাম মুছে নিল। তারপর আবার বলতে লাগল, রান্নার কথা বলে আমার অবোধ সন্তান দুটিকে ভুলিয়ে রেখেছি। অপেক্ষায় আছি ওরা কখন ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে কি হবে আল্লাই জানে। আমাদের যখন এই অবস্থা তখন খলিফা আরাম করে রাজপ্রাসাদে ঘুমাচ্ছেন! বলে থুঃ করে থুতু ফেলে মেয়েটি চুলার কাছে ফিরে গেল।
খলিফা মুহূর্তেই জমে গেলেন। টের পেলেন প্রবল ঘামে শরীর ভিজে যাচ্ছে । গভীর এক গ্লানিবোধে আচ্ছন্ন হলেন খলিফা। ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ফ্যাঁসফ্যাসে কন্ঠে বললেন, বল, কি শুনলে?
আল মুহতাসিম আর কী বলবে। সে চুপ করে থাকে। মেয়েটির কথাগুলি তার পিঠেও চাবুক কষেছে যেন।
খলিফা গম্ভীর কন্ঠে বললেন, আজ রাতে এ শহরের ধনীরা কত খানা নষ্ট করেছে জান?
আল মুহতাসিম চুপ করে থাকে। তার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে। এদের বেশির ভাগই উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী এবং ধনী ব্যবসায়ীর সন্তান। তাদের অপরিসীম ভোগবিলাসিতার কথা আল মুহতাসিম জানে।
খলিফা তিক্ত কন্ঠে বললেন, বাগদাদ নগরের ধনীদের ঘরে-ঘরে খাবার নষ্ট হচ্ছে কি না সেটা দেখার জন্য তো আর পাহারাদার বসানো যায় না! কথাটা বলে এদিক-ওদিক তাকালেন খলিফা। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। যেন কাউকে খুঁজছেন। খলিফার নিরাপত্তা রক্ষীরা আশেপাশেই আছে। যদিও তাদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। খলিফা যখন মধ্যরাতে বাগদাদ নগরে ঘুরে-ঘুরে দরিদ্র নগরবাসীর খোঁজ খবর নেন তখন খেলাফতের নিরাপত্তা রক্ষীরা দূর থেকে খলিফার ওপর নজর রাখে। হাজার হলেও তিনি মুসলিম বিশ্বের খলিফা ...
খলিফা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আঙুল তুলে বললেন, ওই নিঃস্ব দরিদ্রদের হেফাজত করার জন্যেই মহান আল্লাহতালা খলিফাকে নির্বাচিত করেন। দায়িত্বের গাফলতির জন্য খলিফা আল্লাহর কাছে দায়ি থাকেন।
আল মুহতাসিম মাথা নেড়ে পিতার কথায় সায় দেয়। খলিফার এই সুদর্শন পুত্রটির জন্ম তুর্কি এক দাসীর গর্ভে। তথাপি খলিফা হারুন আল রশীদ আল মুহতাসিম কে ভবিষ্যতের খলিফা নির্বাচিত করেছেন। এ সিদ্ধান্ত থেকেই খলিফার মানসিকতার কিছু আভাস পাওয়া যায়। খলিফা আল মুহতাসিম কে মধ্যরাতের সঙ্গী করে ভবিষ্যতের খলিফাকে তৈরি করছেন।
খলিফা বললেন, হে আল মুহতাসিম, তুমি এখন যাও, এদের জন্য এক বস্তা আটার ব্যবস্থা কর। আর সঙ্গে কিছু নুন আর খেজুরও দিও।
ইনশাল্লা। বলে আল মুহতাসিম ঘুরে দাঁড়ায়।
আর শোন বেটা। আটার বস্তা তুমি নিজের কাঁধে বহন করে আনবে ।
খলিফা পুত্রকে নির্দেশ দিলেন।
আল মুহতাসিম মাথা নাড়ে। তারপর দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে। ক্ষুধার্ত শিশু দুটির কথা ভেবে তার চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে।
অশ্রুপূর্ণ চোখে খলিফা আকাশের দিকে তাকালেন। সফর মাসের আকাশে একখানি পরিপূর্ণ চাঁদ। জ্যোতি যদিও ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে। খলিফা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ফজরের আজান-এর আর বেশি দেরি নেই। খলিফা মন্থর পায়ে প্রাসাদের দিকে হাঁটতে থাকেন । এখন কিছু খেয়ে নিতে হবে। আজ রোজা রাখবেন। আজ মাগরিবের ওয়াক্ত অবধি ওই দুটি অবোধ শিশু আর নিরুপায় মা'টির ক্ষুধার কষ্ঠ খলিফা তার শরীরের কোষে কোষে অনুভব করবেন ...
৩০টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×