বাংলায় পাল রাজাদের রাজত্বকালে (খ্রিস্টাব্দ ৭৫০- ১১৭৪) বৌদ্ধধর্মের পরিপূর্ণ বিকাশ হয়েছিল। পাল রাজারা ছিলেন যুগপৎ বাঙালি এবং বৌদ্ধ। তবে পাল আমলে বাংলার জনসংখ্যার অধিকাংশই যে বৌদ্ধ ছিল এমন কথা বলা যায় না। তা সত্ত্বেও ধর্মীয় বিষয়ে পাল রাজাদের মনোভাব ছিল অত্যন্ত উদার । পাল রাজাদের সময়ে অনেক ব্রাহ্মণ গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় পদে চাকরি করতেন। নারায়ণ পাল শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তাঁর মন্ত্রীদের বাড়িতে বলিদান প্রত্যক্ষ করতেন। মদন পালের প্রধানা মহিষী, চিত্রমতিকা মহাভারত পাঠ শুনতেন বলে বলে তৎকালীন নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
বৌদ্ধধর্মের উদ্ভবের পর ধর্মটি হীনযান ও মহাযানে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পাল রাজারা মহাযানপন্থি ছিলেন না, ছিলেন বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। সপ্তম অষ্টম শতকে বাংলায় বৌদ্ধধর্মে নতুন দার্শনিক তত্ত্বের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। এর ফলে যে নতুন বৌদ্ধধর্মের সৃষ্টি হয়েছিল তাকে বলা হয় বজ্রযান, তন্ত্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম। বজ্রযান মূলত বৌদ্ধধর্মের রহস্যময় দিক। চুরাশি জন সিদ্ধাচার্য বজ্রযান প্রচার করেছিলেন। এঁরাই বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদের’ রচয়িতা।
এখন প্রশ্ন হল বাংলায় বজ্রযানের উদ্ভব ঘটল কেন?
প্রথমতঃ পাল আমলের পরিপূর্ণ ধর্মীয় এবং বাক স্বাধীনতা ছিল। পালসম্রাট ধর্মপাল ঘোষনা করেছিলেন যে, তিনি সকল শাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞাত এবং যাতে সব ধর্ম-বর্ণ তাদের কার্যকলাপ বজায় রাখতে পারে সেদিকে তিনি তৎপর থাকবেন। স্বাধীন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীন ধর্ম কিংবা দার্শনিক মতের উদ্ভবের পক্ষে সহায়ক। পাল আমলে তাই ঘটেছিল। একটি চর্যাপদে রয়েছে-
যজ্ঞের হোমাগ্নি মুক্তি প্রদান করে কিনা/
কেউ জানে না/
তবে তার ধোঁয়া/
চোখে নিশ্চিতভাবে পীড়াদায়ক ...
পাল রাজারা মৌলবাদী হলে এরকম মতামত প্রকাশ সম্ভব ছিল না। আরেকটি চর্যাপদে আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে :
এস জপহোমে মন্ডল কম্মে/
অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধম্মে।
অর্থাৎ, এই জপ -হোম-মন্ডল কর্ম নিয়ে সারাদিন বাহ্যধর্মে লিপ্ত আছিস।
বাংলায় বজ্রযানের উদ্ভবের দ্বিতীয় কারণটি হল: পাল আমলে বাংলায় হিমালয়ের সংলগ্ন রাজ্য সমূহের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওসব রাজ্যে আদিম তন্ত্রের চর্চা ছিল। কাজেই পালআমলে তন্ত্রের ধারণা বাংলায় অনুপ্রবেশ করে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘বৌদ্ধ ঐতিহ্যে আচার্য অসঙ্গ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, পর্বত কান্তারবাসী সুবৃহৎ কৌম-সমাজকে বৌদ্ধধর্মের সীমার মধ্যে আকর্ষন করিবার জন্য ভূত,প্রেত, যক্ষ, রক্ষ, যোগিনী, ডাকিনী, পিশাচ ও মাতৃকাতন্ত্রের নানা দেবী প্রভৃতিকে অসঙ্গ মহাযান-দেবায়তনে স্থান দান করিয়াছিলেন। (বাঙালির ইতিহাস। আদিপর্ব। পৃষ্ঠা; ৫২৫)
বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মের মূল বৈশিষ্ট হল দেবীর আরাধনা। প্রধানা দেবী ছিলেন তারা। ইনি বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বদের স্ত্রী। মহাযান বৌদ্ধধর্মে বোধিসত্ত্বদের কল্পনা করা হয়েছিল। বজ্রযানীদের লক্ষ্য ছিল অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা অর্জন। বজ্রযানীরা বিশ্বাস করত যে দেবদেবীদের অনুগ্রহ ভিক্ষা করে লাভ নেই, তাদের বাধ্য করতে হবে। যে বইতে এই সাধনার কথা লেখা রয়েছে, তাকে বলে তন্ত্র। কাজেই বজ্রযানকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বলা হয়। পাল রাজাদের সময়ে বাংলা এবং বিহারে বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মের বিধিবদ্ধ রূপ এবং সম্মানজনক স্থান দেওয়া হয়েছিল।
বজ্রযান থেকে উদ্ভব হয়েছিল সহজযানের। এবং বাউল দর্শনের প্রাথমিক ধারণাটি সহজযানেই নিহিত বলে মনে হয়। সহজযানীরা বেদ-ব্রাহ্মণ মানতেন না। তারা দেবদেবীও স্বীকার করেননি এবং ধর্মের আনুষ্ঠানিক দিকও বর্জন করেছিলেন। স্বয়ং বুদ্ধও সহজযানীদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি। সহজযানীরা বলতেন-পরমজ্ঞান লাভের সংবাদ সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, স্বয়ং বুদ্ধদেবও জানতেন না। সকলেই বুদ্ধলাভের অধিকারী, এই বুদ্ধত্বের অবস্থান দেহের মধ্যে। বোধিলাভ হয় তরুণীর নিরন্তর স্নেহ দ্বারা। শরীরের মধ্যেই অশরীরির গুপ্ত লীলা। সুতরাং বনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঘরে থাকারও প্রয়োজন নেই। দেহবাদ কিংবা কায়সাধনই একমাত্র সত্য। (কায়া এবং ছায়া। কায়ার অর্থাৎ শরীরের সাধনাই একমাত্র সত্য)
এসব সহজযানী ভাবনায় বাউল দর্শনের ক্ষীণ উদ্ভাস পাওয়া যায় ...
সহজযানীদের মতে, আগম, পুরাণ, বেদ সবই বৃথা। বহু শতাব্দী পরে লালন একই কথার প্রতিধ্বনি তোলেন তাঁর একটি গানে-
ভেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা /
আর এক কানা মন আমার/
এসব দেখি কানার হাটবাজার ...
সহজযানের লক্ষ্য মহাসুখ লাভ। শূন্য নিরঞ্জনই মহাসুখ। সেখানে পাপপুণ্য নেই। সুখের চেয়ে বড় পূণ্য নেই। এদের মতে শূন্যতা, প্রকৃতি এবং করুণা, পুরুষ। প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনে বোধিচিত্তের যে পরমানন্দময় অবস্থার সৃষ্টি হয় তাই মহাসুখ। এই মহাসুখই একমাত্র সত্য। এই সত্যের উপলব্দি যদি হয়, তাহলে ইন্দ্রিয়গ্রাম, সংসারজ্ঞান, আত্মপর ভেদ, সংস্কার সব লোপ পায়। সহজযানের লক্ষ্য মহাসুখ বলেই তাঁরা মনে করতেন যে- মস্তিষ্কের উচ্চতম প্রদেশে মহাসুখস্থানের অধিষ্ঠান। সহজযানীরা কায়সাধনা করতেন বলে তারা মনে করতেন যে দেহের ভিতরে ৩২ নাড়ীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শক্তি সেই স্থানে পৌঁছায়। সহজযানীরা নাড়ীগুলির বিভিন্ন নাম দিয়েছিলেন। যেমন, ললনা, রসনা, অবধূতী, প্রবণা, কৃষ্ণা, কৃষ্ণরূপিণী, সামান্যা, সুমনা, কামিনী ইত্যাদি। এদের মধ্যে ললনা, রসনা, অবধূতী নাড়ী তিনটি গুরুত্বপূর্ণ। সহজযানের অবধূতী এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সুষুম্না নাড়ী অভিন্ন। আসলে এসব মানবদেহের ভিতরমহলের বর্ণনা। এবং এ প্রসঙ্গে লালনের সেই বিখ্যাত গানটির কয়েকটি চরণ অনিবার্য ভাবেই মনে পড়ে যায়-
আট-কুঠুরি নয়- দরজা আঁটা/
মধ্যে মধ্যে ঝলকা কাটা/
তার উপরে সদর-কোঠা/
আয়নামহল তায় ...
সহজযানীরা মনে করতেন যে-দেহের ভিতরে পদ্মের পাঁপড়ি অথবা চক্রের মত বিভিন্ন স্থিতি-স্থান আছে এবং ঊর্ধ্বগামী শক্তি এই স্থানগুলি অতিক্রম করে । শক্তি এভাবে মহাসুখস্থানে পৌঁছলে, আগেই বলেছি, ইন্দ্রিয়গ্রাম, সংসারজ্ঞান, আত্মপর ভেদ, সংস্কার সব লোপ পায়। আর এ কারণেই সহজের রূপ নিষ্কলুষ এবং নিস্তরঙ্গ। তার মধ্যে পাপ -পুণ্যের প্রবেশ নেই। সহজে মন নিশ্চল করে, যে সাম্য ভাবনা লাভ করেছে, সেই একমাত্র সিদ্ধ। তার জরা-মরণ থাকে না।
আকাশের মত শূন্য চিত্ত এবং সাম্যভাবনাই ছিল সহজযানের আর্দশ । এই ভাবনায় মধ্যযুগের বাংলার মানবতাবাদের স্ফূরণ লক্ষ্য করি। আবদুল মমিন চৌধুরী লিখেছেন, ‘বাংলায় বৌদ্ধধর্মের এই লোকজসংস্কৃতি হয়তো -বা বাংলার আর্য-পূর্ব উত্তরাধিকারের কারণে ঘটেছিল বলে বলা যেতে পারে এবং এর থেকেই সৃষ্টি নিয়েছিল মানবতাবাদ, কিছুটা বিকৃত হয়তো-বা।’ (প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি। পৃষ্ঠা, ৮১)
সহজযানী দর্শন ছিল গুরুকেন্দ্রিক। গুরুকে হতে হবে যোগ্য। গুরু শিষ্যকে রহস্যের দীক্ষ দিতেন। আমরা জানি বাংলায় গুরুবাদ একটি অতি প্রচলিত ধারণা। একটি লোকগানে শিষ্য আর্তনাদ করেছে এভাবে:
গুরু উপায় বল না/
জনমদুঃখী পোড়া কপাল/ গুরু আমি একজনা।
আর, লালনের একটি গানে রয়েছে-
ভবে মানুষ গুরু নিষ্টা যার। /
সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার।
প্রত্যেক শিষ্যের একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রবণতা থাকে। এই প্রবণতা হল ‘কুল’। এই কুলের সংখ্যা পাঁচ। যেমন, ডোম্বী, নটী, রজকী, চন্ডালী, এবং ব্রাহ্মণী। জীবদেহের পাঁচটি মূল উপাদান, পঞ্চমহাভূত দ্বারা কুলের স্বরূপ নির্দিষ্ট হয়। এই পাঁচটি কুল হল, প্রজ্ঞা অথবা শক্তির পাঁচটি দিক। সাধকের পক্ষে সাধনার সময় তার বিশেষ শক্তির অনুসরণ করা উচিত। কুল যেহেতু পাঁচটি সাধকও পাঁচ শ্রেণির। শিষ্যের মধ্যে কোন্ কুলের প্রাধান্য সেটি আবিস্কার করা এবং সেই অনুসারে তাকে পরিচালনা করা গুরুর কর্তব্য।
চর্যাপদে, বৈষ্ণবগীতি কবিতায়, সহজিয়া নাথ এবং বাউল সাহিত্যে সহজযানের বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে বাংলায় সহজযানের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য শাক্ত ধর্মের মিশ্রণের ফলে কয়েকটি লোকায়ত ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল।শাক্ত ধর্ম সম্বন্ধে Constance A. Jones এবং James D. Ryan লিখেছেন, The term Shakta refers both to the practitioner/ devotee and to the faith, a female-centered religious tradition that evolved out of prehistoric Mother Goddess worship found in civilizations across the globe. The word Shakta derives from the divine feminine power or SHAKTI and indicates a worshipper of the Goddess primarily. Evidence of this Earth-based and female-centered tradition on the Indian subcontinent dates back perhaps as early as the INDUS VALLEY CIVILIZATION (3500B.C.E.–1500 B.C.E.), where numerous Harrapan seals portraying female figures associated with vegetative symbolism have been found. (Encyclopedia of Hinduism. page,438)
যা হোক। লোকায়ত ধর্মগুলি বাংলায় আজও টিকে আছে। ব্রাহ্মণ্য শাক্ত বর্ণাশ্রমকে স্বীকার করলেও লোকায়ত নাথ অবধূত এবং বাউল ধর্ম তা করেনি।
জাত গেল জাত গেল বলে/ একি আজব কারখানা/
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/ সবি দেখি তা না না না। (লালন)
পরিশেষে এই প্রশ্নটি ওঠে যে বাস্তবে বাউল দর্শনের ওপর সহজযানের প্রভাব কত গভীর ছিল ? আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাউল মতের উদ্ভব ষোড়শ শতকে হলেও সহজযানের উদ্ভব অস্টম শতকে; কাজেই এ দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায় ৮০০/৯০০ বছরের ফারাক রয়েছে। এ কারণে বাউলদর্শনের ওপর সহজযানের নিরুঙ্কুশ প্রভাব সম্ভব না। তাছাড়া বাউল মতের ওপর সুফিবাদ ও শ্রীচৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতের প্রভাবও বিবেচনা করতে হবে । সাধারণত মনে করা হয় যে, বাংলার বাউলগণ একটি গুপ্ত সম্প্রদায়ের সদস্য; এবং তাঁরা নিগূঢ় সাধনা করেন। সে যাই হোক বাউলদর্শনের বৈশিষ্ট্য কিছুমাত্র উপলব্দি করার ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় বাংলার দেহবাদী সহজযানী দর্শনটি আমাদের কিছু হলেও পথ দেখায়।
তথ্যসূত্র:
নীহাররঞ্জন রায়; বাঙালির ইতিহাস। আদিপর্ব।
আবদুল মমিন চৌধুরী; প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি
সুনীল চট্টোপাধ্যায়; প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (২য় খন্ড)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




