বলছিলাম যে লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশটি কোথায়? কোথায়-বা অবস্থিত ছিল পট্টিকেরা পুরী?
লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশটি ছিল বর্তমান কুমিল্লা জেলার লালমাই পাহাড়ে। নবম-দশম শতকে ওখানেই ছিল পট্টিকেরা নগর। আর সে নগরে যে অনুপম সব অট্টালিকা ছিল সে তো অনুমান করাই যায়। ছিল রাজপথ, রাজপথে মন্থর গতিতে চলমান হাতি, শালের বন, দিঘী, দিঘীপাড়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু ... সে যাই হোক। আমরা পট্টিকেরা শব্দটির আরও দুটি শব্দ পাই। (১) পট্টিকের; এবং (২) পট্টিকেরক।ইংরেজিতে Pattikera. সেই যাই হোক। প্রাচীন বাংলার দুটি প্রধান ভৌগলিক বিভাগ হল সমতট এবং হরিকেল। ওই সমতট ও হরিকেলজুড়েই ছিল মধ্যযুগের বাংলার পট্টিকেরা রাজ্য অবস্থান।
প্রাচীন বাংলার মানচিত্র। পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বে সমতট ও হরিকেল রাজ্যের অবস্থান । ওই সমতট ও হরিকেলেই ছিল পট্টিকেরা রাজ্যটির অবস্থান।
মধ্যযুগের পট্টিকেরা ছিল একাধারে একটি রাজ্য ও নগর। (অনেকটা ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত প্রাচীন ক্রিটের নসস নগরের মতো ) ... পট্টিকেরা নগরটির অবস্থান ছিল বর্তমান কুমিল্লা শহরের ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে। ওখানেই ছিল কবি আল মাহমুদের পূর্ব পুরুষের শিকড়। যে সাহসী এবং অসাম্প্রদায়িক পূর্ব পুরুষকে নিয়ে কবির অনেক গর্ব। তাঁদেরই স্মরণ করে কবি লিখেছেন:
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন/ করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোতো না আর ...
কবির কথায় বোঝা গেল যে মধ্যযুগের বাংলায় (ধর্মীয় অর্থে) সেরকম কোনও বিভেদ ছিল না । বৈদিক আর্যরা পশ্চিম দিক থেকে সে বিভেদের আগুন বাংলায় নিয়ে এসেছিল। সে বিভেদ ঠাঁই নিয়েছিল করতোয়া নদীর পূর্বপাড়ে, অর্থাৎ পুন্ড্রনগরে (বর্তমান বগুড়া)। মৌর্য আমলে বা তারও আগে বরেন্দ্র এবং পুন্ড্রবর্ধনে (বাংলার উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে) আর্যসংস্কৃতি বিস্তার লাভ করেছিল। (দিনাজপুরের ‘পুনর্ভবা’ নদীর নামটি সেই স্মৃতিই বহন করে?) কিন্তু, পট্টিকেরা রাজ্যের অধিবাসীগণ ছিলেন সাহসী এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী । কাজেই, বিভেদের বৈদিক আগুন (ধর্মীয় শ্রেণিভেদ বা জাতপাত, যা বাঙালির আধ্যাত্মিক গুরু লালন-এর কাছে ছিল ঘৃন্য) করতোয়া পাড় হয়ে পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারেনি।
মানচিত্রে ‘লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশ’ কিংবা কুমিল্লার ময়নামতী। নবম দশম শতকে এখানেই ছিল পট্টিকেরা পুরী।
লালমাই পাহাড়টির বিস্তার লাল মাটির সমতট রাজ্যে। সে জন্য প্রাচীন কালে পাহাড়টিকে অনেকে বলত ‘লাল মাই’ অর্থাৎ লাল রঙের স্তন। এমন ভাবনাটি নিছকই মা-পৃথিবীর জীবনদায়ী অঙ্গের বর্ণনা। এমনটি ভাবা প্রাচীন বাংলায় বিচিত্র কিছু না। কেননা, প্রাচীনকালেই মাতৃতান্ত্রিক বাংলায় নারীবাদী তন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। আমরা যে সময়কালের কথা বলছি, সে সময় বাংলার বৌদ্ধ এবং হিন্দুধর্ম উভয়ই বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে হয়ে উঠেছিল তান্ত্রিক-যা একান্তই নারীকেন্দ্রিক গূহ্য সাধনার বিষয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানচিত্র। কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১
জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মৌড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহন করেছেন। নবম-দশম শতকে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাটি ছিল পট্টিকেরা রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত। মানচিত্রের পূর্বদিকে যে ত্রিপুরা রাজ্যটি দেখছেন, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে মধ্যযুগে ত্রিপুরা রাজ্যটি পট্টিকেরা রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত ছিল।
চন্দ্র বংশের রাজারা পট্টিকেরা রাজ্য শাসন করতেন। অবশ্য একাদশ শতকের মাঝামাঝি তাদের পতন হয়। তারপর পট্টিকেরায় আরেকটি রাজবংশ গড়ে ওঠে। সেই বংশেরই এক রাজার নাম ছিল রণবঙ্কমল্ল শ্রীহরিকলদেব। এঁর সময়কাল (১২০৪-১২২১) । রাজা রণবঙ্কমল্ল শ্রীহরিকলদেব -এর মন্ত্রীর নাম ছিল শ্রীধড়ি-এব। মন্ত্রীর বাবার নাম ছিল হোদি এব। তৎকালীন সময়ের একটি তাম্রশাসনের লেখকের নাম ছিল মেদিনী-এব। এই নামগুলির সঙ্গে পট্টিকেরা রাজ্যের পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মদেশ বা বার্মার অধিবাসীদের নামের গভীর সাদৃশ্য রয়েছে। তাহলে এই বিষয়টি পরিস্কার যে পট্টিকেরা শাসনামলে ভিনদেশি মন্ত্রী হতে পারতেন? এই বিষয়টি
কি বাঙালির সহনশীলতার উদাহরণ হয়ে রইল না? এই সঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় যে বাংলার বৌদ্ধ পালরাজাদের মন্ত্রীদের অধিকাংশই তো ব্রাহ্মণ ছিলেন। ... অথচ এতকাল পরে মায়ানমার থেকে উৎপীড়িত রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের জন্য এলে আমরা আর আনন্দিত হইনা। সেকালে পরিস্থিতি আজকের মতো ছিল না; জনসংখ্যা কম ছিল, ফসলি জমির ভাগ বেশি ছিল ...
বর্তমান বাংলাদেশের মানচিত্র। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত মায়ানমার। তৎকালীন আরাকান এবং বার্মার সঙ্গে পট্টিকেরা রাজ্যের বানিজ্যিক সর্ম্পক ছিল। সেরকম হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা, পুবের ব্রহ্মদেশ বা বার্মা রাজ্য ছিল প্রাচীন বাংলার সমতট আর হরিকেল রাজ্যের গা ঘেঁষেই।
মধ্যযুগের বার্মার অধিবাসীরা পট্টিকেরা রাজ্যকে বলত ‘পতিককর’ কিংবা ‘পতেইক্কর’। তারা পট্টিকেরা রাজ্যকে ‘কালাস’ বা ভিনদেশিদের রাজ্য বলত। একাদশ-দ্বাদশ শতকে বার্মার রাজধানী ছিল ‘পাগান’। সেই সময়ের কয়েকজন বর্মি রাজার নাম: অনোরথ (১০৪০); ক্যানজিৎথ(১০৮৬-১১১২) এবং অলৌঙ্গ সিথু (১১১২-৬৭) । এই রাজাদেরই পশ্চিম সীমান্তবর্তী ছিল পট্টিকেরা দেশ।
বার্মার (মায়ানমার) বাগান রাজ্যের একটি বৌদ্ধ মন্দির। খ্রিস্টপূর্ব যুগেই বার্মাতে বৌদ্ধধর্মের প্রচার হয়েছিল। পট্টিকেরা রাজ্যেও ছিল বৌদ্ধধর্মের চর্চা। দুটি রাজ্যের সর্ম্পকের সূত্রটি এখান থেকেও আবিস্কার করা যায়।
পট্টিকেরার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০১৫ খ্রিস্টাব্দের একটি বৌদ্ধ পান্ডুলিপি থেকে। সেই পান্ডুলিপির নাম ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’। এতে বৌদ্ধ দেবী চুন্দার উল্লেখ রয়েছে এভাবে: ‘পট্টিকেরে চূন্দাবরভবনে চূন্দা।’ এর ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন,‘সম্ভবত মূর্তিটি ছিল পট্টিকেরা নগরে অবস্থিত চুন্দামন্দিরে পূজিতা চুন্দাদেবীর। (দেখুন; কাবেদুল ইসলাম; প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী পৃষ্ঠা; ১৪২) এসব কারণে মনে হয় যে একাদশ শতকে পট্টিকেরা নগরে বৌদ্ধধর্মের চর্চা ছিল। ওই সময়কার একটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়: রাজা রণবঙ্কমল্ল শ্রীহরিকলদেব-এর মন্ত্রী শ্রীধড়ি-এব পট্টিকেরানগরে একটি বৌদ্ধমন্দির নির্মানের জন্য জমি দান করেছিলেন। এসব কথা স্মরণ করে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন:
রাক্ষুসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে/ ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব।
তো, কীভাবে পট্টিকেরা রাজ্যে যাবেন?
বাংলাদেশের যে কোনও জায়গা থেকে প্রথমে কুমিল্লা শহরে পৌঁছবেন। তারপর কান্দিরপাড় যাবেন। কেননা, কান্দিরপাড়ই শহরটির কেন্দ্রস্থল ।
কান্দিরপাড়। (ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কুমিল্লা শহরের মানুষেরা অত্যন্ত আন্তরিক। যে কাউকে বললেই আপনাকে শহরের ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে কোটবাড়ি যাওয়ার উপায় বলে দেবে। ওই কোটবাড়িতেই রয়েছে শালবন বিহার আর লাল রঙের মাটির ময়নামতী পাহাড়। কবির ভাষায় ‘লোহিতাভ মৃত্তিকা’। তারপর কোটবাড়ি পৌঁছে শালবনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনি এ কথাগুলি ভাবতে পারেন। ... ১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। বর্তমান কুমিল্লা জেলাটি সে সময় ব্রিটিশ ভারতেরই অংশ ছিল। ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য কুমিল্লার লাইমাই পাহাড়ে একটি সামরিক স্থাপনা নির্মানের কথা ভাবা হয়। ... তারপর মাটি খোঁড়ার সময়ই মাটির নীচ থেকে বেরিয়ে আসে প্রাচীন সব স্থাপনা , প্রকাশিত হয় বাংলার এক বিস্মৃত অতীত । তারপর গবেষক আর ঐতিহাসিকদের পদচারণায় মূখর হয়ে ওঠে লালমাই পাহাড়ের প্রায় দশ মাইল এলাকাজুড়ে বিস্তির্ণ শালবন। সে যাই হোক । শালবনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনি একবার ভাবতে পারেন: ... একাদশ-দ্বাদশ শতকে এই জায়গাটিই ছিল পট্টিকেরা রাজ্য; যে রাজ্যটির নাম বাংলা ভাষার এক শ্রেষ্ঠতম কবি অমর করে রেখেছেন ‘সোনালি কাবিন’ কবিতায়।
শালবন বিহারের ওই প্রাচীন বৌদ্ধস্থাপনার সিঁড়িতে বসে ক্ষণিকের জন্য হলেও তো অতীতের দিকে একবার ফিরে তাকানো যায় ...যায় না কি?
কবি আল মাহমুদের জন্মস্থান ব্রাহ্মবাড়িয়া হলেও কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে ছেলেবেলায় কবি লেখাপড়া করেছেন । আর এখানেই বলে রাখি যে, আমার বাবার মামাবাড়ি দাউদকান্দি । অবশ্য আমার পিতৃপুরুষের নিবাস চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার নায়ের গাঁ। একাদশ-দ্বাদশ শতকে যাঁরা ছিলেন পট্টিকেরা রাজ্যের প্রজা, যাঁরা (হয়তো )রাজা রণবঙ্কমল্ল শ্রীহরিকলদেব কে খাজনা দিতেন। যে রাজা রণবঙ্কমল্ল শ্রীহরিকলদেব তাঁর দরবারে ভিনদেশি মন্ত্রী নিয়োগ দিতেন, এবং বুদ্ধের শান্তিবাদী ধর্মের প্রতিষ্ঠায় জমি দান করতেন। এই সমস্ত কারণে আমিও চিৎকার করে বলতে চাই:
‘আমারও নিবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে/ পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পট্টিকেরা পুরীর গৌরব’
ছবি। বাংলাপিডিয়া এবং ইন্টারনেট- এর সৌজন্যে ।
তথ্যসূত্র:
আল মাহমুদ;শ্রেষ্ঠ কবিতা। (হাওলাদার প্রকাশনী। পৃষ্ঠা; ৬৮।)
কাবেদুল ইসলাম; প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী
এ কে এম শাহনাওয়াজ; বাংলার সংস্কৃতি বাংলার সভ্যতা
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১:৪৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





