অবিভক্ত বাংলার মানচিত্র । কত বিচিত্র যে এটুকুন অঞ্চলের ইতিহাস। স্থানের নামগুলিও কত বিচিত্র ...
আমরা জানি যে এককালে বাংলায় সেন রাজারা শাসন করতেন। সেই সময়টা ছিল আনুমানিক ১০৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দ । সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম বিজয়সেন (১০৯৭-১১৬০)। বিজয় সেনের মৃত্যুর পর তাঁরই পুত্র বল্লালসেন বাংলার রাজা হন। বল্লালসেন কে নিয়ে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে আনন্দভট্ট নামে এক ঐতিহাসিক ‘বল্লালচরিত’ নামে একখানা বই লিখেছিলেন। (কে বলে বাঙালি ইতিহাস সচেতন নয়?) ... সে বইয়ে লেখা আছে যে ... লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে বাংলা পাঁচটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। (১) রাঢ়; (২); বাগড়ি (৩) বঙ্গ; (৪) বরেন্দ্র; এবং (৫) মিথিলা। মিথিলার অবস্থান বর্তমান নেপালের দক্ষিনে এবং বর্তমান দিনাজপুরের উত্তরে। রাঢ়-এর অবস্থান ছিল বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের একটি বড় অংশ জুড়ে; ঢাকা এবং ফরিদপুর নিয়ে ছিল বঙ্গ; বরেন্দ্রর অবস্থান ছিল প্রাচীন বাংলার উত্তরে।
কিন্তু কোথায় ছিল বাগড়ি ?
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ
কোনও কোনও ঐতিহাসিক বাগড়ি কে the delta of the Ganges বলে অবহিত করেছেন। ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ বইতে পন্ডিত শ্রীরাজকৃষ্ণ মন্তব্য করেছেন, ‘যে ভূভাগ পদ্মা এবং ভাগীরথীর মধ্যস্থিত, তাহার নাম বাগড়ি।’ কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে বাগড়ির প্রাচীন নাম হল ‘বালবলভী।’ এই মতটি অবশ্য বিতর্কিত। অবশ্য প্রাচীন ‘রামচরিত’ গ্রন্থে বালবলভীর যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে বালবলভী দেশটিকে নদীবহুল বলেই মনে হয় । কাজেই বাগড়ির প্রাচীন নাম বালবলভী হলেও হতে পারে। কেননা, বাগড়ি স্থানটি নদীবহুল। যেহেতু, বাগড়ি ছিল পদ্মার দক্ষিণে। সে খুলনা কি বরিশাল হোক না কেন -আজও নদীবহুল।
নদী এবং বাংলা অবিভাজ্য
ঐতিহাসিকগণ বাগড়ি অঞ্চলের আয়তন নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কীসের ওপর ভিত্তি করে? উত্তর: বিশিষ্ট মুগল ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’-র ভিত্তিতে। ঐতিহাসিক শ্রীরজনীকান্ত চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘রাঢ়, বরেন্দ্র, বঙ্গ ও মিথিলা পূর্ব্ব হইতেই ধন-জন-পরিপূর্ণ ছিল; কিন্তু বাগড়িতে মানুষের বাস ছিল না।'
এর মানে কি? বেশ ধাঁধায় পড়া গেল তো! যে বাগড়ি নিয়ে এত কথা হচ্ছে, সে বাগড়িতেই কিনা মানুষের বাস ছিল না? ঐতিহাসিক শ্রীরজনীকান্ত চক্রবর্তী আরও লিখেছেন, "এই স্থান সমুদ্র গর্ভ হইতে মস্তক উত্তোলন করিতেছিল।" (বাংলা ভাষার কি বাহার! মস্তক উত্তোলন করিতেছিল ... ) ...সেই যাই হোক। ঐতিহাসিক শ্রীরজনীকান্ত চক্রবর্তীর কথা অনুযায়ী বাগড়ি-র অবস্থান সমুদ্রের কাছাকাছি।
বাংলাদেশ আর বঙ্গোপসাগরও কখনও কখনও অবিভাজ্য বলেই মনে হয়। বিরাট প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সে জানান দেয় যে সে আছে ...
বিশিষ্ট গবেষক কাবেদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘সুন্দরবন অঞ্চল সম্ভবত এ সময় (অর্থাৎ সেন আমলে) বাগড়ি-র মধ্যে ছিল। তখন একে বলা হত ‘ব্যাঘ্রতটী মন্ডল।’ (দেখুন ; প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী। পৃষ্ঠা;১৪০)
এতক্ষণে বোঝা গেল!
তার মানে বাঘ বা ব্যাঘ্র যে সমুদ্র-তটে বা সৈকতে বাস করে বা চড়ে বেড়ায় তাই ব্যাঘ্রতটী মন্ডল । অর্থাৎ, সুন্দরবন। এর মানে প্রাচীন বাগড়ি দেশ ও জনপদের অন্তর্ভূক্ত ছিল আজকের পৃথিবীবিখ্যাত সুন্দর বন!
মানচিত্রে সুন্দরবন।এ বনে সুন্দরী গাছ বেশি বলে এক সময় পুরনো নামটি বদলে যায়। সাগরের বন বা সমুদ্র-বন-এ থেকেও সুন্দরবন নামের উদ্ভব বলে কেউ কেউ মনে করেন। ১৯৯৯ সালে সুন্দরবন UNESCO World Heritage Site- এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বাংলায় প্রাপ্ত তাম্রশাসন ও লেখমালা বিশ্লেষন করে বোঝা যায় যে ৮ম থেকে ১২শ শতক অবধি ‘ব্যাঘ্রতটী মন্ডল’ বা পরবর্তীকালে বাগড়ি ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি বাঘ অধ্যুষিত এক বিস্তীর্ণ প্রদেশ। মুসলিম শাসনামলে ওই অঞ্চলটিকে বলা হয়: ‘বাগড়ি মহল’। মুগল কর্তৃপক্ষ বনভূমি সাফ করে আবাদ করে জনবসতি গড়ে তোলার উদ্যেগ নেওয়া হয়। ওই সময়ই, অর্থাৎ মুগল আমলে স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নেন বলে জানায় যায় (সুন্দরবন বিষয়ক বাংলা উইকিপিডিয়া দেখুন) ।
সুন্দরবনের প্রাণীকূলের শোভাও অপরূপ
স্থানীয় মুগল শক্তির ক্ষমতা খর্ব করে বাংলার ইতিহাসে আবির্ভূত হয় ইংরেজরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মুগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের কাছ থেকে সুন্দরবনের স্বত্বাধিকার পায় ইংরেজ বেনিয়ারা। তারা শাসনশোষন যাই করুক, সুন্দরবনের মানচিত্র তৈরি করতে কিন্তু ভুল করেনি! ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলা প্রদেশে বন বিভাগ স্থাপনের পর থেকে সুন্দরবন সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে। তারপর? তারপর ‘বিশ্বের প্রথম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্বাবধানের অধীনে আসে।’ (উইকিপিডিয়া) mangrove forest-এর বাংলাটিও বেশ মজার। ‘জোয়ারধৌত গরান বনভূমি’।
উপকূল সংলগ্ন সুন্দরবন
মুগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল-এর ‘আইন-ই আকবরি’ গ্রন্থে বাগড়িকে ‘সরকার-ই-মন্দারণ’ এর অন্তর্গত একটি মহাল বলা হয়েছে। কাজেই সম্রাট আকবরের সময়কার বাগড়িই হচ্ছে ‘বাগড়ি মহাল।’ কাজেই ব্যাঘ্রতটী মন্ডল, বাগড়ি বা বাগড়ি মহাল ছিল বাংলার প্রাচীন নদনদীবহুল জলাভূমিময় বনাঞ্চল।
কীভাবে ব্যাঘ্রতটী মন্ডল যাবেন?
বাংলাদেশের যে কোনও জায়গা থেকে প্রথমে আপনাকে খুলনা পৌঁছতে হবে। এরপর ব্যাঘ্রতটী মন্ডলের গভীরে প্রবেশ করার জন্য আপনাকে মংলা বন্দরে যেতে হবে । কিংবা খুলনার নতুন বাজার লঞ্চঘাট থেকেও ব্যাঘ্রতটী মন্ডলে যাওয়া যায়।
বর্তমান খুলনা শহরের একটি দৃশ্য। (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ) এককালে এই শহরটি ছিল প্রাচীন বাগড়ি বা ব্যাঘ্রতটী মন্ডলের অন্তর্গত ।
ঢাকার সদরঘাট থেকে গাজী ও শাহীন বেলায়েত নামক রকেটে ব্যাঘ্রতটী মন্ডলে যাওয়া যায়।
ব্যাঘ্রতটী মন্ডলের একটি ব্যাঘ্র; ভবিষ্যতে হয়তো সুন্দরবনের নাম হবে "টাইগার কোস্ট" ...আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম ... ক্লু হিসেবে আপনাদের জানিয়ে রাখি যে ‘ব্যাঘ্রতটী মন্ডল’ এর বর্তমান নামটি যাইই হোক না কেন-বিশ্বের লোকে সেটি এক নামেই চেনে। বাংলার বাঘ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকেও এক নামে চেনে বিশ্বের লোকে ...এও কম গর্বের বিষয় নয় কিন্তু।
ব্লগার শামসীর এর সৌজন্যে ব্যাঘ্রতটী মন্ডল-এর আরও ছবি ...
Click This Link
ছবি: ইন্টারনেট।
তথ্যনির্দেশ:
কাবেদুল ইসলাম; প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:৫৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




