somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

১২ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছেঁউড়িয়ার সাঁইজী বলিছেন:

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।


কথা তো সেটাই। মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হওয়া যায় । বাংলার বাউলের এই এক বিশ্বাস; বাউলের ধর্মসাধনার মূলকথাটি তাই, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি । তো, এই মানুষ ভজার পথটি কিন্তু অত সহজ নয়, বরঞ্চ অনেকই জটিল, প্রায় দুঃসাধ্যই বলা চলে। কেননা, দীর্ঘকালের পথপরিক্রমায় বাউল সাধনায় এসেছে মিশেছে নানা পথ ও মত। সে কারণেই জ্ঞান, যোগ এবং বামাচারী সাধনমার্গ হয়ে উঠেছে বাউল সাধনারই অনিবার্য অঙ্গ। বামাচারী সাধনা হল কামজ সাধনা; অর্থাৎ এই সাধনায় নারীসঙ্গ অনিবার্য। বাউলের সাধনা আবার কামশূন্য জ্ঞানমার্গীয়ও বটে।অর্থাৎ বাউলের বিশ্বাস এই যে শুদ্ধজ্ঞান সাধন করেই তবে ‘অজান’ (unknown) খবর জানা যায়। এই নিগূঢ় 'অজান' খবর জানার তৃষ্ণায় কাতর বাউলগণ বাংলার পথে পথে ঘুরে বেড়ান, এবং গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী সৎ গুরুর সন্ধানে হন্যে হয়ে ওঠেন। যে যোগসাধনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রন, বাউলের সাধনায় সে যোগের অমসৃণ পথও এসে মিশেছে । এসব কারণেই বাউলের সাধনা অনায়াস লব্দ নয়। কাজেই মানুষভজার পথটি অত সহজ নয়, অনেকই জটিল। তারপরও তত্ত্বদর্শী বাউলগণ স্বেচ্ছায় সে বক্রসর্পিল পথে হেঁটে যান। একা। মূল না-হারানোর ভয়ে ...

ছেঁউড়িয়ার সাঁইজী আরও বলিছেন-

মানুষে মানুষ গাঁথা/ দেখো যেমন আলোকলতা
জেনে শুনে মুড়াও মাথা
ও তুই জাতে চরবি।


‘মানুষে মানুষ গাঁথা’ ...এই কথার কি মানে ? মানুষে কি মানুষ বিদ্ধ হয়ে রয়েছে? নাকি মানুষের গল্প মানুষের মধ্যে নিহিত? সে যাই হোক। কথা যা হচ্ছে তা মানুষকে নিয়েই, যে মানুষের স্বরূপ উপলব্দিই বাউলজীবনের একমাত্র লক্ষ । ছেঁউড়িয়ার সাঁইজী বলছেন: ‘জেনে শুনে মুড়াও মাথা’। কি এর মানে? সাঁইজী মাথা মুড়াতে বলছেন কেন? বঙ্গে কি ভারতবর্ষে সন্ন্যাস গ্রহনের পূর্বে মাথা মুড়নোর রেওয়াজ রয়েছে । সন্ন্যাস গ্রহনের উদ্দেশ্য ultimate reality-র স্বরূপ উপলব্দি । এই ultimate reality -ই লালনের 'মনের মানুষ'; যিনি আত্মারূপে কিংবা অচিন পাখিরূপে দেহখাঁচার মধ্যে রয়েছেন। যাঁর কথা ভাবলে সাপ দেখার মতোই চমকে উঠতে হয়। (যেখানে শাঁইয়ের বারামখানা/শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে/ দেখতে যেন ভুজঙ্গনা।) ... দেহের ভিতরে বাস করা অচিন পাখিরূপী শাঁই সর্বক্ষণ লীলে করছেন । তাঁকে জানাই ‘জতে ওঠা’, তাঁকে জানার মাধ্যমেই এক মহিমান্বিত আধ্যাত্বিক স্তরে পৌঁছনো যায়। যে কারণেই ইসলামের নবী (সা) বলছেন: 'মানঅরাফা নাফসাহু ফাবাদে আরাফা রাব্বাহু।'অর্থাৎ, যে নিজেকে চিনেছে, সে আল্লাহকে চিনেছে।

ছেঁউড়িয়ার সাঁইজী এবার মনের মানুষের অবস্থান নির্দেশ করছেন-

দ্বিদলে মৃণালে
সোনার মানুষ উজলে।
মানুষ-গুরুর কৃপা হলে
সেই ধন পাবি।


তো লালনের সোনার মানুষ কোথায় রয়েছেন? দ্বিদলে মৃণালে। কিন্তু, কোথায় সেই দুই পাঁপড়ির মৃণাল? মৃণাল রয়েছে মানবদেহের ভিতরে। দেহের ভিতর মৃণাল ছাড়াও রয়েছে আঠারো মোকাম (অর্থাৎ আঠোরোটি ঘর), ছয় লতিফা, বারো বরজ, চারচন্দ্র, চৌদ্দ ভুবন, ষড় রিপু ও দশ ইন্দ্রিয়। এসবই বাংলার বাউলের কল্পনা। বাউলগণ এই কল্পনাসূত্র লাভ করেছেন বাংলার তান্ত্রিক ঐতিহ্য, সুফিমত এবং ষোড়শ শতকের সহজিয়া বৈষ্ণবগণের কাছ থেকে । দেহের ভিতরে আরও রয়েছে পদ্ম। এবং সে পদ্মেই আলোকিত হয়ে রয়েছেন সোনার মানুষ। ‘দ্বিদলে মৃণালে সোনার মানুষ উজলে।’
বাউলের চোখে কী অপূর্ব সেই দৃশ্য ! যেন সূর্যকিরণবিম্বিত অথই রূপ সাগর । রূপের ওই সাগরে তত্ত্বদর্শী রবীন্দ্রবাউলও ডুব দিয়েছেন:

রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করে


তবে সেই অন্তরের মানুষকে পাওয়া কিন্তু সহজ নয়। জ্ঞান, যোগ ও বামাচারের কষ্টসাধ্য কন্টক বিছানো পথ অতিক্রম করেই তবে পদ্মাসনে আসীন সেই মানুষরতনকে পাওয়া যায়। কিন্তু তার আগে চাই মনের মানুষের সায়। ‘মানুষ-গুরুর কৃপা হলে সেই ধন পাবি।’

সবশেষে ছেঁউড়িয়ার সাঁইজী বলিছেন-

মানুষ ছাড়া মন রে আমার
দেখবি ভবে সব শূন্যকার।
ফকির লালন বলে মানুষ আকার
(এই রূপ) ভজলে পাবি।


মানুষ পলে পলে যে শূন্যতার বোধ উপলব্দি করে, তা আসলে সেই অন্তরের মানুষেরই বিহনে। ভিতরকার মানুষের উপলব্দির অভাবহেতু সবই যে শূন্য শূন্য ঠেকে।বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করে। সবই যে অসার আর নিরর্থক মনে হয়, প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়/শূন্য মনে হয় ... এই তিক্ত শূন্যতা মানুষ সইতে পারে না। তাই সেই নিরালম্ব শূন্যতা ভরিয়ে তুলতেই সে মানুষভজনে ব্রতী হয়। সেই মানুষের অলীক স্পর্শ লাভ হলে তবেই গিয়ে হৃদয়ে পরম সন্তোষ আর গভীর চিত্তসুখ লাভ হয়। সেই চিত্তসুখ লাভ করেই সোনার মানুষ রবীন্দ্রবাউল গেয়েছিলেন:


সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/
আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।


তথ্যনির্দেশ:

(১)আবদেল মাননান সম্পাদিত অখন্ড লালনসঙ্গীত; এবং
(২)আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত লালনসমগ্র'র বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ

বাউল আবদুল করিম শাহের কন্ঠে


http://www.mediafire.com/?6t3eyrfeb6vv46t
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:৩৬
১৮টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×