না।
কাজেই নিজেদের পথই ধরি। ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্রতী হই, এবং জীবনানন্দের "ঘোড়া" কবিতাটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।
১৯৪৮ সাল। জীবনানন্দ দাশ ‘সাতটি তারার তিমির’ নামে তাঁর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফকরুল আলম 'সাতটি তারার তিমির' এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন: The Darkness of Seven Stars. ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতার শিরোনাম ‘ঘোড়া’। কবিতাটি পাঠ করা যাক:
আমরা যাইনি ম’রে আজো -তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়;/
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;/
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন -এখানে ঘাসের লোভে চরে/
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর প’রে।
আস্তাবলের ঘ্রান ভেসে আসে একভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝ’রে পড়ে ইস্পাতের কলে;
চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো -ঘুমো-ঘেয়ো
কুকুরের অস্পষ্ট কবলে
হিম হয়ে নড়ে গেল ও-পাশের পাইস্ -রেস্তরাঁতে,
প্যারাফিন -লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে
সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;
এইসব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্দতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।
চল্লিশের দশকের কলকাতা ; জীবনানন্দের কলকাতা ...যে শহরে রাতভর হাঁটতেন কবি
বলেছি যে, ১৯৪৮ সালে জীবনানন্দ দাশ ‘সাতটি তারার তিমির’ প্রকাশ করেন। সে সময়টায় কবি কলকাতায় থাকতেন। কবি বলেই কী এক ঘোরের মধ্যে রাতভর নিঝঝুম কলকাতা শহরের অলিতে-গলিতে এবং বড় রাস্তায় হাঁটতেন । সে সময়ই একবার এক জোৎস্নারাতে রাস্তার পাশে একটি আস্তাবল দেখে থমকে দাঁড়ালেন কবি। পরবর্তীতে সে অভিজ্ঞতার কথা ‘ঘোড়া’ কবিতায় কবি লিখেছেন এভাবে:
আস্তাবলের ঘ্রান ভেসে আসে একভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
তার পরপরই কবির মনে হল:
বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝ’রে পড়ে ইস্পাতের কলে;
কি এর মানে? কবি কি নাগরিক যান্ত্রিকতা বুঝিয়েছেন? সম্ভবত। কবি এর পর আস্তাবলের চারপাশের সুরিয়ালিষ্ট বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন:
চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো -ঘুমো-ঘেয়ো/
কুকুরের অস্পষ্ট কবলে/
হিম হয়ে নড়ে গেল ও-পাশের পাইস্ -রেস্তরাঁতে,/
প্যারাফিন -লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে/
সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;/
এইসব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্দতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।
বোঝা যায়। আস্তাবলের পাশেই একটি পাইস্ -রেস্তরাঁ। তার ‘ চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো -ঘুমো-ঘেয়ো কুকুরের অস্পষ্ট কবলে হিম হয়ে নড়ে গেল’। কি বিকল্পধারার বাক্য বিন্যাস!, কি ভীষণ অন্যরকম ভাবনা! আধুনিক জীবনবোধে আক্রান্ত জীবনানন্দের বিক্ষত হৃদয়টি উপলব্দ হয় যেন। সেই যাই হোক। কবিতার শেষ তিনটি লাইন এরকম:
প্যারাফিন -লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে/সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;/এইসব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্দতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।
গোল আস্তাবলে সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে প্যারাফিন -লন্ঠন নিভে গেল। এইসব ( অর্থাৎ আস্তাবলের) ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্দতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে। নিওলিথ-স্তব্দতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে-মানে কি? তার কিছু ইঙ্গিত পেতে কবিতাটির প্রথমে ফিরে যেতে হবে।
আমরা যাইনি ম’রে আজো -তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়; /
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;/
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন -এখানে ঘাসের লোভে চরে/
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর প’রে। /
তখন একবার বলেছিলাম যে কবি রাতভর হাঁটতেন নিঝঝুম কলকাতা শহরের অলিতে-গলিতে এবং বড় রাস্তায়। সে সময়ই একবার রাস্তার পাশে আস্তাবল দেখে থমকে দাঁড়ালেন। কবির মনে হচ্ছিল আস্তাবলের ঘোড়াগুলি যেন বলছে: আমরা যাইনি ম’রে আজো -তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়। কিন্ত, কি এর মানে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফকরূল আলম অনুবাদ করেছেন:Not that we are all done for-new scenes still come to sight; কিন্তু কি এর মানে? এতেও তো মানে বোঝা যাচ্ছে না। এই লাইনের অর্থ কি এই যে... ঘোড়ারা আজও মরে যায়নি। অর্থাৎ, ঘোড়ারা আজও বেঁচে আছে । এই বক্তব্যের সঙ্গে ‘তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’-এই বাক্যর সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছে না; যাই হোক। অগ্রসর হই -
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
মহীনের ঘোড়াগুলো মনে কি? মহীন নামে কোনও সহিসের ঘোড়া কি? নাকি কবি প্রাচীন কোনও সময়ে ইঙ্গিত দিচ্ছেন? সেরকম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা জানি জীবনানন্দর কবিতাগুলি ইতিহাসচেতনায় মুখর। যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।’ এ কারণেই মনে হয়: মহীনের ঘোড়াগুলো মানে সুপ্রাচীন সেই মহেঞ্জোদারো নগরের ঘোড় নয় তো? হরপ্পা সভ্যতার যে নগরটির উদ্ভব সেই ২২০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বে । হ্যাঁ, সেরকমই হওয়ার কথা।
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন -এখানে ঘাসের লোভে চরে/
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর প’রে।
জীবনানন্দ লিখেছেন: প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন। হরপ্পা সভ্যতা তাম্রপ্রস্তর যুগের সভ্যতা হলেও Neolithic period বা নব্যপ্রস্তর যুগে সভ্যতাটির সূত্রপাত ; মাঠ পর্যায়ে গবেষনা করে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, নবোপলীয়, অর্থাৎ নব্যপ্রস্তর যুগে খাদ্য ও ঘাসের অভাব দেখা দিয়েছিল। নিজেদের এবং পশুদের খাদ্য যোগানোর জন্য নদীর তীরই ছিল উপযুক্ত জায়গা। কাজেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ নদীর তীরে বসতি গড়তে থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে হরপ্পা সভ্যতার কালসীমা খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ থেকে ১৭০০।
ধুতি পাঞ্জাবি পরা সাদাসিদে চেহারার বরিশালের এই কলেজ শিক্ষকটি ছিলেন তীব্র আধুনিক ... সেই চল্লিশের দশকেই যাঁর কবিতার বইয়ের নাম The Darkness of Seven Stars.
এবার কবিতার শেষ তিনটি লাইনে আবার ফিরে যাই।
প্যারাফিন -লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে
সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;
এইসব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্দতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।
চল্লিশের দশকে কলকাতার রাত্রিতে হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ আস্তাবলে যে ঘোড়াদের দেখেছিলেন তাঁর ‘মহিনের ঘোড়া’ প্রাচীন মহেঞ্জোদারোর ঘোড়া মনে হয়েছিল । যে ঘোড়াগুলি ঘাস খেত কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে। আজও পৃথিবীতে জ্যোৎস্নার আলো ছড়ায়; কলকাতার আস্তাবলের ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্দতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে। প্যারাফিন -লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে; ...ঘোড়া তাহলে কোনও কিছুর প্রতীক? সময়ের কি? যে সময়ের দুটি প্রান্তে ঘোড়ারা বেঁচে রয়েছে এবং দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে। যা হোক। এত প্রশ্ন আর উদ্বৃতির পরও হয়তো সবটা বোঝানো গেল না। কবিতা বলেই।
সে যাই হোক। কলকাতায় ১৯৭৫ সালে "মহীনের ঘোড়াগুলি" ব্যান্ডটি গড়ে ওঠে কয়েকজন তরুণ মিউজিশিয়ানের উদ্যেগে। আর তখনই ব্যান্ডটির নাম "মহীনের ঘোড়াগুলি" রাখা হয় । ঘটনাটি হয়তো অনেকটাই আকস্মিক। হয়তো খানিকটা অ্যাবসার্ডও। কেননা, তখনকার কলকাতার সাহিত্যমহলে ‘সুরিয়ালিজম’,‘যাদুবাস্তবতা’, কিংবা ‘ অ্যাবসার্ডবাদ’ ইত্যাদি শব্দগুলি সাহিত্যরসিকের মুখে মুখেই ফিরছিল। এসব হয় তো অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু, 'মহীনের ঘোড়াগুলো'-র মানে যে মহেঞ্জোদারো নগরের ঘোড়া তারই একটা ইঙ্গিত তো আমরা এই আলোচনায় পেলাম এবং যথারীতি জীবনানন্দের ইতিহাস চেতনার গভীরতায় মুগ্ধ হলাম।
জীবনানন্দ দাশ-এর ‘ঘোড়া’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ।
Horses (Ghora)
Not that we are all done for-new scenes still come to sight;
Maheen’s horses yet munch grass in Kartik’s late autumn moonlight;
As if horses from some Paleolithic age-lured
Into grazing in a dreadful dynamo of a world.
The stink from the stable drifts in with the onrushing night breeze;
The sad sound of rustling straw rubs onto steel machines;
The few empty teacups are like kittens-asleep-under the slack watch
of many dogs.
Chilled, they make for the cheap restaurant close by,
The placid puff of time blows out the paraffin lamp of the stable
Caressing the neolithic –still moonlight of these horses.
(অনুবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফকরুল আলম।)
শেষ করছি ঈষৎ অপ্রাসঙ্গিক অথচ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে। মহিনের ঘোড়াগুলি সম্বন্ধে ইউইকিপিডিয়া লিখেছে ( যা আগেও উল্লেখ করেছি) He (মানে জীবনানন্দ দাশ ) is often considered the first Bengali poet to truly break free of Rabindranath's imposing presence. To some extent, Moheener Ghoraguli attempted to do the same for Bengali popular music. কিন্তু আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা যায় না। অঞ্জন দত্ত পরিচালিত ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে নির্মিত ২০১১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ ছবিটির একটি রবীন্দ্রসংগীতই তার প্রমান:
রবীন্দ্রনাথ। চিরকালের, চিরদিনের। জীবনানন্দ যাঁকে উল্লেখ করেছেন "আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ মনিষী হিসেবে।"
মহিনের ঘোড়াগুলি নিয়ে ব্লগার নাহোল এর একটি পোস্ট
Click This Link
তথ্যসূত্র:
আবদুল মান্নান সৈয়দ সংকলিত ও সম্পাদিত প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র জীবনানন্দ দাশ
Fakrul Alam; Jibanananda Das Selected Poems with an Introduction , Chronology, and Glossary
Click This Link
উৎসর্গ:
ডাক্তার মুগ্ধকে, যিনি গতকাল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, যাঁকে আমি কখনও দেখিনি, তবে জানি যে তিনিও জীবনানন্দ ভালোবাসতেন, আর "মহিনের ঘোড়াগুলি" শুনতেন ...
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:২৯