হরপ্পা সভ্যতার মানচিত্র।১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় সিন্ধ অঞ্চলে সব মিলিয়ে চল্লিশটির মতন প্রতœক্ষেত্র আবিস্কার হয়েছিল। এর পর গত ৫০/৬০ বছরে সব মিলিয়ে ১৪০০ প্রাচীন বসতি আবিস্কৃত হয়। এর মধ্যে ৯২৫ টি ভারতে; এবং ৪৭৫ টি পাকিস্তানে। কাজেই বর্তমানকালের রাজনৈতিক সীমানায় হরপ্পা-সংস্কৃতির বিচার করা যাবে না, কাজেই হরপ্পা-সংস্কৃতির সমীক্ষা চালাতে হবে সভ্যতাটি ভৌগোলিক প্রেক্ষপটে। যা বিশাল এক ভূখন্ডে ছড়িয়ে রয়েছে- পশ্চিমে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সুতকাজেন্দর; পুবে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মিরাট জেলার আলমগীরপুর; দক্ষিণে মহারাষ্ট্রের আহমদনগর জেলার ধাইমাবাদ; এবং উত্তরে জন্মু এবং কাশ্মীরের আখনুর জেলার মানডা। পুব-পশ্চিমে সব মিলিয়ে ১৬০০ কিলোমিটার। এবং উত্তরদক্ষিণে ১৪০০ কিলোমিটার।
হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা যে ধরণের পোশাক পরত তার কোনও নমুনা পাওয়া যাওয়ার তো কথা না। তবে হরপ্পায় যেসব মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলি বিশ্লেষন করে হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা কী ধরনের পোশাক পরত সে সম্বন্ধে কিছু হলেও ধারণা পাওয়া সম্ভব। যেমন, পরিধেয় বস্ত্রের ওপরের দিকটা ছিল শালের মত আর নিচের অংশ ছিল ধুতির মতো। নারীপুরুষের পোশাকের বিশেষ পার্থক্য ছিল বলে মনে হয় না। এবং পোশাকের উপাদান ছিল তুলা আর পশম।
হরপ্পা নগর; একালের শিল্পীর চোখে
নারী এবং পুরুষ উভয়ই অলঙ্কার ভালোবাসত। (আর একালের নারীরা পুরুষের চেয়ে অলঙ্কার পছন্দ করে বেশি!) ...সে যাই হোক। হরপ্পায় খননকার্য চালিয়ে নানা ধরনের আংটি, গলার হার, কঙ্কণ পাওয়া গেছে। অলঙ্কার নির্মাণে ব্যবহৃত হত সোনা এবং রূপাসহ নানা মূল্যবান ধাতু । অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'প্রাচীন ভারতের ইতিহাস' বইতে লিখেছেন,‘ মেয়েরা লিপস্টিক ব্যবহার করত।’ ( প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা,২০) এটা কী করে বোঝা গেল তা অবশ্য তিনি ব্যাখ্যা করেননি। কাজেই খটকা রয়েই গেল। অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় আরও লিখেছেন যে, ‘হরপ্পায় পাওয়া একটি ভ্যানিটি ব্যাগ আমাদের কৌতূহল উদ্রেক করে। মনে হয় মধ্যবিত্তের সমৃদ্ধি এই সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। ’
এই ছবিটি হরপ্পা সভ্যতার নগর সম্বন্ধে চমৎকার ধারণা দেয়
এমনকী হরপ্পা সভ্যতায় তিনতলা বাড়িও ছিল! আর সেসব বাড়িতে ছিল ড্রইংরুম বা বৈঠকখানা। আর সে বৈঠকখানায় থাকত খাট, চেয়ার, টুল এবং আলো (এই আলোর ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না। প্রদীপের আলো হবে সম্ভবত) । এছাড়া ঘরে আরও অনেক জিনিসপত্র ছিল। তবে সেসব জিনিস পাথর দিয়ে বানানো হত না, তামা এবং ব্রোঞ্জ দিয়েও বানানো হত । তামা আনা হত বিদেশ থেকে। কাজেই তামা ওরা হিসেব করেই ব্যবহার করত। হরপ্পা সভ্যতার অস্ত্র ছিল- কুঠার, বর্শা, ছোরা, তীর- ধনুক, গুলতি এবং ঢাল। তবে তরবারি জিনিসটা একেবারেই ছিল না। হরপ্পাবাসীর অবসর বিনোদন ছিল পাশা খেলা, শিকার এবং ষাঁড়ের খেলা।
এই ছোট ছোট মূর্তিগুলি হরপ্পায় পাওয়া গিয়েছে
হরপ্পাবাসীর গড় আয়ু ছিল মাত্র ত্রিশ! মোহেনজোদারো নগরে কবর আবিস্কৃত হয়েছে। কবরগুলি থেকে হরপ্পাবাসীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। সব গুলি কবর অবশ্য এক ধরণের ছিল না। এক ধরণের কবরে মৃত ব্যক্তির আসবাবপত্র এবং অলঙ্কার সমাহিত করা হত। কিছু কবরে কেবল মৃত ব্যক্তির কঙ্কাল সমাহিত করা হত। এ ছাড়া আরও এক শ্রেণির কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলিতে মৃতদেহ পূর্বে দাহ করে, পরে ছাইভস্ম ওই কবরে রাখা হয়েছে। আসলে কবরগুলির পার্থক্য হরপ্পাসভ্যতার শ্রেণিবৈষম্যেরই প্রতিফলন মাত্র।
সেই কবে নানা জাতির কোলাহলে মূখর ছিল এই নগরটি
মোহেনজোদারো নগরটি ছিল আর্ন্তজাতিক! কেননা ওই নগরে প্রোটো -অসট্রালয়েড, আলপিনয়ড, মেডিটারেনিয়ান এবং মঙ্গোলয়েড প্রভৃতি জাতির মানুষ বাস করত। লোকসংখ্যা অবশ্য জানা যায় নি। কারও মতে ৩৫০০০। আবার কারও মতে এক লক্ষ। নগরে খাদ্যের অভাব ছিল না। পলিমাটির কারণ্যে ভালো ফসল উৎপন্ন হত । এছাড়া নদীপথে খাদ্য আমদানী করা হত। হরপ্পাবাসীর প্রধান খাদ্য ছিল যব এবং গম। এছাড়া ভাত, দুধ, তরকারি, খেজুর, ভেড়া ও গরুর মাংস প্রভৃতি হরপ্পাবাসীর খাদ্য তালিকার অর্ন্তভুক্ত ছিল।
হরপ্পায় প্রচুর ষাঁড়ের ছবি অঙ্কিত সীল পাওয়া গেছে
হরপ্পা সভ্যতায় কী ধরণের গৃহপালিত জীবজন্তু ছিল- সে কথা আমরা হরপ্পায় প্রাপ্ত পশুর কঙ্কাল থেকে জানতে পারি। যেমন কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়, মহিষ,ভেড়া, হাতি এবং উট। এছাড়াও হরপ্পায় নানা ধরণের মাটির খেলনার ছাঁচ পাওয়া গিয়েছে। কাজেই খেলনার ছাঁচ আর পশুর কঙ্কাল থেকে বাঘ, সিংহ, গরু, কুকুর, গাধা, বাঁদর এবং খরগোশ এসব পশুর কথা জানা যায়। হরপ্পাসভ্যতায় ঘোড়ার অস্তিত্ব নিয়ে এককালে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল।অথচ জীবনানন্দ লিখেছিলেন:
মহীনের ঘোড়গুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে
পরবর্তীকালে খননকার্যের ফলে এই সন্দেহের তীব্রতা অনেক কমে গিয়েছে। কালিবনগানে এবং সুরকোদতে মাটির তলায়, খুব গভীরে না হলেও ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে মনে হয় ঘোড়ার অস্তিত্ব এই সভ্যতার শেষের দিকে ছিল। হরপ্পা সভ্যতার "ঘোড়া রাজনীতির" ওপর লেখা ব্লগার ম্যাভেরিক এর এই পোস্ট পাঠ করতে পারেন ...
Click This Link
হরপ্পা সভ্যতার ওপর ব্লগার ম্যাভেরিক এর আরও একটি পোস্ট
Click This Link
হরপ্পার ধোলাভীর নগর
ক্রমশ ...
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক
Click This Link
Click This Link
ছবি: ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র: শেষ কিস্তিতে সংযুক্ত করা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



