somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হরপ্পা সভ্যতা (তৃতীয় পর্ব)

১৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
হরপ্পা সভ্যতা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছি। হরপ্পা সভ্যতার সম্বন্ধে প্রথম পর্বে ভূমিকা হিসেবে লিখেছি যে হরপ্পা সভ্যতা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সভ্যতা । এবং হরপ্পা সভ্যতার আবিস্কার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা, এই আবিস্কারের পূর্বে মনে করা হত যে ভারতের ইতিহাসের সূচনা আর্যদের ভারতবর্ষে আসার পর থেকে । আজ আর এ কথার কোনও ভিত্তি নেই। হরপ্পা সভ্যতা আবিস্কারের পর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাচীনত্ব এবং মৌলিকত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। অন্তত পাঁচ হাজার বছরের পরনো হরপ্পা সভ্যতাটি প্রাচীনত্বের দিক থেকে মিশর-ব্যাবিলন আসিরিয়ার সমকক্ষতা অর্জন করেছে। সে যাই হোক। প্রাগৈতিহাসিক ভারতবর্ষে সিন্ধু নদের অববাহিকায় হরপ্পা সভ্যতা গড়ে ওঠার সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। মাঠ পর্যায়ে গবেষনা করে প্রতœতাত্ত্বিকগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, নবোপলীয়, অর্থাৎ নব্যপ্রস্তর যুগে খাদ্য ও ঘাসের অভাব দেখা দিয়েছিল। নিজেদের এবং পশুদের খাদ্য যোগানোর জন্য নদীর তীরই ছিল উপযুক্ত জায়গা। কাজেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ নদীর তীরে বসতি গড়তে থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে হরপ্পা সভ্যতার কালসীমা খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ থেকে ১৭০০। মিশর কিংবা মেসোপটেমিয় সভ্যতার তুলনায় হরপ্পা-সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান সীমিত। এর প্রধান কারণ লিখিত দলিলের অভাব। প্রায় হাজার দুয়েক সীল পাওয়া গেলেও সেগুলির পাঠোদ্ধার হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ( (archaeological excavation ) ফলে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে তারই ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। অবশ্য এই খননকার্যও মহেনজোদারোয় ভূগর্ভস্থ কয়েকটি স্তর জলমগ্ন থাকায় পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। সুবিশাল হরপ্পা সংস্কৃতির আয়তন সব মিলিয়ে ১২,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার ।এ প্রসঙ্গে একজন ভারতীয় ঐতিহাসিক লিখেছেন: The total geographical area over which this civilization flourished is more than 20 times of the area of Egyptian and more than 12 times of the area of Egyptian and Mesopotamian civilizations combined.



হরপ্পা সভ্যতার মানচিত্র।১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় সিন্ধ অঞ্চলে সব মিলিয়ে চল্লিশটির মতন প্রতœক্ষেত্র আবিস্কার হয়েছিল। এর পর গত ৫০/৬০ বছরে সব মিলিয়ে ১৪০০ প্রাচীন বসতি আবিস্কৃত হয়। এর মধ্যে ৯২৫ টি ভারতে; এবং ৪৭৫ টি পাকিস্তানে। কাজেই বর্তমানকালের রাজনৈতিক সীমানায় হরপ্পা-সংস্কৃতির বিচার করা যাবে না, কাজেই হরপ্পা-সংস্কৃতির সমীক্ষা চালাতে হবে সভ্যতাটি ভৌগোলিক প্রেক্ষপটে। যা বিশাল এক ভূখন্ডে ছড়িয়ে রয়েছে- পশ্চিমে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সুতকাজেন্দর; পুবে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মিরাট জেলার আলমগীরপুর; দক্ষিণে মহারাষ্ট্রের আহমদনগর জেলার ধাইমাবাদ; এবং উত্তরে জন্মু এবং কাশ্মীরের আখনুর জেলার মানডা। পুব-পশ্চিমে সব মিলিয়ে ১৬০০ কিলোমিটার। এবং উত্তরদক্ষিণে ১৪০০ কিলোমিটার।


হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা যে ধরণের পোশাক পরত তার কোনও নমুনা পাওয়া যাওয়ার তো কথা না। তবে হরপ্পায় যেসব মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলি বিশ্লেষন করে হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা কী ধরনের পোশাক পরত সে সম্বন্ধে কিছু হলেও ধারণা পাওয়া সম্ভব। যেমন, পরিধেয় বস্ত্রের ওপরের দিকটা ছিল শালের মত আর নিচের অংশ ছিল ধুতির মতো। নারীপুরুষের পোশাকের বিশেষ পার্থক্য ছিল বলে মনে হয় না। এবং পোশাকের উপাদান ছিল তুলা আর পশম।



হরপ্পা নগর; একালের শিল্পীর চোখে


নারী এবং পুরুষ উভয়ই অলঙ্কার ভালোবাসত। (আর একালের নারীরা পুরুষের চেয়ে অলঙ্কার পছন্দ করে বেশি!) ...সে যাই হোক। হরপ্পায় খননকার্য চালিয়ে নানা ধরনের আংটি, গলার হার, কঙ্কণ পাওয়া গেছে। অলঙ্কার নির্মাণে ব্যবহৃত হত সোনা এবং রূপাসহ নানা মূল্যবান ধাতু । অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'প্রাচীন ভারতের ইতিহাস' বইতে লিখেছেন,‘ মেয়েরা লিপস্টিক ব্যবহার করত।’ ( প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা,২০) এটা কী করে বোঝা গেল তা অবশ্য তিনি ব্যাখ্যা করেননি। কাজেই খটকা রয়েই গেল। অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় আরও লিখেছেন যে, ‘হরপ্পায় পাওয়া একটি ভ্যানিটি ব্যাগ আমাদের কৌতূহল উদ্রেক করে। মনে হয় মধ্যবিত্তের সমৃদ্ধি এই সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। ’




এই ছবিটি হরপ্পা সভ্যতার নগর সম্বন্ধে চমৎকার ধারণা দেয়


এমনকী হরপ্পা সভ্যতায় তিনতলা বাড়িও ছিল! আর সেসব বাড়িতে ছিল ড্রইংরুম বা বৈঠকখানা। আর সে বৈঠকখানায় থাকত খাট, চেয়ার, টুল এবং আলো (এই আলোর ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না। প্রদীপের আলো হবে সম্ভবত) । এছাড়া ঘরে আরও অনেক জিনিসপত্র ছিল। তবে সেসব জিনিস পাথর দিয়ে বানানো হত না, তামা এবং ব্রোঞ্জ দিয়েও বানানো হত । তামা আনা হত বিদেশ থেকে। কাজেই তামা ওরা হিসেব করেই ব্যবহার করত। হরপ্পা সভ্যতার অস্ত্র ছিল- কুঠার, বর্শা, ছোরা, তীর- ধনুক, গুলতি এবং ঢাল। তবে তরবারি জিনিসটা একেবারেই ছিল না। হরপ্পাবাসীর অবসর বিনোদন ছিল পাশা খেলা, শিকার এবং ষাঁড়ের খেলা।



এই ছোট ছোট মূর্তিগুলি হরপ্পায় পাওয়া গিয়েছে


হরপ্পাবাসীর গড় আয়ু ছিল মাত্র ত্রিশ! মোহেনজোদারো নগরে কবর আবিস্কৃত হয়েছে। কবরগুলি থেকে হরপ্পাবাসীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। সব গুলি কবর অবশ্য এক ধরণের ছিল না। এক ধরণের কবরে মৃত ব্যক্তির আসবাবপত্র এবং অলঙ্কার সমাহিত করা হত। কিছু কবরে কেবল মৃত ব্যক্তির কঙ্কাল সমাহিত করা হত। এ ছাড়া আরও এক শ্রেণির কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলিতে মৃতদেহ পূর্বে দাহ করে, পরে ছাইভস্ম ওই কবরে রাখা হয়েছে। আসলে কবরগুলির পার্থক্য হরপ্পাসভ্যতার শ্রেণিবৈষম্যেরই প্রতিফলন মাত্র।



সেই কবে নানা জাতির কোলাহলে মূখর ছিল এই নগরটি


মোহেনজোদারো নগরটি ছিল আর্ন্তজাতিক! কেননা ওই নগরে প্রোটো -অসট্রালয়েড, আলপিনয়ড, মেডিটারেনিয়ান এবং মঙ্গোলয়েড প্রভৃতি জাতির মানুষ বাস করত। লোকসংখ্যা অবশ্য জানা যায় নি। কারও মতে ৩৫০০০। আবার কারও মতে এক লক্ষ। নগরে খাদ্যের অভাব ছিল না। পলিমাটির কারণ্যে ভালো ফসল উৎপন্ন হত । এছাড়া নদীপথে খাদ্য আমদানী করা হত। হরপ্পাবাসীর প্রধান খাদ্য ছিল যব এবং গম। এছাড়া ভাত, দুধ, তরকারি, খেজুর, ভেড়া ও গরুর মাংস প্রভৃতি হরপ্পাবাসীর খাদ্য তালিকার অর্ন্তভুক্ত ছিল।



হরপ্পায় প্রচুর ষাঁড়ের ছবি অঙ্কিত সীল পাওয়া গেছে


হরপ্পা সভ্যতায় কী ধরণের গৃহপালিত জীবজন্তু ছিল- সে কথা আমরা হরপ্পায় প্রাপ্ত পশুর কঙ্কাল থেকে জানতে পারি। যেমন কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়, মহিষ,ভেড়া, হাতি এবং উট। এছাড়াও হরপ্পায় নানা ধরণের মাটির খেলনার ছাঁচ পাওয়া গিয়েছে। কাজেই খেলনার ছাঁচ আর পশুর কঙ্কাল থেকে বাঘ, সিংহ, গরু, কুকুর, গাধা, বাঁদর এবং খরগোশ এসব পশুর কথা জানা যায়। হরপ্পাসভ্যতায় ঘোড়ার অস্তিত্ব নিয়ে এককালে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল।অথচ জীবনানন্দ লিখেছিলেন:

মহীনের ঘোড়গুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে


পরবর্তীকালে খননকার্যের ফলে এই সন্দেহের তীব্রতা অনেক কমে গিয়েছে। কালিবনগানে এবং সুরকোদতে মাটির তলায়, খুব গভীরে না হলেও ঘোড়ার চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে মনে হয় ঘোড়ার অস্তিত্ব এই সভ্যতার শেষের দিকে ছিল। হরপ্পা সভ্যতার "ঘোড়া রাজনীতির" ওপর লেখা ব্লগার ম্যাভেরিক এর এই পোস্ট পাঠ করতে পারেন ...
Click This Link

হরপ্পা সভ্যতার ওপর ব্লগার ম্যাভেরিক এর আরও একটি পোস্ট

Click This Link



হরপ্পার ধোলাভীর নগর

ক্রমশ ...

প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক

Click This Link
Click This Link

ছবি: ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র: শেষ কিস্তিতে সংযুক্ত করা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২২
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অল্প পুঁজিতে অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসার সন্ধান, যে কেউ চাইলে শুরু করতে পারে

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৫



কেউ একজন জানতে চেয়েছেন ১০/১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কিভাবে মাসে ১/২ লাখ টাকা ইনকাম করা যায়? বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে দেখলাম বাংলাদেশে ১০/১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজনীতির পন্ডিত, ব্লগার তানভীর জুমারের পোষ্টটি পড়েন, জল্লাদ আসিফ মাহমুদ কি কি জানে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৯



সামুর রাজনীতির ডোডো পন্ডিত, ব্লগার তানভীর ১ খানা পোষ্ট প্রসব করেছেন; পোষ্টে বলছেন, ইউনুস ও পাকিসতানীদের জল্লাদ আসিফ মাহমুদ ধরণা করছে, "সেনাবাহিনী ও ব্যুরোক্রেটরা বিএনপি'কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নীল নকশার অন্ধকার রাত

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:১৬


কায়রোর রাস্তায় তখন শীতের হিম হাওয়া বইছিল। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। দুইটা বড় সংবাদপত্র অফিস: আল-আহরাম এবং আল-মাসরি আল-ইয়াউম—হঠাৎ করেই আগুনে জ্বলে উঠলো। কিন্তু এই আগুন কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×