সজল অবিকল ওর বাবার মতোই হয়েছে। আদর্শবাদী। বামপন্থী । এরা এই যুগে বড় বেখাপ্পা । এই মুঠোফোনের যুগেও বাবা আর ছেলের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয় । সম্প্রতি সজল এক চিঠিতে তার বাবাকে লিখেছে, ... বাবা, আমাদের দেশপ্রেম সম্ভবত এক রকমের নয়। তা নাহলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা যখন বাংলাদেশিদের গুলি করে মারছে ঠিক তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অনুষ্ঠানে হিন্দি গান বাজে কেন? এটুকু পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সাঈদ আলী। একবার তিনি বাইপাস অপারেশন করানোর জন্য ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন, তাঁর সে কথাও মনে পড়ে।
সকাল আটটার মতো বাজে। গায়ে চাদর জড়িয়ে দাওয়ার ওপর কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছেন সাঈদ আলী। পায়ের কাছে মাঘ মাসের রোদ পড়ে আছে । এই মফঃস্বল শহরে শীত এখনও অনেকটাই তীব্র । সকাল সন্ধ্যায় ঘন কুয়াশায় ডুবে থাকে। আর চারধার তখন কী রকম নির্জন হয়ে থাকে।
সেতারা চা নিয়ে এলেন। চায়ের কাপ স্বামীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে ক্ষোভের সুরে বললেন, সোহরাব ভাই এইটা কি করলেন, কন তো ?
সাঈদ আলী চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, ক্যান, কি হইছে?
শুনলাম, সোহরাব ভাই নাকি নবীগঞ্জের লোকমান হাজীর বড় ছেলে আমানুল্লার সঙ্গে তার ছোট মেয়ের বিয়া ঠিক করছেন। আমাগো একবার খবরও দিলেন না।
সাঈদ আলী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন । তাঁর বুকটা সামান্য মুচড়ে ওঠে । তিনি অন্যমনস্কভাবে চায়ে চুমুক দেন। সোহরাব, মানে লতিফপুরের ‘গাজীবাড়ির’ বড় ছেলে সোহরাব গাজী সাঈদ আলীর বাল্যবন্ধু। খানদান পরিবার হিসেবে লতিফপুরে গাজীবাড়ির বেশ নাম ডাক আছে । সোহরাব গাজীর দাদা আরাফাত গাজীর নামে দৌলতপুর শহরে একটি স্কুল আছে। গাজীদের অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ ভালো। সোহরাব গাজীর বাবা আজমত গাজীর বাড়ুইপাড়ায় ‘স’ মিল, লতিফপুর স্টেশনের কাছে মুদি দোকান, তালতলার মোড়ে একটা মিষ্টির দোকান ছিল। সোহরাব গাজী আর সাঈদ আলী ছেলেবেলায় এই মফঃস্বল শহরটা দাপিয়ে বেড়িয়েছে। সোহরাব গাজী ছোটবেলা থেকেই সাহসী, বুদ্ধিমান, এবং রসিক; অন্যদিকে সাঈদ আলী মুখচোরা, কিছুটা ভীতু স্বভাবের আর গম্ভীর। দুজনেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দুজনের বয়েস তখনও ষোল অতিক্রম করেনি। এত বছর পরও দুজনের সম্পর্ক ভালো। সাঈদ আলী চায়ে চুমুক দেন। তাঁর মুখেচোখে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে আছে। সত্যিই কি নবীগঞ্জের লোকমান হাজীর ছেলের সঙ্গে সোহরাব গাজী তার ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে? তাহলে সোহরাব গাজী আমাকে সে কথা জানাল না কেন?
স্বামীর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে দেখে সেতারা আর কিছু বললেন না। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকেন। কাজের মেয়েটার জ্বর। রান্নাবান্না যা করার আজ তাকেই করতে হবে। সারা বাড়ি খাঁখাঁ করছে। ছোট ছেলে সজল ঢাকায় থাকে, পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে । বড় মেয়ে পারভীনের ঘরসংসারও ওই শহরেই । মেয়ের কথা মনে হলেই বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করে। সোহরাব ভাইয়ের ছোট মেয়ের নাম স্নিগ্ধা।
বাড়ুইপাড়ার ময়নার মার কাছে স্নিগ্ধার বিয়ের কথা শোনার পর থেকেই বুকটায় জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে। স্নিগ্ধার সঙ্গেই মনে মনে সজলের বিয়ের স্বপ্ন দেখছিলেন সেতারা। স্নিগ্ধা দারুণ রূপবতী-এ এক কারণ। মেয়েটি লতিফপুরে বেড়ে উঠলেও এসএসসি-র পর ঢাকায় ওর এক ফুপুর বাড়ি থেকে পড়াশোনা করছে স্নিগ্ধা। সেতারা ঠিকই জানেন, সজল চাপা স্বভাবের হলেও মনে মনে স্নিগ্ধাকে পছন্দ করে।
চা খেতে খেতে সাঈদ আলী বড় অস্থির বোধ করেন। মেয়ের বিয়ের কথা বলল না সোহরাব গাজী। অথচ দুজনের মধ্যে এতদিনের সম্পর্ক! মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে আগরতলায় মস্কোপন্থী ন্যাপ (ওয়ালি) -এর জালাল ভাই দুজনকেই মার্কসবাদী আদর্শে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তবে মাকর্সবাদী থিওরি সোহরাব গাজী কে তেমন না- টানলেও সাঈদ আলী ছিলেন সিরিয়াস। ওদিকে সোহরাব গাজীর বাবা আজমত গাজী ছিলেন রাজাকার। স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আরাফাত গাজী স্কুলের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে সোহরাব গাজীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল বলে ঘটনা বেশি দূর গড়ায়নি। স্বাধীনতার পর সোহরাব গাজী পৈত্রিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। আর ওই সোহরাব গাজীরই সহায়তায় তাদের পারিবারিক আরাফাত গাজী স্কুলে জয়েন করেন সাঈদ আলী । শিক্ষকতার পাশাপাশি কমিউনিষ্ট পার্টির কাজও এগিয়ে নিয়ে যান। পচাত্তর সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে সোহরাব গাজী পরিবহণ ব্যবসা শুরু করে। দশটা বাস আর পঁচিশটা ট্রাকই এখন সোহরাব গাজীর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার উৎস। অবশ্য এতেও দুজনের সর্ম্পকে কখনোই চির ধরেনি। দু-জনার বন্ধুত্ব বরাবরই অটুটই ছিল। যদিও আদর্শগত কারণেই তাঁরা একে অন্যের প্রতিপক্ষ। সোহরাব গাজী গত চল্লিশ বছরে বৈধভাবে কিংবা ঘুরপথে ধনসম্পদ বাড়িয়েই চলেছেন। অন্যদিকে সাঈদ আলী ধনবন্টনের পক্ষপাতী। সোহরাব গাজী খাইরুন্নেসা প্রাইমারি স্কুলের পিছনের জমি ভাড়াটে লোকজন দিয়ে দখল করে পানাপুকুর ভরাট করে গাছপালা কেটে ফেলে বহুতল মার্কেটের সাইনবোর্ড পুঁতে রাখেন কিংবা আরাফাত গাজী স্কুলের হেডস্যার কর্তৃক ষষ্ট শ্রেণির ছাত্রী যৌন নির্যাতনের শিকার হলে ধর্ষনকারীকে সোহরাব গাজী প্রত্যক্ষভাবে মদদ দেন-এসব অন্যায়ের প্রতিবাদে সাঈদ আলী কে তালতলার মোড়ে মানববন্ধনে দাঁড়াতেই হয়। সোহরাব গাজীর কালো রঙের একটা পুরনো ধ্যাদ্ধেড়া ভক্সওয়াগেন আছে। মানববন্ধনের যে জায়গায় সাঈদ আলী দাঁড়িয়ে থাকেন - ঠিক তার সামনেই সেই ভক্সওয়াগেন এসে থামে। জানালায় কালো সানগ্লাস পরা সোহরাব গাজীর ফরসা ভরাট গোলপানা মুখ, মেহদি রাঙানো তামা রঙের চুল। বুর্জোয়া বন্ধুকে দেখে সাঈদ আলী শিঁটিয়ে ওঠেন। রসিক সোহরাব গাজী তখন সাঈদ আলীর নাম্বারে বারবার মিস কল দিতে থাকেন । সাঈদ আলীর পাঞ্জাবির পকেটে ভাইব্রেশন মোডে থাকা মুঠোফোন বিজবিজ করে বাজে। সাঈদ আলী ফোন ধরেন কি করে ...
এসব বেহাল দশার কথা সেতারা কি সজলকে বলতে পারেন না সাঈদ আলী। বলেন সাদিক আমিন কে। সাদিক আমিন হল সজলের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু; ছেলেটা মাঝেমাঝে লতিফপুর আসে। ছেলেটার মাথায় সারাক্ষণ ফিলমের পোকা ঘোরে। চোখে ফিলম বানানোর স্বপ্ন। কালো মতন চেহারা। মাথায় লম্বা চুল, তাতে ঝুঁটি। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। কানের লতিতে দুল। চোয়াল ভাঙা। মুখে চাপদাড়ি। সব সময় পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে। মিষ্টি করে বাংলা বলে। যদিও গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বড়ুরা। সেই সাদিক আমিনই একমাত্র সোহরাব গাজীর রঙ্গরসিকতার ব্যাপারটা জানে। সাদিক আমিন বলে, আমার ফিলমে এই পার্টটা রাখব চাচা। আচ্ছা, রাইখো। সাঈদ আলী বলেন। ছেলেটাকে পছন্দ করেন সাঈদ আলী। জ্ঞানবুদ্ধি ভালোই। মার্কস- লেনিন এর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা আছে। সাদিক আমিন বলে, ওরাই তো জগতের আসল গুরু চাচা। জগৎ পালটে দিতে এসেছিল। শুনে সাঈদ আলী ভীষণই উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
তো এত কিছুর পরও সোহরাব গাজীর সঙ্গে সাঈদ আলীর সম্পর্ক আজও অটুট আছে। আজ থেকে পাঁচ-বছর আগে সাঈদ আলীর বড় মেয়ে পারভীন যখন জাহাঙ্গীর নামে লতিফপুরের এক তরুণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে পালিয়ে গেল তখন সাঈদ আলী বুকের ব্যথায় মেঝের ওপর ঢলে পড়েছিলেন ; সোহরাব গাজীই তখন খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন। সব খরচ বহন করে ইন্ডিয়ায় নিয়ে গিয়ে বাইপাস অপারেশন করিয়ে এনেছিলেন। আজ হোক কাল হোক বন্ধুর টাকা তিনি শোধ করবেন। সজল কি ভালো চাকরি পাবে না? খটকা এখানেই। সজল কি চাকরি করবে? না, শ্রমিকের ছদ্মবেশে কারখানায় ঢুকে শ্রমিক আন্দোলন করবে?
সেতারা খালি কাপ নিতে দাওয়ায় এলেন । বললেন, পারভীন কইল জামাইয়ের ব্যবসাপাতি ভালো না, মেয়ে নিয়া লতিফপুরে কিছু দিন থাকতে চায়।
সাঈদ আলীর মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। পারভীন কে না-হলেও পারভীনের মেয়ে ঐশীকে দেখার জন্য মন ভীষণ ছটফট করে । মুঠোফোনে মাঝেমাঝে ঐশীর সঙ্গে কথা হয়। কথা বলার সময় ঐশী হিন্দি শব্দ বলে। তখন কষ্ট হয় সাঈদ আলীর । ঐশীরা কি বাংলার বদলে হিন্দি শিখছে নাকি?
সাঈদ আলী বললেন, সজল রে ফোন কইরা কও, পারভীনরে নিয়া আসবে।
আচ্ছা, বলব। সেতারার বুকের ভিতরে কান্নার বলক ওঠে। তার কত সখ ছিল মেয়ে জামাইকে আদরযত্ন করবেন, রান্না করে খাওয়াবেন।
আর শুন, পারভীনের জামাই যেন আমার বাড়িতে না আসে।
কথাটা শুনে সেতারার চোখে পানি চলে আসে। স্বামীর বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস নেই সেতারা বানুর। হায় আল্লা, আমার কপালে তুমি সুখ দিলা না!
সেতারা চলে গেলে সাঈদ আলী বুকে হাত দেন। মেয়ে জামাইয়ের কথা মনে পড়লে পাঁচ বছর আগের সেই পুরনো ব্যথা টের পান। সোহরাব গাজীর কাছে আমারে ছোট করল পারভীন । চিকিৎসা খরচ বাবদ সাত লক্ষ টাকা পায় সোহরাব গাজী। কথাটা মনে হলেই সাঈদ আলীর মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। মেয়েকে কখনও বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না বলে পণ করেছিলেন। মৃত্যুর আগে ঐশীর মুখটা একবার দেখবেন বলেই রাজি হলেন। নাতনীকে নিয়ে মেয়ে আাসতে পারে, কিন্তু মেয়েজামাই কখনও নয়!
ঐশী গত বছর স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তবে স্কুলের বই ও পড়তে চায় না, এমন কী ছবির বইটইও না। সারাক্ষণ টিভিতে কার্টুন দেখে। ‘ডোরেমন’ ওর খুব প্রিয়। সেদিন নাজমাকে হিন্দি ভাষায় পানি আনতে বলল ঐশী। অতটুকু মেয়ের কারিশমায় পারভীন রীতিমতো তব্দ খেয়েছিল । পারভীনকেই ঐশী কে খাইতে দিতে হয়। মেয়েটা নাজমার হাতে খায় না। পারভীন একা কত দিকে সামলাবে । ওদিকে ঐশীর বাবা ‘কাজের মেয়ের হাতে’ খেতে পারে না। রান্নাবান্না পারভীনকেই করতে হয়। এমনিতেই শেয়ার মার্কেটে টাকা-পয়সা লস করে জাহাঙ্গীরের মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে । তরকারিতে নুন কম হলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে । জাহাঙ্গীর দু-বছর আগে গার্মেন্টস-এ একসেসরিস সাপ্লাইয়ের কাজ করত । লাভ যা হোক একটা হত তখন । এক বন্ধুর (কু) পরামর্শে সব জমানো টাকা শেয়ার মার্কেটে খাটাল। আর তাতেই - ...কলেজে পড়ার সময়ই জাহাঙ্গীর-এর প্রেমে পড়েছিল পারভীন। জাহাঙ্গীর পড়াশোনা বেশি করেনি । ব্যবসায় নেমে পড়েছিল। মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন, সাঈদ আলীর তাই সে "অসম" বিয়েতে রাজি হওয়ার কথা নয়। প্রেমের ঘোরে এক সন্ধ্যায় লতিফপুর স্টেশনে বোরখা পরে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ঢাকাগামী ট্রেনে উঠল পারভীন । জাহাঙ্গীর নতুন বৌকে যাত্রাবাড়িতে দুরুমের একটা ভাড়া বাড়িতে এনে তুলেছিল। কী সুখের দিনই না ছিল তখন । সজল তখন সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। দুই ভাইবোনের মধ্যে খুব ভাব । বাবার চোখ এড়িয়ে বড় বোনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত সজল। আর কী কারণে জাহাঙ্গীরকেও পছন্দ করত । লেখাপড়া বেশিদূর না করলে কী হবে-বেশ সহজ সরল আছে জাহাঙ্গীর। সজলের মাধ্যমে স্বামীকে লুকিয়ে টাকা পাঠাতেন সেতারা, কখনও শাড়ি-কাপড় , কখনও আচার। সজল ওর ফিলিম-পাগল বন্ধু সাদিক আমিন কেও মাঝেমধ্যে পারভীনের বাসায় নিয়ে যেত । পাগলাটে সাদিক আমিন- এর সঙ্গে কথা বলে ভারি মাজা পায় পারভীন। সাদিক আমিনও বেশ মিশুক আছে। পারভীনকে ‘আপু’ ‘আপু’ করে। অনায়াসে রান্নাঘরে চলে আসে। একদিন তো সে পারভীনকে বলেই বসল, ‘তোমার মুখটা না আপু ভীষণ ফটোজেনিক।’ শুনে পারভীন লজ্জ্বায় লাল। ভাগ্যিস সজল তখন টিভি অফ করে ড্রইংরুমে ঐশীকে বসিয়ে বাংলা ছড়া মুখস্ত করাচ্ছিল। ... ভোর হল দোর খোল খুকি মনি ওঠ রে /ওই জাগে জুঁইশাখে ফুলকলি ছোট রে । পারভীন বুকের আঁচল ঠিক করেছিল। সারা শরীর ঝনঝন করে বাজছিল । জাহাঙ্গীর-এর সঙ্গে আজকাল সেক্সটা ঠিক উপভোগ করে না পারভীন। শেয়ার বাজারে সর্বশ্রান্ত মানুষটা আগের মত দীর্ঘক্ষণ ধরে সুখ দিতে পারে না, জাহাঙ্গীর-এর স্খলন দ্রুত হয়ে যায়। পারভীন বলে, 'ডাক্তার দেখাও। সারাদিন এত কষ্ট করি ওইটুকু সুখের জন্যই তো।' ... জাহাঙ্গীর কি জানে যে পৃথিবীর কোনও ডাক্তারই এ অসুখ সারাতে পারবে না? সে পারভীনকে আঁকড়ে ধরে কাঁদে। বারবার বলে, কথা দাও আমারে ফেলায়া তুমি কখখোনো যাইবা না। পারভীন বলে, ‘আরে তুমি কি পাগল হইলা। তুমার হাত ধইরা আমি পালাইসি বইলা আমি কি বেইশ্যা নাকি।’ জাহাঙ্গীর তারপরেও কাঁদে, বাচ্চা শিশুর মত কাঁদে। সেদিন সন্ধ্যায় মতিঝিল থেকে ফিরল জাহাঙ্গীর । শরীরের এখানে ওখানে ক্ষত, পুলিশ পিটিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেছে। সেদিনও হুহু করে কেঁদেছিল জাহাঙ্গীর । তারপর অসার্থক মিলন। জাহাঙ্গীরের শরীরে আর বন্য ঘোড়ার মতো শক্তি নেই, সেই শক্তি ছিল যখন বিয়ের আগে লতিফপুরের কোনও নির্জন স্থানে তারা দুজনে মিলিত হত । যেসব দিনে জাহাঙ্গীর গভীর আবেগে স্বীকার করত ... তোমারে আদর করতেই আমার জন্ম পারভীন। এখন সেই আবেগের নদীতে চর পড়ে গেছে। এদিকে পারভীনের দিনদিন যৌনতৃষ্ণা বাড়ছেই। পারভীন আজকাল সাদিক আমিন কে খুব মন দিয়ে দেখে। সাদিক আমিন- এর এক ফুপাতো বোন পলি রামপুরায় থাকে, খুব নিরীহভাবে ঐশীকে নিয়ে পলিদের বাড়িতে যেতে চায় পারভীন ...
আজ সন্ধ্যার পর সজল এসেছিল। টিভি অফ করে ঐশীকে পড়াল কিছুক্ষণ । ঐ দেখা যায় তালগাছ ঐ আমাদের গাঁ/ ঐখানেতে বাস করে কানাবগীর ছা । তারপর ভোর হল দোর খোল ... সজল নাজমাকেও পড়ায়। নাজমা যে নাম সই করতে পারে সে সজলের জন্যই। গেল মাসে নাজমা তার মাকে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে। পারভীন জানে ... এই মুঠোফোনের যুগেও সজল আজও তার বাবা কে চিঠি লেখে। নাজমা দিন দিন ডাগর হয়ে উঠছে। অথচ নিজের ওপর সজলের আশ্চর্য নিয়ন্ত্রণ দেখে অবাক পারভীন। অথচ, নাজমার নগ্নদেহ কল্পনা করে জাহাঙ্গীর-এর চাপা উত্তেজনা ঠিকই টের পায় পারভীন। জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে বড় শহরে আসা এই গরীব কিশোরীকে যথাসাধ্য আগলে রাখে। এতকাল নামাজ-কালামের ধার না ধরলেও আজকাল অবশ্য নামাজ পড়ছে জাহাঙ্গীর। ...
সজল রাত দশটা অবধি ছিল। তখনও জাহাঙ্গীর ফেরেনি। সজল এলে সাধারণত খেয়েই যায়। আজ খাওয়ার পর পারভীন সজলকে বেডরুমে ডেকে নিয়ে গেল। তারপর সব খুলে বলল। আর কত কাল একাএকা সহ্য করা যায়? তোর দুলাভাই শেয়ার মার্কেটে লাখ লাখ টাকা লস করছে । ছয় মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি, নাজমার তিন মাসের বেতন বাকি। সামনের মাস থেকে ঐশীর স্কুল বন্ধ। মায়ের দেওয়া গয়না বিক্রি করে কোনওমতে চলছে সব।
জাহাঙ্গীর তাবলীগ জামাতএর নাম লিখিয়েছে।
কি! জাহাঙ্গীর ভাই তবলীগ জামাত করে? সজল ভীষণ চমকে ওঠে।
হ্যাঁ।
সজল এর শ্যামল মুখটা কী রকম আরক্ত হয়ে উঠেছিল তখন, যেন মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেছে। আপনমনে বলল, যারা সহজেই বেহেস্ত- দোযখে বিশ্বাস করে, তারা সহজেই শেয়ারমার্কেটে ইনভেস্ট করে। দেশে এত স্টুপিড লোক! এদের দিয়ে কী হবে ...ছিঃ
সীমান্তে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দুপুরে টিএসসি-র সামনে মানববন্ধন। বিশিষ্ট গায়ক মাহমুদুজ্জামান বাবুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাদিক আমিন। মাঝেমাঝে হতাশ লাগে সাদিক আমিন এর। কী হয় মানববন্ধন করে। গুলি কি থামবে। মানববন্ধনে সজল নেই। ঘন্টাখানেক আগে পারভীন আপাদের নিয়ে লতিফপুর গেছে। হঠাৎ রাস্তার দিকে তাকিয়ে সাদিক আমিন চমকে ওঠে। ক্রিম কালারের একটা টয়োটা প্রিয়াস শাহবাগের দিকে চলে যাচ্ছে, সামনে ড্রাইভিং সিটের পাশে স্নিগ্ধা বসে । স্নিগ্ধার ফরসা মুখে কালো সান গ্লাস। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে যে সুদর্শন তরুণটি বসে ছিল তাকেও চেনে সাদিক আমিন। নাঈম আদনান । জাস্টওয়ে গ্রুপের চেয়ারম্যান শামসের হুদার ছোট ছেলে । নাঈম আদনান মিডিয়াতেও ইনভেস্ট করেছে। স্নিগ্ধা টল, ফরসা, সুন্দরী। শখের বশে আজকাল মডেলিংয়ের প্রতি ঝুঁকেছে। সেইসূত্রেই নাঈম আদনান-এর সঙ্গে পরিচয় স্নিগ্ধার। সাদিক আমিন মিডিয়ায় ঘোরাফেরা করে বলেই সে জগতের ভিতরের কথা সে জানে। স্নিগ্ধার আকর্ষণ সামান্য ভিন্ন বলেই স্নিগ্ধার সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে উঠছে নাঈম আদনান । মডেলিং ছাড়াও স্নিগ্ধা নাটকে অভিনয় করতে চায়। নাঈম আদনানও রাজি। সজলের কাছে এসব কথা সাদিক আমিন চেপে রেখেছে । স্নিগ্ধা যে নাঈম আদনান এর গ্রিপে চলে গেছে সেটি সজল এখনও জানে না। সজল কষ্ট পাবে বলেই সাদিক আমিন বলেনি। এখন বলার সময় এসেছে। সাদিক আমিন জানে সজল স্নিগ্ধাকে ভালোবাসে। কিন্তু, স্নিগ্ধা? জটিলতা আরও আছে। সজল ওর আর্দশবাদী বাবার আদর্শ সন্তান । স্নিগ্ধার মডেলিং করবে, এটা জানার পর ব্যাপারটা সজল কি ভাবে? মডেলিং যেমন পণ্য সর্বস্ব নয়া ঔপনেবিশিক আগ্রাসনের অংশ, তেমনি আবার নারীস্বাধীনতার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত । এই বিষয়টি এই সময়ের ফিলমে কীভাবে আসা উচিত? সাদিক আমিন ঈষৎ উত্তেজিত। আর যে সব মানুষ নেপথ্যে থেকে পণ্যকে সমাজে ছড়িয়ে স্থানীয় বাজার ধ্বংস করে দেয়,তাদেরকেই- বা ফিলমে কীভাবে দেখানো যায় । কাজেই স্থান কাল পাত্র বিস্মৃত হয়ে সাদিক আমিন স্নিগ্ধা এবং নাঈম আদনান এর নিভৃত দুপুরটি কল্পনায় জীবন্ত করে তুলতে থাকে : ...গাজীপুরে লন ঘেরা বাংলো আদনান-এর লাল টালির বাড়ি । বাংলো। নাম: ‘নায়রি লজ’। এই বাংলোয় নাঈম আদনান এসে মাঝে মাঝে রিল্যাক্স করে । তখন কেউ না কেউ থাকে। কখনও অল্প বয়েসি মডেল কখনও মধ্যবয়েসি নাট্যাভিনেত্রী। আজ স্নিগ্ধা। বাংলোয় একজন বুড়ো কেয়ারটেকার আছে। সে চোখে কম দেখে। লনে নানারকম ফুলের গাছ । বাগানে দোপাটি, ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকা আছে। বাংলোয় সুগন্ধী ঘরে আছে নরম বিছানা। সে বিছানায় শুয়ে থেকে এই মুহূর্তে নাঈম আদনান বড় বিপর্যস্ত বোধ করছে। তার আজ প্রিম্যাচুওর ইজাকুলেশন হয়ে গেছে। নগ্ন অতৃপ্ত স্নিগ্ধা জিগ্যেস করে, হোয়াট'স রং!
নাঈম আদনান বলে, সরি। সে স্নিগ্ধাকে সত্যি কথা বলতে পারে না । বলতে পারে না আমাদের গ্রুপ অভ ইন্ড্রাষ্ট্রির অনেক ব্যাঙ্ক লোন স্নিগ্ধা। আবাসন শিল্পে যেভাবে ধস নেমেছে। রড-সিমেন্টের দাম দিনদিন বাড়ছে। আগের দামে ক্রেতাদের ফ্ল্যাট দিতে পারছি না। ক্রেতারা মামলা করছে। এর ওপর শেয়ার মার্কেটে কোটি টাকা ইনভেস্ট করে লস করেছি। আমার বাবার মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গেছে গত নভেম্বরে। এ শহরে আমাদের চেয়ে আরও কঠিন হৃদয়ের ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বুদ্ধিমান মানুষ বাস করে স্নিগ্ধা। আমরা তাদের কাছে হেরে গেছি।
স্নিগ্ধা বলে, এনি ওয়ে, তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে নাঈম?
ইউ নো, দ্যাটস ইমপসিবল।
বাট, হোয়াই?
বাবা ইকরা গ্রুপের চেয়ারমেন হাজী আলমের ছোট মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে । শুনেছি তাসনুভা খুব রিলিজিয়াস।
স্নিগ্ধা চিৎকার করে ওঠে। আই নো! আই নো! আই নো! উফঃ হাউ আই হেইট অল দিস!
নাঈম আদনান একটা সিগারেট ধরায়। মালবোরো । স্নিগ্ধা কন্ঠস্বর নীচু করে বলে, আমাকে তুমি কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারবে নাঈম? মেয়েটির কন্ঠস্বর কেমন করুণ শোনাল।
লুকিয়ে রাখব মানে?
আমার বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে ফেলেছে। পাত্র নবীগঞ্জের লোকমান হাজীর বড় ছেলে আমানুল্লা আমান না কে যেন। আমি এখন বিয়েটিয়ে করব না । আমি নাটক আর মডেলিং নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। ’কজ আই ওয়ান্ট ফ্রিডম, এনাফ ফ্রিডম! তুমি আমায় কোথাও লুকিয়ে রাখবে নাঈম?
ওকে।
আমার কিন্তু বাবার পাওয়ারফুল লোক। পুলিশের পিছনে টাকা ঢালবে।
নো প্রোব। পুলিশের মুখ আমিও বন্ধ করতে জানি। তুমি কালই গুলশান থানায় তোমার বাবার বিরুদ্ধে একটা জিডি করে রেখ।
ওকে। আমি তাহলে এ মাসেই গুলশানে আলাদা ফ্ল্যাটে উঠব। তোমার বিয়ের আমাকে তোমার লাভ-টাভ করতে হবে না। জাস্ট তুমি মাঝে মাঝে এস। কফি খাওয়াব।
ওকে।
তোমার হবু বউয়ের নাম তাসনুভা, না? খুব রিলিজিয়াস বললে। তার মানে হিজাব পড়ে। ভালো। এরা একটু বোকা কিসিমেরই হয়, রিয়েলিটিকে মিসরিড করে, তাসনুভা আমাদের রিলেশন সহজে টের পাবে না, কেননা, ও ভাববে দয়াময় গড দয়া করে তোমাকে ওকে মিলিয়ে দিয়েছেন; তবে তাসনুভা মেয়ে বলে একদিন টের আমাদের গোপন অভিসার ঠিকই পেয়ে যাবে, বাট ততদিন তোমার আমাকে কিংবা আমাকে তোমার ভালো নাও লাগতে পারে ...হি হি ...
ওরা যখন লতিফপুর বাস্টস্ট্যান্ডে বাস থেকে নামল তখন সন্ধ্যা। পারভীনের কোলে ঐশী। নাজমার বকেয়া বেতন মিটিয়ে দিয়ে ওকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। সজল একটা রিকশায় বড় সুটকেশটা তুলে দিল। ঠিক তখনই মুঠোফোন বেজে ওঠে। ‘তোরা যা। আমি আসছি বলে’ সে হাঁটতে থাকে। সাদিক আমিন ফোন করেছে। তারপর ও প্রান্তের কথা শুনতে শুনতে সজলের শরীর জমে যায়। তারপর ফোন অফ করে হনহন করে হাঁটতে থাকে সে। ততক্ষণে ছোট্ট মফস্বল শহরটায় ঘোর কুয়াশা ছড়িয়ে পড়েছে ... সজল রেললাইনের সমান্তরাল হাঁটছে; লতিফপুর স্টেশনটা পিছনে পড়ে থাকে ... হাঁটতে হাঁটতে কত কথা মনে পড়ে তার ... বাবা, মা, ঐশী, পারভীন, সূর্যসেন হল, মধুর কেন্টিন আর এই দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করবার কথা ... কিন্তু তার চেয়েও বড় হয়তো প্রেম ... যে প্রেম পিছনে ফেলে আসা স্টেশনের মতো ... সামনে আরেকটি স্টেশন ... যে স্টেশনে কোনওদিনই পৌঁছাবে না সে ... কেবল ওকে ঘিরে ধরে মাঘের কুয়াশা আর শীত ... আর ঝিঁঝি পোকার ডাক ...আর ভোর হল দোর খোল ...আর ... বিপরীত দিক থেকে কুউউ ঝিক ঝিক কুউউ ঝিক ঝিক করে আসছিল একটা ট্রেন ...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




