মেহজাবীন-এর তিনজন পুরুষ সহকর্মী অফিসে ওকে আবিউজ করত। চাকরিটা ছিল ঢাকায় একটা বিখ্যাত প্রাইভেট ব্যাঙ্কে । ভালো বেতন। তবে মানসম্মান বাঁচাতেই বিপর্যস্ত অপমানিত কোণঠাসা মেহজাবীন চাকরিটা ছেড়েই দিল।
চাকরি ছাড়ার পর থেকে ফরহাদ মেহজাবীন-এর ওপর বিরক্ত। শ্বশুর গম্ভীর । মেহজাবীন শ্বশুরবাড়িতে পরিস্কার অনাদর টের পায়। কিন্তু, মেহজাবীন সত্যি কথা বলে কি করে? সত্যি কথা বললে হয়তো স্বামী আর শ্বশুর ওকেই দুষবে। ফরহাদ হয়তো হিসহিস করে বলবে, তুমি আঁচল সামলে রাখতে পারনি। এখন ওদের দোষ দিচ্ছ। তোমার কলিগদের আমি দেখেছি। তারা ভালো মানুষ।
তবে বৃদ্ধ শ্বশুরকে একটা মিথ্যা কথা বলল মেহজাবীন ।
বলল যে, ব্যাঙ্কের চাকরি। আমার শরীরে কুলায় না বাবা।
দীর্ঘ কর্মজীবনে মেহজাবীন-এর শ্বশুর ব্যারিষ্টার হেদায়েত খান মজলিশ ছিলেন জাঁদরেল আইনবিদ । তাঁকে ঠকানো মুশকিল। সত্তর বছরের বৃদ্ধ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, শরীরে কুলায় না মানে? তার মানে আমার বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না হয় না বলছ? বাজার তো আমিই করি বউমা।
আমি কি তাই বললাম বাবা? (না এই কথটা মেহজাবীন অবশ্য ওর শ্বশুরকে বলেনি। এও বলেনি যে, বাবা আপনি নাচ অপছন্দ করেন বলেই আমি বিয়ের পর নাচ ছেড়ে দিয়েছি)
ব্যারিষ্টার হেদায়েত খান মজলিশ প্রায় হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, কি হল? চুপ করে রইলে কেন? মুরুব্বিরা কোনও কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে হয় না? বাবা-মা কি তোমাকে সহবত শেখায়নি নাকি?
মেহজাবীন অবদমিত কান্না অতি কষ্টে চেপে রাখে। কান্না দেখলে বৃদ্ধ আবার সাতকথা শোনাবেন। অথচ বিয়ের পর বৃদ্ধ শ্বশুর ওকে কতই না আদর করতেন। নিঃসঙ্গ বিপত্নিক বৃদ্ধ। মেহজাবীন- এর শাশুড়ি বেঁচে নেই। বিয়ের পর বৃদ্ধ মেহজাবীনকে পাশে বসিয়ে কত কথা বলতেন । বৃদ্ধের ডায়াবেটিস আছে। চোখে ছানি পড়েছে। এই সত্তর বছর বয়েসে বৃদ্ধের একটা আত্মজীবনী লেখার খায়েস হয়েছে। বৃদ্ধ এলোমেলো কত কথা বলে যেতেন । টিভি সিরিয়াল দেখা বাদ দিয়ে বিরক্ত না হয়ে সে সব কথা ল্যাপটপে টাইপ করত মেহজাবীন । তারপর এডিট করত। শ্বশুরকে পড়ে শোনাত।
বৃদ্ধ শ্বশুর হঠাৎ এমন করে বদলে গেলেন কেন?
চাকরি ছাড়ার পর ফরহাদও কেমন বদলে গেছে।
বিয়ের আগে ফরহাদ হরদম সিগারেট খেত। বিয়ের পর মেহজাবীন-এর ধমকে ফরহাদ সিগারেট অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। এখন আবার বাড়িয়ে দিয়েছে। চাকির ছাড়ার পর মেহজাবীন কে আর তোয়াক্কা করছে না ফরহাদ। মেহজাবীন আবার সিগারেটের ধোঁওয়া একেবারে সহ্য করে পারে না। অথচ কিছু বলতেও পারছে না। সবচে খারাপ লাগে যেটা ... ফরহাদ অরণ্যার সামনেই সিগারেট খায়। ওদের টিভিটা বেডরুমে । অরণ্যা বেডরুমে বসে টিভি দেখে। তখন নোটবুক কিংবা স্মার্টফোনে কাজ করতে করতে সিগারেট খায় ফরহাদ।
ওদিকে মেহজাবীন এখন আর টিভি তে ওর প্রিয় সিরিয়াল দেখতে পারে না। ফরহাদ টেনিস খেলা দেখে। টেনিস না ছাই! আসলে মেয়েদের উরু দেখে।
ফেসবুক নিয়েও সেদিন একটা বাজে মন্তব্য করল ফরহাদ।
এভাবে বদলে গেল ফরহাদ?
অরণ্যা পড়ে ক্লাস থ্রিতে । বিয়ের আগেই চাকরি তে জয়েন করেছিল মেহজাবীন । ব্যাঙ্কে টাকা কিছু জমেছিল। অরণ্যা হওয়ার পর গভীর আবেগে মেহজাবীন বলেছিল ... আমার মেয়ের পড়াশোনার সব খরচ আমার। ফরহাদ জানে মেহজাবীন-এর হাত এখন খালি। তারপরও অরণ্যার খরচ দেয় না। তাছাড়া মেহজাবীন এর অন্য খরচও আছে। শ্বশুরের ট্রিটমেন্টের খরচ, বুয়ার বেতন, সামাজিকতা ... আজকাল বড় বোন শারমীন আপার কাছে টাকা ধার করছে মেহজাবীন । শারমীন আপার আবার মন ভালো। শারমীন আপার স্বামীর গার্মেন্টেস এর ব্যবসা।
খরচ মেটাতে গোপনে গয়নাও বিক্রি করছে মেহজাবীন ।
কিন্তু মেহজাবীন ভাবছিল ... সংসারে টাকাই কি সব? টাকার জন্য স্বামী-শ্বশুর জীবন থেকে এমনভাবে সরে যাবে? মেয়েটাও কেমন পাথরের মতন ভারী ঠেকছে আজকাল। সব মিলিয়ে ওর বেতন ছিল ২৫,০০০। এই টাকাটা আয় না করার জন্য কাছের মানুষ এভাবে বদলে গেল ...
অবশ্য ফরহাদের দোষ দেয় না মেহজাবীন । ফরহাদ গ্রামীণ ফোনে চাকরি করে। সিক্স ডিজিট এর স্যালারি । তবে ওই কোম্পানীতে কাটছাঁট চলছে। যে কোনও দিন ফরহাদের চাকরি চলে যেতে পারেন। তখন?
ধানমন্ডির এই দোতাটা বাড়িটা শ্বশুরের। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের নিরানন্দ অবসর জীবন। বৃদ্ধ ইগো-সেনট্রিক মানুষ। মনে করেন তিনিই সব ভালো বোঝেন। টেলিফোন করে একে-ওকে শেয়ার কেনার পরামর্শ দিতেন। তারা শেয়ারে ইনভেস্ট করে সব টাকা লস করে পথে বসেছে। ইগো-সেনট্রিক বৃদ্ধটিও বেশ টাকা-পয়সা চেনেন। নিজেও জমানো টাকা শেয়ারে ইনভেস্ট করে লস করেছেন। ভাগ্যিস একতলাটা ভাড়া। মাসে ৫০ হাজার টাকা ভাড়া পেলেও অর্ধেকই চলে যায় ধার শোধ করতে।
চাকরির জন্য চাপ দিচ্ছে ফরহাদ। মেহজাবীন বলে, খুঁজছি তো।
মনে মনে বলে, জীবনে আমি চাকরি করব না ফরহাদ। অফিস ভরতি মাংসলোভী কুকুর।
কাজেই মেহজাবীন
অভিমানে অভিমানে
নিজে কে প্রথমে পাথর
তারপর মৃত জেনেছে ।
নিঃসঙ্গ মেহজাবীন আজকাল এই নিদারুণ গ্রীষ্মে ভয়ানক শীতল বোধ করে। যেন ও বিশাল একটা ডিপ ফ্রিজে বন্দি। চারিদিকে কেবল বরফ আর বরফের ধোঁওয়া। কেউ কোথাও নেই। বড় শব্দহীন। বড় বিচ্ছিন্ন। বড় বেদনাদায়ক।
ও আজকাল অনেকটা নিরূপায় হয়েই রেজার কথা ভাবে।
রেজার সঙ্গে বিয়ের আগে পরিচয় ছিল। ঠিক পরিচয় না। প্রেম। মেহজাবীন-এর বিয়ে রেজার সঙ্গেই হত। বিশেষ একটা কারণে হল না। বলা যায় মেহজাবীন এর অনবদ্য নৃত্যপ্রতিভার কারণেই হল না। অর্থাৎ, মেহজাবীন ভালো নাচত বলেই হল না। তার মানে, মেহজাবীন এর প্রতিভাই কাল হয়েছিল।
রেজার সেল নাম্বারটা ওর আজও মনে আছে। মেহজাবীন জানে মেহজাবীন ফোন করে সময় চাইলে রেজা ওকে ঠিকই সময় দেবে। রেজা কর্কট রাশি। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে মেহজাবীনও কর্কট রাশি।
মেহজাবীন একদিন ভীষণ অস্থির বোধ করছিল। শারমীন আপা আর টাকা ধার দিতে চাইছে না। সেদিন ফস করে বলেই বসল, এত টাকা নিচ্ছিস। ফেরৎ দিবি কিভাবে?
কে যেন বুকে তীক্ষ্ম তীর বিদ্ধ করল।
গয়নাও যা ছিল শেষ।
মেহজাবীন চারিদিকে অন্ধকার দেখে।
সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে রেজাকে ফোন করে মেহজাবীন ।
রেজা সময় দেবে বলল। একটা ক্যাফের নাম বলল। সেই ক্যাফেতে অপেক্ষা করবে সে।
অবশেষে প্রতীক্ষা ফুরালো।
ক্যাফেটা কাছেই। মেহজাবীন হেঁটেই যাবে ঠিক করল। তার কারণ আছে। এক. আজকাল টাকার হিসেব করছে ও। দুই. শ্বশুরের গাড়ি নেবে না।
গেটের কাছে ড্রাইভার সাত্তার অবশ্য ওকে দেখে সালাম দিল । সাত্তার জানে না মেহজাবীন- এর চাকরি নেই । জানলেও সালাম দিত হয়তো।
বেলা তিনটের মতন বাজে। মেহজাবীন হাঁটছিল। অনেকদিন পর রেজার সঙ্গে দেখা হবে। ইচ্ছে করেই সাজেনি, তবে কালো রঙের একটা জামদামী পরেছে। না সাজার কারণ আছে। এক। শ্বশুর বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। সাজলে অমূলক সন্দেহ করতেন বৃদ্ধ। ইন্টারভিউ আছে বলে বেরিয়েছে মেহজাবীন ।
দুই। রেজা দেখুক ওর মলিন রূপ। যদি ওর দয়া হয় তো ...
ফুটপাত ধরে হাঁটছিল মেহজাবীন । হাঁটলে ওর সমস্ত শরীর কেমন টলটল করে বাজে। আর ফুটে ওঠে নৃত্যের ছন্দ। বিয়ের আগে মেহজাবীন যখন নাচত ... তখন ওর অনেক সহশিল্পীই ওকে ঈর্ষা করত। ওকে নাচের জগৎ থেকে সরানো জন্য আড়ালে কত যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল তখন । ওর এক ঈর্ষাকাতর সহশিল্পী নাকি বলেছিল, দেখিস বিয়ের পর ও (মেহজাবীন) এমনিতেই সরে যাবে।
তাই তো হল। সে কথা মনে করে মেহজাবীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তবে অরণ্যা হওয়ার পর বেশ মুটিয়েছে। সকালে এক্সসারসাইজ করার সময় পায়নি। অফিসে যেতে হত। তাছাড়া শ্বশুরের জন্য ভোর ছটার মধ্যেই রুটি বানিয়ে রাখতে হয় ...
মেয়েবেলা থেকে মেহজাবীন নাচের তালিম নিয়েছিল বলেই হয়তো ওর হাঁটর সময় এক ধরণের ছন্দ ফুটে ওঠে। এটা আসলে শিল্প। তবে রাস্তার শিল্পান্ধ পুরুষেরা এসব শিল্পটিল্প বোঝে না। তারা ওর শরীরের দিকে লোভী চোখে তাকায়। এসব সময়ে ওর গা রি রি করে ওঠে। এখন অবশ্য লোভার্ত চোখের আঠালো দৃষ্টিতে ও অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ও তো জানেই রাস্তার ওসব শিল্পান্ধ পুরুষরা সানিয়া মির্জার টেনিস খেলা উপভোগ করতে শেখে নি। টেনিসের মাধুর্য-সৌন্দর্য বোঝেনি। তারা সানিয়ার ভারী স্তন দেখে, পুরুষ্ট উরু দেখে ... এভাবে ঘরের ড্রইংরুমকে ছেলেমেয়ের সামনেই নিষিদ্ধ ক্যাবারে ডান্স ক্লাব করে তোলে । হায়।
কিন্তু, রাস্তার ওই শিল্পান্ধ পুরুষদের সঙ্গে আমার বিবিএ/ এমবিএ পাশ করা ব্যাঙ্কার কলিগদের কি পার্থক্য?
পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। রাস্তার শিল্পান্ধ পুরুষেরা আর্ট/ কালচারের বড়াই করে না। আমার ব্যাঙ্কার কলিগরা আর্ট/ কালচার শিক্ষা-দীক্ষার বড়াই করে। তবে তারা এক একটা রুচিহীন পারভার্টস! ... অনায়াসে অশ্লীল কথা উচ্চারণ করত তারা! বাথরুমে যাওয়ার সময় গায়ে হাত দিত। নুড মেয়েদের ছবি দেখাত । পরকীয়া নিয়ে আলোচনা করত। জিজ্ঞেস করত?
সানি লিওনকে কেমন লাগে?
সানি লিওন কে?
আশ্চর্য! সানি লিওনকে চিন না?
পৃথিবীর সবাইকে চিনতে হবে এ কেমন কথা?
ফ্লোরা- মেহজাবীন এর এক কলিগ- সমস্ত আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ওই কামুক বিকৃতরুচির পুরুষদের সঙ্গে সহজ সুখে ভেসে গিয়েছিল।
মেহজাবীন পারেনি।
... কলিগদের মধ্যে আদনান ভাই ... কি অমায়িক। চমৎকার গান করে ... আদনান ভাইয়ের বউ কলি- কী লক্ষ্মী মেয়ে। বাচ্চাদের একটা ইস্কুলে পড়ায়। ওদের একটাই মেয়ে। ভীষন কিউট। নাম অপলা। ছোট্ট অপলাকে নিয়ে ওদের কী সুখের সংসার। কিন্তু, কিন্তু,কলি কি জানে আদনান ভাই একটা পারভার্টস টু দি এক্সট্রিম। মেহজাবীন জানে। অফিসেই মেহজাবীনকে প্যান্টের চেন খুলে শিশ্ন দেখিয়ে আদনান ভাই বলেছিল: ফরহাদের চেয়ে বেশি সুখ পাবি ...আয় ...
ওই দিনই রিজাইন লেটার লিখল মেহজাবীন ...ফরহাদের সম্মানের কথা ভেবেই চাকরিটা না ছেড়ে পারেনি ও ।
আর আমায় আজ ফরহাদ অনাদর করে
মেয়েটাও জন্য আত্মহত্যাও করতে পারছে না ...
এই শহরে আজ ভীষণ গরম।
হাঁটতে হাঁটতে ঘামছিল মেহজাবীন । তবে সে তীব্র খরতাপ আর নোনা ঘাম টের পাচ্ছিল না ও । ও ভাবছিল রেজা কি ওর বউকে নিয়ে সুখি? নাকি ...
রেজার বউয়ের নাম হুমায়রা। হোম ইকোনমিক্সে পড়ত। মেহজাবীন চিনত। হুমায়রা রেজার ছোটবোন তামান্নার সঙ্গে পড়ত।
রেজা ওর বিবাহিত জীবনে সুখি কিনা এই প্রশ্নটা এখন একটা বাজি ধরার মতন ...
হাঁটতে- হাঁটতে গ্রীষ্মের আগুনঝরা অপরাহ্নের রাস্তায় পরপর তিনটি অবাক-করা দৃশ্য দেখল মেহজাবীন:
প্রথম দৃশ্য: ফুটপাতের ওপর পাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে একজন ঘোলা চোখের বৃদ্ধা ভিখিরি বসেছিল । ওর কেউ কি নেই? তাহলে কোণ শক্তিতে একা এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে বৃদ্ধা ?
দ্বিতীয় দৃশ্য: কালো রঙের টি-শার্ট পরা ঝাঁকড়া চুলের এক তরুণ ... তরুণের হাতে ঠান্ডা মিনারেল ওয়াটারের বড় একটা বোতল ...পানি খেতে খেতে হঠাৎ বাকিটা এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার মাথায় ঢেলে দিল সে । বৃদ্ধের সে কি হাসি ...
তৃতীয় দৃশ্য: রাস্তার ধারে একটা তৃষ্ণার্ত কুকুর দাঁড়িয়েছিল। তৃষ্ণার্ত জিভ লক লক করছিল। একটা মধ্যবয়েসি মহিলা আসছিল। মহিলার হাতে সাদা একটা ক্যান। কুকুরকে দেখে মহিলা দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর রাস্তায় পড়ে থাকা একটা পাত্রে ক্যান থেকে পানি ঢালে। তারপর হাঁটতে থাকে ।পিছনে তাকায় না। কুকুর পানি খায় ...
দৃশ্য তিনটে দেখে বুকের ভিতর কী রকম আলোরণ টের পেল মেহজাবীন । এমন অদ্ভূত সব রাস্তার দৃশ্য আগে দেখেনি ও । এর আগে এমন ভাবে রাস্তার মানুষের দিকে তাকায়ওনি ও। আসলে তাকানোর অবকাশও পায়নি। হৃদয়ে তেমন তীব্র দুঃখ ছিল না বলেই হয়তো। শুধু রেজা ওর জীবন থেকে হারিয়ে গেলে ভীষণ দুঃখ পেয়েছিল ও। কেউ টের পাবে না বলে গভীর রাতে কাঁদত। তবে তখনই ওই বিখ্যাত প্রাইভেট ব্যাঙ্কটি চাকরিটা হয়ে যাওয়াতে দুঃখ কিংবা বিরহ সারাদিনের ব্যস্ততার ফলে অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছিল। নামকরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়ে ভালো লাগছিল। ফেসবুকে ও নতুন চাকরির কথা জানিয়েছিল। তারপরই তো বিয়ে হয়। ফরহাদের বলিষ্ট পুরুষশরীর। সে শরীরে কত সুখ; সুখ আর সুখ ... সত্যি ভুলে গেছিল রেজাকে। মাঝেমাঝে কেবল মনে পড়ত ...
ক্যাফেতে ঢোকার আগে সেলফোনটা অফ করে দিল মেহজাবীন । ফরহাদ পরে যা বলার বলুক। হারানোর আর কি আছে। ক্যাফের নাম: ক্যাফে হিমি। ভিতরে মৃদু আলো জ্বলেছিল। মোটামুটি ফাঁকাই আছে। একেবারে পিছনের টেবিলে বসল। যে টেবিলে মেহজাবীন ইউনিভারসিটি জীবনে ওর বন্ধুদের নিয়ে বসত। সে কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। বন্ধুদের সঙ্গে মাঝেমাঝে টেলিফোনে কথা হয়। আর ফেসবুকে ...
কফির অর্ডার দিল ও । রেজা কখন আসে। আসবে তো? না আসবে না। মেহজাবীন জানে রেজা আসবে। রেজার তো কোনও দোষ ছিল না। তাহলে দোষ কার? মনে পড়ে ... উড়িষ্যা থেকে তখন নৃত্যশিল্পী ইন্দ্রাণী রেহমান এসেছিলেন ঢাকায়। মেহজাবীন-এর নাচ দেখে ভীষন মুগ্ধ, ভীষন উচ্ছ্বসিত। মেহজাবীন কে জড়িয়ে ধরে ইন্দ্রাণী রেহমান বললেন, আমি তোমায় উড়িষ্যা নিয়ে যাব। ওখানে সবাইকে বলব, দ্যাখো উদয়শঙ্করের দেশের মেয়েরা আজও কী ভাবে নাচ ধরে রেখেছে। তখন রেজার সঙ্গে বিয়ের কথা চলছিল। তখনও ব্যাঙ্কে চাকরিটা হয়নি। মেহজাবীন ইন্দ্রাণী রেহমান এর সঙ্গে উড়িষ্যায় চলে গেল। রেজা কথাটা ওর মা/বাবাকে বলেছিল। বলতেই রেজার মা/বাবা বেঁকে বসল। কি! মেহজাবীন ইনডিয়া গেছে?
হ্যাঁ।
একা?
হ্যাঁ। একা। তো?
তো এই বিয়ে হবে না। ও মেয়েকে আমরা কিছুতেই ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেব না।
রেজা এল। ঠিক সাড়ে চারটায়। রেজাকে দেখে মেহজাবীন ভীষণ অস্থির বোধ করে। মনে হচ্ছিল যে সেন্সলেস হয়ে যাবে। শরীর এমন কাঁপছিল। পায়ের তলার মেঝে কেঁপে উঠল কি? নাকি শহরে এই মুহূর্তে ভূমিকম্প হচ্ছে?
রেজার পরনে কালো পাঞ্জাবি; শ্যামলা চেহারা। ভারী মিষ্টি মুখ। চোখে চশমা। ওই সময়টায় তুখোর সেতার বাজাত রেজা। কলকাতায় পন্ডিত ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের কাছে পাঁচ বছর তালিম নিয়েছিল। এটাই ছিল রেজার প্রতি আকষর্ণের অন্যতম একটা কারণ। তখন অনেক পুরুষই তো মেহজাবীন -এর আশেপাশে ঘুরঘুর করত তখন। তাদের মধ্যে শিল্পপতির ছেলেও ছিল। স্মার্ট। সুদর্শন। অন্তসারশূন্য।
রেজা বসে। বসে ম্লান হাসল। মেহজাবীন বলে, তুমি কেমন আছো?
রেজা বলে, ভালো। তুমি?
মেহজাবীন বলে, আমি ভালো (তুমি জান না আমি কেমন আছি) এত শুকিয়ে গেছ কেন?
রেজা ম্লান হাসে।তারপর উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, এ কি! তোমার মুখে অমন দাগ কিসের?
ম্লান হাসল মেহজাবীন। চুপ করে রইল। মনে মনে বলল, দাগের কথা বলা যাবে না। এ হল চাঁদের কলঙ্ক। বরং বলল, সেতার বাজাও তো?
না। আজকাল তেমন সময় পাই না। অফিস। বলে হাসল রেজা।
তারে জং ধরে গেছে বুঝি? বলে হাসল মেহজাবীন।
না, জং ধরেনি। হুমায়রা রোজ সেতার মুছে।
মেহজাবীন এই প্রথম টের পেল সুতীক্ষ্ম ছোরা বুকে বসিয়ে দিলে কী রকম যন্ত্রণা হয় ...
কথাটা রেজা ইচ্ছে করে বলেনি। বললে এই মুহূর্তেই মরেই যেত মেহজাবীন ....
ভীষন ভীষন ভালো লাগছিল রেজা মুখোমুখি বসে থাকতে। ভীষন ভালো লাগছিল। ভীষন ...
রেজা তারপর কফি খেতে খেতে একটা ভয়ানক দুঃসবাদ দিল।ও আর হুমায়রা বিদেশ চলে যাচ্ছে। নিউজিল্যান্ড। ওখানে হুমায়রার এক নিঃসঙ্গ নিঃসন্তান বৃদ্ধ মামার বাড়ি। রেজা বলল, তিনি চান আমরা ওখানে সেটল করি। বাবা-মাও বেঁচে নেই যখন ...আমরা নেক্সট মান্থেই চলে যাচ্ছি ...
ওহ্!
মেহজাবীন অলখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তারপর রেজার ফোন বাজল। ফোনে কথা বলে। তারপর ফোন অফ করে বলে, সরি। আমাকে এখুনি যেতে হবে। বস খোঁজ করছেন। বোঝোই তো চাকরি ছাড়াও আগে সব বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে।
তারপর রেজা কখন চলে গেল।
মেহজাবীন বসে থাকে। বসেই থাকে। কেবল একবার ভাবল রেজাকে অফিস আওয়ারে আসতে বলা উচিত হয়নি। শুক্র কিংবা শনিবারে দেখা করলেই হত। ওহো ওই দিনগুলি তো হুমায়রার।
মেহজাবীন আরও অনেক অনেক ক্ষণ বসে থাকে। তারপর উঠে দাঁড়ায়। ভাবছিল বাইরে শীতল হাওয়ার স্পর্শ পাবে । আকাশ ভরতি মেঘ। তারপর বৃষ্টি পড়বে । না। সেরকম কিছু তো হল না। ও ক্যাফের বাইরে দাঁড়াতেই গরম হাওয়ার ঝাপটা পেল। কি আর করা। ও হাঁটতে থাকে । কেমন একটা ঘোরের মধ্যে। অনেক ক্ষণ ধরে হাঁটল। চেতনাশূন্য। তারপর কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ওর কেবলই মনে হচ্ছে ওর পৃথিবী দ্রুত কেমন বদলে যাচ্ছে। নইলে এই গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় কুয়াশা ঘনিয়ে উঠবে কেন? ঘন কুয়াশার জন্য রাস্তার কারও মুখ দেখা যায় না। কেবল চলাচল অনুভব করা যায়। পোড়া ডিজেলের গন্ধমাখা অকাল কুয়াশায় মেহজাবীন হাঁটতে থাকে। হাঁটতে-হাঁটতে ও ভাবছিল আবারও নাচের জগতে ফিরে যাবে কি না। একা একা মেয়েকে নিয়ে বাঁচাটা কঠিন হবে কিনা ...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




