somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুফিবাদ: সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (প্রথম পর্ব)

০৩ রা জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুফিবাদ নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। সে কারণেই এই বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখার ইচ্ছে হল। তথ্যের জন্য একান্তভাবে নির্ভর করেছি ড. মুহম্মদ এনামুল হক- এর বিখ্যাত ‘বঙ্গে স্বূফী প্রভাব’ বইটির ওপর । সুফিবাদের ওপর ড. মুহম্মদ এনামুল হক- এর গভীর পন্ডিত্যের কথা বাঙালি পাঠক অবহিত। তাঁর তথ্যবহুল ‘বঙ্গে স্বূফী প্রভাব’ বইটিও আকর গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। যদিও ড.মুহম্মদ এনামুল হক ‘সুফি’ বানানটি লিখেছেন ‘স্বূফী’ । কিন্তু, আমরা সুফি-ই লিখব।ড. মুহম্মদ এনামুল হক অন্যান্য অনেক ইসলামি পরিভাষার বানানও ফারসি উচ্চারণে লিখেছেন। যেমন, অদৃশ্যবস্তু কে ‘ঘয়ব’ লিখেছেন। কিন্তু, আমরা লিখব ‘গায়েব’। আমরা আমাদের পরিচিত এবং জানা বানানই লিখব।
সে যা হোক। এক কথায় সুফিবাদ হল ইসলামের মরমি (এই মরমি বানানটি অশুদ্ধ নয়) ভাষ্য, যা বাংলাদেশে ‘মারেফাত’ নাম পরিচিত। শরিয়ত বাংলাদেশে একটি বহুল পরিচিত শব্দ।শরিয়ত হল ইসলামের কর্মমূখী/আচরণবাদী দিক। আর মারেফাত হল ইসলামের মর্মমুখী বা মরমি দিক। তবে সুফি মতবাদটি ঠিক মৌলিক নয়; তার মানে ইসলামের এই মরমি মতবাদটির উদ্ভবের পরে সুফিবাদের ওপর প্রথমে পারস্য এবং পরবর্তীকালে ভারতীয় সভ্যতার অনিবার্য প্রভাব পড়েছিল। যার ফলে সুফিরা ইসলামী বিশ্বাস থেকে সরে এসেছেন বলে সুফিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামী শাস্ত্রবাদী ওলেমারা সংস্কার অন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, যে কারণে অনেক সুফির জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তবে সুফিবাদের অগ্রগতি ও বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়নি। মতবাদটি দুর্বার গতিতে প্রথমে পারস্যে, পরবর্তীকালে পারস্য থেকে উত্তর ভারতে এবং উত্তর ভারত থেকে বাংলায় এসে পৌঁছেছিল। কি ছিল সেই মরমি সুফিদের প্রাণশক্তির উৎস? এসব প্রশ্নে আজও আমরা বিস্মিত হই। পাশাপাশি বিচিত্র সুফি মতবাদের কারণে আজও সুফিবাদ নিয়ে আমাদের কৌতূহলের যেন কমতি নেই।
তবে সুফিবাদ নিয়ে বির্তকও কম নেই। এসব সত্ত্বেও বাংলার জনসমাজে প্রায় হাজার বছর ধরে মতবাদটি দারুন জনপ্রিয় ও গ্রহণীয়। বাংলার সুফি-দরবেশদের চিন্তাধারা আজও বাঙালি মুসলমানের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে।
সুফিবাদের উদ্ভব আরবে, বলা যায় ইসলামের অভ্যূদয় লগ্নে। প্রাথমিক যুগের সুফিদের অনুপ্রেরণা ছিল কোরান শরীফের বিশেষ বিশেষ আয়াত। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই আদি সুফিমত অনেকটাই বিকৃত হয়ে পড়েছিল এবং সর্বশ্বেরবাদী ধ্যানধারনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। এরপর প্রথমে পারস্যে, তারপর ভারতবর্ষে এবং পরবর্তীকালে মধ্যযুগের বাংলার সুপ্রাচীন যোগ ও তন্ত্রের প্রভাবে সুফিবাদ ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এভাবে উদ্ভব ঘটেছিল "লৌকিক ইসলাম" এর; যার মূলে রয়েছে ‘বেদাত’‘শিরক’-এর মতো ইসলামবিরোধী ধ্যানধারণা। অপরদিকে সুফিবাদের জাতপাত, বর্ণ, শ্রেণি এবং সাম্যবাদী ধ্যানধারণা গৌড়িয় বৈষ্ণব মঠের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল; প্রভাবিত করেছিল বাংলার বাউলদর্শনকেও । পরিশেষে সুফিবাদ থেকে বাংলায় উদ্ভব ঘটে পীরবাদ- যা ইসলামের আমূল বিকৃতি। এসব বিষয়ই ড.মুহম্মদ এনামুল হক- এর ‘বঙ্গে স্বূফী প্রভাব’ বইটির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা এই ধারাবাহিক পোস্টে থাকবে । এবং এই প্রথম পর্বের আলোচনার বিষয় সুফিবাদের উত্থান পর্বের ইতিবৃত্ত।
কিন্তু, সুফি শব্দটির উদ্ভব হল কিভাবে?
এই প্রশ্নটির মীমাংশা বেশ জটিল। কেননা, গবেষকগণ এ বিষয়ে একমত নন। কারও মতে ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে সমস্ত দরিদ্র মুসল্লী মসজিদের প্রাঙ্গনে বসে নামাজীদের কাছ থেকে ভিক্ষাগ্রহন করতেন তারাই সুফি। অন্যমত হল: গ্রিক Philosophos (প্রজ্ঞাপ্রিয়) শব্দের আরবি অপভ্রংশ হল ‘ফয়লসূফ’; এর মানে দার্শনিক। অর্থাৎ, ‘ফয়লসূফ’ শব্দ থেকে সুফি শব্দের উৎপত্তি। অন্যরা বলেন: গ্রিক Philosophos শব্দ থেকে নয় গ্রিক Sophisma শব্দ থেকেই সুফি শব্দটির উদ্ভব। সফিসমা বা জ্ঞান শব্দের আরবি অপভ্রংস হল সফসত্বী-এর অর্থ: ‘ভ্রান্তকূটতার্কিক’। ধর্মের ক্ষেত্রে বিপথগামী হয়ে যারা কূটতর্ক করে তারাই ‘সুফি’। তবে বেশিরভাগ আরবি পন্ডিতদের মতে আরবি ‘ইসমু-জামিদ’ শব্দ থেকে সুফি শব্দটির উদ্ভব। এই ‘ইসমু-জামিদ’ শব্দের মূলে রয়েছে ‘স্বূফ’‘ইসমু-জামিদ’ শব্দের অর্থ: পশম। এসব পন্ডিতদের মত হল-ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে সব উদাসীন মানুষ পশমের জামা পরে সংসার থেকে নির্লিপ্ত থাকবার চেস্টা করতেন তারাই ‘সুফি’। এঁরা পশমী জামা পরিধান করতেন। আরবের অধিবাসীরা তাদের বলত ‘পশমী জামা পরিধানকারী’ । ইসলামের প্রাথমিক যুগে পশমী পোশাক ছিল অনাসক্তি ও ভোগবিলাস বিরোধী প্রতীক। সাম্যবাদী খলিফা উমর (র) পরতেন লম্বা ঢোলা পশমী জোব্বা ।
আমরা জানি মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ) ও চার খলিফার শাসনব্যবস্থার অবসানের পর ইসলামী বিশ্বে রাজতন্ত্রের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে বিলাসিতা, আড়ম্বর ও ধনদৌলতের প্রতি আসক্তি অত্যধিক বেড়ে গিয়েছিল। সেই সময়ই একদল সৎ, উদাসীন ও আল্লাহভক্ত মানুষ নিজেদের এসব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁরা সাদাসিদে পশমের পোশাক পরতেন। তারা অনেকটা নিরবেই বিলাসিতা, আড়ম্বর ও সংসার আসক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মূখর হয়ে উঠেছিলেন। ইসলামী সমাজে আগের যুগের সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণা ফিরিয়ে আনার জন্যেই সেই সব ত্যাগী আর সৎ মানুষদের অনেকটা বাধ্য হয়েই একটা মরমি আদর্শ দাঁড় করাতে হয়েছিল। সেসময় তাদের বলা হল সুফি বা ‘পশমী জামা পরিধানকারী।’
সুফি শব্দের উদ্ভবের বিষয়টি তো জানা গেল। কিন্তু সুফি মতবাদের উদ্ভব কিভাবে হয়েছিল? এই বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আসলে সুফি মতবাদ হল মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাধারা ও মরমী জ্ঞানের স্ফূরণস্বরূপ। সভ্যতার উন্মেষলগ্ন থেকেই মানুষের এক্সটারনাল বা বাহ্যিক জ্ঞান বিকাশ লাভ করেছিল। তারই পাশাপাশি অতি স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মরমি চেতনারও বিকাশ হয়েছিল। তার কারণ মানুষ চিরদিনই অজানা অদৃশ্যলো সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করতে চেয়েছে। দৃশ্যের ওপারের দৃশ্য দেখার নেশা মানুষের বরাবরের। অজানা অনন্তকে জানার এই যে অনন্ত প্রয়াস এটি মানুষের হৃদয়ে সদা জাগরূকই থাকে । এটি মানুষের এক স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ড.মুহম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘বঙ্গে স্বূফী প্রভাব’ বইয়ে লিখেছেন: ‘স্বূফী-মতবাদ উদ্ভবের মূলেও ঠিক এমনই একটি তীব্র প্রেরণার অনুভূতির সন্ধান আমরা পাইয়াছি। (পৃষ্ঠা:২৬)
প্রতিটি নতুন ধর্মেই দুটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। একটি হল নবীন ধর্মটি মানুষকে মরমি চৈতন্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তাকে ঐশি প্রেরণায় অনুপ্রাণিত করে। দ্বিতীয়টি হল-নবীন ধর্মটি মানুষের কর্মমুখী প্রবনতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে কর্মশীল করে বাস্তবাদী সামাজিক জ্ঞানের পথে তাকে পরিচালিত করে। একটি নবীন ধর্ম হিসেবে ইসলামের ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছিল। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ) ও চার খলিফার শাসনব্যবস্থার সময় এই দুটি প্রবণার চমৎকার ভারসাম্য আমরা লক্ষ্য করি। কিন্তু, মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ) ও চার খলিফার শাসনব্যবস্থার অবসানের পর আরবদের মধ্যে কর্মমূখী দিকটিই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এবং আরবদের বাস্তববাদী পদক্ষেপগুলি যেন আরব চেতনার অর্ন্তগত মরমি চেতনাকে গ্রাস করতে উদ্যত হল। ফলে এই অপ্রত্যাশিত ভারসাম্যহীনতার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই পশমী জামা পরিধানকারীদের অর্ন্তমূখি মরমি মতবাদ বা সুফিবাদের উদ্ভব ঘটে।
মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতায় সাধকপুরুষদের আবির্ভাব ঘটেছে। বিশ্বের সকল সাধু ও সুফিদের লক্ষ অভিন্ন। অজানার সন্ধানে ছুটে চলা, অজ্ঞাতকে বোধের সীমানায় নিয়ে আসা। কিন্তু এই সব সাধুসন্তদের সঙ্গে আরব সুফিদের পার্থক্য কোথায়? আরব সুফিদের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য সাধুসন্তদের পার্থক্য আসলে সাধনপদ্ধতিতে বা বলা যায় পার্থক্যটি মার্গজ। সাধনাপদ্ধতির পার্থক্যের কারণ হল বিশেষ সামাজিক পরিবেশ। প্রাথমিক যুগের সুফিরা আরব-উদ্ভূত, আরব-জাত। প্রাথমিক যুগের সুফিরা মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ) এবং চার খলিফার সাদাসিদে জীবনাদর্শ অনুসরণ করতেন। যে কারণে সেই সব সুফিদের জীবন ছিল পবিত্র। ওই সময়কার কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সুফিসাধক হলেন: হাসান বসরি (মৃত্যু ৭২৮:খ্রিস্টাব্দ); রাবেয়া বসরি (মৃত্যু: ৭৫৩ খ্রিস্টাব্দ); ইব্রাহীম ইবনে আদম (মৃত্যু: ৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ); আবু হাশিম (মৃত্যু ৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ);মারূফ করখী (মৃত্যু: ৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রমূখ। এদের নাম আজও ইসলামি বিশ্বে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় এবং এক পবিত্র ছবি ভেসে ওঠে। এরা সবাই ছিলেন আরববাসী । এঁরা ইসলামের আওতার মধ্যে থেকেই ইসলামের মরমি দিক বা তরিকত বা সুফিসাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন । অবশ্য এঁদের মধ্যে ভাবের প্রবল্য ছিল। তার কারণ ছিল। এঁরা কর্ম কোলাহল মূখর কর্মমুখী জীবন পরিত্যাগ করে মরমি-নির্জন জীবনে অত্যধিক ঝুঁকে পড়েছিলেন। এই সুফিদের মধ্যে নবম শতক অবধি নতুন কোনও চিন্তার স্ফূরণ ঘটেনি। হয়নি। আদি সুফিবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল- আরবের সুফি আন্দোলন একেবারেই সংগঠিত ছিল না। কেননা, সুফিদের মরমিসাধনা ছিল একান্তই ব্যক্তিগত। সুফিরা নিজস্ব ধারণা অবলম্বন করে সাধনা করতেন। এই জন্যেই বিশিষ্ট সুফিদের সাধনপদ্ধতি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
আরববিশ্বে একচ্ছত্র রাজতান্ত্রিক আধিপত্য ও ভোগবিলাসে দরুনই সম্ভবত খ্রিস্টীয় নবম শতকের প্রথম ভাগ থেকে সুফিদের মধ্যে বৈরাগ্য ও অনাসক্তির ভাব প্রবল হয়ে ওঠে। ইসলাম যদিও বৈরাগ্য ও অনাসক্তির অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেয়নি কখনও। তবুও ইসলামের পরিধীর মধ্যে থেকেই সুফিবাদের আওতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে সুফি মতবাদ আরবের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ছিল। বিখ্যাত সুফিরা সুফিতত্ত্বের ব্যাখ্যা বয়ান করছিলেন। এভাবে দশম শতাব্দীর মধ্যেই সুফিমত একটি নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে।
কিন্তু, ওই যুগের সুফিরা কি ব্যাখ্যা বয়ান করতেন?
তারা বলতেন যে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ) তাঁর জামাতা ও বন্ধু হযরত আলী (রা) কে গুপ্তজ্ঞান বা ইলমু-ল-মরফত (Esoteric Knowledge) দান করেছিলেন । তাঁরা আরও বলতেন: মহানবী তাঁর জীবদ্দশায় সত্তর জন লোক কে এ বিষয়ে দীক্ষা দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে চারজনকে ইলমু-ল-মরফত- এর শিক্ষা প্রচার করার জন্য খলিফা বা প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিলেন। এর পর সুফি মতবাদ এই চারজন খলিফার মাধ্যমে আরব জাহানে ছড়িয়ে পড়েছিল। ড.মুহম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘বঙ্গে স্বূফী প্রভাব’ বইয়ে লিখেছেন: ‘এই সকল কথার কোনই ঐতিহাসিক সত্যতা নাই।’ (পৃষ্ঠা, ৩০) সুফিরা আরও বলতেন যে, মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ) এর শিক্ষায় ইসলামের বাহ্যিক আচার আচরণ ও নিয়মকানুন ছাড়াও একটি গুপ্তজ্ঞানের দিক ছিল। সমাজ রাষ্ট্র ও নীতির কথা প্রচার করলেও মহানবী এই গুপ্তজ্ঞানের বিষয়টি একেবারেই আড়ালে রাখেননি। কারণ কোরান শরীফেও এই গুপ্তজ্ঞানের বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে তৎকালীন সুফিরা কোরান শরীফের বিশেষ ছয়টি আয়াতের কথা বলেন। যেমন সূরা বাকারার ১৫১ সংখ্যক আয়াত -

‘আমি তোমাদের মধ্যে তোমাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছি, যে আমার আয়াত (বাক্য) সমূহ তোমাদের কাঠে পাঠ করে, তোমাদের পবিত্র করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়। এবং তোমরা যা জানতে না তা শিক্ষা দেয়।’

দ্বিতীয় আয়াতটিও সুরা বাকারার ৩নং আয়াত-

‘যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, যথাযথভাবে নামাজ পড়ে ও তাদের যা দান করেছি তা হতে ব্যয় করে।’

তৃতীয় আয়াতটি কোরান শরীফের চতুর্বিংশ সূরা নূর- এর ৩৫ সংখ্যক আয়াত -

‘আল্লাহই আকাশমন্ডলী এবং পৃথিবীর জ্যোতি (নূর)’।

চতুর্থ আয়াতটি কোরান শরীফের ৫০ সূরা নং সুরা ক্বাফ-এর ১৬ সংখ্যক আয়াত -

‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার অন্তরের নিভৃত কু-চিন্তা সম্বন্ধে আমি অবহিত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর।’

পঞ্চম ও ষষ্ট আয়াত দুটি কোরান শরীফের ৫১ নং সূরা যারিয়ার ২০ ও ২১ নং আয়াত-

২০. নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে নিদর্শন রয়েছে। এবং
২১. এবং তোমাদের মধ্যেও । তোমরা কি অনুধাবন করবে না।

(আমি আয়াতসমূহের বাংলা অনুবাদ নিয়েছি মাওলানা মোবারক করীম জওহর-এর অনুবাদ করা ‌"কুরআন শারীফ" থেকে। হরফ প্রকাশনী। কলিকাতা।)

কাজেই কোরান শরীফের বিশেষ বিশেষ আয়াতের ব্যাখ্যা বয়ানের ওপরই পরবর্তীকালের সুফিমত একটা কোরানিক ভিত্তি লাভ করে। এবং এই ছয়টি আয়াতের গভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন অব্যাহত থাকে। তাতে সুফি-পরিমন্ডলে নতুন এক চিন্তার উদ্ভব ঘটে। যেমন: কোরান শরীফের আয়াতে উজ্জীবিত হয়ে সুফিরা অদৃশ্য বস্তু বা ঘয়ব (গায়েব)- এর সঙ্গে মিলন এবং তার মধ্যে বিলীন (ফানা) হয়ে যেতে আকূল হয়ে ওঠেন। এই বিলীন হওয়ার জন্য সুফিরা চারটি পর্যায় নির্দিষ্ট করেন।

১. ইমান। (অদৃশ্য বস্তুতে বিশ্বাস)
২. তলব। (অদৃশ্য বস্তুর অনুসন্ধান)
৩. ইরফান। (অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ)
৪. ফানা। (অদৃশ্য বস্তুতে বিলীন।)

এভাবে, আমরা লক্ষ্য করি যে- সুফিচিন্তা আদি পর্যায় থেকে একটি নির্দিষ্ট রূপ পেল। প্রথমতঃ সূফিকে গায়েবে পরিপূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। এই দৃশ্যমান জগৎ ও বস্তুর বাইরে সাধারণ জ্ঞানের অগোচরে আরও এমন এক জগৎ আছে যা বলা হল ‘আলিমুল গায়েব’। সুফিরা বললেন, আলিমুল গায়েব সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন না করতে পারলে মানুষের জ্ঞান অপূর্ণ রয়ে যায়। কাজেই আলিমুল গায়েব- এর অনুসন্ধান হয়ে উঠল অনিবার্য। তবে সে সন্ধান দূরবর্তী ধূ ধূ প্রান্তরে কিম্বা দূর্গম পার্বত্য শিখরে আবশ্যক নয়। কেন নয়? কেননা, সুফিরা কোরান শরীফের ৫০ সূরা নং সুরা ক্বাফ -এর ১৬ সংখ্যক আয়াত উল্লেখ করলেন। যে আয়াতে আছে-‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার অন্তরের নিভৃত কু-চিন্তা সম্বন্ধে আমি অবহিত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর।’ কাজেই, এই পৃথিবীতে এমনকী মানবদেহে সেই অনামা অদৃশ্যের পরিস্ফূট চিহ্ন বর্তমান। পাশাপাশি সুফিরা কোরান শরীফের সূরা গাষীয়াহ্- র বিশেষ পাঁচটি আয়াত উল্লেখ করলেন। যে আয়াতে আছে- ‘তবে কি ওরা লক্ষ্য করে না উষ্ট্র কিভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে? কিভাবে আকাশ ঊর্ধ্বে স্থাপিত হয়েছে; পর্বতমালা কিভাবে সংস্থাপিত হয়েছে? এবং ভূতলকে কিভাবে সমতল করা হয়েছে? অতএব তুমি উপদেশ দাও। তুমি তো শুধু একজন উপদেষ্টা। ’(আয়াত ১৭-২১) এই আয়াতের ওপর সুফিরা বললেন, এই দৃশ্যমান জগতের সৃষ্টিরহস্যের ভিতর দিয়ে সেই আলিমুল গায়েব-এর ইঙ্গিত, ইশারা ও অভিব্যাক্তির আভাস বুঝত হবে। যে ব্যাখ্যা-বয়ান সুফিবাদকে সর্বেশ্বরবাদ বা Pantheism এর ধারণায় পৌঁছে দিয়েছিল। সুফিবাদের প্রাথমিক যুগে সুফি মতবাদটি সর্বেশ্বরবাদী হয়ে উঠেছিল বলেই আমরা সর্বেশ্বরবাদ বা Pantheism -এর বিস্তারিত সংজ্ঞাটি পাঠ করব।

Pantheism, doctrine that identifies the universe (Greek pan, “all”) with God (Greek theos). The thinker may start from an awareness of the divine reality and then begin to speculate on the relationship of the nondivine to the divine; this position is commonly called acosmic pantheism. Conversely, the thinker may start from an apprehension of the full reality of finite, changing entities and give the name God to their all-inclusive totality; this is called cosmic pantheism.(সূত্র: Microsoft ® Encarta ® 2008. © 1993-2007 Microsoft Corporation. All rights reserved.)


কোরান শরীফের বিশেষ কয়েকটি আয়াতের ওপর সুফিরা এই সিদ্ধান্ত নিলেন যে আল্লাহ বুঝি এই দৃশ্যমান জগতে ব্যাপ্ত, একে ছাড়িয়ে নন। আল্লাহ এই দৃশ্যমান জগতের ভিতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। কাজেই দৃশ্যমান জগতের বাইরে আল্লাহর নিজস্ব অস্তিত্ব নেই, নিজেকে প্রকাশ করতে আল্লাহর দৃশ্যমান জগতের দরকার। মনে হল অদৃশ্য বস্তু বা আলিমুল গায়েব আর গায়েব নাই, চোখের সামনে চলে এসেছে। এই অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ড.মুহম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘বঙ্গে স্বূফী প্রভাব’ বইয়ে লিখেছেন, ‘হঠাৎ তাঁহার জ্ঞাননেত্র খুলিয়া যায়-তিনি তাহাকে যাবতীয় সৃষ্টির মধেও তাহার বাহিরে সর্বত্র বিরাজিত অবস্থায় প্রত্যক্ষভাবে দেখিতে পান, প্রত্যক্ষভাবে বুঝিতে পারেন ও প্রত্যক্ষভাবে উপলব্দি করিতে পারেন। ইহাই ইরফান বা জ্ঞানলাভ বা বোধিলাভের অবস্থা।’ (পৃষ্ঠা, ৩৩)
সুফি অদৃশ্য ও দৃশ্য বস্তুর মধ্যে কোনও প্রভেদ বোধ করেন না। এমনকী নিজের অস্তিত্বও বিস্মৃত হন। সুফি নিজেই অদৃশ্য বস্তুতে বিলীন হয়ে যান। এই অবস্থায় অনেক সুফিই আমিই সত্য আমিই সুন্দর আমিই শাশ্বত বা আনাল হক-এমন সব অসাধারণ বাক্য অচৈতন্য অবস্থায় বলে ফেলেন। কোরান শরীফে আছে, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইয়াহি রাজিউন।’ (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁহার নিকট ফিরিয়া যাইব। ) এই কারণে প্রশ্ন ওঠে-মানুষ মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে ফিরে আল্লাহর কাছে বিলীন হবে? না আল্লাহর কাছে বিলীন না হয়ে মানুষ অন্য কোথাও অবস্থান করবে? মুসলিম শাস্ত্রবিদগণ অবশ্য বলেন, মানবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিশতে পারে না। মানুষের জন্য সিজ্জীনইল্লীন নামে আলাদা বাসস্থান আছে। কেয়ামতের পর মানুষের আত্মা বেহেস্ত বা দোজখে যাবে। বেহেস্তবাসী মাঝেমাঝে আল্লাহর দর্শন পাবে। এসব মত উপেক্ষা করে সুফিরা বলেন, মানবাত্মা পরমাত্মা থেকে উদ্ভূত। সে কারণে মানুষ মূলের (আস্বল=আসল) সঙ্গে না মিশে পারে না। মানবাত্মা পরমাত্মাতে বিলীন হয়েই অবস্থান করবে। এভাবে মানবাত্মা পরমাত্মায় নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে মিশে যাওয়াকে সুফিবাদের পরিভাষায় বলা হয় ‘বক্বা বিল্লাহ’ বা আল্লায় স্থায়িত্ব প্রাপ্তি। সুফিদের মতে ফানা হল অহংবোধের বিলুপ্তি আর ‘বক্বা বিল্লাহ’ হল আল্লায় স্থায়ীভাবে বিলীন হওয়া।

ক্রমশ...
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:৩৯
৪৬টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×