‘কৃষ্ণ দিলায় রাধার গলে/রাধায় দিলা কৃষ্ণর গলে/আনন্দে সখীগণ নাচে/ দেখিয়া প্রেমের খেলা।’ হযরত সুফি শাহ আরকুম আলী (র.)
আরকুম শাহ ১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসের এক কুয়াশাময় ভোরে সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ।দিনটি ছিল আশ্বিন মাসের শেষ দিন; নদীর শীত-জড়ানো শীতল বাতাসে বৃদ্ধের ষাট বছরের শরীরটি একবার কেঁপে উঠল যেন। নদীর ওপরে ঘন কুয়াশার একটি চাদর বিছানো। নদীর ওই পাড়ে কাজিরবাজার; কুয়াশার চাদর ভেদ করে দেখা যায় না। রোদও এখনও ফুটে ওঠেনি। ধূসর কুয়াশার কারণে নদীতে নৌকাও চোখে পড়ে না। কেবল পিছনের চালতাবাগান থেকে পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যায়। চালতাবাগানের ভিতর দিয়ে সরু একটি পথ। তারপর ঘন বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় পেরিয়ে একটা পানা পুকুরের ধারে ধরাধরপুর গ্রামের বায়তুল জান্নাহ জামে মসজিদ। ফজরের নামাজ শেষ করে তসবি হাতে নদীপাড়ে এসেছেন আরকুম শাহ। বৃদ্ধ প্রতিদিন ভোরেই সুরমাপাড়ে এসে দাঁড়ান।
বৃদ্ধের পরনে কালো রঙের দীর্ঘ একটি আলখাল্লা। তার ওপর একটি পুরনো তসরের চাদর। মরমি গানের সাধক হিসেবে আরকুম শাহর নামডাক আছে সুরমা নদীর দুই পাড়ে, সিলেট অঞ্চলে। বরই কান্দির ভক্ত আবদুল জব্বার বড় শখ কইরা দিসিল এই চাদরখানা।
বৃদ্ধ বেশ লম্বা, তাঁর গায়ের রং তামাটে। মাথায় কিস্তি টুপি। মুখ ভরতি দরবেশদের মতন পাকা লম্বা দাড়ি। তবে বৃদ্ধকে কেমন এই মুহূর্তে কেমন বিষন্ন দেখায়। আজ শেষ রাত্রির খোয়াবে পির সাহেবকে দেখা দিয়াছেন। মন এই কারণেই হয়তো বিমর্ষ ...
আরকুম শাহর পিরের নাম শাহ আবদুল লতিফ। পীর ছাহেব বছর দশেক হইল ইন্তেকাল করিয়াছেন। পিরকে অত্যন্ত ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন আরকুম শাহ। পিরের কাছেই বাতেনি-মারাফতের জ্ঞান লাভ করেছেন বৃদ্ধ। একমাত্র মরমি কাব্যগ্রন্থ ‘হকিকতে সিতারা’ পিরের স্মরণেই লিখেছেন। সে বইতে লেখা আছে: ‘মুর্শিদ ধরিও কান্ডার/ অবুঝা বালাকের নৌকা ডুবিব তোমার।’ ...
অনেক কাল হইল পির সাহেব শাহ আবদুল লতিফ তাঁর চিল্লাখানায় বসিয়া আল্লাহতালার শান ও সিফাত বর্ণনা করতেছিলেন। উনিশ শো চব্বিশ সালের ঘটনা। বর্ষাকাল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছিল। চিল্লাখানার পিছনে একটি পানা ভরতি বিল; খোলা জানালা দিয়া পানার গন্ধ আসিতে ছিল। তখনও জুহরের ওয়াক্ত হয় নাই। আমি, আমার পিরজান শাহ আবদুল লতিফ এবং সিলেট সদর আদালতের মুন্সেফ শাহাবুদ্দীন আলী মজুমদার চিল্লাখানার লাল সিমেন্টের মেঝেতে বসিয়া দ্বীনের আলোচনা করিতেছিলাম। পির সাহেব একখানা উঁচা তক্তপোশে জায়নামাজ পাতিয়া বসিয়াছিলেন। পির সাহেব বলিলেন, আল্লাহতালার গুণ বান্দার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাহার শান মুখে বলা যায় না। ... এই কথা শুনিয়া আমার ভাব আসিলে পরে আমি তখন গাহিয়া উঠিলাম: ‘এই নৌকা বানাইল যে কারিগরে/ তার তুল্য মেস্তরি নাই এই ভব সংসারে।' এই গান শুইন্যা নি আমার পিরজান আমারে জড়াইয়া ধরে কান্দন আরম্ভ করলেন।
এই সব কথা স্মরণ করে বৃদ্ধ আরকুম শাহ এই মুহূর্তে সুরমা নদীর পাড়ের এই কুয়াশা ছড়ানো ভোরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।
পির সাহেব বলছিলেন, আরকুম?
বলেন, হুজুর।
চিলমচিতে পানের পিক ফেলিয়া আমার পিরজান বলিলেন, তোমার জন্মের পরেই তোমার ফকিরির বয়েত হইয়া গেছে আরাকুম। তোমার আমার মুরিদ হওনের দরকার নাই।
এই কথায় আমার কান্দন আসিল। আমার সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামের কথা মনে পড়িয়া গিয়েছিল; দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামেই আমার জন্ম ... ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হইল যেই বৎসর (১৭৭০ ইং) তার সাত বছর পরে । বেনিয়া ইংরেজরা তখন বঙ্গদেশে পাকাপোক্ত ভাবেই ঘাঁটি গাড়িয়া বসিয়াছে। আমি আমার মায়ের মুখে শুনছি ... দুর্ভিক্ষের বছরে বঙ্গদেশে প্রবল বৃষ্টিপাত হইছিল; ফলত, বন্যায় সমস্ত ফসল তলাইয়া গিয়াছিল। মানুষ খাইব কী। তয় দুর্ভিক্ষের বছরেও বিয়া-শাদি বন্ধ হইয়া ছিল না। বেটুয়া নদীর পাড়েই আমার নানার বাড়ি। সেই নদীর পানি উছলিয়া উঠছিল দুর্ভিক্ষের বছরে । আমার পিতা শরিয়ত মোতাবেক দুই জন মাত্র মুরুব্বি লইয়া নৌকাযোগে দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রাম হইতে যাত্রা করিয়া কন্যাগৃহে উপস্থিত হইলেন। আশ্বিন মাসের বারো তারিখে আমার মায়ের বিয়া হইয়া গেল। আমার মার কোল আলো করিয়া আমি ভুমিষ্ট হইলাম। আমার মা ছিলেন স্নেহশীলা রমনী। তিনি আমায় অতিশয় স্নেহ করিতেন। আমার মা গান জানিতেন। সৈয়দ আবদুর রহিম হোসাইনি চিশতির গান গাইতেন- 'দয়াল রসুল হবিব বিনে কে আছে আমার/সকলি ছাড়িয়া দয়াল ধইরাছি চরণ তোমার'... কবি তাজ উদ্দীনের কবিতা সুর করিয়া পড়িতেন-'পূর্বেতে আছিলা প্রভূ নৈরূপ আকার/ইচ্ছিলেক নিজ সখা করিতে প্রচার/ নিজ সখা মোহাম্মদ প্রথমে সৃজিলা/ সেই জ্যোতি নুরে ত্রিভূবন নির্মীলা' ... এই সকল মরমি গান আমার শৈশব জুড়িয়া ছিল। মায়ের মুখে এই সকল গান শুনিয়া আমি বড় হইতেছিলাম। আমাকে যথাসময়ে পাঠশালায় পাঠানো হইল। বেটুয়া নদীর ধারে পাঠশালা। আমি পাঠশালায় যাইতে শুরু করিলাম। একদিনের কথা। পাঠশালায় যাইতে যাইতে আমার মনের মধ্যে কথা ও সুরের উদয় হইল ...'মা বাপের ঘরে পয়দা জনমের স্থান/নাই জানি কোথায় আছে আখেরি মোকাম।' ... আমি অবাক হইয়া গেলাম। কে গান গায়? আমি আশেপাশে তাকাইয়া দেখি কেউ নাই। পানা ভরতি চৈত্যার মার খালের উপরে কেবল একখানা বাঁশের সাঁকো ধনুকের মতন বাঁকিয়া আছে। খালের যতখানি পরিস্কার পানি, তাহাতে আকাশের ছায়া পড়িয়াছিল। আমি তখন বুঝিলাম আমার মা কেবল গান গাহিতে পারেন; আমার মা গান বাঁধিতে জানেন না; আমি গান বাঁধিতে পারি। সিলেটের মাটি হইল উদাসী বাউরি মাটি। সে মাটির গুণে আর সুরমার বাতাসের টানে আমার পিতা একদিন বিবাগী হইয়া গেলেন। আমার মায়ে কান্দিল আর কান্দিল। আমি গাহিলাম:‘পাগল আরকুম বলে মিছা ঘরবাড়ি/সুয়াপাখি উড়িয়া গেলে পিঞ্জিরা হয় খালি রে।’ আমার গান শুনিয়া আমার মা আর কাঁদিল না। আমার গান শুনিয়া মা ধন্য হইয়াছেন। তাঁহার আর কোনও দুঃখ নাই। পুত্র দয়াল রসুল হবিব -এর রহমত লাভ করিয়াছে।
আজ সুবেহ সাদিকে মুয়াযজিন এর মধুরকন্ঠে আমার ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল। আস সালাতু খায়রুম মিনান নাউম ...ঘরের আবছা অন্ধকারে মেশক আতরের হাল্কা গন্ধ। আমার পিরজানকে খোয়াব দেখিলে পর ঘুম ভাঙিবার পর ঘরের মধ্যে আতরের গন্ধ পাই। চৌকি হইতে নামিয়া পায়ে চটি গলাইয়া খিল খুলিয়া ঘর হইতে বাহির হইলাম। উঠানে কুয়াশা ছিল। পুত্ররা সব দোর বন্ধ করিয়া পুত্রবধূদের লইয়া আয়েশ করিয়া ঘুমাইয়া আছে। আমার দীর্ঘশ্বাস পড়িল। পুকুরপাড়ে আসিয়া শীতল পানিতে অজু করিলাম। বাড়ির পিছনে গাবগাছ, খাল; তাহার পর রেললাইন। মোল্লারগাঁওগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনের ঝমঝম আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। জমিন কাঁপিয়া উঠিল। আমি হাঁটিতে হাঁটিতে সেই পানা পুকুর পার হইয়া, সেই ঘন বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়া বায়তুল জান্নাহ জামে মসজিদ আসিয়া উপস্থিত হইলাম।মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা কম এবং অধিকাংশই বৃদ্ধ। তাহাদের সঙ্গে জামাতে নামাজ আদায় করিলাম। ফজরের নামাজ শেষ করিয়া তসবি হাতে মসজিদ হইতে বাহির হইতেই কী এক সুর মাথায় গুঞ্জন করিয়া উঠিল; সেই সঙ্গে তালও বাজিতেছিল, পরিচিত তাল; ছন্দও পরিচিত । তবলা কিংবা মৃদঙ্গ নয়-ঢোলের বোল শুনিলাম যেন । কিন্ত, হায়, সুরের সঙ্গে কথা আসিতেছিল না। এমন তো হয় না কখনও। আমি একপ্রকাশ অস্বস্তি বোধ করিতে থাকি । আমার কি যাওনের সময় হইল নাকি? আল্লাহতালার সঙ্গে মিলনের সম্ভাবনায় আমি শিউরাইয়া উঠিলাম।
সূর্যালোকে কুয়াশা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। চরাচরে শাদা নরম রোদ ফুটে উঠছিল। ১৯৩৭ সালের আশ্বিন মাসের ভোরের বাতাসে সুরমার দক্ষিণ পাড়ের বিস্তীর্ণ শুভ্র কাশফুল দুলছিল। শরতের আসমান কী নীল দেখায়। নীল আসমানে সাদা-সাদা মেঘপুঞ্জ ভাসিয়া বেড়াইতেছে। বৃদ্ধ আরাকুম শাহ গভীর শ্বাস টানলেন। বাতাসে দুর্বাঘাসের নরম গন্ধ। দেবী দূর্গা আইতেছেন। বৃদ্ধ যেন ঢাকের শব্দ শুনতে পেলেন। আজ মহালয়ার অমাবস্যা। আরকুম শাহ জানেন: মহালয়ার তিথিতেই দেবীপক্ষের সূচনা। সিলেটের হিন্দুসমাজে তাঁর ভক্তের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাঁর লেখা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান ... যেমন - বিনা দরশনে অঙ্গ জ্বলিয়া হইল ছারখার/ মনের দুঃখ রইল মনে কলঙ্কী রাধার।....এই পদটি সুরমার দুই পাড়ের হিন্দুসমাজে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। আরকুম শাহর বন্ধু রমেশচন্দ্র বলেন, ‘ আরকুম, দূর্গাপূজা মানে হইল অসুরের বিরুদ্ধে দেবী মায়ের সংগ্রামের সূচনা। দূর্গপূজা হইল অসুর বধের পূজা।’
এই অসুর হইল ইংরাজ ... বৃদ্ধ এই মুহূর্তে ভাবলেন। ইংরাজদের ভেদবুদ্ধির যড়ষন্ত্রের কারণে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রতি বিনষ্ট হইতেছে; হিন্দু-মুসলমানের বন্ধন ছিন্ন হইতেছে । আরকুম শাহ আক্ষেপে ফুঁসে ওঠে। দিন কয়েক আগে রাতের অন্ধকারে দুর্বত্তরা নাকি মোল্লারগাঁও- এ প্রতিমা ভাঙচুর করছে । বৃদ্ধ দরবেশ ভারি মর্মাহত বোধ করেন। এরা হইল ইংরাজের চর। তাঁর জন্মের পর তিনি মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংকীর্ণ এবং অনুদার একটি অংশের এমন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াইতে দেখেন নাই। ইংরাজের চর না হইলে এমন দুষ্কর্ম করে?
নদীতে রোদ আর কুয়াশার মিশে ছিল। নদীর পাড় ঘেঁষে রেললাইন। মেইল ট্রেনের ঝমঝম শব্দ শুনতে পেলেন বৃদ্ধ। আগামী মঙ্গলবার রেলগাড়িতে চড়িয়া একবার মোগলা বাজার যাওয়ার কথা। মোগলা বাজার বাদাউরা বিলে ধলা চৌধুরীদের বাড়িতে গানের জলসা আছে । এই বয়েসেও গানের ডাক আসে। আল্লাহর অশেষ রহমত ছাড়া আর কী!
বাঁ পাশে নদীর পাড় ঘেঁষে একটি বিশাল বটবৃক্ষ। বৃক্ষতলায় নদীর ঘাট। চাদরমুড়ি দিয়ে কয়েকজন নারীপুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল। বড় একটি দুধের ধামার পাশে গোয়ালা রাইচরণকে দেখতে পেলেন। মাছের ঝুড়ি নিয়ে ইন্নাসকে দেখতে পেলেন। খেয়া পারাপার শুরু হয়ে গেছে। একটি নৌকা এসে এইমাত্র ভিড়েছে ঘাটে। নৌকা থেকে কয়েক জন নারী-পুরুষ নামল।
পরনে ধুতি আর গায়ে চাদর জড়ানো বাইশ-তেইশ বছরের একটি তরুণ এদিকেই এগিয়ে আসছে। রাধানাথ। আরকুম শাহর প্রিয় শিষ্য সে। রাধানাথ-এর বাড়ি সুরমা নদীর উত্তরপাড়ে টুকের বাজার; থাকে অবশ্য সিলেট শহরের শিবগঞ্জ। রাধানাথ- এর গায়ের রং কালো মতন। মাথার চুল কামানো। হাড় জিরজিরে শরীর । তবে রাধানাথ সুকন্ঠে অধিকারী। রাধানাথ যখন গায়-বিনা দরশনে অঙ্গ জ্বলিয়া হইল ছারখার /মনের দুঃখ রইল মনে কলঙ্কী রাধার। তখন ... তখন আরকুম শাহ কান্দেন।
রাধানাথ দ্রুতপায়ে এসে উবু হয়ে গুরুর পদধূলি গ্রহন করল।
কি খবর রে রাধানাথ?
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রাধানাথ বলল, খবর ভালা না গুরু।। টুকের বাজারে গত পরশু রাতের আন্ধারে পাষন্ডরা পূজা মন্ডপের প্রতিমা ভাঙচুর করছে । এই বছর পূজা হয় কিনা সন্দ আছে। মানুষের মইধ্যে গুজগুজ ফিসফিস শুরু হইছে। এইসব কী শুরু হইছে, বাপের জন্মেও দেখি নাই।
ইংরাজ গো চাল। বলে বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
রাধানাথ কাতরকন্ঠে বলল, সেইটা আমরাও বুঝি। তয় আপনি আছেন গুরু। আপনি কিছু করতে পারেন না?
বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আরে বোকা! পিরদরবেশরা কি ভারতবর্ষের মালিক নি? ভারতবর্ষের মালিক হইল বেনিয়া ইংরাজরা। আমার তেমন জোর নাই যে সরকারকে বইলা মন্ডপে- মন্ডপে পাহারা বসামু। বলে বৃদ্ধ নদীর দিকে তাকালেন। নদীর বাতাসে তাঁর শুভ্র দাড়ি পতাকার মতন উড়ছিল। দীর্ঘকালো আলখাল্লা পরিহিত বৃদ্ধকে দরবেশের মতন দেখায়।
সেই খেয়া নৌকাটি আবার ঘাট ছেড়েছে। ভোর থেকে একটি-দুটি জেলে নৌকাও ভাসছিল। মাছ যা ধরা পড়েছে কাজির বাজার নিয়ে যাবে বেচতে। কাছেই সুরমা পাড়ের জেলেপাড়া। পাড়াটি হিন্দু অধ্যুষিত। এই দুঃসময়ে একবার ওদের কাছে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া দরকার। তিনি বললেন, চল রে রাধা। একবার হিন্দুপাড়ায় যাই।
চলেন গুরু। রাধানাথ বলল। রাধানাথ গুরু কে প্রায় দশ বছর ধরে চেনে। সে জানে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। গুরু সুরমা পাড়ের নিম্নবর্গীয় অন্ত্যজসমাজে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। গুরু তাদের কাছে দরবেশ বলে পরিচিত। গুরুকে দেখে তারা ভরসা পাবে।
উঁচু পাড় থেকে নেমে এলেন বৃদ্ধ। তাঁর ঠিক পিছনেই রাধানাথ। হাঁটতে হাঁটতে আরকুম শাহ তসবি জপছেন। কী মনে হতেই তিনি বললেন, বুঝলি রে রাধানাথ-
কন, গুরু।
আইজ ভোর থেইকা আমার মনে একটা সুরের খেলা চলতেছে। ফজরের নমাজ শেষ করছি,মসজিদ থেইকাও বাহির হইছি, সুরডা তখনই আইল মাথায়। তয় কথা আর খুঁইজা পাই না। আমার কি যাওনের সময় হইল নাকি রে রাধা?
কি যে কন! কথা যথাসময়ে পাইবেন গুরু। বলে সুর করে গেয়ে উঠল রাধানাথ- আপনি হইলেন আরকুম শাহ/পিরের বয়েত লইয়া/ ভাব-তরঙে কাটিল জীবন/ সুরের নাও বাইয়া। ... বৃদ্ধ দরবেশ হাসেন। তা রাধায় কথা মিছা কয় নাই রাধায়। সেই যে বাল্যকালে পাঠশালায় যাওনের পথে সুর আইছিল মাথায়, এই ষাইট বছর বয়েসও সমানে সুর আইতাছে। আল্লাহর কী মেহেরবাণী! আমার পিরজান শাহ আবদুল লতিফ কইতেন, ‘সুর হইল আল্লাহর কুদরত রে আরকুম, আল্লাহর কুদরত। রব নিজে নিরাকার বইলা তিনি বান্দারে দেখা দেন না, রব সুরের মাধ্যমে বান্দারে জানান দেন ... বলেন যে আমি তর কাছে আছি ... তুই কান্দস ক্যান ... ’ বলে আমার পিরজাম কান্দতেন।
জেলেপাড়ার ঢোকার মুখে একটা একটা বিশাল কামরাঙা গাছ। তারই তলায় ধুতি পরে খালি গায় দাঁড়িয়ে ছিল ঘনশ্যাম । বলিষ্ট গড়নের মধ্যবয়েসি ঘনশ্যাম দক্ষিণ সুরমা অঞ্চলের বিশিষ্ট ঢাকি। জেলেপাড়ায় জন্ম হলেও ঢাকবাদ্যে এতদ্বঞ্চলে তার জুড়ি মেলা ভার।
আরকুম শাহ হেসে বললেন, কি রে ঘনশ্যাম? পোলাপাইনের মতন গাছতলায় দাঁড়ায় আছস ক্যান?
ঘনশ্যাম কথা কম বলা মানুষ; সে মাথা চুলকায়। যদিও তার মাথাটিও মসৃনভাবে কামানো। ভোরে সুরমায় স্নান করে গায়ে-মাথায় জবজব করে সর্ষের তেল মেখেছে মনে হল। তবে ঘনশ্যামের মুখ ভার। সে গান পাগল মানুষ; পুজার টাইমে মনের সুখে ধিতাং ধিতাং বোলে ঢোল-মাদল বাজাতে না পারলে মুখ ভার তো হবেই।
আরকুম শাহ বললেন, যা রে ঘনশ্যাম, তোর ঢোলখান বাইর কর। আজই আমি নতুন পদ বান্ধছি। আমার সঙ্গে তুই বাজাবি। আয়।
ঘনশ্যামের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে ঘুরে দৌড়াতে লাগল।
আরকুম শাহ খড়ের গাদা পেরিয়ে কলাঝোপের ভিতর দিয়ে একটি বাড়ির উঠানে উঠে এলেন। এ ক’দিন বৃষ্টি-বাদলা তেমন না হলেও উঠনে প্যাচপ্যাচে কাদা । বাতাসে শুকনো মাছের গন্ধ। উঠানে জাল শুকাতে দিয়েছে। এক বৃদ্ধ মুখ কালো করে ছেঁড়া জাল সেলাই করছিল।
বৃদ্ধ দরবেশ অতি মধুর সুরে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে জোরে গলা খাকারি দিলেন।
বৃদ্ধ দরবেশ কে দেখে বাড়ির নারীপুরুষশিশুবৃদ্ধ সব ছুটে এল। দেখতে দেখতে উঠানে মনমরা কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে ওঠে। কি ব্যাপার? দরবেশ এসেছেন যে মহালয়ার ভোরে!
ঘনশ্যাম ঢোল নিয়ে আসে। আরকুম শাহ ভোরে যে সুর পেয়েছেন- এই মুহূর্তে ওপর কথা পেয়ে গেলেন । তিনি জড়ো হওয়া পাংশু মুখগুলির দিকে একবার তাকালেন। তারপর গলা ছেড়ে গাইতে থাকেন:
কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে
ফুলে বাইলা ভোমরা,
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা।
ঘনশ্যাম ততক্ষণে তাল বুঝে ফেলেছে। সে হয়ে ঘুরে ঘুরে ‘ঢুকু ঢুকু/ ‘ঢুকু ঢুকু’ মধুর আওয়াজে ঢোলের বোল তুলতে থাকে। রাধানাথও ততক্ষণে সুরটি ধরে ফেলেছে। সে প্রাচীনকালের যমুনাপাড়ের গোপীদের মতন নাচতে থাকে।
আরকুম শাহ গাইতে থাকেন:
সোয়া চন্দন ফুলের মালা
সখিগণে লইয়া আইলা,
কৃষ্ণ দিলায় রাধার গলে
বাসর হইল উজালা
রাধানাথ চিৎকার করে ধুয়া তুলল-
বাসর হইল উজালা গো
বাসর হইল উজালা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা।
জেলেপাড়ার শীর্ণকায়, কৃষ্ণকায়, বেঁটে বেঁটে অচ্ছুত মানুষগুলির রক্তে আদিম ঢাকবাদ্যের বোলধ্বনি শব্দিত হতে থাকে; তাদের নিষাদ পূর্বপুরুষগণ একদা যেমন করে বোঙ্গা দেবতাকে ঘিরে দুলে দুলে নাচত, ... হাজার বছর পরে এক মহাত্মা দরবেশের মাদক-মাদক সুর, ছন্দ ও দারুণ গায়কিতে দারুণ এক দুঃসময়ে আরও একবার এই অন্ত্যজগণ দুলতে শুরু করেছে; যেন তাদের মনে কোনও শঙ্কা নেই, আতঙ্ক নেই, তারা শোষক ইংরেজের ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে নির্ভয়ে গাইছে, নাচছে, কেউ কেউ আবার হাততালিও দিচ্ছে, যেমন বৃদ্ধরা দাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে ; এমন কী শিশুরাও নির্ভয়ে গাইছে, নাচছে, তারাও হাততালি দিচ্ছে। জাল ফেলে ছুটে এসেছে সেই দুঃখী বৃদ্ধটিও। হাসছে ফোকলা দাঁতে ... ভগবানের কৃপা লাভের জন্য দু’হাত ওপরে ধরে রেখেছে সে ...
‘কৃষ্ণ দিলায় রাধার গলে
রাধায় দিলা কৃষ্ণর গলে
আনন্দে সখীগণ নাচে
দেখিয়া প্রেমের খেলা।
জেলেপাড়ার রোগা- ভোগা, কালো, ও কোণঠাসা মানুষগুলি একে অন্যের শরীরে ঢলে পড়তে পড়তে সমস্বরে ধুয়া তুলে –
দেখিয়া প্রেমের খেলা গো
দেখিয়া প্রেমের খেলা।
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা।
কৃষ্ণ প্রেমের প্রেমিক যারা
নাচে গায় খেলে তারা,
কূল ও মানের ভয় রাখে না
ললিতা আর বিশাখা
কৃষ্ণকায় হাড় জিরজিরে অন্ত্যজ মানুষগুলি গাইতে থাকে-
ললিতা আর বিশাখা গো
ললিতা আর বিশাখা
ময়ূর বেশেতে সাজুইন রাধিকা।
মহালয়ার এই সোনালি রোদের সকালে বৃদ্ধ দরবেশের গানের কথায় ও সুরে প্রাণস্পর্শী এমন কিছু ছিল- যাতে সুরমাপাড়ের জেলেপাড়ার লড়াই করে টিকে থাকা নিম্নবর্গীয় কালো কালো মানুষগুলির পান্ডুর চোখে-মুখে এক ধরণের স্বর্গীয় জ্যোতি প্রতিফলিত হচ্ছিল। তাদের এই মুহূর্তে বৃদ্ধ ফকিরকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে হয় ...
ঘটনাটি কাল্পনিক ...
সিলেটের মরমি গীতিকবি আরকুম শাহ (জন্ম ১৮৭৭) ১৯৪১ সালে মৃত্যুবরণ করেন । তিনি একজন সাধক দরবেশ ছিলেন বলেই তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামে তাঁর মাজার গড়ে উঠেছিল । সিলেট অঞ্চলে মরমি গীতিকবি আরকুম শাহ হযরত সুফি শাহ আরকুম আলী (র.) নামে পরিচিত। আর এই কারণেই এই কাল্পনিক আখ্যানে তাঁকে দরবেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সে যাই হোক। প্রতি বছর হযরত সুফি শাহ আরকুম আলী (র.)-র ভক্তেরা দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামে তাঁর মাজারে সমবেত হয়। প্রতি বছরই ওরশ পালিত হয়। এ বছর দরবেশের সত্তরতম ওফাত দিবস উপলক্ষ্যে ভাবগম্ভীর পরিবেশে ওরশ শরীফ উদযাপিত হয়।
বেশ কিছুদিন ধরে আমি ভাবছিলাম ... পৃথিবীতে যে এত গান আছে, সেই গানের মধ্যে সবচে নির্মল এবং নিস্পাপ চরণ কোনটি । অনেকেই দ্বিমত পোষন করলেও আমি পৃথিবীর হাজারও গানের মধ্যে হযরত সুফি শাহ আরকুম আলী (র.) রচিত এই দুটি চরণই সবচে নির্মল ও নিস্পাপ চরণ মনে করি ... ‘কৃষ্ণ দিলায় রাধার গলে/রাধায় দিলা কৃষ্ণর গলে/ আনন্দে সখীগণ নাচে/ দেখিয়া প্রেমের খেলা।’ কিছুদিন আগেও আমি জানতাম যে ‘ কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে/ফুলে বাইলা ভোমরা’ -এই গানটির রচয়িতা এবং সুরকার আরকুম শাহ নন, সুনামগঞ্জের উজান ধল গ্রামের শাহ আবদুল করিম। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের তরুণ প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই এই ভুল ধারণাটি রয়েছে । তাদের ভুল ভাঙাতেই এই কাল্পনিক ঘটনাটির অবতারণা ...
তথ্যসূত্র:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সুমন কুমার দাশ সম্পাদনা করেছেন ‘আরকুম শাহ রচনাসমগ্র’ । মরমি লোকগানের এই অমূল্য বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন। আশা করি বইটি অনেকই সংগ্রহে রাখতে চাইবেন। তাদের জন্যই নীচের এই ই-ঠিকানাটি ...
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১২ সকাল ৮:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




