সামনে রাখা পেয়ালায় ঠান্ডা সরপড়া চায়ের উপর নীল রঙ্গের স্বাস্থ্যবান দুটো মাছি উড়ছে।
নিবিষ্টভাবে সেদিকে তাকিয়ে আছেন আয়াত আলী। প্রথমে দেখলে মনে হবে তিনি বুঝি গভীর মনযোগে মাছিদুটোর উড়াউড়ি পর্যবেক্ষণ করছেন। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, আসলে আয়াত আলী এখন কিছুই দেখছেন না। গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছেন।
কিছুদিন আগেও সকাল-বিকেল এ স্টুডিও, সেই ফ্লোরে সুট্যিংয়ে ব্যস্ত থাকতেন আয়াত আলী। আর আজ সময় কাটানোটাই তার জন্য একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কখনো কখনো আর্থিক অনটনের চেয়েও কর্মহীন অলস মুহুর্তগুলোকে বেশি অসহ্য মনে হয়।
কাজ কাজ করে এ জীবনে বিয়েই করা হলো না। আর সে সময় একজন মেকাপ ম্যানের আয়ই বা কতো ছিল! এসব কারণেই নিজের জীবনের সঙ্গে নতুন করে আর কাউকে জড়ানোর সাহস হয়নি। তবে এখন সময় বদলেছে। নানান চ্যানেল, শত শত প্রডাকশন হাউজ...কাজ যেমন বেড়েছে, মেকাপ ম্যান থেকে শুরু করে এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত সকলের আয়ও বেড়েছে। শুধু আয়াত আলীরই কপাল খারাপ। এই সুসময়ে বাজার পড়ে গেছে।
মেকাপ ম্যান হিসেবে এখনও পুরাতন পরিচালকরা আয়াত আলীকেই গুরু মানেন। কিন্তু নতুন নতুন পরিচালকদের পছন্দ এ যুগের ছোকরাগুলো। হাতে ধরে একদিন যাদের কাজ শিখিয়েছেন, আজকে তারাই নাকি সময়ের চাহিদা বুঝে নায়ক-নায়িকা থেকে শুরু করে সবার মেকাপ দিতে সিদ্ধহস্ত। আর আয়াত আলীর ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা কিছুই না?
মেকাপ ম্যানের কাজটাও যে কতো বড় শিল্প সেটা এদের কে বোঝাবে! একজন মানুষের চেহারার গড়ন, ব্যক্তিত্ব, স্বভাব, মুদ্রাদোষ- এসব কিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তবেই না হাত চালাতে হয়। যেমন নিপাট ভালোমানুষের মতো চেহারার একজনকে যদি খল চরিত্রের মেকাপ দিতে হয়, তাহলে তাহলে তার চেহারায় গব্বর সিংয়ের মতো চুল-দাড়ি চাপিয়ে দিলেই হবে না। তাকে বানাতে হবে মিটমিটে শয়তান। এভাবেই চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব বুঝে মেকাপ দেওয়াটাই একটা বড় মুন্সিয়ানা। দীর্ঘদিন মানুষের মুখে তুলি চালিয়ে ধীরে ধীরে এই যশ রপ্ত করেছেন আয়াত। কিন্তু তাতে লাভ কী হলো?
কড়া নাড়ার শব্দে সম্বিত ফিরে পান তিনি। দরজার নীচ দিয়ে তরতাজা দৈনিকটি এগিয়ে আসে। এই চরম দু:সময়ে একটি বিলাসিতাই ধরে রেখেছেন আয়াত আলী। প্রতিদিন আটটি টাকা খরচ করে একটি দৈনিক কেনাকে এখন চরম বিলাসিতাই বলা যায়।
ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে র্তি কাঁচাপাকা দাড়ি একবার চুলকে নিয়ে পত্রিকাটি হাতে তুলে নেন। নতুন দৈনিকে সুঘ্রান তার কাছে যে কোনো লোভনীয় খাবারের চেয়ে কম আকর্ষনীয় নয়। কর্মহীন অলস দিনগুলোর একটি বড় অংশ প্রতিদিন পত্রিকা পড়েই পার করে দেন। সেদিক থেকে বিচার করলেও দৈনিক পত্রিকা এখন তার একটি বড় বন্ধু।
ওস্তাদ, আরেক কাপ চা দেবো?
পত্রিকার পাতা থেকে চোখ সরিয়ে সুলেমানের দিকে তাকান। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আবার ডুবে যান কাগজের পাতায়।
তিনের পাতায় বক্স করে ছাপা একটা বড় বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায় আয়াত আলীর। দশ লাখ পাকা পুরষ্কার- এ লাইনের নীচেই একটি ছবি দেওয়া। বিজ্ঞাপনটিতে লেখা আছে, ছবির ব্যক্তি আবু আসলাম একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের বড় নেতা। বর্তমানে সে বাংলাদেশে আত্মগোপন করে আছে। এর সন্ধানদাতাকে সরকার নগদ ১০ লাখ টাকা পুরষ্কার দেবে।
দ-শ-লা-খ টাকা! এই দশ লাখ টাকা হাতে পেলে এই মুহুর্তে আয়াত আলীর প্রায় সবগুলো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। বিকল কিডনি নিয়ে পিজি হাসপাতালের বিছানায় ধুঁকতে থাকা ছোট ভাইটির চিকিৎসা, বাড়ি ওয়ালার বকেয়া ভাড়া পরিশোধ, মা ও বিধবা বোনটিকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসাসহ যেসব খুচরা ঋণের জন্য সকাল-বিকেল পাওনাদারদের হাতে হেনস্তা হতে হচ্ছে, সেগুলোর হাত থেকেও মুক্তি মিলবে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে আবার ছবিটার দিকে তাকান আয়াত আলী। আয়াত আলীর বাড়িতে টিভি নেই। থাকলে তিনি জানতে পারতেন গত কয়েকদিন ধরে সবকটি চ্যানেলেও এ সরকারি বিজ্ঞাপনটি দেওয়া হচ্ছে।
স্বভাবজাত কারণে এবার খুব মনোযোগ দিয়ে চেহারাটা স্টাডি করতে থাকেন। দাড়ি-গোফে ঢাকা চেহারার আড়ালে তিনি তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন একটি তরুণকে আবিষ্কার করেন। খাড়া নাক এবং চওড়া কপালের সুদর্শন এ তরুণটিকে যে কোনো টিভি সিরিয়ালের নায়কের চরিত্রে বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আরো কিছুক্ষণ গভীরভাবে ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে আয়াত আলীর বুকটা কেঁপে উঠে। মনের অন্ধকার দিকটি গ্রাস করতে থাকে সকল বিবেচনাবোধ আর শুভবুদ্ধিকে। একটা কূটবুদ্ধি মাথার ভেতর ডালপালা মেলতে থাকে।
সুলেমানের হাত থেকে চায়ের মগটি নেওয়ার এবার একেবারে অন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকান আয়াত আলী।
সম্ভব, খুবই সম্ভব।
শুধু একটু হাত চালিয়ে গড়ে-পিটে নিতে হবে। আর এতো আয়াত আলীর বাঁ হাতের খেলা।
এ মুহুর্তে ন্যায়-অন্যায় বোধ হারিয়ে ফেলেন তিনি। ভুলে যান, গত এক মাস সুলেমানের টাকাতেই তার খাওয়া-পড়া চলছে। হাতে-কলমে মেকাপের কাজ শেখার জন্য তার কাছে আসা ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র সুলেমানই নিয়মিত পয়সা দিচ্ছে, অন্যরা সব কাজ শিখে নেয়, কিন্তু পাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে দেবো-দিচ্ছি করে তালবাহানা করে। ঢাকায় থাকার জায়গা নেই বলে আপাতত সুলেমান কার সঙ্গেই থাকে।
গত এক মাসে ছেলেটার ওপর বেশ মায়া পড়ে গেছে আয়াত আলীর। রান্না-বান্না থেকে শুরু করে বাজার-ঘাট সব সেই করছে। অবশ্য আয়াত আলীর কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যপার। কাজ শিখতে গিয়ে বিহারী ওস্তাদ জুলমত খাঁর জুতো পর্যন্ত সাফ করেছেন আয়াত আলী। তার পরেও একটু এদিক-সেদিক হলে চড়চাপড় দিতে ইতস্তত করতেন না জুলমত। কিন্তু মেকাপম্যান হিসেবে সে ছিল এক নম্বর। পাকিস্তান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে জুলমতের সমকক্ষ আর কেউ ছিল না। সে তুলনায় সুলেমানের সঙ্গে রীতিমতো ভালো ব্যবহার করছেন তিনি।
মনে মনে এসব ভেবে অপরাধবোধকে চাপা দিতে চেষ্টা করেন আয়াত আলী। বিজ্ঞাপনের ছবির চেহারাটির সঙ্গে সুলেমানের মুখটা এতোটা মিলে যাওয়ার পর আয়াত আলীর আসলে আর কিছুই করার ছিল না। এ যেন নিয়তিই সুলেমানকে তার কাছে নিয়ে এসেছে।
এবার সবকিছু ছক অনুযায়ী করতে থাকেন আয়াত আলী। এতো সহজেই যে প্ল্যানটা কাজ করবে স্বপ্নেও ভাবেননি। সুলেমানকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়ে কড়া ঘুমের ওষুধ জোগার করা, কৌশলে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো এবং সব শেষে সকল প্রতিভা ঢেলে দিয়ে ধীরে ধীরে সুলেমানকে আবু আসলাম বানানো- সবকিছু যে এতো সহজে হয়ে যাবে তা নিজেও ভাবেননি আয়াত আলী।
পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশটিই সবচেয়ে কঠিন। এতোক্ষণে আয়াত আলী সেটা বুঝতে পারেন। তবে তিনি নিজেও পাকা খেলোযাড়। সুলেমানের মুখে নকল দাড়ি-গোঁফ লাগানো হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই তা পুলিশের কাছে ধরা পড়তে বাধ্য। তাই জঙ্গী নেতা আবু আসলামের শশ্রুমুন্ডিত চেহারাটি কল্পনা করে সে অনুযায়ী সুলেমানের মেকাপ দিয়েছেন তিনি। নিজের শেষ কড়িটি পর্যন্ত বাজি রেখে বলতে পারেন আয়াত আলী, এখন সুলেমানের নিজের মা এসেও তাকে চিনতে পারবে না।
কিন্তু তার পরেও পুলিশের সঙ্গে ধাপ্পাবাজি। মনটা সায় দিচ্ছেনা। অথচ এখন আর পিছিয়ে আসার কোনো মানেই হয় না। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে সুলেমানের সেল ফোনটা হাতে তুলে নেন। ডায়াল করেন বিজ্ঞাপনে ছাপা নম্বরে।
এর পর অপেক্ষা। সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমে অচেতন আবু আসলামের রূপধারী সুলেমান। আগামী তিন-চার ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসার কোনো সম্ভবাবনাই নেই। তার পর কী হবে! জ্ঞান ফিরে পেয়েইতো পুলিশের কাছে সবকিছু ফাঁস করে দেবে সুলেমান। আর এই তিন-চার ঘন্টায় নিশ্চই দশ লাখ টাকা হাতে ধরিয়ে দেবে না সরকার। থানায় দারোগা টাকার বস্তা হাতে বসে আছে-এটা ভাবাও হাস্যকর।
এ জালিয়াতির পরিকল্পনার বাস্তব দিকগুলো একে একে সামনে আসতে থাক। ঝোঁকের মাথায় কতোটা কাঁচা কাজ করেছেন ভেবে হাতপা পেটের ভেতের ঢুকে যায় আয়াত আলীর। কিন্তু ঢিলতো ছোড়া হয়ে গেছে। এখন আর ফিরে আসার পথ নেই। আসলেই কী ফিরে আসার পথ নেই!
ঠিক এ সময় দরজার কড়া নড়ে উঠে।
ভুতগ্রস্তের মতো দরজা খুলে দেন আয়াত আলী। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কালো পোষাক পড়া রবের একটি দল দ্রুত ঘরের ভেতন ঢুকে পড়ে। দলের নেতা আয়াত আলীকে বাইরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হাতকড়া পড়ানো অচেতন সুলেমানকে গাড়িতে তুলে র্বের দলটি রওনা দেয়। আরেকটি গাড়িতে তুলে নেওয়া হয় আয়াত আলীকে। যেতে যেতে পুরো ঘটনাটি আবারও মনে মনে ভাবেন আয়াত আলী।
এখনও সময় আছে, থানায় গিয়ে সবকিছু স্বীকার করা। সে ক্ষেত্রে হয়তো অল্পবিস্তর সাজা জুটবে আয়াত আলীর কপালে, কিন্তু তার এ জালিয়াতির কথা জানতে পারলে- কে জানে হয়তো রবের ক্রসফায়ারেই জীবনের ইতি হবে।
সামনের গাড়িতে হাতকড়া পড়া ঘুমে অচেতন বন্দীর পাশে বসে রাবের কমান্ডার রেজওয়ান চৌধুরী চওড়া গোফের নীচে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসছেন।
আজ তার ছয় মাসের পরিশ্রম সফল হলো। ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে মোটা টাকার পুরষ্কার ছাড়াও সামনে ঝুলছে নিশ্চিত প্রমোশন। ইন্টারপোলের লিস্টেড এ টেরোরিস্টকে ধরার ফলে শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। দিব্য চোখে নিকট ভবিষ্যতের সেই দিনগুলো দেখতে পাচ্ছেন তিনি।
গত ছয় মাসে কম ভুগায়নি এই আসলাম । এর মধ্যে অন্তত ২০জনকে আসলাম সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু সবগুলোই ছিলো জালি। এবার তাই খবর পেয়ে নিজেই ছুটে এসেছেন। বাঁ হাতের তালুতে কাটা দাগ আর পেটে বুলেটের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন দেখে নিশ্চিত হয়েছেন- এবার আসলটিকেই জালে পুরা গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০০৯ দুপুর ২:৫১