somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জন্মান্তরবাদ : কেবলই বিশ্বাস? মিথ? বিজ্ঞান সম্মত? মিথ্যা নাকি সত্য!! -২

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মানুষের সব ক্রিয়াকাণ্ডের মূলে রয়েছে মন বা আত্মার সক্রিয় ভূমিকা। শরীর বা দেহ আত্মার নির্দেশ পালনের হাতিয়ার স্বরূপ- আত্মার হুকুম তামিল করার জন্য সে সদা প্রস্তুত। মনে হলো আপেল খাবো- মনের এই ইচ্ছা প্রতিপালনের জন্য দেহে গতি সঞ্চার হয় এবং ইচ্ছা পরিপূরণের জন্য দেহ সক্রিয় হয়ে ওঠে : যথা হস্ত সঞ্চালন করে টেবিল থেকে আপেলটি তুলে নেয়া, এবং মুখ গহ্বরে পুরে দেয়া ইত্যাদি। দেহে অবস্থিত আত্মাই এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আত্মার মূলত দু’টি প্রবৃত্তি রয়েছে : সুপ্রবৃত্তি এবং কুপ্রবৃত্তি অথবা বলা চলে বুদ্ধিবৃত্তি ও জীববৃত্তি।
সুপ্রবৃত্তি মানুষকে ন্যায়, সৎ ও সঠিক পথ নির্দেশ করে অন্য দিকে কুপ্রবৃত্তি মানুষকে অন্যায়, অসৎ ও বিপথে পরিচালিত করে। মানব জীবনে চলছে : ‘সু’ ও ‘কু’ এই দুই বৃত্তির অভিনব খেলা। ‘সু’ টানছে সত্যের পথে ‘কু’ প্ররোচিত করছে অসত্য ও মিথ্যার পানে। কখনো ‘সু’ মন বা আত্মার ওপর এর প্রভাব বিস্তার করে আবার কখনো কখনো ‘কু’-এর আধিক্য প্রবল হয়ে ওঠে- এই দোদুল্যমানতার ভেতর দিয়েই চলছে জীবনপ্রবাহ। ইসলাম এক পবিত্র ধর্মের মহাগ্রন্থ হলো আল-কুরআন। মন-আত্মা, রূহ বা নফসসংক্রান্ত বিষয়েও এখানে আলোচিত হয়েছে। ইসলামের পরিভাষায় ‘নফস’-কে সাধারণত তিন স্তরে বিন্যস্ত করা হয়।

১. নফসে আম্মারা : কুপ্রবৃত্তিমূলক আত্মা
২. নফসে লাওয়ামাহ : বিবেক তাড়িত বা ধিক্কারজনিত আত্মা এবং
৩. নফসে মুতমাইন্না : প্রশান্ত আত্মা বা প্রফুল্ল চিত্ত।

নফসে আম্মারা :
পবিত্র কুরআনে সূরা ইউসুফে ২৪ নম্বর আয়াতে (১২:২৪) বর্ণিত হয়েছে : ‘নিশ্চয় মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ’

বিচিত্র এই জগতে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা আপাত দৃষ্টিতে লোভনীয় আকর্ষণীয় বলে প্রতীয়মান হয় আসলে এগুলো সত্য নয়। সত্যের আড়ালে মিথ্যা। মানুষ সহজেই এ সবে আকৃষ্ট হয় এবং ভুল ও বিপথে পরিচালিত হয়। দু’টি বিশেষ গুণ সাধারণত মানুষকে পরিচালিত করে : জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি।
মানুষকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে বুদ্ধিসম্পন্ন জীব হিসেবে- মানুষ মূলত : জীব এবং জীবের সব বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে বর্তমান- তবে বুদ্ধি-বিবেক বা সুআত্মা নামক এক অতিরিক্ত গুণ দিয়ে মানুষকে বিভূষিত করা হয়েছে এবং তাকে অন্যান্য জীব-জানোয়ার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখা হয়েছে। এই বিবেক-বুদ্ধির কারণেই মানুষ, মানুষ নামে অভিষিক্ত- শুধু তা-ই নয়, সে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পরিচিত। বুদ্ধির প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান জীববৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা যাতে করে হীন-নীচ-কদর্য বৃত্তিগুলো প্রকটিত হয়ে না ওঠে এবং তাকে বিপথে পরিচালিত করতে না পারে। কিন্তু বাস্তব জীবনে ক্ষণস্থায়ী সুখের প্রলোভন এত অপরূপ সাজে সজ্জিত করে রাখা হয়েছে, মানুষ স্বভাবতই এতে আকৃষ্ট হয় এবং নিজ পতন ডেকে আনে যেমন অগ্নির উজ্বল আলোতে পতঙ্গ ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নিজ মরণ ডেকে আনে।
এখানে নফসের যে অংশটুকু মুখ্য ভূমিকা পালন করে তা হলো নফসে আম্মারা অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তিমূলক আত্মা। এই আত্মার জীব বা পশুবৃত্তির আধিক্য অত্যন্ত প্রবল- ফলে তা স্বভাবগতভাবেই মানুষকে মন্দ- অর্থাৎ অসৎকর্মে প্ররোচিত করে। এই আত্মার প্রবল প্রভাবে আত্মার বুদ্ধির অংশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে- বিবেকের ক্রিয়া-তৎপরতা নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। মন্দ-অশ্লীল খারাপ অন্যায় কুপ্রবৃত্তি ও কু-বাসনাজনিত কর্মগুলোকে এমন সুশোভিত করে প্রদর্শন করা হয় যে মানুষ সহজেই এতে প্রলুব্ধ হয় এবং নিজেকে পাপে নিমজ্জিত করে ফেলে। মন্দ বা অসৎ কর্মে লিপ্ত হওয়ার পানে এই আত্মার প্রবণতা বা ঝোঁক থাকে বেশি। যারা এ অবস্থা থেকে নিজেদের কিছুটা মুক্ত বা উত্তরণ ঘটাতে পারেন তারা আত্মার পরবর্তী স্তর অর্থাৎ নফসে লাওমাহ-তে উন্নীত হন। কাজটি কঠিন তবে অসাধ্য নয়।

নফসে লাওয়ামাহ- বিবেক তাড়িত বা ধিক্কারজনিত আত্মা : সূরা কিয়ামাহের ২ নম্বর আয়াতে উক্ত হয়েছে ﴿وَلَا أُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ﴾ অর্থাৎ আরো শপথ করি সেই মনের যে ধিক্কার দেয়।’ আয়াতে প্রথমেই শপথ নেয়া হয়েছে সে-ই মনের যা পাপের জন্য ভর্ৎসনা করে। আল্লাহ যখন কোনো বিষয়ের ওপর শপথ নেন তখন সে-ই বিষয়ের মাহাত্ম বা গুরুত্ব বোঝাতে গিয়েই তা করা হয়। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে এর উল্লেখ রয়েছে : وَالْمُرْسَلَاتِ عُرْفًا﴾ যেমন মৃদু সঞ্চারিত বায়ুর শপথ (المرسلات1) وَالسَّمَاءِ وَالطَّارِقِ আকাশের ও আগমনকারীর শপথ طارق:১ ইত্যাদি। উল্লিখিত আয়াতে বিবেক তাড়িত আত্মার’ মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্যই এর শপথ নেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন জাগে : বিবেক তাড়িত বা ধিক্কারজনিত আত্মা বলতে কী বোঝায়? আত্মার এই স্তরে বুদ্ধি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বুদ্ধি বা বিবেক যা নফসে আম্মারার প্রভাব অবদমিত ছিল তা এবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং জীব বা পশুবৃত্তিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়। এই অবস্থায় আত্মা সু-কু ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দ সৎ-অসৎ-এর মধ্যে ক্ষীণ পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হয় এবং নিজ কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ করতে পারে। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দেয়, তিরস্কার করে। ধিক্কারটি দুই তরফ থেকে হয় : ক. অসৎ কর্মের জন্য ভর্ৎর্সনা খ. সৎ কর্ম না করার জন্য তিরস্কার। অসৎ কর্মের জন্য ধিক্কার হচ্ছে এই কারণে যে তার বোধশক্তি হয়, অনুশোচনা হয় কেন সে এই অপকর্মটি করল- সে তো নিজেকে সংবরণ করতে পারত- সে তো ভালো কাজও করতে পারত। সৎ কর্মের জন্য আত্মা তিরস্কার করে এই কারণে যে তার পুঁজিতে সৎ কর্মের পরিমাণ আরো বেশি মজুদ নেই কেন? সুফি সাধকরা বলেন : নফস স্বভাবগত ও মজ্জাগতভাবে মন্দপ্রবণ- তবে ঈমান, আমলে সালেহা বা সৎ কর্ম এবং সাধনার দ্বারা তা নফসে লাওয়ামাতে উন্নীত হওয়া যায়- তবে মন্দ প্রবণতা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয় না। ক্রমাগত সৎকর্ম এবং ঈমান বৃদ্ধির ফলে সৎকর্ম যখন ব্যক্তির মধ্যে স্থায়ী রূপ লাভ করে তখন তা আত্মার পরবর্তী স্তর অর্থাৎ নফসে মুতমাইন্না- প্রশান্ত আত্মাতে উপনীত হয়।

নফসে মুতমাইন্না : প্রশান্ত আত্মা: সূরা ফজরের ২৭-৩০ নম্বর আয়াত ৮৯: (২৭-৩০)-এ নফসে মুতমাইন্নার প্রসঙ্গ পরিব্যক্ত হয়েছে : বলা হয়েছে ‘হে প্রশান্ত মন। তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’
এসব আয়াতে স্বভাবত যেসব প্রশ্ন উদয় হয় : ক. প্রশান্ত আত্মা বলতে কী বোঝায়? খ. এ আত্মার অবসস্থান আসলে কোথায়? গ. এ আত্মা কার সংস্পর্শে থাকে? ঘ. জান্নাত কী?

প্রশান্ত আত্মা হচ্ছে আমাদের বর্ণিত ত্রি-স্তর আত্মার সর্বোচ্চ ধাপ। এই স্তরে আত্মা থাকে সর্বপ্রকার কলুষতা থেকে মুক্ত- এ বিশুদ্ধ পবিত্র ও খাঁটি আত্মা। পশুবৃত্তি ও জীববৃত্তি এবং সব প্রকার কুপ্রবৃত্তিগুলো এখানে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়ে যায়- বুদ্ধি ও বিবেকের প্রাধান্য এখানে অত্যন্ত প্রবল- শুধু তাই নয় ঐশী বা পরমাত্মার জ্যোতিতে বুদ্ধিও এই পর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়- এ হচ্ছে নির্মোহ আত্মা। ঈমান, আমলে সালেহা ও ধারণার সমন্বয়ে সাধক এ পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন। আল্লাহর গভীর ধ্যান ও প্রেমই হচ্ছে এই আত্মার বৈশিষ্ট্য- আল্লাহর জিকর ও স্মরণ ছাড়া এই আত্মায় আর কিছুই থাকে না। সাধক যখন তার ইবাদতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন এবং তার ইবাদতে পরিমাত্রা আল্লাহও পরিতুষ্ট হন তখন তা প্রশান্ত মন বা প্রশান্ত চিত্ত হয়ে যায়। আল্লাহ এরূপ আত্মাকেই নির্দেশ দেন তার মূলে ফিরে যেতে অর্থাৎ যেখান থেকে তার আগমন (মহান আল্লাহর পানে- পরমাত্মায়)। তিনি আরো নির্দেশ দেন আল্লাহর পছন্দিত আত্মার সাথে এরা যেন বসবাস করে- সংসর্গ করে সে-ই সুমহান স্থানে অর্থাৎ এর প্রকৃত আবাস স্থলে যেমন বেহেশত বা জান্নাতে। আল্লাহ রূহকে নিজের সাথে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন। কোনো উপকরণ ছাড়া মানবাত্মা আল্লাহর আদেশে সৃষ্টি হয়েছে- এর মধ্যে আল্লাহর জ্যোতি বা নূর গ্রহণ করার যোগ্যতা রয়েছে যা মানুষের ছাড়া অন্য কোনো জীবাত্মার নেই।
মানব সৃষ্টির উপকরণ দশটি-পাঁচটি সৃষ্ট জগতের- পাঁচটি আদেশ জগতের। সৃষ্ট জগতের উপাদান হচ্ছে : অগ্নি, পানি, মৃত্তিকা, বায়ু এবং পঞ্চমটি হচ্ছে এদের থেকে সৃষ্ট সূক্ষ্ম শক্তি যাকে মর্তজগতে রূহ বা নফস বলা হয়। আদেশ জগতের পাঁচ উপকরণ হচ্ছে। কলব, রূহ, সির, খফি ও আখফ। এত সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরও আত্মার স্বরূপ উদঘাটন সহজসাধ্য নয়- এ প্রকৃতই এক রহস্যময় বিষয়। পবিত্র কুরআনে এই রহস্যকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ রাসূল সা:-কে উদ্দেশ করে বলেন : ‘তারা আপনাকে রূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বলে দিন : রূহ আমার পালনকর্তার আদেশে গঠিত। এ বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞান দান করা হয়েছে। ১৭:৮৫। আসলে মানুষকে আত্মা সম্বন্ধে অতি অল্প জ্ঞান দান করা হয়েছে।

রুহ-
মৃত্যুর পর মানুষের রুহ বা আত্মা কোথায় যায় এবং কোথায় অবস্থান করে। কিয়ামত সংঘটিত হবার পরে বিচার শেষে মানুষ জান্নাত বা জাহান্নামে অবস্থান করবে। কিন্তু এর পূর্বে সুদীর্ঘকাল মানুষের আত্মা কোথায় অবস্থান করবে? কোরআন-হাদীসে এর স্পষ্ট জবাব রয়েছে। মৃত্যুর পরের সময়টিকে যদিও পরকালের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে, তবুও কোরআন-হাদীস মৃত্যু ও বিচার দিনের মধ্যবর্তী সময়কে আলমে বরযখ নামে অভিহিত করেছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
“ এবং তাদের পেছনে রয়েছে বরযখ- যার সময়কাল হচ্ছে সেদিন পর্যন্ত যেদিন তাদেরকে পুনর্জীবিত ও পুনরুত্থিত করা হবে ” (সূরা মুমিনুন-১০০)
এই আয়াতে যে বরযখ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, এর অর্থ হলো যবনিকা পর্দা। অর্থাৎ পর্দায় আবৃত একটি জগৎ- /ভিন্ন ডাইমেনশনের কাল যেখানে মৃত্যুর পর থেকে আখিরাতের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের রুহ্ অবস্থান করবে। ইসলাম পাঁচটি জগতের ধারণা মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে।

প্রথম জগৎ হলো, রুহ্ বা আত্মার জগৎ- যাকে আলমে আরওয়াহ্ বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় জগৎ হলো মাতৃগর্ভ বা আলমে রেহেম।
তৃতীয় জগৎ হলো আলমে আজসাম বা বস্তুজগৎ- অর্থাৎ এই পৃথিবী।
চতুর্থ জগৎ হলো আলমে বরযাখ বা মৃত্যুর পর থেকে আখিরাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যে সুক্ষ্ম জগৎ রয়েছে, যেখানে মানুষের আত্মা অবস্থান করছে।
পঞ্চম জগৎ হলো আলমে আখিরাত বা পুনরুত্থানের পরে অনন্তকালের জগৎ।

এ কথা স্পষ্ট মনে রাখতে হবে যে, রুহ বা আত্মার কখনো মৃত্যু হয় না। মৃত্যুর পর এই পৃথিবী থেকে আত্মা আলমে বরযখে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ আত্মা দেহ ত্যাগ করে মাত্র, তার মৃত্যু হয় না।

নফস এবং রুহ
নফস এবং রুহ দুইটির মধ্যে পার্থক্য কি ? এব্যপারে অনেকের অনেক রকম মতভেদ লক্ষ করা যায় । কেউ বলে নফস ও রুহ একই জিনিস আবার কেউ বলে দুইটি দুই রকম এবং তাঁদের পৃথক পৃথক সক্রিয়তা আছে ।
নফস ও রুহ সর্ম্পকে কোরান কি বলে ।
সূরা আম্বিয়া আয়াত ৩৪: কুল্লু নাফসুন জায়েকাতুল মওউত ।
অর্থ্: প্রত্যেক নফস মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে ।
সূরা ফাজর আয়াত ২৭ – ২৯: ইয়া আইয়্যুতু হান্নাফসুল মুতমাইন্না,ইরজিয়ী ইলা রাব্বিকা রাদ্বিইয়াতাম্মারদিয়া,ফাদখুলিফী ইবাদী ওয়াদ-খুলী জান্নাতী ।
অর্থ্: হে প্রশস্ত নফস প্রফুল্লচিত্তে স্বীয় পালন কর্তার দিকে প্রত্যাবর্তন কর।প্রভুও তোমার উপর সন্তষ্ট এবং তুমিও প্রভুর উপর সন্তুষ্ট । তুমি আমার বান্দাদের মধ্যে এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর ।এ কথা নফসকে সম্বোধন করে বলা হইতেছে ।
সূরা শামস আয়াত ৬ – ৭ : ওয়া নাফসিও-ওয়ামা সাও-ওয়াহা,ফা-আল হামাহা ফুজুরাহা ওয়া তাকওয়া ।
অর্থ্: যে নফসের পরিশুদ্ধ করিয়াছে সে সফল কাম হইয়াছে।আর যে নফসকে কলুষিত করিয়াছে সে তাঁহার জীবন ব্যর্থ্ করিয়া ফেলিয়াছে ।
সূরা বনী ইসরাইল আয়াত : ৮৪ ওয়াইয়াস আলুনাকা আনির রুহ,কুল্লির রুহ মিন আমরি রব্বি ওয়ামা অুতিতুম মিনাল ইলমি ইল্লা কলিলা অর্থ্: (হে আমার হাবিব ) আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে রুহ সমন্ধে । আপনি বলে দিন রুহ আমার রবের আদেশে সৃষ্ট । এতটুকু জানিয়া রাখ এ ব্যপারে তোমাদের কে অতি অল্প জ্ঞান দান করা হয়েছে ।



নফস এবং রুহ সর্ম্পকে আলোচনায় আসা যাক:
কোরান বলেছে, কুল্লু নাফসুন জায়েকাতুল মওউত ।অথাৎ: প্রত্যেক নফস মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে ।একটু ভালভাবে খেয়াল করুন- কোরান প্রত্যেক নফসের মৃত্যুর কথা ঘোষনা করেছে ।
কোথাও কিন্তু বলা হয়নি- ‘কুল্লু রুহন জায়েকাতুল মওউত’ অথাৎ প্রত্যেক রুহ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে । এমন একটি বাক্য দুরের কথা একটি শব্দও কোরানে উচ্চারিত হয়নি । কেন উচ্চারিত হয়নি ? কারণ রুহ হল আত্মা আর আত্মা কোনদিনও মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে না ।

যাহা মৃত্যুর অধিন নয় তাঁকে বলা হয় অমর । সুতরাং আত্মা হল অমর এবং নিত্য । এই জন্যই কোরানের কোথাও আত্মার মৃত্যু হবে অথবা আত্মার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে এই জাতীয় একটি কথাও নেই । বরং আত্মাকে বলা হয়েছে আল্লাহর আদেশ ও তাঁরই কর্ম্ । এবং এই আদেশ শব্দটির গভীর রহস্য সম্বন্ধে সমস্ত কোরানে মাত্র সতেরবার উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই আদেশটির রুপ খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যাও করা হয়েছে । সুতারং আমরা এখন পরিস্কার বুঝতে পারছি যে, নফস এবং রুহ এক জিনিস নয় বরং সম্পুর্ণ্ আলাদা । নফসেরই মৃত্যু হয় । নফসই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে ।

রুহতো আত্মা বলে সবাই কমবেশি জানি এবং বুঝি । কিন্তু নফস বলতে কী বুঝায় ? মানবীয় সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকেই বলা হয় নফস ।তা যত কমবেশি ভাগেই ভাগ করা হোক না কেন । মানবীয় ইন্দ্রিয়গুলো বলতে কী বুঝায় ? মনের যতগুলো বৃত্তি আছে তথা ডালপালা আছে, সেই বৃত্তিগুলোর কাজ কর্মকেই বলা হয় নফস । এক কথায় মানবীয় চিত্তবৃত্তির সামগ্রিক প্রকাশটিকেই বলা হয় নফস ।
রুহ বা আত্মা সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালাই আপনার জবাব দিয়েছেন কুরআন মাজীদে।

وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي

অর্থাৎ, লোকেরা আপনাকে রুহ বা আত্মা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে জানতে চায়। আপনি বলে দিন রুহ হচ্ছে আমার প্রতিপালকের নির্দেশ মাত্র।(সুরা বনী ইসরাইল: ৮৫ )

অন্য কথায় বলতে গেলে- রুহ একটা অদৃশ্য বিষয়। আমরা যেমন বাতাস ইত্যাদিকে দেখতে পাইনা অথচ, তা উপলব্ধি করতে পারি। রুহ বা আত্মাও সে রকমই একটি জিনিস। বাংলায় যেটাকে আমরা জীবন বা জান বলে থাকি। বিশেষ সাধনায় তা দৃশ্যমান হয় বটে তবে তা খুবই উচ্চমানের সাধু অলিগণ অর্জন করতে পারে।
রূহ সম্পর্কে
সূরা বনী ইসরাইলের ৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا (85)

“এরা তোমাকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করছে৷ বলে দাও,এ রূহ আমার রবের হুকুমে আসে কিন্তু তোমরা সামান্য জ্ঞানই লাভ করেছো।” (১৭:৮৫)

‘‘যিনি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সৃজন করেছেন উত্তমরূপে এবং কর্দম হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অত:পর তিনি তার বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস হতে। পরে তিনি তাকে করেছেন সুঠাম এবং তাতে ফুঁকিয়ে দিয়েছেন তাঁর রূহ হতে এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্ত:করণ, তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’’ সূরা আস-সাজদা: ৭- ৯

‘‘আমি তো বহু জ্বিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তদের কর্ণ আছে তা দ্বারা তারা শ্রবণ করে না, তারা পশুর ন্যায় বরং তারা অধিক বিভ্রান্ত, তারাই গাফিল।’’ সুরা আল-আ‘রাফ: ১৭৯

‘‘আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে, অত:পর আমি তাদেরকে হীনতাগ্রস্থদের হীনতমে পরিণত করি। কিন্তু তাদেরকে নয় যারা মু’মিন ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।’’ সুরা আত-তীন: ৪-৬

এই উপমহাদেশে সনাতন ধর্ম বা আরো আগে থেকেই এই বিষয়ে চর্ছা হয়ে আসছে। আত্মা নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র ধারনা। ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনের একটি মৌলিক ধারণা আত্মা । আত্মার ধারণা সম্পর্কে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য ভাবধারায় দুটি বিপরীতধর্মী মতামত রয়েছে। আত্মাকে সাধারণত একটি স্থায়ী আধ্যাত্মিক সত্তা মনে করা হয়। এই সত্তা দেহকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকে ও মৃত্যুবরণ করে এবং মৃত্যুর পর অন্য দেহে অবস্তান্তর প্রাপ্তি হয়।
ঋক বেদের স্তোত্রে এক ঈশ্বরের উল্লেখ রয়েছে যিনি পরমসত্তা এবং বিশ্বের অন্য সকল দেবতা ও বস্ত্তর সৃষ্টিকর্তা বা উৎস। উপনিষদে এই পরমসত্তাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়: আত্মা, ব্রহ্ম, সৎ (অস্তিত্বশীল সত্তা) ইত্যাদি। আত্রেয় ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে যে, সর্বপ্রথম শুধু আত্মারই অস্তিত্ব ছিল এবং ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আত্মাকে জানলেই সবকিছু জানা হয়ে যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদে অনুরূপ ধারণা লক্ষ করা যয়। এখানে বলা হয়েছে, ‘শুরুতে শুধু একটি সত্তাই ছিলেন, তিনি এক ছিলেন এবং তাঁর কোনো দ্বিতীয় ছিল না।’ বিশ্বতাত্ত্বিক নীতি হিসেবে আত্মা হচ্ছে ‘শাশ্বত আত্মা’ বা ‘শাশ্বত বিদেহী আত্মা’ যা ব্রক্ষের সমার্থক। বৃহদারণ্যক উপনিষদের বিভিন্ন উক্তি, যেমন, ‘এই আত্মাই হচ্ছে ব্রহ্ম’ বা ‘আমিই ব্রহ্ম’, থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, আত্মা ও ব্রহ্ম এক ও অনুরূপ। ব্রহ্ম ‘দ্বিতীয়হীন’। তিনি শুধু এই বিশ্বের নীতি বা স্রষ্টা নন, তিনি বরং প্রতিটি জীবনের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান।

শংকরের অদ্বৈতবাদের (একত্ববাদ) মতো বেদান্ত দার্শনিক সম্প্রদায় আত্মা ও ঈশ্বরের অভিন্নতা সম্পর্কিত উপনিষদের মতবাদ স্বীকার করেন এবং তাঁদের মতে প্রতিটি জীবন্তসত্তা ও ব্রহ্ম সম্পূর্ণ অভিন্ন এবং আত্মা সব জগতে পরিব্যাপ্ত। রামানুজের দ্বৈতাদ্বৈতবাদের (দ্বৈতবাদ) মতো অন্য একটি বেদান্ত দার্শনিক সম্প্রদায় শংকরের অদ্বৈতবাদী মতবাদের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করে। তাঁদের মতে, প্রতিটি জীবন্তসত্তার আত্মা ও পরমসত্তা বা পরমাত্মা ভিন্ন। শংকরের অদ্বৈতবাদ হচ্ছে বিশুদ্ধ নির্গুণ একত্ববাদ, কারণ তিনি এক ঈশ্বর ভিন্ন অন্য কিছু স্বীকার করেন না, বরং ঈশ্বরের মধ্যে সকল প্রকার বহুত্ব অস্বীকার করেন। সুতরাং, তাঁর মতে জগৎ প্রকৃত সৃষ্টি নয়, অবভাস মাত্র। ঈশ্বর তাঁর মায়ারূপ শক্তি দিয়ে এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের অবিদ্যার কারণেই এই জগৎ প্রকৃত জগৎ বলে মনে হয়। রামানুজ ও শংকরের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন যে, ঈশ্বর হচ্ছে পরমসত্তা, কিন্তু তিনি এই কথা অস্বীকার করেন যে, ঈশ্বর ভিন্ন আর কিছু নেই। রামানুজ বহুত্বে বিশ্বাস করেন, কারণ ঈশ্বরের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ রয়েছে: জড়বস্ত্ত ও সসীম আত্মা। রামানুজের দ্বৈতাদ্বৈতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়, কারণ ব্রহ্মের ঐক্যের (অদ্বৈতের) চেতনা ও অচেতন নামক দুটি অংশ রয়েছে। সুতরাং, রামানুজের মতে, শংকর যাকে মায়া বলেছেন, জগৎ সে রকম মায়া নয়, জগৎ ঈশ্বরের (ব্রহ্মের) অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও প্রতিটি আত্মার একটি শারীরিক রূপ আছে, তথাপি আত্মা এই বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে। মুক্ত আত্মা ঈশ্বরের অনুরূপই হয়, তাঁর সঙ্গে অভিন্ন হয় না।
সাংখ্য, ন্যায় বৈশেষিক, যোগ ও মীমাংসার মতো অন্যান্য আস্তিক সম্প্রদায় ও বেদান্ত দার্শনিকদের মতো দেহ-মন থেকে স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক সত্তা হিসেবে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। সাংখ্য দর্শনে আত্মাকে দ্বিতীয় সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই দ্বিতীয় সত্তা পুরুষ নামে পরচিত, আর অন্য সত্তাটি হচ্ছে প্রকৃতি। জগতের বিবর্তনে আত্মা (পুরুষ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনের ফলেই আত্মা বিবর্তিত হতে শুরু করে। সাংখ্যদর্শনে আত্মার অস্তিত্ব স্ব-প্রকাশিত, কারণ প্রত্যেকেই তার স্ব-স্ব অস্তিত্ব অনুভব করে। বেদান্তের অদ্বৈতবাদ যেখানে সকল জীবনসত্তায় পরিব্যাপ্ত এক শাশ্বত আত্মার কথা স্বীকার করে সেখানে সাংখ্য প্রতিটি জীবসত্তার সঙ্গে সংযুক্ত বহু আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে।
ন্যায়-বৈশেষিক ও মীমাংসা দর্শন আত্মাকে অবিনশ্বর, শাশ্বত ও অসীম হিসেবে বর্ণনা করে, কারণ আত্মা দেশকালে সীমাবদ্ধ নয়। দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন থেকে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে আত্মা জ্ঞান, অনুভূতি ও কর্চেছার মতো গুণের অধিকারী। উপনিষদে আত্মাকে অসীম চেতনা হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। অবশ্য ন্যায়-বৈশেষিক ও মীমাংসা দর্শনে চেতনা আত্মার আবশ্যিক ও অবিচ্ছেদ্য গুণ নয়। দেহের সঙ্গে যুক্ত হলেই আত্মাকে সকল চেতনা অবস্থা ও জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে। অবশ্য আত্মা সর্ব পরিব্যাপ্ত নয় বলে সকল জীবনদেহে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন দেহের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আত্মা রয়েছে। দেহ প্রাপ্তি হলেই আত্মায় চেতনা জাগ্রত হয়, তার দেহের বিনাশ সাধনে আত্মা সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান ও চেতনামুক্ত হয়।
যোগদর্শন অনুসারে স্থূল ও সূক্ষ্মশরীরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও আত্মা (জীব) একটি মুক্ত সত্তা। সূক্ষ্ম শরীর ইন্দ্রিয়, মন, অহং ও বুদ্ধির দ্বারা তৈরি। ন্যায় বৈদেশিক এবং মীমাংসা দর্শন থেকে ভিন্নমত পোষণ করে যোগদর্শন দেহ ও মন থেকে মুক্ত আত্মাকে বিশুদ্ধ চেতনা হিসেবে গণ্য করে। অবিদ্যা বা অজ্ঞানতার কারণে আত্মা ও মনকে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হয়।
তিনটি নাস্তিক্য দার্শনিক সম্প্রদায়ের (এখানে নাস্তিক্য বলতে বেদের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা বুঝানো হয়েছে) মধ্যে জৈনদর্শন আত্মা সম্পর্কিত চার্বাক ও বৌদ্ধ দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে। আস্তিক্য দার্শনিক সম্প্রদায়ের মতো জৈনদর্শন মনে করে যে, জীব ও অজীব সকল সত্তার মধ্যে আত্মা বিরাজমান, কিন্তু চার্বাক ও বৌদ্ধদর্শন এই মতবাদ সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। জৈনদের মতে, পৃথিবীতে যত সংখ্যক বস্ত্ত আছে, ঠিক ততো সংখ্যক আত্মাও আছে।
দেহ থেকে স্বতন্ত্র আত্মার অস্তিত্ব বিদ্যমান- চার্বাক বস্ত্তবাদীরা ভাববাদীদের এরূপ মতবাদ প্রত্যাখ্যান করে। চার্বাক দর্শন অনুসারে চৈতন্যযুক্ত দেহই আত্মা। চৈতন্য দেহের গুণ, আত্মার গুণ নয়। ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চারটি প্রত্যক্ষগোচর উপাদানের সমন্বয়ে দেহে চেতনার উদ্ভব হয়। দেহের মৃত্যু হলে এই চারটি উপাদান খন্ড-বিখন্ডিত হয় এবং চেতনার বিলুপ্তি ঘটে। ফলে চেতনার আর কোনো অংশই অবশিষ্ট থাকে না।
চার্বাকদের মতো বৌদ্ধদর্শনও আত্মা সম্পর্কিত ভাববাদী মতবাদ প্রত্যাখ্যান করে; এবং একই সঙ্গে আত্মা দেহের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ- চার্বাকদের এই মতবাদও প্রত্যাখ্যান করে। বৌদ্ধ অনাত্মবাদকে বৌদ্ধদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে গ্রহণ করা যায়: প্রতীত্যসুম্যুৎপাদ এবং অনিত্যবাদ ও ক্ষণিকত্ববাদ। প্রতীত্যসম্যুৎপাদ তত্ত্ব অনুসারে জগতের সমুদয় বস্ত্ত ‘অন্যকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত, আকস্মিক, অনিশ্চিত ও ঘটনাচক্রজাত এবং অন্য কিছু দ্বারা শর্তাধীন এবং সকল কিছু পৌর্বাপর্য সম্পর্কে সম্পর্কিত, অর্থাৎ সব কিছুর আগমন ঘটছে আবার তিরোহিত হচ্ছে, আবির্ভূত হচ্ছে আবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ক্ষণিকত্ববাদ অনুসারে, সমগ্র বিশ্ব একটি অন্তহীন পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার অধীন, সকল শরীরী এবং অশরীরী বস্ত্ত নিরন্তর পরিবর্তনশীল। সুতরাং, মানুষের মধ্যে স্থায়ী বা শাশ্বত দ্রব্য বলে কিছু থাকতে পারে না। বৌদ্ধদর্শন তাই অস্বীকার করে যে, জীবন্তসত্তার সদা পরিবর্তনশীল উপাদানের মধ্যে স্থায়ী কোনো কিছু থাকতে পারে। আমরা সাধারণত যখন ‘আমি’ শব্দ ব্যবহার করি তখন এর দ্বারা স্থায়ী কোনো কিছু নির্দেশ করে না। একটি নিত্য পরিবর্তনশীল সত্তা বলতেই এই প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করা হয়।
তাই বলে বৌদ্ধ দর্শন অ-বস্ত্তগত কোনো সত্তার অস্বিত্ব অস্বীকার করে না এবং বৌদ্ধদর্শন দৈহিক বস্ত্ত ও মানসিক বস্ত্তর মধ্যে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য সৃষ্টি করে। বৌদ্ধদর্শন অনুসারে, প্রত্যক্ষগোচরীভূত মানবসত্তা পঞ্চখন্ডের সমষ্টি যা নাম-রূপ নামে অভিহিত। এখানে রূপ হচ্ছে জড় অংশ এবং নাম হচ্ছে মানসিক অবস্থা, যেমন, অনুভূতি, প্রত্যক্ষ, মানসিক গঠন ও চেতনা। আত্মাকে যেমন এই খন্ডগুলোর সমষ্টি বলা যায় না, তেমনি এসব থেকে ভিন্নও বলা যায় না। আত্মা হচ্ছে শুধুমাত্র এসব খন্ডের সমষ্টির নাম মাত্র। এই বিষয়টি একটি বৌদ্ধ শাস্ত্রীয় গ্রন্থ Questions of King Milinda-এ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমাদের পিতা-মাতা আমাদের প্রত্যেকের নামকরণ করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তির নাম নাগসেন রাখা হয়, তাহলে এই নামটি শুধুমাত্র হবে একটি ‘নাম, একটি উপাধি, একটি ধারণাগত শব্দ, বর্তমান খেতাব’ ইত্যাদি। তাই ব্যক্তি নাগসেনের আত্মাকে এসবের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা অন্য একটি উদাহরণ দিতে পারি। একটি রথ দন্ড, খুঁটি, চাকা, কাঠামো, পতাকার খুঁটি, জোয়াল, লাগাম ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে তৈরি। কিন্তু রথের এসব উপকরণের মধ্যে রথকে আবিষ্কার করা যায় না, কিংবা এর সবগুলো উপকরণকে একত্রিত করলেও তার মধ্যে রথকে পাওয়া যায় না। ‘নাগসেন’ নামটি দেহের ৩২টি অংশ বা খন্ডের উপর নির্ভরশীল। একইভাবে ‘রথের’ নাম বা ধারণাগত শব্দটি খুঁটি, দন্ড, চাকা প্রভৃতির উপর নির্ভরশীল।
বৌদ্ধদের অনাত্মা মতবাদ এবং ব্রিটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউমের আত্মা বা মনের সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে। হিউম যুক্তি প্রদান করেন যে, আমাদের আত্মা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, কারণ আমাদের আত্মার কোনো ইন্দ্রিয়ছাপ নেই। তিনি আরো বলেন যে, আমি আমার মধ্যে এক ধরনের প্রত্যক্ষণ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাই না, যেমন ‘গরম বা ঠান্ডা, আলো বা ছায়া, ভালোবাসা বা ঘৃণা, বেদনা বা আনন্দ’ ইত্যাদি। হিউমের মতে, আমরা যাকে আত্মা বলি তা বিভিন্ন প্রত্যক্ষণের পুঞ্জ বা সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়, এসব প্রত্যক্ষণ ধারণাতীত দ্রুততার সঙ্গে পরস্পরকে অনুসরণ করে এবং সব সময়ই পরিবর্তিত হতে থাকে। হিউম যাকে বিভিন্ন প্রত্যক্ষণের পুঞ্জ বা সমষ্টি বলেন তাই বৌদ্ধদর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মানসিক প্রবাহধারা বা মানসিক প্রক্রিয়া’ এবং এর পিছনে কোনো আত্মা নেই। যেমন নেই ‘বিভিন্ন প্রত্যক্ষণের পুঞ্জ বা সমষ্টি ছাড়া’ কোনো মন বা আত্মা নেই। [নিরুকুমার চাকমা]

এই পর্বে রুহ বা আত্মা নিয়ে এত আলোচনার কারণ একটাই পরবর্তীতে জন্মান্তরবাদের মূল বিষয় হিসেবেই আত্মাই মূখ্য ভূমিকায় থাকা। দেহেরতো আপন লয় হয়ে যায় স্বল্প সময়ে। বহুমূখি ধারায়। যে প্রাণের উপস্থিতিতে দেহ এতটা দামী বা মূল্যবান এক অস্তিত্ব তার স্বরুপ অন্বেষনে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা!
র্ধৈর্য্যশলি পাঠকরা আশাকরি উপকৃত হয়েছে। যারা জানেন তারা তো জানেনই যারা জানেন না তাদের জন্য তথ্য সন্নিবেশন।

প্রথর্ম পর্বের লিংক
ক্রমশ:

সংকলন তথ্য সূত্র: অন্তর্জাল
সকল সাইট, সকল লেখক এবং সকল গবেষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে তথ্য সংগ্রহের ফলে সকল লিংক দিতে না পারায় দু:খিত।
কিছু পুরানো বই এবং যারা এ যাবত কাল এই জ্ঞান এবং ভাবনাকে চলমান রেখেছেন সকলের প্রতি শ্রদ্ধা !
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০২
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×