আগের কাহিনীর পর.........।
কাহিনী দুই+তিন
ডিভিটার খবর পাওয়ার পর মনে মনে খুঁজাখুঁজি শুরু হইয়া গেল যে এলাকার কেউ আম্রিকায় থাকে কি না। বহুত খুঁজাখুঁজির পর আমাদের থানায় একজন লোককে পাওয়া গেল যে কিনা অনেক বছর থেকেই আম্রিকায় থাকে। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দুরে সেই ভদ্রলোকের বাসা। মাগার যোগাযোগের কোন মাধ্যম পাওয়া গেল না।
এরই মধ্যে খবর পাইলাম আমাদের ক্যাম্পাস থেকেই নাকি দুই বড় ভাই ডিভি পাইয়া আম্রিকা গেছে! উনারা নাকি প্রথম আর দ্বিতীয় ব্যাচের ছিলেন আর আমি কিনা সেই ক্রমে সপ্তম ব্যাচের ছেলে। আর মজার ব্যাপার হইল ওনারাও নাকি ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্সের ছাত্র ছিলেন। আমাদের ক্যাম্পাসের ভেটদের মধ্যে একটা অসাধারণ ব্রাদারহুড আছে যেইটা অন্য কোন সাবজেক্টের ছেলেদের মধ্যে নাই। বড়ভাইরা বেশ হেল্পফুল। লাকিলি এই দুইজন ভদ্রলোকই আমার ডিভি প্রসেসিঙের সময় দেশে গেছিলেন।
ফার্স্ট ব্যাচের ভাইয়ের নাম হইল শাওন ভাই। অসাম লোক একজন। আমারে নিজের ছোটভাইয়ের মতই মনে করেন এই ভাই আমাকে। ইনার সাথে প্রথম দেখা হইছিল আমাদের হলের (বর্তমানে তাজউদ্দীন হল) রাজু ভাইয়ের রুমে! যাইয়া দেখি এনারা জামাত কইরা বিড়ি টান্তেছেন! তার উপ্রে ওইসময় উনারা একটা রহস্যময় পানীয় নিয়াও আলাপ করতেছিলেন। আমি হাল্কা ভড়কাইয়া গেলেও আশা হারাই নাই। পরবর্তীতে উনার কাছ থেকে অনেক সুন্দর সুন্দর উপদেশ পাইছি। ইনি না থাকলে আম্রিকায় লাইফ আরেক্টু কঠিন হইয়া যাইত আরকি! এই লোক কোন অলৌকিক যাদুমন্ত্রবলে সেকেন্ড ব্যাচের এক আপুকে (সিমি আপু) পটাইয়া বিবাহ করিয়া আম্রিকা ভাগাইয়া নিয়া আসছে। এখন উনারা এক বাচ্চা লইয়া উডসাইডে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতেছেন। ইনফ্যাক্ট আমিও টেকনিক্যালি ওই বাসাতেই থাকি। আমি প্রায়ই চিঠিপত্র আন্তে ওইখানে যাই।
যদিও ইনি আমারে বহুত হেল্প করছেন মাগার এই লোক আমাকে বহুত চাপে রাখিয়াছেন। কয়েকদিন পর পর জিজ্ঞাসা করেন কলেজে এত্ত সুন্দরি থাকতে আমি কাউকে পটাই নাই কেন? খালি কয়েকদিন পর পর একই প্রশ্ন করিয়া লজ্জা দেন। উনি তো আর জানেন না এই অধমের মাথায় কি চলিতেছে! একবার এনারে কইলাম একটা খুশির খবর আছে। এই লোক উত্তরে আমারে কয়, “কই ছবি দেখি”!
সেকেন্ড ব্যাচের বড় ভাইয়ের নাম হইল তাপস। এই লোকের সাথেও আমার দিনাজপুরেই দেখা হইছিল। এই লোকটা হইল আমার দেখা সবচেয়ে ভাল আর রিলায়েবল মানুষগুলার মধ্যে অন্যতম। এই দাদা আমাকে কিছু স্পেসিফিক ইনফরমেশন দিয়ে হেল্প করছেন। উনার কাছে যখন প্রথম শুনছিলাম যে আম্রিকায় যাইয়া প্রথমে অড জব করতেই হবে, তখন মনে মনে ধরেই নিছিলাম যে আম্রিকায় যাইয়া নির্ঘাত ড্রেন পরিষ্কার করা লাগবে! উনার কাছ থেকেই শুনছিলাম যে ট্যাক্সি চালাইয়া পড়াশুনা করা সম্ভব। তখন থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করছিলাম যে আম্রিকায় যাইয়া ট্যাক্সি ড্রাইভার হমু আর কলেজে যামু!
এই দুইজন লোক এই মুহূর্তে আম্রিকায় আমার সবচেয়ে কাছের লোক। আমি তাদের নিঃস্বার্থ উপকারের জন্য আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
যাইহোক কাহিনীতে ফিরার সময় হইছে!
এরপর বাসায় আইসা আম্রিকা যাবার প্রিপারেশন তৈরি করা হইয়া গেল। লাগেজ গুছানো একটা ভয়াবহ রকমের স্ট্রেসফুল কাজ হইয়া দাড়াইল। আস্তে আস্তে আত্মীয় স্বজন সবার বাড়িতে যাইয়া যাইয়া বিদায় নিয়া আসলাম সাথে ফাইনাল মেহমান খাওয়া! বাড়িতে মিলাদ পড়ানো হইল বেশ ধুমধামের সাথেই। বাড়ি থেকে আসার কয়েকদিন আগে আমার আব্বা আমাকে বারান্দায় বসাইয়া বলল, “শোন বিদেশে তো যাইতেছিস। যা কোন সমস্যা নাই। কিন্তু মদ, নারী আর জুয়া এই তিনটা জিনিস থেকে দুরে থাকবি। যদি না পারিস তাইলে ধ্বংস অনিবার্য।” এখনো পর্যন্ত সেই ধরনের কোন সিচুয়েশনের মুখোমুখি হইলে আমার মাথায় এই স্টেটমেন্টটা অটোমেটিক্যালি প্লে হয়।
তারপর একদিন হুট করেই সেই ড্রেডেড দিনটা চলে আসলো। বাড়ি মেহমানে গিজ গজ করতেছে। আমার আম্মা সকাল থেকেই কানতেছে। আমার খালারা আমার মাকে সান্তনা দিবার ব্যারথ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমার চাচা চাচীরা আসছে। আমার খালারা, খালাত ভাই বোন সহ আরও অনেকে আসছে। সকালেই ঘুম থেকে উঠে আমি নানার সাথে দেখা করে আসলাম (আমাদের বাসা থেকে প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার দুরে তাদের বাসা)। এত্ত ভ্যাজালের মধ্যেও এতগুলা লোকের জন্য খাবার-দাবারের ব্যাবস্থা আমার মাকেই করা লাগল। আমার চাচি-খালারাও অবশ্য কিছুটা হেল্প করল। এই দিনে বাড়ির পরিবেশটা অদ্ভুত হয়ে গেছিল। বাতাসে উৎসবের আমেজ যেমন ছিল তেমনি শোকাবহ একটা পরিবেশ ছিল।
বিকাল হইলে বাসা থেকে বের হবার সময় হয়ে গেল। আমার লাগেজ আগে থেকেই গুছানো ছিল। আম্মা আমার লাগেজে চিড়া দিতে চাইছিল, অনেক বলে কয়ে নিরস্ত করা লাগছিল। পরিবেশটা আগে থেকেই বিস্ফোরণমুখী ছিল, ওই সময় যেন সবার ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গে গেল। আমার আম্মার কান্না দেখে তো মনে হইলে যে আমারে বাড়ি থেকে বাইর হইতেই দিবে না। আমার খালারা, চাচীরা, পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই আমার জন্য কান্তেছিল। আমার দাদি বারান্দার সিঁড়িতে বসে মাথায় হাত দিয়া কান্তেছিল। আমার আব্বা, যেই লোকটাকে আমি কোনদিন তার কুল হারাইতে দেখি নাই, সবসময় ধৈর্য আর স্ট্রেন্থের প্রতিমূর্তি হিসাবে ছিল। কোনদিন ইমোশনাল কোন দুর্বলতা প্রকাশ করতে দেখি নাই। সেই আব্বা আমার যাওয়ার সময় সামলাইতে না পারে কাঁদে ফালাইল। কান্তে কান্তে শুধু আমার দাদিকে বলল “তোর নাতি চলে যাচ্ছে, দুয়া করিস মা”। এই মেমরিটা যখনই আমার চোখের সামনে আসে তখনই নিজেকে এতটা দুর্বল মনে নিজেকে, যেইটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। গলার কাছে লাম্প ফর্ম হয়, ডীপ ব্রেথ নেওয়া লাগে কয়েকটা। নিজেকে বলা লাগে, “কাম ডাউন বিপ্লব”।
একটু তার পরে আমিও কান্তে কান্তে বাইর হইলাম, বিয়া দেওয়ার সময় গ্রামে কনেগুলা যেইভাবে কান্দে ঠিক সেইভাবে। বাইর হইয়া দেখি আশেপাশের সব লোক বাইর হইয়া রাস্তায় দাঁড়াইয়া আছে। আমারে দেখতেছে। দেইখা তো পুরাই শরম পাইয়া গেলাম। হাজার হোক ছেলেমানুষ তো! রাস্তায় দাঁড়াইয়া তো আর কান্তে পারি না। মহা মুসিবতে পইড়া গেলাম। কান্না আর শরম পাওয়া দুইটার কুনটারেই থামাইতে পারতেছি না। তাড়াহুড়া কইরা কান্তে কান্তে মাইক্রোতে উইঠা বাঁচলাম!
তারপরে ব্যাপারটারে ফাস্ট ফরোয়ার্ড কইরা এয়ারপোর্টে নিয়া আসি। এয়ারপোর্ট খালি দূর থেইকা দেখছিলাম যখন ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসছিলাম তখন। এইবার একচুয়ালি এয়ারপোর্টে আইসা কেমন ভয় ভয় হইতে লাগল। এয়ারপোর্টে আনোয়ার নামে আমাদের গ্রামের এক ছেলে কাজ করত। ওর সাথে আব্বা আগেই কথা বলে রাখছিল। ওরে ফুন দেওয়াতে ও আইসা আমাদেরকে ভিত্রে নিয়া গেল। ওইখানে ঢুকার সময় দেকলাম ভিত্রে ঢুকতে আবার ২০০ টাকা কইরা দেওয়া লাগে! অবশ্য না হইলে দেখা যাইত গরমের সময় আশেপাশের লোকজন ওইখানে বিনা কামে যাইয়া এসির বাতাস খাইত!
যাইহোক এই লোক আমারে ভিত্রে নিয়া চা খাওয়াইল। তারপর প্র্যাক্টিক্যাল কিছু লেসন দিয়া দিল। উনি আমারে কইয়া দিলেন পিলেনের ভিত্রে খাওয়া দাওয়া সব ফিরি। খালি লাল পানি খাইতে নাকি টাকা দেওয়া লাগবে। একটু পরে সময় হইয়া গেলে ফরমালি ভিত্রে ঢুকলাম। ব্যাগ স্ক্যান করাইলাম। আমার গ্রামের এক মামা আসছিল আমার সাথে এই লোক কইল, ব্যাগগুলা দড়ি দিয়া পেচাইয়া দাও নাইলে ছিড়া যাইতে পারে। তারপর ওই মামাই আমার একটা ব্যাগ এমুনভাবে দড়ি দিয়া বাইন্ধা দিল যে পিলেন ছিরা যাইতে পারে মাগার লাগেজ ছিড়ব নাহ! এরাম দড়ি বান্ধা আমি কেবল কাপড়ের গাট্টিতেই বানতে দেখছি। এরপর যারা আসছিল তাদের কাছ থেইকা বিদায় লইয়া ইতিহাদ এয়ারলাইন্সের লাইনে দাঁড়াইলাম। এই খানে যাইয়া শুনলাম আমারে নাকি পিলেন চেঞ্জ করা লাগবে? ভয়াবহ ব্যাপার একটা! একটা পিলেনেই উঠি নাই, আবার আরেকটারে নাকি খুঁজা বাইর করা লাগবে? এরপর সবার দেখাদেখি ক্যামনে ক্যামনে কইরা ইমিগ্রেশনও পার হইয়া গেলাম। গেটটাও নিজে নিজেই খুইজা বাইর করলাম। মজার ব্যাপারটা হইল যে এই মুহূর্ত থেইকা ফ্যামিলিরে ছাইড়া যাওয়ার যে বিষণ্ণ ভাবটা ছিল সেইটা চইলা গেছিল। আমি নতুন হোয়াটেভার সামনে আইতেছিল তার জন্য এক্সাইটেড ফীল করতেছিলাম।
(চলতে থাকপে......।)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:২২