বন্ধুত্ব নিয়ে বিখ্যাত ফিলসোফার এরিস্টটল বলেছেন “ প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু, বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয়,ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়। ” বন্ধুত্ব নিয়ে এর চেয়ে খাটি নিখাত বাক্য আর হতে পারে না। বন্ধুত্ব নিয়ে জ্যাক দেলিল বলেছেন “নিয়তি তোমার আত্মীয় বেছে দেয়, আর তুমি বেছে নাও তোমার বন্ধু।” কথাটার মাঝে চরম মাত্রায় সত্য পদার্থ আছে । কথায় আছে মানুষ তার আপন প্রকৃতির মানুষকেই বেশী পছন্দ করে তাই এতটুকু বলা যায় আমরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মতাদর্শের সাথে মিলে এরকম কারো সাথেই আমরা বন্ধুত্ব করি।
এছাড়া এই মুহূত্যে মনে পড়ছে বন্ধুত্ব নিয়ে জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত উক্তি যা আমরা হরহামেশাই বলে থাকি “যদি থাকে বন্ধু মন গাং পার হইতে কতক্ষণ।” বন্ধু নিয়ে চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন “ আমার সব থেকে ভালো বন্ধু হল আয়না, কারণ আমি যখন কাঁদি তখন সে হাঁসে না ”
আমার কাছে বন্ধুত্ব হল নির্মল এক সম্পর্কের নাম যার কাছে জীবনের অনেক কিছুই শেয়ারের করা যায়, যাকে বিশ্বাস করা যায়, যার সাথে সময় কাটালে ভাল লাগে। বন্ধু নিয়ে রবার্ট লুই স্টিভেন্স বলেছেন “ কোন মানুষই অপ্রয়োজনীয় নয় যতক্ষণ তার একটিও বন্ধু আছে ।” বন্ধুত্ব নিয়ে আমি এক আর্টিকেল পড়েছিলাম যেখানে লেখা ছিল সেই সফল যার জীবনে ৩-৪ জন সত্যিকারের ভাল বন্ধু আছে।
Childhood is magical. You only get to be a child once, so don't spend it worrying too much about the future ! মার্ক জুকারবার্গের মেয়ে হয়েছে আরেকটি এবছর, মেয়েকে লেখা খোলা চিঠিটার এক জায়গায় উপরুক্ত কথাগুলো বলেছেন জুকারবার্গ! এর চেয়ে নিখাদ খাটি কথা আর হতে পারে না! ছোটবেলার সেই রঙ্গিন সময়গুলোকে বন্ধুরা আরও বেশী রাঙ্গিয়ে তুলে।আজ শৈশব-কৈশোরের বন্ধুদের বিষয়ে আলোচনা করব না, সেটা অন্যকোন দিন বলব না হয়।
বেশীর ভাগ মানুষের সবচেয়ে ভাল বন্ধু নাকি হয় স্কুলের বন্ধুদের সাথে। আমার স্কুল জীবন থেকে কলেজের জীবনে বেশ কিছু ভাল বন্ধু পেয়েছিলাম। আমি পড়তাম পুরনো ঢাকার এক সরকারী কলেজে।কলেজে যখন ফাস্ট ইয়ারে পরি তখনই পরিচয় হল ইমতিয়াজ আর ইশতিয়াক এর সাথে। ওরা দুজন চাচাত ভাই ছিল, দুজনই ছিল অত্যন্ত শরীফ ও নরোম মেজাজের।কলেজের গেটে ওদের সাথে আমার পরিচয় হল। অল্প দিনেই আমরা বেশ ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম, আমরা এক সাথেই ফিজিক্স, কেমিস্টি প্রাইভেট পড়তাম তাই দিনের বেশীর ভাগ সময়ই এক সাথে থাকা হত আমাদের। আমরা তিন জনেই এক সাথে বসতাম কলেজে, কেউ একজন আগে আসলে বাকিদের জন্য জায়গা রেখে দিতাম।
আহা কি সময় ছিল তখন। এই লেখাটা লেখার সময়ও বারবারই নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছি! সকাল সকাল কলেজে চলে আসতাম আমরা, এসেই কলেজের সামনে একটা হোটেল ছিল, সেখানে গিয়ে একসাথে নাস্তা করতাম।
একবার আমরা বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম সংসদভবন যাব ঘুরতে। খাদ্যের ব্যাপারি আমি হুসিয়ার আদম, যাবার সময় বেশী করে খানা-খাদ্য কিনে নিয়ে গেলাম। সংসদভবনে সারাদিন ঘুরাঘুরি করলাম, দুপুরে একসাথে ভোজন কর্ম সম্পাদান করলাম, ব্যাপক আড্ডা দিয়েছিলাম সেদিন।
ওদের বাসা ছিল বিক্রমপুর, ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকত ওরা। ঢাকায় ওদের গাড়ির টায়ারের দোকান ছিল , ওরাও সেই দোকানে মাঝে মাঝে বসত। আমার কলেজে যাবার পথে ওদের দোকান পরত। আমি সেই পথ দিয়ে গেলে ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করত সেখানে , তার পর তিন বন্ধু এক রিক্সায় যেতাম কলেজে। সেই দিনগুলো কখনও ভুলার নয়!
দেখতে দেখতে কলেজ শেষ হয়ে গেল। ইন্টারমিডিয়েটের আমলনামা যেদিন হাতে পেলাম সেই দিনই ওদের সাথে কলেজে শেষ মোলাকাত হয়েছিল। এরপর কলেজ শেষ করে ওরা অনার্সে ভর্তি হল, আমি হলাম ইঞ্জিনিয়ারিং।মাঝে অবশ্য ওদের দোকানে গিয়ে কয়েকবার দেখা করেছিলাম। দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ই দেশের বাহির থেকে আন্ডারগ্রাজুয়েট স্কলারশিপ পেলাম। দেশের বাহিরে যাবার পর আর ওদের সাথে আমার যোগাযোগ হত না। ওদের ফোন নাম্বার হারিয়ে ফেলেছিলাম কিভাবে যেন।
আমি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শেষ করে মাঝখানে দেশে এসেছিলাম, ওদের সাথে দেখা করতে সেই দোকানে গিয়েছিলাম কিন্তু আফসোস ওদের আর খুঁজে পাইনি, ওই দোকানটা এখন অন্য কেউ চালায়। আমি ওদের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কেউ কোন তথ্য দিতে পারেনি।
এখন দেশের বাহিরে পি,এইচ,ডি করছি। কিছুদিন আগে বউ বাচ্চা নিয়ে দেশ থেকে ঘুরে এলাম । দেশে আমার শৈশব-কৈশোরের সব বন্ধুদের সাথে প্রায় প্রতিদিনই মন খুলে আড্ডা দিতাম।ইমতিয়াজ আর ইশতিয়াকদের দোকানটা যেখানে ছিল, রাস্তা দিয়ে যাবার সময় তাকিয়ে ছিলাম দোকানটার দিকে,কেমন যেন বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
আমার বউ বলে ফেইসবুকে খুঁজে দেখ পাবে হয়ত, আমি প্রায় খুঁজি ওদের কিন্তু পাই না! পৃথিবীটা গোল হয়ত কোন একসময় ওদের খুঁজে পাব। যেখানেই থাকুক ভাল থাকুক আমার বন্ধুরা।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪২