কাজটা খুব একটা সহজ নয়, তারপরও তার গবেষণার জন্য কাজটি তাকে করতেই হবে। সেন্ট্রাল ডাটাবেসের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্রোন, তাই সিকিউরিটি ভেঙে তথ্য বের করা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া ধরা পরলে প্রাণ দন্ডে দণ্ডিত হতে হবে ইথান সেটা খুব ভাল করেই জানে।
ইথান একটা সিমিউলেটেড পৃথিবী তৈরি করবে, যেখানে এই সত্যিকারের পৃথিবীর আদলে সব বাড়িঘর অফিস-আদালত, রাস্তা ঘাট এমনকি মানুষজন থাকবে। সেন্ট্রাল ডাটাবেসে প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা আলাদা প্রোফাইল সংরক্ষিত আছে। এই প্রোফাইলে সবার জিনোম সিকোয়েন্স, মস্তিষ্কের নিউরন সংখ্যা এবং মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষণের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্রোন অত্যন্ত শক্তিশালী এলগোরিদম ব্যাবহার করে প্রতিটি মানুষের প্রোফাইলের এই তথ্যগুলোকে এনকোড করেছে। প্রতিটি মানুষ কি পড়াশুনা করবে, কি ধরনের চাকরি করবে, কার সাথে বন্ধুত্ব করবে এমনকি কাকে বিয়ে করবে এই বিষয়গুলো মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ক্রোন নির্ধারণ করে।
ইথান পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রোফাইল হ্যাক করে তার সিমিউলেটেড পৃথিবীতে ব্যাবহার করবে যাতে সিমিউলেটেড পৃথিবী সত্যিকারের পৃথিবীর একটা অনুলিপি হয়, কোন পার্থক্যই যেন ধরা না যায়। ইথান ইতিমধ্যেই সত্যিকারের পৃথিবীর আদলে সিমিউলেটেড পৃথিবী তৈরি করেছে এবং একটি শক্তিশালী এলগোরিদম তৈরি করেছে। এই এলগোরিদমের বিশেষত্ব হল যখনই কোন মানুষের প্রোফাইল পাবে তখন সেই মানুষের একটা অনুলিপি তৈরি করবে। কাজটা খুব একটা কঠিন নয় কারণ মানুষের জিনোম সিকোয়েন্সে প্রতিটি মানুষের বায়োলজিক্যাল তথ্য যেমন গায়ের রং, উচ্চতা, শারীরিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সব কিছুই ইন-কোডেড অবস্থায় সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে।এই এলগোরিদমটি যখনই এই তথ্যগুলোকে পাবে তখনই জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে হুবহু সত্যিকারের পৃথিবীর মানুষের আদলে প্রতিটি মানুষ তৈরি করবে, আর যেহেতু স্মৃতিসহ আছে তাই সত্যিকারের পৃথিবীর মানুষের সাথে কোন পার্থক্যই থাকবে না।
বেশ কয়েকমাস নিরলস ভাবে চেষ্টা করে অবশেষে ইথান কোয়ান্টাম কম্পিউটার ক্রোনকে ফাকি দিয়ে সেন্ট্রাল ডাটাবেস হ্যাক করল। অত্যন্ত সাবধানে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের প্রোফাইল এমনকি তার নিজেরটাসহ সে তার সিমিউলেটেড পৃথিবীতে প্রবেশ করাল।
ইথান ওয়ারলেস হেড ফোনের মাধম্যে তার নিজের ভার্সনের সাথে যোগাযোগ করল। অন্য কারো সাথে যোগাযোগ করা খুব একটা নিরাপদ নয় কারণ সিমিউলেটেড পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই নিজেরাও হয়ত জানেও না তাদের সিমুউলেশোন করে তৈরি করা হয়েছে।
'কেমন আছ ইথান? আমি সত্যিকারের পৃথিবীর ইথান বলছি।'
'ভাল! তুমি কেমন আছ ইথান?'
'ভাল। শুন আমাদের দুজনের নাম যেহেতু একই তাই তোমাকে আমি অন্য নামে ডাকতে চাই। তুমি একটা সিমুউলেটেড পৃথিবীতে আছ তাই তোমার নাম আজ থেকে সিমুউলেটেড ইথান। ঠিক আছে?'
'হুম। তোমার যা ইচ্ছে।'
এরপর থেকে তারা দুজন প্রায় কথা বলে, ইথান অফিস থেকে ফিরলে তাকে খাবারের কথা মনে করিয়ে দেয়, তার সাথে গল্প করে। ইথান খুবই একাকী একটা ছেলে তার বায়োলজিক্যাল বাবা মা নেই, তাকে জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করে গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছে, তাই সে ল্যাবরেটরিতেই বড় হয়েছে। ল্যাবরেটরিতে বড় হবার ফলে তার সামাজিকতার কিছুটা ঘাটতি আছে, কাজেই ইথানের ভাল কোন বন্ধু নেই, যার সাথে মনের ভাব আদান-প্রদান করবে, ঘুরতে বের হবে বা একসাথে বসে কখনও দুপুরের খাবার খাবে।
সিমুউলেটেড ইথানের সাথে কথা বলতে বলতে তার আর আজকাল খুব একটা একাকী অনুভব হয় না। নিজের মনের কথা বলতে পারে, নিজের কাজ নিয়ে আলোচনা করতে পারে, হোকনা সিমুউলেটেড তবু-তো তার নিজস্ব অনুলিপি তাই তাকে অনেক বুঝতে পারে।
ইথান আজকাল নিজের মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ করেছে, কিছুটা সামাজিক আচরণ করতে পারছে সে, বেশ কিছু বন্ধুও জুটেছে তার। সময়গুলো আগে মত আর নি:স্বঙ্গ লাগে না তার।
এক পড়ন্ত বিকেলে ইথান অফিস শেষে নিজে গাড়ি চালিয়ে বাসায় আসছিল। হঠাৎ মোবাইলে রিং বেজে উঠল। গাড়িটার গতি কিছুটা কমিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটি মেয়েলি কণ্ঠ কোমল গলায় বলল 'হ্যালো ইথান আমি নীসিতা বলছি।'
নীসিতার গলা শুনেই ইথানের বুকের ভিতরটা কেমন জানি ধরাস করে উঠল। স্মৃতি হাতরে সাত বছর আগে চলে গেল। ইথান তখন কলেজে পড়ে, নীসিতার সাথে কলেজেই প্রথম দেখা হয়। প্রথম দেখাতেই নীসিতাতে মুগ্ধ ইথান। সেই মুগ্ধতার ডালপালা ছড়াতে আর বেশীদিন সময় নেয়নি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনেই খুব ভাল বন্ধু হয়ে যায়, একসাথে ক্লাসের বেঞ্চে বসা, দুপুরের খাবার খাওয়া এবং ঘুরে বেরানো চলতে থাকে। অল্পদিনেই ইথান নীসিতার জন্য মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং নরেপিনেফ্রিন নামক ভালবাসার জন্য দায়ী হরমোনের অস্তিত্ব টের পায়। তবে সেই ভালবাসা কুড়ি থেকে ফুটবার আগেই ঘটে বিপত্তি, নীসিতার জেনেটিক্স এক ধরনের জটিল রোগ ধরা পরে।
'ইথান শুনছ? আমি সেন্ট্রাল হসপিটাল থেকে বলছি। ডক্টর বলেছে আমি কোমা থেকে সুস্থ হয়ে গেছি। শরীরটা খুবই দুর্বল। জানোতো আমার বায়োলজিক্যাল বাবা-মা নেই তুমি একটু আসবে।' ভেজা গলায় বলল নীসিতা। তার কন্ঠে আকুলতা ঝরে পড়ছে।
ইথানের চিন্তায় ছেদ পরল, মনটা হু হু করে উঠল। মনের অজান্তেই ফোনটা রেখে সেন্ট্রাল হসপিটালের পথে গাড়ি ঘুরালো।
'সিমুউলেটেড ইথান তুমি কি শুনছ?' ঠোট দিয়ে জিব ভিজিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ইথান। ইথানকে দেখে বুঝার উপায় নেই কত বড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার হৃদয়ে।
'হুম, শুনছি।'
'এটা তোমার কাজ তাই না সিমুউলেটেড ইথান! ও আচ্ছা সত্যিকারের ইথান!'
ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এলো। 'কিভাবে বুঝলে তুমি?'
'আমি এত দিন তোমাকে সিমুউলেটেড ইথান ভেবে আসছিলাম, অথচ' কিছু বলতে চাচ্ছিল ......আমি কত বোকা বলেই থামল।
একটু জিরিয়ে নিয়ে বলল 'তুমি আসলে অনেক নি:স্ব একাকী অথচ আমাকে এই জগতে কিছু বন্ধু দিয়েছ, আমি মানে তুমি কখনই এতটা সামাজিক ছিলাম না অথচ আজকাল আমি বেশ সামাজিক আচরণ করছি। তোমার ইচ্ছে ছিল গিটার বাজানো কিন্তু বাস্তবতার কষাঘাতে শেখা হয়নি, কিন্তু আমি সেদিন লক্ষ্য করলাম আমি সুন্দর গীটার বাজাতে পারি, কিছুক্ষণ আগে নীসিতা ফোন করেছিল, কি আশ্চর্য নীসিতা সাত বছর পূর্বেই মারা গিয়েছিল, আমি মানে তুমি এই সাত বছরের প্রতিটা ক্ষণেই তাকে অনুভব করেছি।'
কথা বলার মাঝে আবেগে তার গলা বার বার কেপে উঠছে। বুকের মাঝে একটা চাপ অনুভব করছে সে, ঢোক গিলে আবার বলল 'তুমি তাকে এই সিমুউলেটেড পৃথিবীতে জীবিত করেছ। তার স্মৃতিতে ছোট একটা পরিবর্তন করেছ সে কোমায় ছিল।'
ইথান একটু থামল, যোগ করে বলল 'তুমি তোমার সমস্ত না পাওয়াকে, সমস্ত অপূর্ণতাকে আমার মাঝে পূর্ণতা দিয়েছ। তাই না? '
ওপাশ থেকে কোন শব্দ আসছে না।
ইথান গাড়িটা থামিয়ে বলল 'সত্যিকারের ইথান তুমি কি একটু বৃষ্টি দিবে, সব দুঃখ হতাশা ধুয়ে মুছে নিবার বৃষ্টি।'
ইথান গাড়ি থেকে নামল, তার হৃদয়টা কমল আছন্নতায় ভরে উঠল, হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠল, চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো। আকাশটা মুহুর্তেই কালো হয়ে বৃষ্টি নামল, ইথানের চোখের পানি ধুয়ে মুছে গেল সেই বৃষ্টিতে, সে মনে মনে বিড় বিড় করে বলল 'ভাল থেক সত্যিকারের ইথান, তোমার সমস্ত অপূর্ণতা নিয়ে ভাল থেক।' (শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৮ বিকাল ৪:১২